প্রাসকোভিয়া।
জঙ্গলের গভীরে। দক্ষিণ দিকে। একটা জরাজীর্ণ কুটিরের বিছানার কাছে একপাশে হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় বসে আছে ইনায়া। ক্যারিজ থেকে নেমে জঙ্গলের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেই পেছন থেকে কেউ একজন কাপড় দিয়ে ওর নাক মুখ চেপে ধরেছিলো।
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ইনায়া অচেতন হয়ে যায়। যখন চেতনা ফিরে আসে, ও নিজেকে এই জরাজীর্ণ কুটিরে আবিষ্কার করে। হাত আর মুখ বেঁধে রাখা ছিলো। নিজের জন্য বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা হয় না। ভয়াবহ দুশ্চিন্তা হয় সিয়ার জন্য। অস্ফুটস্বরে ইনায়া আওড়ায়,,,,,,
– সিয়া কোথায়?
কুটিরের ভিতরে চারদিকে নজর বুলিয়ে সিয়াকে খুঁজতে শুরু করে। কিন্ত সম্পূর্ণ ঘরটায় কাউকেই দেখতে পায়না। আধভাঙ্গা দরজার ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ভিতরে আলো প্রবেশ করছিলো। বাইরে থেকে অট্টহাসির শব্দ শোনা যায়। কতগুলো কন্ঠস্বর। কেউ একজন হাস্যরসাত্নক কন্ঠে বলে,,,,
– মালিক, মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর। মে’রে ফেলার আগে ওকে একবার ছুঁয়েও দেখবেন না? এটা অন্যায়। মানতে পারছি না। পাপ হবে পাপ।
উচ্চশব্দে হেঁসে উঠে ফ্লভেয়ার। অকপটে বলে,,,,
– হিমানো, আমাকে কি তোমার আব্রাহামের মতো মনে হয়? আমি এদুয়ার্দোর মতো হতে চাই।
– অপরাধ ক্ষমা করবেন। আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, এই মেয়েটার জন্যই সম্পূর্ন বদলে গেছেন এস্টীম রুলার। তিনি এখন কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকান না।____হিমানো সহাস্যে কথাটা বলে।
– আমি আগ্রহ পাচ্ছি না। এদুয়ার্দোর হলে অবশ্যই ছুঁয়ে দেখতাম। সাথে আরও অনেক কিছু হতো। কারন এদুয়ার্দোর সবকিছুই আমি আমার নিজের করে নিবো। ওর যা কিছু আছে একদিন সেসবকিছু আমার হবে।
– দয়া করুন। তাহলে আমাদের মধ্যে থেকেই কাউকে সুযোগ দিন।___হিমানো উচ্ছ্বসিত কন্ঠে অনুমতি চায়।
– এতোটাই বেপরোয়া হয়ে গেছ!___প্রশ্ন নয়, ফ্লভেয়ার বিস্মিত হয়। হিমানো মাথা চুলকায়।
– মা বলেছিলো, মেয়েটাকে মে’রে রেখে যেতে। যাতে আব্রাহাম এসে ওকে মৃ’ত দেখতে পায়। আমি অন্য কিছু করার চিন্তা করিনি। ঠিক আছে, তুমি যখন এতো করে বলছো। তখন যাও।
হিমানো ভীষণ খুশি হয়। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে সে। দ্রুত পায়ে কুটিরের দিকে যায়। চার পাঁচজন ভ্যাম্পায়ার সেনার সাথে বিশ জনের মতো সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো। ওরা করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দৈহিক কামনা বাসনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। কিন্তু অনুমতি পেয়েছে শুধু হিমানো। সে কুটিরের ভাঙ্গা দরজাটা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। ইনায়া চকিত দৃষ্টিতে তাকায়। হিমানো অশালীন ভঙ্গিমায় ঠোঁট কামড়ায়।
সবগুলো কথা শুনতে না পেলেও বাইরে থেকে ভেসে আসা ফ্লভেয়ারের শেষ কথাগুলো কান পেতে শুনে নিয়েছে ইনায়া। তাই ছেলেটার ভিতরে প্রবেশ করার মতলব বুঝে নিতে ওর সময় লাগে না। তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। সমস্ত ক্রোধ গিয়ে জমা হয় আব্রাহামের উপর। শয়তানটা যে এতোটা জঘন্য মনমনসিকার কখনো কল্পনা করেনি ও। মোচড়ামুচড়ি করে দু’হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করে। একটুও ভয় পায় না। ও বীরযোদ্ধা ক্রিসক্রিংগলের মেয়ে। বাবার কথা মনে পড়ে যায়। নিজের মনোবল বাড়ায়।একবার দু’হাতের বাঁধন খুলতে পারলে হয়। তারপর বের করে আনবে র’ক্তচোষাদের মারণাস্ত্র। ছড়িয়ে দিবে ভয়াবহ আতংক।
ইনায়া নিজের ভুল বুঝতে পারে। আব্রাহামের কথায় ওর সাথে চলে আসা ঠিক হয়নি। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না সিয়াকে খুঁজে বের করার। যেখানে প্রশ্ন প্রানপ্রিয় ছোট বোনের সুরক্ষার, সেখানে উপস্থিত বুদ্ধিও শূন্যের কোটায় গিয়ে দাড়ায়।
হিমানো পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। ইনায়া সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। নড়চড় করে না। হিমানো ওর ক্রোধিত চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে বেশ বিস্মিত হয়। অদ্ভুত মোহনীয় চোখজোড়া। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে কামুক উন্মাদনা। তর সয় না। ত্বরিত ইনায়ার মুখের বাঁধন খুলে দেয়। শাসানোর স্বরে বলে,,,
– দেখো মেয়ে। পালানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। বাইরে আমাদের অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমি তোমার হাত দুটো খুলে দিচ্ছি। আমার মনোরঞ্জনে সায় দাও। আমাকে খুশি করো।
ক্রোধের আধিক্যে ইনায়ার দু’চোখের সাদা অংশটুকুতে রক্ত জমে যায়। কিন্তু নিশ্চুপ নির্বাক হয়ে থাকে। হিমানো আশ্বস্ত হয়। ভেবে নেয় ইনায়া রাজি আছে। ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়ে। বিশ্রী হেঁসে বিছানার দিকে ইশারা করে বলে,,,,
– উঠে বসো।
ইনায়া কাঠ পুতুলীর মতো ধীরে ধীরে উঠে দাড়ায়। পায়ের কাছ থেকে আস্তে আস্তে গাউন সরিয়ে নেয়। হিমানো লোভারতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ইনায়ার ফর্সা পা দুটোর দিকে। অত্যাধিক লালসায় তার চোখজোড়া চকচক করে উঠে। ইনায়া উরুর কাছে বেঁধে রাখা এক টুকরো কাপড় খুলতে শুরু করে। হিমানোর খেয়াল নেই অন্য কোনো দিকে। অধিক উত্তেজনায় বাকি সবকিছু ভুলে যায়। কারন ইনায়া ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অমায়িক ভঙ্গিমায় হাসে। ওর আরক্তিম ঠোঁটজোড়ার দিকে তাকিয়ে হিমানো সম্বিত হারায়। এই সুযোগে ইনায়া নিজের কাজ সম্পন্ন করে। উরুতে বেঁধে রাখা কাপড়ের গিঁট খুলে ক্রুশ বের করে আনে। হিমোনোর চোখের সামনে ধরে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে,,,
– জা’নোয়ার, আমাকে স্পর্শ করতে চাস? এতো বড় দুঃসাহস? আয়, কাছে আয় আমার।
হিমানো সম্বিত ফিরে পায়। ভীষণ ভড়কে যায়। মেয়েটার হাতে ক্রুশ কিভাবে এলো? একটা নয়। চার পাঁচটা ক্রুশ একসাথে। হিমানো দু’পা পেছনে সরে দাড়ায়। ভয়ার্ত মুখে রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে,,,,
– ফেলে দাও ওগুলো। ফল ভালো হবে না। আমাদের সাথে সাধারণ মানুষও আছে। ওরা তোমাকে খুবলে খাবে। নিজের সম্মান বাঁচাতে চাইলে ওগুলো ফেলে দাও।
ইনায়া একপা দু’পা করে এগোয়। ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হাসে। হিমানো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে কুটিরের বাইরে বেরিয়ে যায়। ইনায়াও দৌড়াতে শুরু করে। হিমোনো চিৎকার দিয়ে ডাকে। বিচলিত কন্ঠে বলে,,,,,,
– মালিক। মেয়েটার হাতে চার পাঁচটা ক্রুশ চিহ্ন আছে। ওকে থামান। ও পালিয়ে যাচ্ছে।
শুকনো পরিষ্কার সবুজ ঘাসের উপর সটান হয়ে শুয়ে ছিলো ফ্লভেয়ার। হিমানোর কথা শুনে ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়ে সে। কুটির থেকে বের হতেই মানুষগুলো ইনায়াকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। ফ্লভেয়ার ইনায়ার বুদ্ধির প্রসংশা করে সহাস্যে বলে,,,,,
– তুমি বেশ বুদ্ধিমতী। ভয়াবহ সুন্দর বটে। কিন্তু তুমি কি জানো? আমার বুদ্ধির কাছে তুমি দুগ্ধপোষ্য শিশু সমতুল্য। আমি কি এখানে শুধু ভ্যাম্পায়ার সেনা নিয়ে এসেছি? দেখো তোমার চারপাশে কতগুলো সাধারণ মানুষ দাড়িয়ে আছে।
আব্রাহামের প্রতি ইনায়ার ঘৃণার পরিমান বেড়ে যায়। হতবাক হয়না ও। নিজের মায়ের হ’ত্যাকারীর থেকে ভালো কিছু কিভাবে আশা করতে পারে?
ইনায়া চারদিকে নজর বুলায়। বাচা মরা ঈশ্বরের হাতে। কিন্তু ও আপ্রাণ চেষ্টা করবে বেঁচে ফেরার। সিয়াকে শেষবারের মতো না দেখে মরতে চায়না। ওর বাবা কোথায় আছে জানে না। জীবিত অবস্থায় বাড়িতে ফিরে যেতে না পারলে সিয়াকে এদুয়ার্দোর থেকে রক্ষা করবে কে?
– এসো, একটা খেলা খেলি।____ফ্লভেয়ার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে।
ইনায়া কোনো কথা বলে না। সুযোগ সন্ধানী বাজ পাখির মতো ফাঁক ফোকড় খুঁজে পালানোর জন্যে। ফ্লভেয়ার নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে হেঁসে উঠে বলে,,,,
– জিজ্ঞেস করো কি খেলা?
ইনায়া এবারেও মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করে না। পাথরের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ফ্লভেয়ার কিঞ্চিত ঘাড় বাঁকায়। চোখ পিটপিট করে ইনায়ার দিকে তাকায়। অতঃপর ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,,,
– তুমি সাধারণ একটা মেয়ে। মানুষ হয়ে আমাদের সাথে দৌড়ে জিততে পারবে না। তোমার জন্য একটা সুন্দর প্রস্তাব রাখছি। তুমি দৌড়াবে। প্রাণপণে দৌড়াবে। এই যে ঘোড়াগুলো দেখছো। আমরা কয়েকজন ঘোড়া নিয়ে তোমার পিছনে ধাওয়া করবো। যতক্ষণ দৌড়াবে ততক্ষণ বাঁচতে পারবে। দৌড় থামানো যাবে না। তাহলে আমরা তোমাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়বো। দৌড়াতে দৌড়াতে জঙ্গল পেরিয়ে যেতে পারলে তুমি মুক্ত। বলো, রাজি আছো?
ঘোড়ার সাথে দৌড়ে জিতে যাওয়া কিভাবে সম্ভব? থেমে গেলেই তীরের আঘাতে নিশ্চিত প্রাণ যাবে। ইনায়া ভাবে। বুকের গহীনে মৃ’ত্যুর হিমেল স্পর্শ অনুভব করে। ফ্লভেয়ার উচ্চস্বরে বলে,,,,
– তোমার সময় শুরু গেছে। দৌড়াও। যত দ্রুতগতিতে সম্ভব, দৌড়াতে থাকো।
ইনায়ার সামনে থেকে মানুষগুলো সরে দাড়ায়। ইনায়া ছুটতে আরম্ভ করে। বাকিরা ঘোড়ায় চেপে বসে। পেছনে কতগুলো ঘোড়ার তীব্র হ্রেষাধ্বনি শোনা যায়। ইনায়া নিজের প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ায়।
__________
ইম্যুভিল।
সেদিনকার সেই রাস্তায়। যেখান থেকে ইনায়াকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলো আব্রাহাম। ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে সেখানেই পৌঁছেছিলো সবাই। রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে থেকে ভেবেছিলেন মার্টিন লরেন্স। ক্যারিজটা সামনের দিকে গেছে। অর্থাৎ ইম্যুভিল থেকে পশ্চিমে প্রাসকোভিয়ার দিকে। কিন্তু ওদিকে কেনো যাবে?
আব্রাহামের দুর্গ ওডেসায়। নিজের মা বা এদুয়ার্দোর আদেশে ইনায়াকে তুলে নিয়ে গেলে স্যাভেরিন ক্যাসল অথবা ওয়াভেল কোটে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। তাহলে ইনায়াকে কেনো সে প্রাসকোভিয়ার দিকে নিয়ে যাবে? সহসা মার্টিনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠে। তিনি উচ্চস্বরে ক্রিসক্রিংগলকে ডেকে বলেন,,,,
– ক্রিসক্রিংগল, প্রাসকোভিয়া জঙ্গলে। দক্ষিন দিকে। ক্লারেসিয়া যেখানে জন্মেছিলো সেই জায়গায়। একবার খুঁজে দেখা উচিত। পথিমধ্যে আমরা বাকি জায়গাগুলোও খুঁজে দেখতে পারবো।
ক্রিসক্রিংগল সহমত প্রকাশ করেছিলেন। বাকিদের সাথে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে প্রাসকোভিয়া জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন।
সিয়া ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠেছিলো। সবার সামনে থ্যাসোকে ডেকে নিতে পারছিলো না ও। হাতে সময় নেই। এভাবে সাধারণ ঘোড়ায় চেপে কতক্ষণে পৌঁছাতে পারবে?
দেখতে দেখতে ওরা প্রাসকোভিয়া জঙ্গলে পৌঁছে যায়। দু’দিকে দু’টো রাস্তা দেখতে পেয়ে সিয়া অন্য রাস্তা ধরে ঘোড়া ছুটায়। নিজের বাবাকে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বলে,,,,,
– বাবা, আমার জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না। আমাকে ওখানেই পেয়ে যাবেন। আপনাদের আগেই পৌঁছে যাবো।
সিয়া কিভাবে জায়গাটা চিনবে? ক্রিসক্রিংগল উদ্বিগ্ন কন্ঠে কিছু বলতে চান। মার্টিন বাঁধা দেন। আশ্বস্ত করে বলেন,,,,
– মার্কস আর ক্রিস্তিয়ানকে সাথে নিয়ে তুমি এদিক দিয়ে যাও। আমি ক্লারেসিয়ার পেছন পেছন ওদিক দিয়ে যাচ্ছি।
ক্রিসক্রিংগল সম্মতি জানান। তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটান। সিয়া পেছন ফিরে দেখে। মার্টিনকে দেখে আশাহত হয়। নিজের করা পরিকল্পনা নষ্ট হওয়ায় ও মনে মনে রেগে যায়। কিন্তু নিরুপায়। মার্টিন খুব সহজেই ধরে ফেলে ওকে।
______
প্রাসকোভিয়া।
অতিপ্রাকৃত রহস্যে পরিপূর্ণ গহীন জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে থাকে ইনায়া। পেছনে কতগুলো অতৃপ্ত আত্মা তাকে ধাওয়া করছে। ছুটতে ছুটতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদের আঘাতে আঘাতে ওর পা দু’টো রক্তাক্ত হয়ে যায়। তবুও ইনায়া থামে না। যেন জীবনকে হাতের মুঠোয় পুরে বাঁচার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠে।পেছন থেকে ফ্লভেয়ারের ভয়ানক কন্ঠস্বর ভেসে আসে,,,
– ছুটো। আরোও জোরে ছুটো। যতক্ষণ ছুটবে ততক্ষণই বাঁচতে পারবে। থেমে গেলেই মৃ’ত্যু অবধারিত।
ইনায়ার গলা শুকিয়ে আসে। ভীষন তৃষ্ণার্ত ও। এই মুহূর্তে পানি না খেতে পারলে এমনিতেও মা’রা যাবে। কিন্তু ম’রে গেলে চলবে কি করে? ওকে বাঁচতে হবে।
প্রাণপনে ছুটে ইনায়া। পৌঁছে যায় একটি ঝিরিপথের কাছে।ঝিরিপথের দু’পাশে থাকা ছোট ছোট ধারালো পাথরের আঘাতে ইনায়ার আত্মা বেরিয়ে আসে। যতবার পাথরগুলোর উপর পা রাখে ততবার চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামরে ধরে। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে অস্ফুট আর্তনাদ। ঝিরিপথ পেরিয়ে ফের ছুটতে থাকে ও। দৌড়াতে দৌড়াতে ঘন হয়ে আসা গাছপালার সাথে বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ে স্যাঁতস্যাঁতে পিচ্ছিল কর্দমাক্ত মাটিতে।করুন কন্ঠে গোঙ্গানি দিয়ে উঠে। অস্পষ্ট স্বরে ডাকে,,,,,
-বাবা।
যেন সাথে সাথে ওর বাবা উত্তর দেন। সাহস যুগিয়ে বলেন,,,
– উঠে দাড়াও আমার সাহসী মেয়ে। শয়তানগুলো তোমার সন্নিকটে। যদি মোকাবিলা করার শক্তি না থাকে, তবে পূর্ন শক্তি অর্জন করেই জা’নোয়ারগুলোর মুখোমুখি হবে।
ইনায়া পেছন থেকে হ্রেষাধ্বনি শুনতে পায়। ওর বাবার কন্ঠস্বর হাওয়াই মিলিয়ে যায়। অভুক্ত অসাড় হয়ে আসা শরীরটাকে কোনোরকমে টেনে তুলে ও উঠে দাড়ায়। ফের ছুটতে শুরু করে।পেছনে থাকা শ’য়তানগুলো ওকে দৌড় করিয়ে ভীষণ মজা পায়। উচ্চশব্দে ভয়ংকর ভাবে হাঁসতে শুরু করে।
চারদিকে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে। রাতের অন্ধকার নয়। ইনায়া দু’চোখে অন্ধকার দেখে। ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টির আবছা আলো আবছা অন্ধকারে জঙ্গলের গাছপালাগুলোকেও কেমন অদ্ভুতুরে মনে হয়। মনে হয় দানবীয় গাছগুলো তাদের দু’হাত বাড়িয়ে ওকে জাপ্টে ধরতে চায়। বিশাল হা করে ওকে গিলে নিতে চায়। ঝোপঝাড়ের পাশে কি যেন সড়সড় করে উঠে।গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলো আতংকিত হয়ে ডানা ঝাপ্টায়। শঙ্কিত কন্ঠে চেঁচামেচি করে ইনায়ার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বহুদুরে পাড়ি জমায়।
ইনায়া ছুটে। ছুটতে ছুটতে পেছন ফিরে দেখে। ঘোড়াগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। অসাবধানতাবশত ধাক্কা খায় সামনে থাকা শক্ত কিছুর সাথে। নজর সরিয়ে সামনের দিকে তাকায়। মুহূর্তেই ভয়াবহ চমকায়। সামনে দাড়িয়ে থাকা যুবকটাকে দেখে ভীষণ ভয় পায়। যুবকটা আর কেউ নয়। নীলাভনেত্র আর সোনালী চুলের অধিকারী আব্রাহাম।
আব্রাহাম যেন দেহে প্রাণ ফিরে পায়। নিজের চোখ দু’টোকেও বিশ্বাস করতে পারে না। তার সামনে তার ইনায়া দাড়িয়ে আছে। বুকের কাছে মিশে গেছে, দু’হাতের বাহুবন্ধনীতে আঁটকে গেছে ও। আব্রাহামের চিত্ত পুলকিত হয়। দু’চোখে খুশির অশ্রু চিকচিক করে উঠে। আচম্বিতে ইনায়া তাকে দু’হাতে ঠেলে দুরে সরিয়ে দেয়। নিজেও দু’কদম পিছিয়ে যায়। ওর চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনাকাক্ষিত ভয়ে কন্ঠস্বর অবরোধ হয়ে আসে। পুনরায় পিঠ পেছনে হ্রেষাধ্বনি শুনতে পায়।
ইনায়া পিছন ফিরে তাকায়। সহসা ওর হৃৎস্পন্দন থেমে যায়।বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে আবারও ও সামনের দিকে তাকায়। একসাথে দু’জায়গায় অবিকল একই ব্যক্তিকে দেখে নিশ্চল, নির্বাক হয়ে যায়। দু’জন আব্রাহাম। একজন সামনে দাড়ানো। অন্যজন ঘোড়ার পিঠে চড়ে দলবল সাথে নিয়ে ওর দিকেই এগিয়ে আসে। কিন্তু একই ব্যক্তি দু’টো জায়গায় কিভাবে থাকতে পারে?
ইনায়ার সাথে আব্রাহামও পেছনের দিকে তাকায়। নিমেষেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। অবিকল নিজের মতো একজন ব্যক্তিকে দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়। এটা কিভাবে সম্ভব? আব্রাহাম ভাবে। ইনায়াও ভাবে। ওর ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে আলোর গতিতে একটা তীর ছুটে আসে। বিদ্ধ হয় ইনায়ার পিঠে। ঠিক মেরুদন্ডের হাড়ের বা’পাশে। একটা ক্ষিপ্ত করুন আর্তনাদ শোনা যায়। আব্রাহাম সম্বিত ফিরে পায়। ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বীভৎস চিৎকার দিয়ে উঠে,,,
– ইনায়া!!
ইনায়া পড়ে যেতে নেয়। আব্রাহাম ওকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে। পেছনে থাকা ফ্লভেয়ার আর শয়তানগুলো শব্দ তুলে হাসে। আরও কতগুলো তীর ছুটে আসে। তীরগুলো প্রতিহত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে আব্রাহাম। তার মুখখানা বিধ্বস্ত। দিশেহারা হয়ে পড়ে। উন্মাদের মতো আচরণ করে। ইনায়াকে ছেড়ে দিতেই ও লুটিয়ে পড়ে মাটির উপর কাঁটা ছড়িয়ে থাকা ঘাসে। ইনায়া কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারে না। দু’চোখের পাতা বুজে নেয়।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন এদুয়ার্দো ছুটে আসে। দাড়ায় আব্রাহাম আর ফ্লভেয়ারের মাঝখানে। দু’দিকে দু’টো আব্রাহামকে দেখে সে নিজেও স্তব্ধ হয়ে যায়। ফ্লভেয়ারের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেছে। আব্রাহাম দু’হাটু মুড়ে বসে। ইনায়ার দু’গালে দু’হাত রেখে কাতর কন্ঠে ডাকে,,,
– ইনায়া। কথা বলো।
তীরটা বিষাক্ত ছিলো। ইনায়া সাড়া দেয় না। এদুয়ার্দো একবার আব্রাহামের দিকে তো আরেকবার ফ্লভেয়ারের দিকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। আব্রাহাম উচ্চস্বরে ডাকে,,
– ভাই!! ইনায়া কোনো রেসপন্স করছে না ভাই। আমার ইনায়াকে বাঁচাতে হবে।
একমুহূর্তের জন্যও অনুধাবন করতে চায়না, এই ঘটনার পেছনে সত্যিই এদুয়ার্দোর হাত আছে কিনা। বরং সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে ছোট ভাই হয়ে বড় ভাইয়ের কাছে সাহায্য কামনা করে। তার ডাকে এদুয়ার্দো সম্বিত ফিরে পায়। হুট করে সে চলে আসায় ফ্লভেয়ারের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আব্রাহাম অবিরত আকুলিবিকুলি করে ডাকে,,,,
– ইনায়া। কথা বলো। ইনায়া।
গহীন অরণ্যের মধ্যিখানে একই জায়গায় তিনদিকে তিনজন একই চেহারার পুরুষ দাঁড়িয়ে। যাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব আলাদা। বাকি দু’জনের থেকে এদুয়ার্দো কিছুটা লম্বা।
হুবহু একই দেখতে দু’জন ব্যক্তির মধ্যে আব্রাহামকে চিনে নিতে এদুয়ার্দোর খুব বেশি সময় লাগেনা। ইনায়াকে কিভাবে বাঁচাবে? এই গহীন অরণ্যে ডাক্তার কোথায় খুঁজে পাবে? এটা কোনো সামান্য ক্ষত বা দাগ নয় যে, এদুয়ার্দো বা আব্রাহামের হাতের স্পর্শে ঠিক হয়ে যাবে। তীর বিদ্ধ ক্ষতটা গাঢ়। অনেকটা ভিতরে ঢুকে গেছে। সেটা টেনে বের করতেও ভীষণ ভয় পায় আব্রাহাম। এদুয়ার্দো উচ্চস্বরে বলে,,,,,
– প্রথমে ওর পিঠ থেকে তীরটা টেনে বের করো। তারপর ওকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাও।
এই মুহূর্তে আব্রাহামের দোষগুন বিচার করে না এদুয়ার্দো। ইনায়া প্রাণে বেঁচে যাক শুধুমাত্র এটাই কাম্য।
অকস্মাৎ এদুয়ার্দো উপস্থিত হওয়ায় শ’য়তানগুলো তীর ছোঁড়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। স্বয়ং র’ক্তচোষাদের মহারাজকে দেখে ফ্লভেয়ার যেন পালাতে ভুলে গিয়েছিলো। কয়েক জন ইতোমধ্যে সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেছে। এদুয়ার্দো হিংস্রাত্মক হয়ে আক্রমন করতে ছুটে যায় ফ্লভেয়ারের দিকে। বাতাসের বেগে। ফ্লভেয়ার ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে মিলিয়ে যায়। পেছনে এদুয়ার্দো ধাওয়া করে তাকে।
আব্রাহাম স্তব্ধ, নিশ্চল। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা যেন কোনো ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। চারপাশের সবকিছু থেমে যায়। থমকে যায় সময়। শ্রবণেন্দ্রিয় ভোঁতা হয়ে আসে। সামান্য তীর টেনে তুলতেও ভয় পায় সে। ইনায়া পুনরায় ব্যথা পাবে। কষ্ট হবে ওর।
কিন্তু তীরটা তুলতে হবে। ওটা বিষাক্ত। যতক্ষণ ইনায়ার শরীরে গেঁথে থাকবে ইনায়ার বাঁচার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে আসবে। আব্রাহাম কাঁপা কাঁপা হাতে তীরটাকে স্পর্শ করে। তীব্র যন্ত্রণায় নেত্রচ্ছদ বুঁজে ফেলে। যেন ইনায়া ব্যথা পাওয়ার আগেই ওর ব্যথাটুকু সে নিজে অনুভব করে। মনে সাহস যোগায়। তীরটা টেনে তুলে অদুরে ছুড়ে মারে। ইনায়া দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে নেয়। আব্রাহাম উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকে,,,,
– ইনায়া। ইনায়া কথা বলো। তোমার কিছু হতে পারে না। আমার থেকে তোমার অনেক শাস্তি পাওয়া বাকি। উঠো। কথা বলো। দয়া করে সাড়া দাও। আমাকে আঘাত করো, তবুও উঠে দাড়াও।
ইনায়া নিশ্চল, অসাড়। আব্রাহাম ইনায়ার দু’গালে হাত রেখে হালকা চাপড় দিয়ে ডাকে। ইনায়া কোনো ভাবেই সাড়া দেয় না। আব্রাহাম উন্মাদের মত আচরণ করে। বেদনার্ত কণ্ঠে বলে,,,,,
– এই,, এই ইনায়া। আমার হিংস্র সিংহী। তাকাও, তাকাও একবার। দেখো, তোমার সামনে তোমার অপরাধী দাঁড়িয়ে। আমাকে বি’নাশ করবে না?
আচমকাই একটা লম্বা শ্বাস টেনে নেয় ইনায়া। পরমূহূর্তে নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিতেই ওর সম্পূর্ণ শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মনে হয়, যেন দেহ ছেড়ে গেছে ওর প্রাণ। আব্রাহামের জগৎ সংসারটাই যেন শূন্য মনে হয়। ইনায়ার সাথে সাথে থেমে যায় তার হৃৎস্পন্দন। ইনায়াকে ছেড়ে দিয়ে বসে থেকেই খানিকটা পেছনে সরে যায় আব্রাহাম। মুখখানা প্রচন্ড ভয়ার্ত। অত্যাধিক ফ্যাকাশে। দু’চোখের সামনে ঝাপসা ঠেকে সবকিছু। ঝাপসা হয়ে আসে ইনায়ার মুখশ্রী। ও কি সত্যিই ছেড়ে গেল তাকে?
Next part plz