সাদিফ ভেজা তোয়ালে চেয়ারের হাতলের ওপর রাখল। হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। পড়নে কালো ট্রাউজার শুধু। উদাম ফর্সা গা বেয়ে পানি পরছে এখনও। দু আঙুলে জেল মেখে চুলে মাখাল,পরপর ঠেলে দিল ওপরে। এতক্ষনের লতিয়ে থাকা চুল,মুহুর্তে শক্ত হয়ে সজারুর কাটার মতোন দেখাল। সে যখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত,সেই ক্ষনে দরজায় এসে দাঁড়াল মৈত্রী। সাদিফের উন্মুক্ত, ধবধবে সাদা পৃষ্ঠ দেখে ঢোক গিলল। তারপর ঝটপট ফিরিয়ে আনল দৃষ্টি। খোলা দরজায় টোকা দিল তার মনোনিবেশ পেতে। মিহি কণ্ঠে শুধাল,
‘ আসতে পারি?’
মেয়েলী স্বরে চোখ তুলল সাদিফ। আয়নার ভেতর থেকে দেখতে পেল একটা ঝাপসা প্রতিবিম্ব । চটপট টেবিল থেকে চশমা নিয়ে চোখে গুজল। পিছু ঘুরতেই মৈত্রী কে দেখে হোচট খেল। খেয়াল হলো সে খালি গায়ে। ত্রস্ত হাতের কাছে তোয়ালে পেয়েই জড়িয়ে নিলো দুকাঁধে।
অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনি? ‘
‘ ভেতরে এসে বলি?’
‘ জি,আসুন।’
মৈত্রী নম্র পায়ে ঘরে ঢোকে। নুপুরের ঝুনঝুন শব্দে ফ্লোর কাঁ*পে। কাঁ*পছে তার বুকটাও। পড়নের গাউন তার রুপের জৈলুশ কয়েকগুন বাড়িয়েছে। অথচ সাদিফ ভালো করে দেখলোওনা। সে অস্বস্তিতে গাঁট। এই মেয়ে হঠাৎ তার রুমে কেন? কালকের ওই ঘটনার পর একে দেখলেই অস্বস্তি চারগুন বাড়ে। এখন প্রোপোজ -টোপোজ করবে না কী? ও গড না না না।
অদৃশ্যভাবে সহস্র বার মাথা ঝাঁকাল সাদিফ। মৈত্রী এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল,
‘ রেডি হবেন না?’
‘ হ্যাঁ, ওই,হচ্ছিলাম। ‘
‘ওহ।’
এরপরে চুপ করে গেল মেয়েটা। চোখ নামিয়ে পায়ের ওপর ফেলল। তার উশখুশ, উশখুশ ভাব সাদিফকে দ্বিগুন অপ্রতিভ করে তোলে। সে ক্ষনে ক্ষনে সতর্ক চোখে দরজার দিক তাকায়। পাছে কেউ এসে যায়! এভাবে দেখলে? কী না কী ভেবে বসে আল্লাহ মালুম। তার পরিচ্ছন্ন চরিত্রে কালি মাখার ইচ্ছে একটুও নেই। ওদিকে মৈত্রী তালা দিয়েছে মুখে। কথা কীভাবে, কোনদিক দিয়ে শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। এভাবে যেঁচে পরে একটা মেয়ে,এক ছেলের কাছে এসব বললে কেমন দেখায় না?
সাদিফ খেই হারাল ধৈর্যের। প্রশ্ন করল,
‘ কিছু বলবেন আপনি? ‘
মৈত্রী মাথা তোলে, সরাসরি চোখাচোখি হতেই সাদিফ দৃষ্টি সরাল। কিন্তু মেয়েটা চেয়ে থাকে। সাদিফের গোল,ফর্সা, ক্লিনশেভ মুখশ্রী ভেতরে ঢেউ তোলে। অন্তরে বইয়ে দেয় কালবৈশাখি।
‘ আপনি কিছু বললে একটু তাড়াতাড়ি বলবেন প্লিজ? আমাকে তৈরী হতে হবে।’
ব্যস্ত কণ্ঠে মৈত্রীর সম্বিৎ এলো। আকুল চাউনী চটপট সরিয়ে জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। আস্তেধীরে বলল,
‘ আপনি আমার ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করেননি কেন? ‘
সাদিফ ভাণ করে বলল ‘ রিকুয়েষ্ট দিয়েছিলেন? কই পাইনি তো।’
মৈত্রী ভ্রুঁ কোঁচকাল ‘ পাননি? কিন্তু আমিত দিয়েছিলাম। অবন্তী জামান মৈত্রী নামে… ‘
সাদিফ হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ হতে পারে। আসলে আমি ফেসবুকে অত এক্টিভ নই। নামে মাত্র আইডি খুলেছিলাম। ‘
‘ ওও….। আচ্ছা,তাহলে আপনার হোয়াটস-এ্যাপ নম্বরটা দেয়া যাবে?’
সাদিফ ফটাফট বলল ‘ আমার হোয়াটসঅ্যাপ নেই। ‘
‘ তাহলে ইমো?’
‘ ওটাও নেই।’
‘ ইনস্টা?’
‘ নেই।’
মৈত্রী আশ্চর্য বনে বলল,
‘ এ যুগের মানুষ, অথচ কিছুই নেই?’
সাদিফ চমৎকার হেসে বলল ‘ আসলে আমাকে দেখতে আধুনিক হলেও আমি ভেতর ভেতরে বেশ সেকেলে। ফোন ঘাটাঘাটি পছন্দ না তেমন। আ’ম ঠু ডেডিকেটেড অন মাই ক্যারিয়ার।’
কথাগুলো বলে থামল সে। ভাবল ব্যাপার মিটে যাবে। স্বস্তির শ্বাস নিতে না নিতেই মৈত্রী বলল,
‘ তাহলে ফোন নম্বরটা দিন। এটা তো আছে। ‘
বিপত্তি বাঁধল এবার। সাদিফের অল্প হাসি মুছে গেল। ডুব*ল মহাচিন্তায় । ফোন নম্বর দেব না,মুখের ওপর বলবেই বা কী করে? অথচ হুটহাট জ্বিভে উত্তরও এলোনা। মৈত্রী তাড়া দিলো,
‘ কী হলো? দিন।’
পাশাপাশি ফোনের ডায়াল প্যাড বের করল সে। যেন সাদিফ নম্বর বলতেই সঙ্গে সঙ্গে সেভ করবে। সাদিফ আই-ঢাই করল কিছুক্ষন। চট করে মাথায় বুদ্ধির উদ্ভব হতেই বলল,
‘ হ্যাঁ তুলুন।’
মৈত্রীর ঠোঁট ভরে আসে হাসিতে। সাদিফের আওড়ানো এগারটা ডিজিট উৎফুল্ল হাতে ওঠাল সে। বলল,
‘ আমি কল দিচ্ছি,লাস্টে ৫১।’
সাদিফ মাথা দোলায়। মৈত্রী ডায়াল করল, সেকেন্ডে উত্তর এলো’
‘ কাক্ষিত নম্বরে সংযোগ প্রদান সম্ভব হচ্ছেনা।’
মৈত্রী চকিতে চেয়ে বলল ‘ বন্ধ কেন?’
সাদিফ কাধ উঁচায় ‘ চার্জ নেই।’
‘ ওও… আচ্ছা বেশ পরে কল দেব।’
সাদিফ মনে মনে বলল ‘ দেবেন,কিন্তু কল আমি অবধি আসবেনা। ‘
মুখে বলল ‘ নিশ্চয়ই, এনিটাইম।’
মৈত্রী মুগ্ধ হাসে।
‘আমি এখন আসছি।’
সাদিফ আস্তে করে বিড়বিড় করল
‘ আসছি নয়,বলুন যাচ্ছি। তাহলেই বাঁচি।’
‘ কিছু বললেন?’
‘ হু? না না,বললাম আচ্ছা যান।’
মৈত্রী আর একবার লাজুক চোখে তাকে দেখে ঘর ছাড়ল। সাদিফ বুক ফুলিয়ে দীর্ঘ,বড় শ্বাস নিলো। নিস্পৃহ কণ্ঠে আওড়াল
‘ আপদ! ‘
তারপর গিয়ে দোর চাপালো। কী ভেবে ছিটকিনিটাই তুলে দিল। এগিয়ে এসে গুছিয়ে রাখা পাঞ্জাবি পাজামার সেট তুলে তৈরী হতে ব্যস্ত হলো। ওপরের দুটো বোতাম আটকাতে আটকাতে গান ধরল,
‘ চাইনা মেয়ে তুমি অন্য কারো হও…
পাবেনা কেউ তোমাকে তুমি কারো নও।
আরেকবার আয়না দেখে চুল ঠেলল সে। কব্জিতে চকচকে ঘড়ি ঝুলিয়ে, সেজেগুজে পকেটে মোবাইল ভরে ফুরফুরে মেজাজে ঘর ছাড়ল।
মারিয়া দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। চেয়ে চেয়ে দেখল সাদিফের সিড়ি বেয়ে নামা। হাত ঝেড়ে ক্রু*র হেসে আওড়াল,
‘ যা বাছাধন যা,একটু পরেই বুঝবি,কত মরিচে কত ঝাল!’
***
পিউয়ের বক্ষস্পন্দন জোড়াল। সপ্তদর্শীর ভেতরটা ভরে গেছে এলোমেলো হাওয়ায়। ব্যগ্র,ব্যাকুল দুটো চোখ ধূসরেতে নিবদ্ধ। মানুষটার গায়ের একটা পাঞ্জাবি তাকে মুহুর্তে কেমন থমকে রেখেছে। তার মাথায় এখনও ঢুকছেনা, ‘ ধূসর ভাই এই পাঞ্জাবি কই পেলেন?’
সাদিফ ভাইয়ার থেকে নিলেন কী? কিন্তু ওনার থেকে ধূসর ভাইয়ের স্বাস্থ্য ভালো,হওয়ার তো কথা নয়। পিউ রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ। ভাবল, একবার সাদিফ কে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে। ঘুরে হাঁটা দেয়ার আগেই দেখল মৈত্রী এগিয়ে আসছে। মুখটা হাসিহাসি ভীষণ। এসে কাছে দাঁড়াল,পিউয়ের আপাদমস্তক দেখে বলল,
‘ বাহ পিউ, তোমাকে তো ভীষণ সুন্দর লাগছে! আমাকে কেমন লাগছে?’
পিউ হেসে বলল ‘ সুন্দর।’
মৈত্রী আশেপাশে তাকাল। কেউ ধারেকাছে আছে কী না দেখতে। পিউ যেতে নিলে বলল,
‘ কোথায় যাচ্ছো?’
‘ একটু আসছি।’
‘খুব তাড়া?’
‘ ওই আর কী, কিছু বলবে তুমি?’
‘ বলতাম,শুনবে একটু?’
পিউ শান্ত হয়ে দাঁড়ালো,
‘ বলো।’
মৈত্রী চোখ নামিয়ে মুচকি হাসল। লজ্জ্বা লজ্জ্বা ভাব ফুটল চেহারায়। সুস্থির স্বরে বলল,
‘ আমি আসলে,কীভাবে যে বলি…’
পিউয়ের অবাক লাগে তার হাবভাব। বিয়ের প্রস্তাব দিলেও মানুষ এমন করে না কী? ঠিকঠাক করতে বলল,
‘ আরে এত ভাবাভাবির কী আছে? বলোনা কী বলবে!’
মৈত্রী আস্বস্ত হলো একটু। পিউয়ের মুখের দিক তাকাল। সোজাসাপটা বলে দিলো,
‘ আমার না,তোমার সাদিফ ভাইয়াকে ভীষণ ভালো লাগে। ‘
পিউ হতবিহ্বল হয়ে বলল’ এ্যা?’
মৈত্রী মাথা ঝাঁকায়। অসহায় কন্ঠে বলে ‘ হ্যাঁ। আসলে যেদিন প্রথম দেখেছি সেদিন থেকেই। সময় যত যাচ্ছে তত বেশি করে প্রেমে পড়ছি ওনার। তুমি আমাকে একটু হেল্প করোনা পিউ! তোমার সাথে তো ওনার ভীষণ মিল।’
পিউ পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নড়ন-চড়ন নেই। মূর্তি বনে থাকা দেখে কপাল বাঁকায় মৈত্রী। হাত ঝাকিয়ে বলে,
‘ এই পিউ,কিছু বলো?’
পিউ ওভাবেই জমে থাকে। আচমকা বড় করে শ্বাস ফেলে। ভীষণ মন খা*রাপ নিয়ে জানায়,
‘ সাদিফ ভাইয়ের সাথে যে আমার আপুর বিয়ে ঠিক করা মৈত্রী আপু।’
তৎক্ষনাৎ মৈত্রীর প্রানবন্ত হাসিটা মুছে গেল। মাথায় পরল বজ্রপাত।
আর্তনাদ করে বলল ‘ কী বলছো?’
পরমুহূর্তে হাসার চেষ্টা করে বলল ‘ মজা করছো তাইনা?
পিউ চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ল দুপাশে। বলল,
‘ সেজো মা আরো আগে থেকে ঠিক করে রেখেছেন। সেজো চাচ্চু ফিরলেই কথা পাকাপাকি হবে। আর সবথেকে বড় কথা, ওরাও দুজন দুজনকে পছন্দ করে।’
মৈত্রীর চোখ ভরে উঠল। ছলছলে দৃষ্টিতে ভেজা কণ্ঠে বলল ‘ তাহলে আমার প্রথম প্রেম মিথ্যে হয়ে গেল পিউ?’
পিউ সহায়হীন নেত্রে ঢাকায়। আফসোস করে বলে,
‘ ওরা যদি দুজন দুজনকে পছন্দ না করতো,আমি এই মুহুর্তে সাদিফ ভাইয়াকে গিয়ে বলতাম তোমার কথা, বিশ্বাস করো। কিন্তু…. ‘
মৈত্রী গাল বেঁয়ে জল গড়াতে দেখে পিউয়ের বুকটা ফেঁ*টে গেল। নরম মনের মেয়েটার কোটর জ্ব*লে ওঠে ওমনি। কিছু বলতে গেলে মৈত্রী শোনেনা। চোখ মুছে চলে যায় বাড়ির ভেতর।
পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখানে তার কিছু করার নেই। আজ না হোক কাল,সত্যিটা তো সবাই জানত।
একটু আগের ধূসরকে দেখে পিউয়ের জেগে ওঠা বসন্ত,মন খারা*পের ভীড়ে হারিয়েছে। সে ভুলে গেল পাঞ্জাবি নিয়ে তদন্তের কথা। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। মৈত্রী ভালো মেয়ে। মন,মানসিকতাও বেশ। মেয়েটাকে দুঃ*খ দেয়ার একটুও ইচ্ছে তার ছিল না। কে যে বলেছিল সাদিফ ভাইকে অত সুন্দর হতে!
আচমকা মাথায় চাঁটি পরতেই পিউয়ের হুশ ফেরে। নড়েচড়ে, ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকায়। সাদিফ ভ্রুঁ উঁচাল,
‘ এখানে দাঁড়িয়ে কেন?’
পিউ ছোট করে বলল ‘ এমনি।’
‘ আচ্ছা শোন,ওই মেয়েটা,মানে, মৈত্রী কী বলছিল তোকে? ‘
পিউ প্রথম দফায় ভুরু গোঁটায়। পরক্ষনে বলে ‘আপনার কথা।’
সাদিফ সাবধানী বানি ছুড়ল,
‘ একদম আমার ব্যাপারে কিছু বলবিনা। নম্বর চাইলে তো একেবারেই দিবিনা। মনে থাকবে?’
‘ উনি আপনাকে পছন্দ করেন ভাইয়া।’
‘ তোকে বলেছে?’
পিউ ওপর-নীচ মাথা ঝাঁকাল। সাদিফ গুরুতর ভঙিতে বলল ‘তুই কী বলেছিস?’
‘ যা সত্যি তাই। বলেছি আপনার অন্য কাউকে পছন্দ।’
সাদিফ লক্ষ্যহীনভাবে মাথা দোলায়। চৈতন্য ফিরতেই সচেতন কণ্ঠে বলল ‘ তুই কী করে জানলি?’
পিউ মুখ বেঁকিয়ে বলল
‘ না জানার কী আছে? আমি কি কঁচি খুঁকি? আমি সব বুঝি।’
সাদফ বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করল। কিছু বলতে গেল,আচমকা মুঁচড়ে উঠল শরীর। ঘাড়ের কাছটা চুরচুর করছে। সে হাত দিয়ে চুলকাল। পরপর টের পেল পিঠটাও চুল্কাচ্ছে। সাদিফ সেখানেও নখ বোলায়। হঠাৎ করে বাহু,পেট,কোমড়,গলা, বুক,পা, হাঁটু সব জায়গায় একে একে চুলকানো শুরু হয়। সাদিফ মোড়ামুড়ি শুরু করল। এক জায়গা চুল্কাতে গেলে আরেক জায়গা সুড়সুড় করছে। টাল সামলাতে আঁকা-বাঁকা হয়ে যাচ্ছে সে। পিউ তব্দা খেল সাদিফের মোচ*ড়া-মুচড়ি দেখে। তাজ্জব বনে বলল,
‘ কী হলো আপনার? ‘
‘ কেমন যেন চুল্কাচ্ছে! আ.. উফ,আজব, এত চুল্কাচ্ছে কেন? আরে,এই পিউ,চুল্কাচ্ছে তো।’
সাদিফ নড়ছে, দুলছে,আর ওকে দেখতে পিউয়ের অক্ষিপট ঘুরছে। ছেলেটা ব্যাঁকা হয়ে যাচ্ছে একটু পরপর। চুল্কাতে চুল্কাতে হিমশীম খাচ্ছে। অস্থির অস্থির ভাব। দিকদিশা খুইয়ে একটা হাত পিউয়ের দিক বাড়িয়ে দিয়ে হাঁসফাঁস করে বলল,
‘ একটু চুল্কে দে তো!’
পিউ হতভম্ব হলো। অথচ হাত ওঠাল। ছোঁয়ার আগেই সাদিফ আবার টান মেরে নিল। পাঞ্জাবি গলিয়ে পেট -পিঠে নখ টানাটানি শুরু করল। কী মহাজ্বা*লা। পিউয়ের মাথা ঘুরছে। সাদিফ ভাই এমন করছেন কেন? চুল্কাতে চুল্কাতে তার হাত পরল পকেটে। বাঁধল কয়েকটা খসখসে পাতা। বের করে আনতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল। পিউ বিস্মিত হয়ে বলল,
‘ এটাত বিচুটি পাতা। আপনার জামায় কে রাখল?’
সাদিফ থমকে বলল ‘ বিচুটি পাতা?’
‘ হ্যাঁ। এটার জন্যেই তো এত চুল্কাচ্ছে।”
‘ ও মাই গড।’
হাহা*কার করে বলেই, ঘরের ভেতর ছুট্টে গেল সাদিফ। পিউ পেছনে যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। আচমকা খেয়াল হলো সাদিফের পাঞ্জাবির দিকে। সেই মেরুন রঙটা ওনার গায়ে ছিল না? হ্যাঁ তাইত। অচিরাৎ পিউয়ের সব কিছু গোলমেলে হয়ে যায়। দুহাতের তর্জনী দুটো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলল,
‘ যদি সাদিফ ভাইয়ার গায়ে পাঞ্জাবিটা থাকে,তাহলে ধূসর ভাইয়ের এই পাঞ্জাবি কোত্থেকে এলো?’
ধূসরের কথা মনে পড়তেই,মানুষটাকে দেখতে পিউ পেছন ঘুরল পুনরায়। সঙ্গে সঙ্গে নাকটার সং*ঘর্ষ হলো একটা চওড়া বুকের সাথে।
গা থেকে ছুটে আসা পরিচিত ঘ্রান,মুহুর্তে চিনিয়ে দিল,এই মানুষটি বহু কাঙ্ক্ষিত তার!
পিউ নিভু চোখে তাকায়। ধূসরের শ্যামলা মুখ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ,আর চোখা নাকটা বক্ষে তোলে অশা*ন্ত ঝড়। ঠিক যেদিন পাঞ্জাবিটা হাতে ধরে ধূসর ভাইকে কল্পনায় এঁকেছিল,আজ হুবহু তেমনই লাগছে।
পিউ বিমোহিত লোঁচনে চেয়ে থাকে। ইচ্ছে করে একটু ছুঁয়ে দিতে। ধূসর ভাইয়ের হাতটা শ*ক্ত করে মুঠোয় ধরে বলতে,
‘ আপনি এই ছোট্ট পিউয়ের রাজপূত্র ধূসর ভাই। আমার এই চোখদুটো আজীবন মুগ্ধ হয়ে শুধু আপনাকেই দেখুক ‘
তক্ষুনি ধূসর ভ্রুঁ উঁচালো,জানতে চাইল ‘ কী?’
পিউ উত্তর দিলোনা। তবে গড়গড়ে ভঙিতে
প্রশ্ন ছু*ড়ল ‘ এই পাঞ্জাবিটা কোথায় পেলেন ধূসর ভাই।’
‘ ভিক্ষে করে এনেছি।’
পিউ চুপসে গিয়ে বিড়বিড় করল ‘ সব সময় ত্যাড়া ত্যাড়া কথা। ‘
পরপর অনুরোধ করল ‘ বলুন না কোথায় পেলেন?’
ধূসর দড় কণ্ঠে বলল ,
‘ কেন,কিনতে পারিনা? নাকি ভাবিস আমি মিসকিন,টাকা পয়সা নেই।’
পিউ আগে-পিছে খেয়াল না করে শেষ টুকু ধরে বসল। উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ আমি সে কথা কখন বললাম?’
ধূসর নিরুত্তর। উলটে সরু নেত্রে তার পা থেকে মাথা অবধি দেখে বলল,
‘ তুই কি ভাবছিস তোকে খুব সুন্দর লাগছে?’
আচমকা,অসময়ে, অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে পিউ হতচেতন। অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল,
‘লাগছে না?’
ধূসর মুখের ওপর বলল ‘ না।’
পিউয়ের সংকীর্ণ চেহারা শতধাপ ছোট হলো। দুঃ*খ পেয়ে উলটে এলো ওষ্ঠাধর। যার জন্যে সাজল,সে জীবনে প্রসংশা করেনি। করবে কী, চেয়েইতো দেখেনা। অথচ ঠিক নিন্দে করল আজ? আকষ্মিক ধূসর চমকে দেয়া কান্ড ঘটায়। পিউয়ের খোপায় গোজা পাঞ্চক্লিপটা এক টানে খুলে ফেলে। হুরহুর করে কোমল কেশ ছড়িয়ে পড়ে পিঠে। বিস্ময় সমেত তাকায় পিউ। চাউনীতে প্রশ্ন,জিজ্ঞাসা। ধূসর এবারেও তাতে গা ভাসালো না। উলটে বলল,
‘ চুল বাঁধলে তোকে জ*ঘন্য লাগে!’
তারপর পিউয়ের হাত টেনে এনে মুঠোয় ক্লিপটা ধরিয়ে দিলো। মেয়েটাকে নির্বোধ বানিয়ে রেখে প্রস্থান নিলো। পিউ একরাশ ক*ষ্ট,আর আ*হত মন নিয়ে চোখ ফেরায়। এই ধূসর ভাই কী দিয়ে তৈরি? রসায়নের বিক্রিয়া গুলোও ওনাকে বোঝার চেয়ে সহজ।
তাৎক্ষনিক ওপাশ থেকে হৈচৈ এলো
,’ বর এসছে,বর এসছে।’
পাশাপাশি সবাই ছুটল গেটের দিকে। পিউ দুহাতে লেহেংগার দুমাথা ধরে কেবল পা বাড়াবে পেছন থেকে হাতটা টেনে ধরল কেউ একজন। পিউ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। অবাক চোখে ফিরে তাকায়। ধূসরকে দেখে টুপটুপ চোখের পাতা ফেলে ভাবল ‘ মানুষটা না চলে গেল,এলো কখন?’
ধূসর পুরু কণ্ঠে শুধাল ‘ কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ গেটের কাছে।’
‘যাবিনা।’
নির্বিকার ভঙি তার। পিউ বলল,
‘ গেট ধরব না? আমিতো শালী হই।’
ধূসর বলল,
‘ অনেক ছেলে,এখানেই দাঁড়িয়ে থাক।’
পিউ ছোট কণ্ঠে বলল ‘ কিন্তু….. ‘
মিনিটে ভেসে আসে ধূসরের তপ্ত আদেশ ‘ যা বলেছি তাই হবে।’
সে মিইয়ে গেল। নীচু কণ্ঠে বলল,
‘ সবাই ওখানে,আমি এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকব?’
ধূসর ধরে রাখা হাত ছাড়ল না। বরং পেছন থেকে কদম ফেলে এসে পাশাপাশি হলো। পায়ের দিক চেয়ে বলল ‘ দ্যাখ।’
পিউ চোখ ফেলল নীচে।
তার আর ধূসরের পা সমানতালে দাঁড়িয়ে। ঠিক একই জায়গায়। তারপর ধূসরের দিক তাকাতেই সে নিরেট কণ্ঠে বলল,
‘ এখনও বলবি তুই একা?’