রাতে তুর্য বাসায় এসে দেখে হূলস্থুল কাণ্ড। চারদিকে সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তুর্য তাহমিনা বেগমের উদ্দেশ্য বলে,
“ঘরের এই হাল কেন?”
তাহমিনা বেগম মিনিট দুয়েক চুপ থেকে উত্তর দেন,
“উপরের নতুন ভাড়াটিয়ার মেয়ে পরী করেছে। কতটা অসভ্য আর বদমেজাজি ভাবতে পারিস তুই? ঘরের সবকিছু ভেঙেচুড়ে গেছে। আবার হুমকি-ধামকিও দিয়ে গেছে।”
তুর্যর কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। কপাল কুঁচকেই বলে,
“পরী কি এমনি এমনিই ভাঙচুর করে গেছে?”
“কী বলতে চাস তুই?”
“আমি কিছুই বলতে চাই না। আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই। একটা মেয়ে কোনো কারণ ছাড়াই ঘরের জিনিস ভাঙচুর করে যাবে। আর তোমরা মুখ বুজে সেগুলো সহ্য করবে?”
তাহমিনা বেগম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেন,
“তুই ওর সাপোর্ট নিচ্ছিস? ও তোর মা-বোনকে হুমকি দিয়ে গেছে এরপরও?”
“সেই এক কথা! আমি কেন ওর সাপোর্ট নিতে যাব? ও কে হয় আমার? আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই। আর শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে, আমি পরীকে যতদিন ধরেই চিনি এমনি এমনি ঝামেলা করার মেয়ে ও না।”
এ কথায় তাহমিনা বেগমের রাগের তেজ যেন আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। চিৎকার করে তিথির দিকে তাকিয়ে বলেন,
“শুনলি? শুনলি তুই ওর কথা? মায়ের থেকেও অন্যের মেয়ের প্রতি ওর বেশিই দরদ।”
তুর্য বিরক্ত হয়ে বলে,
“আহ্ মা! শুধু শুধু চেঁচাচ্ছ তুমি।”
তুর্য মায়ের সাথে কথা না বাড়িয়ে গলা উঁচিয়ে দিশানকে ডাকে। দিশান একছুটে ড্রয়িংরুমে চলে আসে। বলে,
“কী হয়েছে ভাইয়া?”
“পরী কি এসব ভাঙচুর করেছে? তুই দেখেছিস?”
“না ভাইয়া। পরী আপু কয়টা ভাইয়া আর একটা আপুকে নিয়ে এসেছিল। আপুটা আমায় বাহিরে নিয়ে গেছিল। তারপর সবাই চলে যাওয়ার পর এসে দেখি সবকিছু এমন।”
তিথি এবার কথা কেড়ে নিয়ে বলে,
“এরপরও তুমি ঐ ফালতু মেয়েটার সাপোর্ট নেবে? মায়ের কথা বিশ্বাস করবে না?”
তুর্য তিথির দিকে এক পলক তাকিয়ে দিশানকে বলে,
“পরীকে গিয়ে বলবি একটু পর ছাদে আসতে।”
“আচ্ছা” বলে দিশান চলে যাওয়া ধরলে তুর্য আবার ডেকে বলে,
“সাথে ওর বাবা-মাকেও আসতে বলবি।”
দিশান চলে যাওয়ার পর তুর্য পকেট থেকে ফোন বের করে এক বন্ধুকে কল করে ছাদে লাইটের ব্যবস্থা করতে বলে। বাবাকেও ইতিমধ্যে কল করে আসতে বলে। শুধু তাই নয়। উপস্থিত থাকতে বলে প্রান্তকেও। তিথি এবং তাহমিনা বেগম এতক্ষণ শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুর্যর ফোনে বলা কথাগুলো শুনছিল।
কথা শেষ হলে তাহমিনা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
“সবাইকে ছাদে আসতে বললি কেন? আর প্রান্তকেই বা আসতে বললি কেন? ঝামেলা আমাদের আর পরীদের মধ্যে। ওদের তুই অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দে।”
“দেবো। এত অস্থির হচ্ছো কেন? প্রান্তকে তো ডাকবই। সবকিছুর মূলে তো প্রান্তই আছে।”
“প্রান্তর কোনো দোষ নেই এখানে। সব দোষ ঐ মেয়েটার”
“তোমার একার কথা শুনে তো আমি সত্যমিথ্যা যাচাই করব না মা। আর প্লিজ, এটা নিয়ে কোনো কথা বাড়িয়ো না।”
.
তুর্য ছাদে গিয়ে দেখে ওর বন্ধু লাইটের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। তুর্য আগেই বলে দেয় সবাই ছাদে আসার পর বাহির থেকে যেন পাহারা দেয়। যাতে অন্য কেউ ছাদে আসতে না পারে। সবার আগে ছাদে আসে প্রান্ত। তুর্যকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো কারণে খুব বিরক্ত আর রেগে আছে। প্রান্ত হেসেই জিজ্ঞেস করে,
“কীরে? এত জরুরী তলব?”
তুর্য ফোল্ড করা শার্টের হাতাটা কনুইয়ের ওপর গুটিয়ে নিয়ে বলে,
“অপেক্ষা কর।বলব।”
প্রান্ত কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিজের মতো ফুঁকতে থাকে। তিথিকে ছাদে আসতে দেখে সেলিম প্রান্তকে ইশারা দিয়ে বলে,
“ভাই! তিথি আপাও তো দেখি আইছে।”
প্রান্ত একবার পিছনে তিথির দিকে তাকিয়ে আবার বামদিকে সরাসরি তাকায়। তুর্য ছাদের রেলিং ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একে একে আসে তাহমিনা বেগম ও তার স্বামী। এরপর আসে দিশান, পরী, রেহেনা বেগম এবং তার স্বামী। সবাই আসার পর তুর্য দিশানকে ওর বন্ধুর সাথে ছাদের দরজার বাহিরে দাঁড়াতে বলে। ছাদে এখন পিনপতন নিরবতা চলছে। রাগে ফুলছে পরী। এখনো প্রান্তকে চোখে পড়েনি। নিচের দিকে মাথা করে তাকিয়ে হাতের নোখ কাটছে দাঁতে।
তুর্য লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে পরীর মাকে জিজ্ঞেস করে,
“আন্টি পরী যে আমাদের ঘরের জিনিস ভাঙচুর করেছে জানেন সেটা?”
রেহেনা বেগমের নির্লিপ্ত উত্তর,
“জানি।”
“আপনি কিছু বলেননি?”
পরী তীক্ষ্ণ চোখে তুর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
“কী বলবে? আমি কোনো দোষ করিনি।”
“আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলছি না পরী।”
“আপনার আমার সাথেই কথা বলতে হবে। যা করেছি আমি করেছি। আমার মা নয়।বিধায় আপনাকে আমার দিক থেকে শুধু আমার সাথেই কথা বলতে হবে।”
তুর্য আরেকটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে,
“বেশ! তাহলে তুমিই বলো কেন ঘরের জিনিস ভেঙেছ?”
“আপনার মা আর বোন গিয়ে আমার মাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করেছে। ঘরের সব জিনিস ভাঙচুর করেছে। শুধু তাই নয়। আমাকে শাসিয়েছেও। এরপরও আপনি আশা করেন আমি চুপ করে থাকব?”
তুর্য তিথি আর তাহমিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
“একটু আগে তোমরা শুধু পরীর দিকটাই আমার দিকে তুলে ধরেছিলে। এখন পরীও তো তোমাদের বিরুদ্ধে একই কথা বলল। এগুলো সত্য?”
তাহমিনা বেগম এবার চুপসে যান। তিনি ভাবেননি সকলকে একসাথে জড়ো করে তুর্য এভাবে জেড়া করবে। ছেলের রাগ সম্পর্কে তিনি বেশ ভালোমতোই অবগত। এখানে মিথ্যা বললে ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। তাহমিনা বেগমের আগেই তিথি দাঁতমুখ খিঁচে বলে,
“যা করেছি একদম ঠিক করেছি। ভুলটা আমারই। এসব না করে যদি লোক দিয়ে ওকেই মেরে ফেলতাম তাহলে সেটাই ঠিক হতো। ও কেন আমার থেকে আমার প্রান্তকে কেড়ে নেবে কেন!”
সবার সম্মুখে ঠাঁটিয়ে একটা থাপ্পড় পড়ল তিথির গালে। সবাই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তিথি গালে হাত দিয়ে ছলছল করা চোখে তাকায় প্রান্তর দিকে। এতক্ষণ পর পরীর চোখেও প্রান্তকে পড়ে। প্রান্ত রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“এতটা নিচ তোমার মানসিকতা? কী করে পারলে এসব করতে?”
তাহমিনা বেগমও এবার দমে যান না। ধমক দিয়ে বলেন,
“তুমি আমার সামনে আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলছো?”
“হ্যাঁ তুলছি। মেয়েকে শিক্ষা দিতে পারেননি?”
তুর্য ধমক দিয়ে বলে,
“ব্যবহার ঠিক কর প্রান্ত। তোকে এখানে আমার পরিবারের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে ডাকিনি।”
প্রান্ত দ্বিগুণ রেগে বলে,
“করব না আমি ব্যবহার ঠিক। তার আগে তুই তোর মা-বোনকে ব্যবহার শেখা।”
তাহমিনা বেগম রাগে ফুঁসে আবারও সেই একই কাজ করেন। সবার সামনেই অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে পরী ও ওর মাকে। তুর্যর বাবা শান্তশিষ্ট মানুষ। তিনি ভালোভাবে ঝামেলা মেটাতে চাচ্ছেন। তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। যতই তাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা চলছে ততই তার মুখ থেকে জঘন্য গালি বের হচ্ছে। পরীর বাবা পরীর হাত ধরে বলেন,
“চল এখান থেকে। এত্ত জঘন্য পরিবার আমি কখনো দেখিনি। আমারই ভুল হয়েছিল ছোটলোকদের বাসায় বাড়ি ভাড়া নেওয়া।”
তাহমিনা বেগম একটা জঘন্য গালি পরীর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
“নিয়ে যান এই অসভ্য মেয়েকে। আমার ছেলে-মেয়ে দুজনের জীবনই নষ্ট করতে আসছে এই অপয়া। ওরে আমি হাতের কাছে পেলে মেরেই ফেলব। তিনি এবার বলেই ক্ষান্ত হলেন না পরীর দিকে তেড়ে গিয়ে থাপ্পড় দিতে উদ্যত হোন। তখন পরীর আব্বু হাত ধরে ফেলেন। হাতটা ঝাঁকি দিয়ে ফেলে বলেন,
“আপনার সাহস দেখে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। এতক্ষণ যা নয় তাই বলেছেন আমার মেয়ে আর স্ত্রীকে। আর এখন আমার সামনেই আমার মেয়েকে মারতে এসেছেন? আপনি যদি মেয়ে না হতেন…
আপনার সাথে কথা বলতেই আমার রুচিতে বাঁধছে।”
তিনি আবার পরীর হাত ধরে চলে যাওয়া ধরেন। তাহমিনা বেগম আবারও এগিয়ে গিয়ে পরীর হাত ধরে নিজের দিকে ঘোরান। পরীর চুলের দিকে হাত বাড়ানোর আগেই তুর্য মায়ের হাত ধরে চোখ রাঙিয়ে বলে,
“অনেক বেশিই বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু তুমি!”
তাহমিনা বেগমের রাগ সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেছে। তিনি এখন স্বামী-ছেলে কাউকেই মানছেন না। মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছেন। তুর্যর বাবা রাগ আর কন্ট্রোলে রাখতে পারছেন না। কিন্তু মারধর বিষয়টি তার খুবই বিশ্রী লাগে। তবে এই পর্যায়ে চুপ করে থাকা মানে নিজেকেই ছোট করা। তিনি তাহমিনা বেগমকে আবারও মানানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাহমিনা বেগম তার জায়গায় অনড়। বিরক্ত হয়ে তিনি তাহমিনা বেগমকে টানতে টানতে নিচে নিয়ে যায়।
তিথির তখন কী হলো কে জানে! প্রান্তর হাত পেঁচিয়ে ধরে বলে,
“প্লিজ প্রান্ত! সবকিছু ঠিক করে নাও। তুমি যা বলবে আমি তাহলে তাই শুনব।”
প্রান্ত তিথির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে পরীর বাবার পথ রোধ করে বলে,
“আঙ্কেল যা কিছু হয়েছে তার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি পরীকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই আমি পরীকে।”
বিয়ের কথা শুনে কান্নারত তিথি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রান্তর মুখপানে। পরী একবার চকিতে প্রান্তর দিকে তাকালেও পরমুহূর্তে চোখ দুটো ফিরে তাকায় তুর্যর দিকে। হাজারও বিস্ময় নিয়ে তুর্যর দুটি চোখও তাকিয়ে আছে পরীর দিকে।
পরী তুর্যর চোখের দিকে চোখ রেখেই প্রান্তকে উত্তর দেয়,
“আমি আপনাকে বিয়ে করব না!”
———————–
পরীর বাবা নতুন বাড়ির খোঁজ করছেন। পরী আর মেহেনুবা কলেজে যাওয়ার পথে প্রান্তর সাথে দেখা। পরী দেখেও না দেখার ভান করে সেখান থেকে দ্রুত চলে যায়। প্রান্তর অসংখ্য ডাক পরীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে পারে না।
বাস স্টপেজে গিয়ে তুর্যর সাথেও দেখা হয়ে যায়। পরীকে দেখেই তুর্য এগিয়ে আসে। বোঝা যাচ্ছে হয়তো পরীর জন্যই অপেক্ষা করছিল। দ্রুত পায়ে পরীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“তোমার কি একটু সময় হবে?”
পরী হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। একবার মেহেনুবার দিকে তাকায়। আরেকবার তুর্যর দিকে। তুর্য এখনো প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। এই একটা মাত্র মানুষ! যার সামনে পরীর সব রাগ উবে যায়। মানুষটার প্রতি না করা যায় রাগ আর না করা যায় অভিমান। বিরস মুখে পরী উত্তর দেয়,
“আমার তো এখন ক্লাস আছে।”
“একদিন ক্লাস না হলে সমস্যা হবে কি?”
পরী সঙ্কোচ নিয়ে তাকায় মেহেনুবার দিকে। মেহেনুবা অভয় দিয়ে বলে,
“ঠিকাছে তুই যা উনার সাথে। আমি তোর প্রেজেন্ট দিয়ে দেবো।”
পরীর আগে তুর্য বলে,
“থ্যাঙ্কিউ আপু।”
মেহেনুবা বাসে করে কলেজে চলে যায়। তুর্য একটা রিক্সা ডেকে পরীকে নিয়ে ওঠে। রিক্সাওয়ালাকে বলে ক্যাফে যেতে। তুর্য মলিনমুখে বলে,
“কাল সবাইকে এক করে চেয়েছিলাম ঝামেলা মিটিয়ে নিতে। কিন্তু এতে ঝামেলা বেড়ে গেল। আমি জানি আন্টিও আমায় ভুল বুঝেছে। কিন্তু সত্যিই আমি চাইনি এমন কিছু হোক। নিজের মায়ের এসব ব্যবহারের জন্য আমি সত্যিই লজ্জিত। আন্টির মুখোমুখি হতেও আমার লজ্জা করছে।”
পরী নিশ্চুপ। তুর্য আবার বলে,
“তবে একটা কথা কি জানো? তিথি সত্যিই প্রান্তকে খুব ভালোবাসে। এদিকে প্রান্ত তোমাকে ভালোবাসে। সবকিছু কেমন গোলমেলে হয়ে গেল।”
পরী আড়চোখে একবার তুর্যর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
“আর আমি ভালোবাসি আপনাকে!”
বিপরীত দিকের রাস্তায় হাঁটতে থাকা রিনি দুজনকে একসাথেই রিক্সায় দেখে ফেলে। রিনি সময় নষ্ট না করে একটা রিক্সা নিয়ে দুজনকে ফলো করে।
Leave a comment