শীতের সময় পেরিয়ে গেছে। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে পরী আর তিথি। সেই সাথে একটুখানি সময় বের করে কথা বলছে দুজন দুজনার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে। প্রাইভেট থেকে একসাথে ফিরছিল পরী, তিথি আর মেহনুবা। পথে প্রান্তর সাথে দেখা হয়ে যায়। প্রান্ত হেসে সবার সাথে কথা বলা শেষ করে পরীর উদ্দেশ্যে বলে,
“তোমার কি পাঁচ মিনিট সময় হবে?”
পরী একবার তিথির দিকে তাকিয়ে প্রান্তর দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”
“আজ কিছু কথা বলব। যেগুলো তুমি জানো না। তিথিরও জানা দরকার।”
তিথি বলে,
“এমন কী কথা যেটা আমিও জানিনা?”
প্রান্ত দোকানের দিকে এগোতে এগোতে বলে,
“এসো। বলছি।”
পরী, তিথি, মেহনুবা তিনজনই প্রান্তকে অনুসরণ করে পেছন পেছন যায়। চায়ের দোকানে গিয়ে থামার পর সেই ভ্যানওয়ালা দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। যার জন্যই প্রান্তর লোকদের সাথে ঝামেলা করেছিল পরী। লোকটি পরীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
“ভালো আছো মা?”
পরী উত্তরে শুধু মাথা নাড়ায়। লোকটি পূণরায় জিজ্ঞেস করে,
“আমায় চিনছ?”
পরী উত্তরে বলে,
“আপনি তো সেই যাকে…”
পরীর অসম্পূর্ণ কথা পূর্ণ করে প্রান্ত বলে,
“যাকে আমি মেরেছিলাম। আর উনার জন্যই তুমি প্রতিবাদ করেছিলে।”
পরী অবাক হয়ে বলে,
“আপনি মেরেছিলেন?”
প্রান্ত অপরাধের ন্যায় মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“হু। কিন্তু আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি। বারবার মনে হয়েছিল তোমাকে সত্যিটা জানাই। ভয়ে জানাতে পারিনি। পাছে জানতে পেরে যদি তুমি বা তিথি আমায় ঘৃণা করো এজন্যই আজ সত্যিটা জানিয়ে দিলাম। তাছাড়া আমি নিজেও উনার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।”
লোকটি বলে,
“মা যা হওনের হইয়া গেছে। মানুষ তার ভুল বুঝতে পারলে তারে মাফ কইরা দেওন লাগে।”
উত্তরে পরী মৃদু হেসে বলে,
“আমি মাফ করার কেউ নই। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে এতেই খুশি আমি।”
.
পরীক্ষার বাকি আর মাত্র সাতদিন। এরমধ্যে প্রিয়ম ও রোজের বিদেশ যাওয়ার ভিসা হয়ে গেছে। এই নিয়ে ভাইয়ের সাথে পরীর রাগের শেষ নেই। অভিমানে প্রিয়মের সাথে কথা বলাই বাদ দিয়েছে। খাওয়ার টেবিলে সবাই যখন চুপচাপ খাচ্ছিল তখন প্রিয়ম বারবার খোঁচাচ্ছে পরীকে। কিন্তু পরীও যেন পণ করে বসেছে কথাই বলবে না। রেহেনা বেগম প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে বলে,
“কীরে প্রিয়ম? ওর পেছনে লেগেছিস কেন?”
পরী রাগ দেখিয়ে বলে,
“তোমার ছেলেকে বলে দাও আমার সাথে যেন কথা না বলে।”
প্রিয়ম নালিশ করে বলে,
“আমি কী করেছি ওকে বলতে বলো আম্মু।”
“আমি কোনো স্বার্থপরের সাথে কথা বলি না মা।”
রেহেনা বেগম দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
“তোরা থাম। কী হয়েছে বল আমায়। এত রাগ কেন?”
প্রিয়ম টেবিলের ওপর চাপড় দিয়ে বলে,
“আমিও তো তাই বলি। কাল চলে যাব আমি আর ও কী শুরু করেছে আজ।”
পরী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“খাবই না আমি।”
এরপর রাগে গজরাতে গজরাতে নিজের রুমে চলে যায়। ব্যালকোনিতে গিয়ে এক কোণায় বসে পড়ে। মন খারাপ হচ্ছে এখন ভীষণ। প্রিয়মও পিছু পিছু এসে পরীর পাশে বসে। বলে,
“সত্যিই কথা বলবি না?”
সব রাগ-অভিমান ভুলে পরী প্রিয়মকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,
“তোমায় খুব মিস করব ভাইয়া।”
প্রিয়ম পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আমিও তোকে খুব মিস করব পাগলী। তুই চিন্তা করিস না। তোর পরীক্ষা শেষ হলে তোকেও আমার কাছে নিয়ে আসব। তুই ইংল্যান্ডে থেকে পড়বি।”
পরী ফু্ঁপিয়ে ফু্ঁপিয়ে বলে,
“আমি বাংলাদেশেই পড়ব।”
“কেন রে? বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি?”
পরী থতমত খেয়ে বলে,
“আম্মু-আব্বুকে রেখে যাব না।”
“আচ্ছা পাগলী। আর কাঁদিস না এখন। চল খাবি।”
পরী হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে বলে,
“চলো।”
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাতে ঘুমানোর আগে তুর্যকে কল দেয় পরী। দু’বার কল দেওয়ার পরও তুর্য ফোন রিসিভ করে না। এমনিতেই মন খারাপ তার ওপর উনি আবার ফোনও তুলছে না। মন খারাপ নিয়েই বিছানায় কাৎ হয়ে শুয়ে থাকে পরী। মিনিট পাঁচেক পর তুর্য ফোন করে। প্রথমবার রিং হয়ে কেটে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বারে ফোন রিসিভ করে পরী। তুর্য বলে,
“স্যরি গো! ফোন সাইলেন্ট ছিল।”
পরী অভিমানিসুরে বলে,
“এত ব্যস্ত থাকো কেন?”
“অফিসের কাজ করছিলাম।”
“অফিসের কাজ বাড়িতে কেন?”
“ইনকমপ্লিট ছিল তো তাই।”
“এখন যা খুশি করো। কিন্তু আমাদের বিয়ের পর ভুলেও অফিসের কাজ বাড়িতে আনার চেষ্টা কোরো না।”
তুর্য কোলের ওপর বালিশ নিয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,
“তাহলে কী করবে?”
“বাড়িতে ঢুকতে দেবো না।”
“তাহলে কোথায় থাকব আমি?”
“ছাদে থাকবে।”
“তোমার কষ্ট হবে না?”
“একটুও না।”
“সত্যিই না?”
“একদম না।”
“ঠিকাছে। আমারও সমস্যা নেই। সকালে পাশের ছাদে একটা সুন্দরী মেয়ে আসে। ভালোই হবে। ঘুম থেকে উঠে সুন্দরী মেয়ের মুখটা তো দেখতে পারব।”
পরী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে,
“শালা এই ছিল তোর মনে? তুই প্রতিদিন ছাদে গিয়ে অন্য মেয়ে দেখিস? আবার বলিস সুন্দরী?”
পরীর চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলায় দারুণ মজা পাচ্ছে তুর্য। আরেকটু রাগিয়ে দিতে বলে,
“সুন্দরকে তো সুন্দর’ই বলব তাই না? সত্যি বলছি ভাই, মেয়েটা পুরো দেখার মতো।”
পরী এবার চেঁচিয়ে বলে,
“চুপ কর তুই! আর একটা কথাও বলবি না। একেই তো অন্য মেয়ের প্রশংসা করতেছিস আমার কাছে। আবার বলিস ভাই! আমি তোর ভাই লাগি?”
তুর্য শব্দ না করেই হাসছে। তবে কতক্ষণ শব্দ ছাড়া হাসতে পারবে জানা নেই। একটা মানুষ রাগলে যে এত আনন্দ পাওয়া যায়! আর সেই মানুষটা যদি হয় নিজের ভালোবাসার মানুষ তাহলে তো কথাই নেই। তুর্য এবার শব্দ করেই হেসে ফেলে। পরী ধমক দিয়ে বলে,
“হাসিস কেন আবার?”
তুর্য শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
“তুমিই না বললে চুপ করতে?”
“আমি চুপ করতে বললেই চুপ থাকতে হবে নাকি?”
“অবশ্যই। আমি কি তোমার কোনো কথা ফেলি বলো?”
“ঢং করবি না একদম। চুপ থাকতে বললে আরো বেশি বেশি কথা বলবি।”
“ওহ আচ্ছা তার মানে অন্য মেয়ের প্রশংসা করতাম এটা বলতেছ?”
পরী দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“তোর কচুর কথা শোনার মতো সময় আমার নাই। ফোন রাখ।”
তুর্যকে আর কিছু বলতে না দিয়েই পরী কল কেটে দেয়। ঐদিকে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খায় তুর্য। কয়েকবার ফোন দিলেও ফোন ধরে না। তুর্য এতদিনে পরীর রাগ ভাঙানোর উপায় জেনে গেছে। গান! এখন একমাত্র গান গেয়ে শোনালেই মহারাণীর রাগ ভাঙবে। তুর্য ফোনে টেক্সট করে,
“ফোনটা রিসিভ করো। তোমার কোনো কথা বলতে হবে না। রাগাব না এখন সত্যি।”
পরী ম্যাসেজটা দেখে কিন্তু রিপ্লাই করে না। প্রায় সাথে সাথেই ফোন দেয় তুর্য। পরী ফোন রিসিভ করে চুপ করে থাকে। তুর্য গান ধরে,
“তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবেই সঙ্গে থাক,
সারাদিন, সারা রাত।
তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবেই সঙ্গে থাক
সারাদিন, সারা রাত।
আমি তোর আয়না হব আজ,
তুই শুধু ইচ্ছে মতো সাজ।
আমি তোর আয়না হব আজ তুই শুধু ইচ্ছে মতো সাজ।
রোদ্দুরে যায় উড়ে মন জাহাজ!
তুই আমাকে আগলে রাখ,
ঠিক এভাবেই সঙ্গে থাক
সারাদিন, সারা রাত।”
গান শুনেই পরীর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুঁটে ওঠে। গান শেষে শুধু অস্পষ্টভাবে বলে,
“ভালোবাসি খুব।”
——————————
পরী আর মেহনুবাকে কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে প্রিয়ম, রোজ আর পরীর বাবা এয়ারপোর্টে চলে যায়। প্রাইভেটে মন বসছে না একটুও। বারবার ভাই আর ভাবির কথা মনে পড়ছে। এতদিনে রোজের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে পরীর। প্রাইভেটে একটা পরীক্ষা থাকায় পরী আর এয়ারপোর্টে যেতে পারেনি।
প্রাইভেটে এক্সাম শেষ হলে বাসায় এসে শুয়ে থাকে পরী। রেহেনা বেগম পরীর রুমে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“মন খারাপ?”
পরী মায়ের কোলের মাথা রেখে বলে,
“ভাইয়াকে খুব মিস করছি মা।”
রেহেনা বেগম নিরুত্তর। পরী মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি অনেক শক্ত মনের মানুষ মা। তোমার কষ্ট হচ্ছে তবুও বুঝতে দাও না।”
“আমি কি তোর মতো বাচ্চা নাকি?”
“আমি বাচ্চা নই মা। আমি বড়।”
“ইশ! বাবা-মায়ের কাছে সব সন্তানরাই ছোট। বুঝেছিস?”
পরী মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“হুম।”
.
সন্ধ্যার দিকে তুর্যর সাথে কথা বলা শেষ করে মাত্রই পড়তে বসেছিল পরী। তখন বাবা রুমে এসে বলেন,
“পড়ছিস মা?”
পরী দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,
“হুম আব্বু। ভেতরে আসো।”
তিনি ভেতরে গিয়ে পরীর পাশে দাঁড়ান। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
“দশ মিনিট পর পড়তে বোস।”
“ঠিকাছে। কিন্তু কেন?”
“তোর মা সব বলবে।”
“বাবা!”
তিনি চলে যাওয়ার সময় পিছু ফিরে বলেন,
“কিছু বলবি মা?”
পরী চেয়ার থেকে উঠে বাবার কাছে গিয়ে বলে,
“কিছু কি হয়েছে?”
তিনি পরীর গালে হাত রেখে মায়াদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
“তুই কত বড় হয়ে গেছিস মা।”
“এভাবে কেন বলছ?”
“প্রিয়মকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেওয়ার সময় ওখানেই আমার এক বাল্যকালের বন্ধুর সাথে দেখা হয় বহু বছর পর। ওর ছেলে আজ দেশে ফিরেছে। অনেক জোড়াজোড়ি করে আজ বাসায় নিয়ে গেল। পরিবারের সবাই খুব ভালো বুঝলি। ওর ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে আগে থেকেই। তোর কথা শুনে এখন হাতে ধরে বলে, ‘মেয়ে তোর যেমনই দেখতে হোক। তোর মেয়েকেই আমি আমার ছেলের বউ করতে চাই।’ তাই আজই ওরা তোকে দেখতে আসবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিয়ে ঠিক করে রাখব। তোর পরীক্ষা শেষ হলেই বিয়ে হবে। ছেলে খুব ভালো। তোর অপছন্দ হবে না।”
পরী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এতক্ষণ বাবার সব কথা শুনছিল। এটা কী করে সম্ভব!
Leave a comment