তোমাকে | মুন্নি আক্তার প্রিয়া | পর্ব – ৩৪

লেকে পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। সন্ধ্যার আঁধার প্রায় নেমে এসেছে। সূ্র্য মামা টাটা বাই বাই জানাচ্ছে। চারপাশটাই এখন গোধুলী লগ্নে ঢেকে আছে।

“ফুসকা খাবে?”
তুর্যের আকস্মিক প্রশ্নে কিছুটা চমকে যায় পরী। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“না।”
“আরে বাহ্! হলো কী আজ? ফুসকা রিজেক্ট করছ?”
“খেতে ইচ্ছে করছে না।” মৃদু হেসে বলল পরী।
“কাউকে খুঁজছ নাকি তুমি?” পরীর অভিমূর্তি দেখে জিজ্ঞেস করল তুর্য। উত্তরে পরী বলল,
“হ্যাঁ।”
“কাকে?”
“একটা বাচ্চাকে।”
“কোন বাচ্চা?”
“নাম তো জানি না। বোধ হয় বলেছিল। কিন্তু মনে নেই।”
“চেনো কীভাবে তাহলে?”
“এখানেই দেখা হয়েছিল। তোমার সাথে এখানে যেদিন ঝগড়া হয় সেদিন বৃষ্টির সময় দেখা হয়েছিল। হাতে করে খাবার বিক্রি করে।”
“ওহ আচ্ছা! ও’কে এখন কোথায় পাবে?”
“এখানেই অপেক্ষা করি। পেলেও পেতে পারি।”
সেদিন যে জায়গায় পরী বসেছিল সেখানেই আজ পরী আর তুর্য বসে আছে। তুর্য বারবার জিজ্ঞেস করেছে কী খাবে। কিন্তু প্রতিবারই পরীর উত্তর ছিল কিছুই না। সময় কাটানোর জন্য তুর্য বাদাম কিনে আনে। বাদামের খোসা ছাড়িয়ে পরীকে সাধলে পরী বলে,
“আমি খাব না।”
“খেতে হবে।”
জোড়াজুড়ি করে না পেরে অবশেষে খায়। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর সেই পিচ্চির দেখা মেলে। পরী পিচ্চির খোঁজ-খবর নিয়ে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“এইটা হলো আমার বিয়ের কার্ড। আর আমার পাশে যাকে দেখছ সে তোমার ভাইয়া। উনার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
“আপা আপনাগোরে দারুণ লাগতাছে।”
পরী হাসে। বলে,
“বিয়ের দিন তোমার পরিবার নিয়ে এই ঠিকানায় চলে আসবে। সঙ্গে তোমার বন্ধু যতজন আছে তাদেরও নিয়ে আসবে। ঠিকানা যদি না চেনো তাহলে রিক্সাওয়ালাকে বলবে সে নিয়ে যাবে।”
“আমি যামু আপা?”
“হ্যাঁ, আসবে। আমি খুব খুশি হব।”
“আইচ্ছা আপা।”
তুর্য ছেলেটার থেকে একটা পানির বোতল নিয়ে পাঁচশ টাকার একটা নোট ওর হাতে গুঁজে দেয়।
“এত টাকা ভাংতি নাই তো ভাই।”
তুর্য মৃদু হেসে বলে,
“ভাংতি লাগবে না। এটা তোমায় ট্রিট দিলাম খুশি হয়ে।”
.
.
রোজ আর প্রিয়ম বাড়িতে ফিরেছে ভোরের দিকে। সাথে নিয়ে এসেছে অনেক অনেক উপহার। পরী তখন ঘুমে ছিল। প্রিয়ম গিয়ে পরীর কানে কটনবার ঢুকিয়ে দিতেই পরী লাফিয়ে ওঠে। প্রিয়মকে দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে থাকে। ঘোর কাটার পর ঝাঁপিয়ে পরে ভাইয়ের বুকে। 
এরপর দুই পরিবারের আবার সাক্ষাত হয়। তুর্যর বাবা জানায়, দুই ছেলে-মেয়ের একসাথে বিয়ে দেওয়াটা তার জন্য অনেক ঝামেলার হয়ে যাবে। তাছাড়া একমাত্র বোনের বিয়েতে তুর্যর দায়িত্বও তো কম নয়। তাছাড়া বিয়ের পর ফিরতি চলন নিয়েও ঝামেলা হবে তাদের। তাই সবদিক ভেবে দুই পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় তিথি আর প্রান্তর বিয়ে হবে ওদের বিয়ের তিনদিক আগে। তার মানে তাদের হাতে আর দুটো দিন। তাই তুর্যর পরিবার তিথির বিয়ের জন্য সব বন্দবস্তের আয়োজন শুরু করে দেয়। তিথি ও প্রান্তর অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে ভালোই ভালো বিয়েটা হয়ে যায়।
.
বিয়ের কেনাকাটার সময় তুর্য ছবি তুলে তুলে পরীকে হোয়াটসএপে পাঠিয়েছে। সকল কেনাকাটা করেছে পরীর পছন্দেই। এমনকি নাকফুলটাও পরীর পছন্দমতো কিনেছে। দুই জুটির অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। হলুদ শাড়িতে হলুদিয়া পরী সেজেছে আজ নববধূ। সেজেগুজে হোয়াটসএপে ছবি পাঠাতে হয়েছে তুর্যর কাছে।ছবি দেখেও ক্ষান্ত হয়নি তুর্য। ভিডিও কলে কথা বলবে বলে আবদার করেছে। তুর্যর কথা ফেলতে পারেনি। ঐদিকে সবাই হলুদের জন্য ডাকাডাকি করছে। পরী তাড়া দিয়ে বলে,
“দেখা হয়ে গেছে? এখন রাখছি।”
“আরে! দেখলামই তো না এখনো ভালো করে।”
“আর দেখতে হবে না। রাখলাম।” বলে পরী ফোন কেটে দেয়।
দরজার সম্মুখে দেখা হয়ে যায় বাবার সাথে। গভীর মমতায় তাকিয়ে আছেন পরীর দিকে। চোখ তার ভেজা ভেজা। 
“কিছু বলবে আব্বু?” মাথা নত করে জিজ্ঞেস করল পরী।
বাবা সামনে এগিয়ে এসে পরীর দু’গালে হাত রাখেন। বলেন,
“আমার ওপর তোর খুব রাগ-অভিমান জেগে আছে তাই না মা?”
পরী মৃদু হেসে বলে,
“এমন কিছুই না আব্বু”
বাবার কান্নায় গলা ধরে আসে। চোখ দুটোও ভিজে আসে কথা বলার সময়। তিনি বারবার চেষ্টা করছেন চোখের পানি আটকানোর। কিন্তু সেই চেষ্টা বৃথা। কান্নারত অবস্থায় পরীর দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,
“তোর ওপর আমি খুব অন্যায় করেছি রে মা। তোকে কত নিষ্ঠুরভাবে মেরেছি। আমায় তুই ক্ষমা করে দিস মা।”
পরী এবার নিজেও কেঁদে ফেলে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“এভাবে কখনো বলবে না আব্বু। তুমি কোনো ভুল করোনি। তোমার জায়গায় তুমি ঠিক ছিলে। তাছাড়া আমায় মারার, বকার অধিকার তো তোমার আছে। এজন্য তুমি কেন ক্ষমা চাইবে?”
“খুব কষ্ট হচ্ছে রে আম্মু! তুই কাল শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি। আমার বাড়িটা যে ফাঁকা হয়ে যাবে আম্মা। প্রতিদিন আমি কার ঘুমন্ত মুখটা দেখে অফিসে যাব? অফিস থেকে ফেরার সময় কার জন্য খাবার আনব? কে বলবে আমায় ‘আব্বু বান্ধবীরা মিলে ঘুরতে যাব। না করতে পারবে না কিন্তু।’ আমি তোরে ছাড়া কেমনে থাকব মা?”
পরী এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমি যাব না আব্বু। আমি বিয়ে করব না। তবুও তুমি কেঁদো না।”
বাবা পরীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“শোনো পাগলীর কথা! সব মেয়েকেই একটা সময়ে শ্বশুরবাড়িতে যেতে হয় রে মা। আর সব মেয়ের বাবা-মা’কেই এই কষ্টকর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়। এটাই যে নিয়ম।”
পরী কোনো কথা বলছে না। শুধু কেঁদেই চলেছে। পরী যেতে দেরি হচ্ছিল বলে রেহেনা বেগম, রোজ আর মেহনুবা এসেছিল ডাকতে। এসে বাবা-মেয়ের আবেগময় দৃশ্য দেখে তাদেরও চোখও অশ্রুপূর্ণ হয়ে যায়। ভাবি চোখের পানি মুছে ভেতরে এসে বলে,
“অনেক কান্নাকাটি করা হয়েছে। এখন চলেন ম্যাম।”
বাবা বলেন,
“হ্যাঁ মা, আমার আম্মাকে নিয়ে যাও।”
দরজার বাইরে গিয়ে মুখোমুখি হয় রেহেনা বেগমের। তার গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। পরী গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। মা পরীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“এখন আর কোনো কান্না নয়। চল।”
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়ে যায় উৎসব আনন্দে। পরীর প্রায় সব কাজিনরাই নেচেছে। কেউ গেয়েছে। পরেরদিন পরীকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে লোক আসে। পরীর ইচ্ছে ছিল লাল বেনারসী পরবে। আর শ্বশুরবাড়ি যাবে পালকিতে করে। পালকিতে যাওয়ার কথা শুনে তুর্য খুব হেসেছিল আর অবাকও হয়েছিল। এখন কি আর পালকির চল আছে? কেই বা পালকি করে এখন শ্বশুরবাড়ি যায়? গ্রামেও তো এখন আর পালকি করে বউ নিয়ে যাওয়া হয় না। কিন্তু পরীর এক কথা। পালকিতে করে যাবে মানে পালকিতেই যাবে। এমন তো নয় দুজনের বাড়ির দূরত্ব অনেক। সামান্যই তো দূরত্ব। সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যাই তো নেই। পরীর কথা রাখার জন্য তুর্য ও ওর কাজিনরা অনেক ঘুরেফিরে পালকির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। হ্যাঁ, আজ পালকি করেই যাবে পরী শ্বশুরবাড়িতে। বরযাত্রী এসে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢোকার অনুমতি পায়নি এখনো। পাবে কী করে? আগে যে শ্যালক আর শালিকাদের দাবি পূরণ করতে হবে। কমিউনিটি সেন্টারের নিচ তলায় সব আয়োজন করা হয়েছিল। বর এসেছে শুনে সবাই নিচে নেমে এসেছে। দুই তলার বারান্দা থেকে নিচতলার সবটাই দেখা যায়। পরী লুকিয়ে লুকিয়ে বারান্দার দেয়ালের আড়ালে দাঁড়ায়। এখান থেকে তুর্যকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ইশ! শেরওয়ানীতে যে কী দারুণ লাগছে! আজ তো খুন-ই হয়ে যাবে পরী। শ্যালক-শ্যালিকাদের দাবি মিটিয়ে অবেশেষে ভেতরে প্রবেশ করে বরযাত্রীরা। পরীর বুক দুরুদুরু কাঁপছে তুর্যকে দেখে। সকলে দেখে ফেলার আগেই পরী সেখান থেকে সরে যায়। কিন্তু আনন্দের রেশ কাটেনি তখনো। কিছুক্ষণ পর পরীকে এনে তুর্যর পাশে বসানো হয়। সবার খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলে বেশকিছুক্ষণ ছবি তোলার পর্ব চলে। যদিও খাওয়ার আগেও একবার ছবি তোলার পর্ব শেষ হয়েছিল। পরী আর তুর্য অনেকগুলো কাপল ছবি তোলে। এরপর দুজনের সেই সময়টা আসে। একজনের জীবনের সাথে আরেকজনের জীবন জুড়ে যাওয়ার মুহূর্ত। এরপর শুরু হয় নাচের অনুষ্ঠান। সর্বপ্রথম একসাথে নাচে তিথি আর প্রান্ত। ওদের নাচ দেখে এখন পরীর নিজেরও নাচতে ইচ্ছে করছে। আবার কে কী ভাববে ভেবে চুপ করে থাকে। কিন্তু ডিজে গানে নিজেকে আটকে রাখা মুশকিল। অলরেডি হাত, কাঁধ নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। তুর্য সেটা খেয়াল করে বিড়বিড় করে বলে,
“নাচানাচি বন্ধ করো।”
পরী কপাল কুঁচকে বলে,
“চলো দুজনে নাচি।”
“পাগল হয়েছ নাকি তুমি?”
“পাগল হওয়ার কী আছে? কত মেয়েই তো নিজের বিয়েতে নাচে। হাজবেন্ডরাও নাচে। তাহলে আমরা নাচলে সমস্যা কী?”
“অনেক সমস্যা। এত নাচতে মন চাইলে ঘরে আমায় নেচে দেখিও।”
“ওরে! নিজের বিয়েতে নাচতে পারব না আর ঘরে নেচে দেখাব? ঘরে তুই নাচবি শালা!”
তুর্য কিছুক্ষণের জন্য থতমত খেয়ে যায়। মিনমিন করে বলে,
“রেগে যাচ্ছ কেন? এখানে কোনো গালাগাল দিও না আবার প্লিজ।”
পরী রাগি দৃষ্টিতে একবার তাকায় তুর্যর দিকে। এরপর আবার তিথি আর প্রান্তর নাচের দিকে মনোযোগ দেয়। দুজনকে কী সুন্দরটাই না লাগছে! দুজনের নাচ শেষ হলে প্রিয়ম আর রোজ নাচে। ওদের নাচ শেষ হলে মেহনুবা আর সাগর নাচে। তারপর রেহান আর ওর গার্লফ্রেন্ড।  ওদের নাচ শেষ হলে পরীর আর তুর্যর ছেলে কাজিনরা একসাথে নাচে। এরপর মেয়েরা সবাই একসাথে নাচে। ওদের নাচ শেষ হলে ওরা চাচা-চাচি, খালা-খালু, মামা-মামি, ফুপা-ফুপি আর শ্বশুরবাড়ির মুরুব্বীদেরও টেনে নিয়ে আসে নাচার জন্য। তারা সেখান থেকে চলে যেতে চাইলেও পারছে না। অগত্যা বাধ্য হয়ে ওদের সাথে তারাও নাচে। তা দেখে উপস্থিত সকলে, তুর্য, পরীও হাসে। প্রান্ত পরীর বাবা ও তুর্যর বাবাকে টেনে নিয়ে আসে। তিথি টেনে আনে পরীর মাকে। তাদেরও জোর করে নাচায়। পরী এবার হাসতে হাসতে থেমে যায়। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। এইদিনটা স্মৃতির পাতায় গেঁথে থাকবে পরীর। পরী আজ স্বার্থক। পরিবার মানিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পেয়েছে। পরিবারকেও খুশি দেখছে। কিচ্ছু হারাতে হয়নি পরীকে। পরী আজ সম্পূর্ণা। 
পরীর ঘোর কাটে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তুর্যর ডাকে। হাত দিয়ে চোখের কোণে থাকা পানিটুকু দ্রুত মুছে ফেলে। তুর্য হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরী আশেপাশে তাকিয়ে হেসে মেহেদী রাঙা হাতটি তুর্যর হাতের ওপর রাখে। তুর্য শক্ত করে একহাতে পরীর হাত ধরে। অন্য হাতে মাইক্রোফোন। এরপর পরীর দিকে মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে গান শুরু করে,
“Tere sang yaara
Khush rang bahara
Tu raat deewani
Main zard sitaara.
O karam khudaya hai
Tujhe mujhse milaya hai
Tujhpe marke hi toh
Mujhe jeena aaya hai.
O tere sang yaara…
Khush rang bahara
Tu raat deewani
Main zard sitaara
O tere sang yaara
Khush rang bahara
Main tera ho jaaun
Jo tu karde ishara
Kahin kisi bhi gali mein jaaun main
Teri khushboo se takraaun main
Har raat jo aata hai mujhe
Woh khwaab tu…
Tera mera milna dastoor hai
Tere hone se mujhme noor hai
Main hoon soona sa ek aasmaan
Mehtaab tu…
O karam Khudaya hai
Tujhe maine jo paaya hai
Tujhpe marke hi toh
Mujhe jeena aaya hai
O tere sang yara
Khushrang bahara
Tu raat deewani
Main zard sitaara.
O tere sang yara
Khushrang bahara
Tere bin ab toh
Na jeena ganwara.
Maine chhode hain baaki saare raste
Bas aaya hoon tere paas re
Meri aankhon mein tera naam hai
Pehchaan le…
Sab kuch mere liye tere baad hai
Sau baaton ki ik baat hai
Main na jaunga kabhi tujhe chhod ke
Ye jaan le
O karam Khudaya hai
Tera pyar jo paaya hai
Tujhpe marke hi toh
Mujhe jeena aaya hai.
O tere sang yaara
Khush rang bahara
Tu raat deewani
Main zard sitaara.
O tere sang yaara
Khush rang bahara
Main behta musafir
Tu thehra kinara.
গান শেষে পরী সকলের সামনেই তুর্যকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে আনন্দে। বাকিদের মুখে তৃপ্তির হাসি।
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে আসে বিদায়ের পালা। তার আগে কাছে আসে সেই পিচ্চি ছেলেটা। পরীকে বলে,
“আপা তোমারে আজ রাজকন্যার মতো লাগতাছে। খুব সুন্দর তুমি।”
তুর্য ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“আজ থেকে তোর আপা আমার কুইন। মানে রাণী। রাজকন্যা থেকে আজ রাণীও হলো। রাজকন্যা আমার শ্বশুর মশাইর কাছে। আর রাণী হলো আমার কাছে। বুঝলি?”
“হ।আপনারা সারাজীবন এমন সুখে থাকেন দোয়া করি ভাইজান।”
বিদায়ের মুহূর্তে চারদিক একদম থমথমে হয়ে আছে। পরীর বড় চাচা পরীর মাথায় হাত রেখে বলেন,
“মা রে স্বামী, সংসার নিয়ে সুখে থাক। বাড়িতে সবার সঙ্গে মানিয়ে চলবি।”
পরীর বুক ফেঁটে তখন কান্না চলে আসে। পরীর বাবা এসে পরীর হাত তুর্যের হাতে তুলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“বাবা, অনেক আদরে মানুষ করছি আমার আম্মারে। আমার কলিজার টুকরা আজ আমি তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। কখনো ওরে কষ্ট দিও না বাবা। কোনো ভুল করলে ওরে বুঝিয়ে বলবা। তবুও কখনো কষ্ট দিও না।”
পরী হাউমাউ করে কেঁদে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বাবাও এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলেন। রেহেনা বেগমের কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গেছে। তিনি পরীর কাঁধে হাত রাখেন। পরী তখন মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমি যাব না মা। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারব না।”
তিনি কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না। শুধু শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখেন মেয়েকে। সব আত্নীয়-স্বজনের চোখেই পানি। মেয়েদের বিদায় বেলা যে এত কষ্টকর! বুকের ভেতর ফেঁটে চৌচির হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে যাদের সাথে বেড়ে ওঠা তাদেরকেই পর করে দিয়ে আপন করে নিতে হয় শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের। প্রিয়ম পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কাঁদবি না লক্ষী। কয়েকদিন পরপরই আসবি।”
কান্নার জন্য আর কিছুই বলতে পারছে না। ভাবি, মেহনুবা সকলের থেকে বিদায় নিয়ে পালকিতে ওঠে। মনটা যেতে চাইছে না একদম। বাবা-মা, ভাই, আত্মীয়-স্বজনকে এত বিষাদময় পরিস্থিতিতে রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না একদম। পালকি নিয়ে চলা শুরু করেছে। বুকের ভেতর পরিবারের জন্য কষ্ট নিয়েই এগিয়ে যায় নতুন জীবনে। 
তুর্যদের বাড়িতে পৌঁছানোর পর তাহমিনা বেগম বরণ করে ঘরে তোলেন পরীকে। বাড়ির আশেপাশে থেকে অনেক মানুষজন নতুন বউ দেখতে আসে। পরী চুপটি করে বসে আছে। কিন্তু গরমে ঘেমে শরীর কেমন কেমন করছে। যদিও মাথার ওপর ফ্যান চলছে। গোসল না করা পর্যন্ত শান্তি নেই একটুও।এছাড়া আবার ভারী গয়নাতেও দম আটকে আসছে। অস্বস্তি লাগছিল খুব। মানুষজন আসতে আসতে কমতে থাকে। বাহিরের মানুষ চলে যাওয়ার পর তিথি ও আরো কয়েকজন পরীকে তুর্যর রুমে নিয়ে যায়। শুধু খাটই নয় পুরো রুম ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। পুরো রুম ফুলের ঘ্রাণে ভরে আছে। মন ভরে যাচ্ছে ফুলের ঘ্রাণে। কিন্তু এতকিছুতেও অস্বস্তি কমছে না। তাই তিথিকে কাছে ডেকে কানে কানে বলে,
“আমার খুব অস্থির লাগছে তিথি। গোসল করতে পারলে ভাল্লাগত।”
“বলো কী? তাহলে তো সব চেঞ্জ করতে হবে।”
“হোক!”
“আচ্ছা আমি রুম ফাঁকা করে দিচ্ছি। আর তোমার লাগেজটাও নিয়ে আসছি।”
তিথি রুমে থাকা সকলকে নিয়ে বাহিরে চলে যায়। মিনিট দুয়েকের মধ্যে পরীর লাগেজ নিয়ে এসে বলে,
“এখানে তোমার সব জিনিসপত্র আছে। আমি ভাইয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
পরী মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। তিথি দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে যায়। লাগেজ খুলে লাল কালার একটা জুম শাড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিস বের করে নেয়। পরনের শাড়ি গয়না খুলে ওয়াশরুমে চলে যায়। পরী গোসল করতে যাওয়ার পরই তুর্য আসে। তুর্যর নিজেরই খুব গরম লাগছে। শেরওয়ানী খুলে বসে আছে। পরী বের হলেই তুর্যও গোসলটা সেরে নেবে। গোসল শেষ করে শাড়িটা কোনোরকম পেঁচিয়ে বের হয় পরী। তা দেখে তুর্য বলে,
“এভাবে শাড়ি পরেছ কেন? শাড়ি পরতে পারো না?”
“বলদ! শাড়ি ওয়াশরুমে পরব কীভাবে? আর আমি শাড়ি পরতে জানি।”
তুর্য আফসোসের মতো করে বলে,
“ইশ! সিনেমার মতো তোমায় শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হলো না আমার!”
পরী চুল থেকে টাওয়ালটা খুলে তুর্যর মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
“ঢং!”
তুর্য হেসে ফেলে। তারপর গোসল করতে চলে যায়। পরী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। নিজের কাছেই নিজেকে অন্য রকম সুন্দর লাগছে। তুর্য আসতে আসতে অল্প সেজে নেয় পরী। দু’হাতে দুইটা চুড়ি পরে। তখন তুর্য চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে আসে। আয়নায় পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আকাশের চাঁদ আজ আমার ঘরে!”
পরী ভেংচি কেঁটে বলে,
“এত ঢং করো কীভাবে?”
তুর্য পরীর দিকে এগিয়ে যায়। পরীর কাঁধে থুতনি রেখে বলে,
“বউর সাথেই তো ঢং করব। কিন্তু এটা ঢং ছিল না। এটা সত্যিই বলেছি। তুমি আমার চাঁদ। আমার চাঁদ বউ।”
পরী কাঁধ নাড়িয়ে তুর্যকে সরিয়ে দেয়। বলে,
“আমার সুড়সুড়ি লাগে।”
তুর্য হাসে। চোখেমুখে দুষ্টুমির ছড়াছড়ি। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। টাওয়াল দিয়ে পরীর চুল মুছতে মুছতে বলে,
“এখনো চুল মুছতে শেখোনি? চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।”
“উঁহু! শিখিনি। আগে মা মুছে দিত। আর এখন তুমি দেবে।”
তুর্য পরীর নাক টেনে বলে,
“আমার পিচ্চি বউ।”
পরী তুর্যর গাল টেনে বলে,
“আমার মিষ্টি বর।”
তুর্য হাসে। মুগ্ধ করা হাসি।
“আচ্ছা তুমি থাকো। আমি আসতেছি।” বলে তুর্য বাহিরে যায়। এই সুযোগে শাড়িটা পরে ফেলে। বিছানায় বসে বসে তুর্যর জন্য অপেক্ষা করছে আর গোলাপের ঘ্রাণ নিচ্ছে। অনেক রকমের ফু্ল দিয়ে খাট আর রুমটা সাজানো হয়েছে। তারমধ্যে গোলাপ ফুলই বেশি। তুর্য ফিরে আসে হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে। প্লেটটা পাশের টেবিলে রেখে দরজা আটকে দেয়। পরী বলে,
“তোমার ক্ষুধা পেয়েছে?”
প্লেট হাতে নিয়ে অপর হাতে চেয়ার টেনে পরীর সামনে বসে। বিরিয়ানির লোকমা পরীর মুখের সামনে ধরে বলে,
“জি না ম্যাম! তোমার জন্য এনেছি। সেই যে সকালে খেয়েছ তুমি। আর তো খাওয়া হয়নি তোমার।”
খুশিতে আবারো চোখে পানি চলে আসে পরীর। তুর্য মেকি ধমক দিয়ে বলে,
“এখন কাঁদলেই মারব। তোমরা মেয়েরা এমন কেন বলো তো? কষ্ট পেলেও কাঁদো, খুশি হলেও কাঁদো। মানে চোখের পানি একদম এনেই রাখো।”
তুর্যর কথায় হাসে পরী। খাবার মুখে নিয়ে তুর্যকেও খাইয়ে দেয় আর বলে,
“সবসময় এমনই থাকবে তো?”
“যতদিন বেঁচে থাকব ইনশাআল্লাহ্‌। কষ্টকে তোমায় স্পর্শ করতে দেবো না। ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখব তোমায়। প্রচুর প্রচুর ভালোবাসব। চলবে?”
“দৌঁড়াবে।”
দুজনে একসঙ্গেই হাসে। খাওয়া শেষ করে তুর্য বলে,
“তখন না নাচতে চেয়েছিলে? চলো এখন নাচো।”
“ইশ! আমার ঠেকা।”
তুর্য সাউন্ডবক্সে গান ছাড়ে। 
“Mujhko barsaat bana lo
Ek lambi raat bana lo
Apne jazbaat bana lo jaana
Mujhko alfaaz bana lo
Dil ki aawaaz bana lo
Gehra sa raaz bana lo jaana
Nasha hoon main behakne do
Mere kaatil mujhe jeene ka haq toh do
Mujhko barsaat bana lo
Ek lambi raat bana lo
Apne jazbaat bana lo jaana”
গানের তালে তালে পরীকে নিয়ে নাচছে তুর্য। সফট গানে সফট ডান্স। রুমের লাইট অফ। শুধু নীল কালারের ডিম লাইটটা জ্বালানো। পরীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তুর্য। তুর্যর প্রতিটা স্পর্শই আজ নতুন। যা অন্যরকম অনুভূতির সাথে পরিচয় করাচ্ছে পরীকে। লজ্জায় পরী নুইয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট কাঁপছে অনবরত। মুখে কিছু বলার উপায় নেই। আর না আছে তুর্যর থেকে দূরে সরার উপায়। সত্যি বলতে পরীর নিজেরও কোনো ইচ্ছে নেই তুর্যর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। তুর্য পরীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। পরী চোখ নিচু করে তুর্যর শার্ট খামচে ধরে। তুর্য ডান হাতে পরীর গাল স্পর্শ করে। পরী লজ্জায় কেঁপে ওঠে। তুর্য অধর দ্বারা পরীর অধর ছুঁয়ে দেয়। পরী সায় দেয় তুর্যর ভালোবাসায়।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।