এক সমুদ্র প্রেম

ইকবাল দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে পুষ্পর। এমনিতে মেয়েটা সব সময় আগে আসে, আজ যে কী হলো!
সে বিচলিত, চিন্তান্বিত। পুষ্প তো দেরী করেনা কখনও। উলটে আগে আগে এসে বসে থাকে। যদি সাক্ষাৎ এর সময় থাকত এগারটা,পুষ্প হাজির হতো সাড়ে দশটায়। আধ ঘন্টা পথ চেয়ে বসে থাকত ওর। বলত ‘তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে যে সুখ পাই,সেই সুখ অন্য কিছু তে পাইনা ইকবাল।’

ইকবাল মনে মনে হাসল। পুরনো স্মৃতি চারণ থেকে বেরিয়ে আরেকবার হাতঘড়ি দেখল। ফোন করবে কী করবেনা দ্বিধান্বিত সে। আজত শুক্রবার,পুষ্পর ক্লাস নেই,ভার্সিটি বন্ধ। ফোন করা নিষেধ। পাছে ধরা পরে! পিউ সেদিন ফোন ধরে ফেলায় দুজনেই আরো অধিক তটস্থ। এত কিছুর মধ্যেও ওদের দেখা করা চাই। মেয়েটা নানান অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হবে। দুজন-দুজনকে না দেখলে শান্তি নেই যেন।

ইকবাল অস্থির ভঙিতে এ মাথা- ও মাথা হাঁটল। ধুর ভাল্লাগছে না! আসছেনা কেনও ও? কখন আসবে? এত ক*ষ্ট অপেক্ষায়? কোনও সমস্যা হয়েছে কি বাড়িতে? ফোন করবে একবার? করবে ভেবেও থেমে গেল। ওর জন্যে সমস্যা হলে পুষ্প চিঁ*বিয়ে খাবে। তার অধীর অপেক্ষার মাঝে একজন এসে দাঁড়াল সেখানে। মুখ ভর্তি মেক আপ,সালোয়ার কামিজ পরিহিত মানুষটি কেমন মোটা স্বরে বলল,
‘ অ্যাই ভাইয়া টাকা দাও।’
ইকবাল ঘুরে তাকাল। নিমিষে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কথা না বাড়িয়ে মানিব্যাগ বের করে দশ টাকা বারিয়ে দিতেই আগন্তুক দুদিকে মাথা নাড়লেন। ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললেন,
‘ আজকের দিনে দশ টাকায় হবেনা,গুনে গুনে একশ টাকা দাও।’

‘ আজ কী?’
‘অ্যাই ভাইয়া কী বলে? আজ কী তুমি জানোনা বাবু? চারপাশে দেখছোনা কত নিব্বা নিব্বি বসে,হু হু? আজ ভালোবাসা দিবস,আবার পহেলা ফাল্গুন। দাও দাও, একশ টাকা দাও জলদি, সময় নেই। ‘

ইকবালের কপালের ভাঁজ মসৃন হয়। জ্বিভ কা*টল মনে মনে। আজ যে ভালোবাসা দিবস ভুলেই বসেছিল। অবশ্য ভুলবেনা কেন,সে কি এই একদিন তার পুষ্পকে ভালোবাসে? আলাদা করে ভালোবাসা দিবস তারাই পালন করে যাদের ৩৬৪ দিন ঘাটতি থাকে ভালোবাসতে। তার তো নেই।
‘ এই কী ভাবছো? এত ভাবাভাবি না করে টাকা দাও ত। নাহলে কিন্তু ভুল জায়গায় হাত দিয়ে দেব হু।’

ছেলেটার চোখ কপালে উঠল। দাঁড়ানো থেকে দু পা পিছিয়ে এলো ওমনি। এদের বিশ্বাস নেই। দিতেও পারে। তড়িঘড়ি করে একশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিতেই সে খুশিমনে নিলো। যেতে যেতে রসিয়ে বলল,
‘ তুমি হ্যান্ডসাম আছো, ভালোও। তাই সালাম দিলাম,আসসালামু আলাইকুম।’

ইকবাল হেসে উত্তর করল। তারপর আশেপাশে উদগ্রীব চোখে তাকাল। এতক্ষণ ফুল নিয়ে কত ছেলেমেয়ে ঘুরেছে৷ অথচ এখন একটাও নেই। সে এগিয়ে গেল কয়েক পা। ওইত একটু দূরেই দুটো বাচ্চা ছেলে ফুল নিয়ে বসে। ইকবাল গিয়ে সেখানে দাঁড়ায়। ভীড় আছে ভালোই। প্লাস্টিকের দুটো মগ ভর্তি বড় বড় গোলাপ। টকটকে, তবে তাজা নয়। সব গুলো ন্যাতানো। ইকবালের পছন্দ হলো না। এমন নেতানো পুষ্প তার পুষ্পরানির জন্যে নহে!

ইকবাল চলে এলো। ব্য*র্থ হয়ে বেঞ্চে বসল। পুষ্প কী রা*গ করবে সে ফুল না দিলে? তার ভাবনার মধ্যে কেউ একজন চে*পে ধরে দুই চোখ। খানিকটা হকচকাল সে। পরপর মুচকি হেসে হাতদুখানি আক*ড়ে ধরল। হস্তের মালিক বলল,
‘ কে আমি, বলুন তো?’
ইকবালের দৃঢ় প্রত্যয়ী জবাব,
‘ আপনি সে, যে এই ইকবাল নামক মানুষটার মনের মধ্যে বিশাল এক ঘড় বানিয়ে বসবাস করছে, তাও ভাড়া ব্যাতীত। ‘
পুষ্প হেসে ওঠে। ইকবাল হাতদুটো সরিয়ে এনে ডান হাতের তালুতে চুমু খেল। ঈষৎ কম্পনে শরীর দুলে ওঠে তার। ইকবাল হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ভ্রুঁ নাঁচিয়ে বলে,
‘ আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি জানো?’
পুষ্পর সহজ উত্তর ‘ হ্যাঁ। কে না জানে!’
ইকবাল একটু হাসলো। সুধীর কন্ঠে বলল
‘ এই ভালোবাসা দিবসে আমার কি তোমাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসা উচিত মাই লাভ?’

পুষ্প তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারল না। ইকবালের প্রতিটি কথা ভেতরটা গুলিয়ে দিতে যথেষ্ট।
চটজলদি ওই নেশালো চোখ থেকে দর্শন ফিরিয়ে নেয় সে। নি*ক্ষেপ করে পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর।

পুষ্পর লাজুক,লতানো হাসি ইকবালের বক্ষে সুনামি ওঠায়। তান্ড*ব করে ঝ*ড়ের ন্যায়। ভুলভাল কিছু করে ফেলতে মন চায়। সে টেনেহি*চড়ে সরায় দৃষ্টি। আরেকদিক ফিরে, ঘাড় ঘষে, স্পষ্ট বিড়বিড়িয়ে বলে,
‘ এভাবে হেসোনা মাই লাভ,যা তা ঘটে যাবে।’

পুষ্প সচেতন হয়ে তাকালে চোখ টিপল সে। আরো কয়েক ধাপ বাড়তি লজ্জায় নুইয়ে গেল মেয়েটা। ইকবাল সেই কুণ্ঠা তীব্র করতে বলল,
‘ বিলিভ মি পুষ্প,তুমি যখন মাথা নামিয়ে, মুচকি মুচকি হাসো, আমার ইচ্ছে করে তোমার ফোলা গাল দুটো খেয়ে ফেলতে। ইচ্ছে করে…’
পুষ্প আর্ত*নাদ করে ওঠে,
‘ চুপ করবে ইকবাল?’
ইকবাল স্বশব্দে হেসে উঠল। হাসিতে দোল খেল লম্বাচওড়া দেহ। স্বইচ্ছায় এরকম লজ্জ্বার বাণ ছু*ড়েছে সে। পুষ্প ঠোঁট চে*পে হাসছে। উশখুশ -উশখুশ করছে।
এই ঠোঁট কা*টা মানুষটা বড্ড জ্বা*লায়! অন্তঃস্থলে পী*ড়া দেয়। অথচ একেই ওর চাই। কী তাজ্জব ব্যাপার!
ইকবাল হাসি থামাল। হঠাৎই গুরুতর কণ্ঠে শুধাল,
‘ একটা কথা বলব?’
আওয়াজ শুনে তটস্থ হয়ে বলল,
‘ বলো।’
‘ তোমার জন্যে আমি কোনও ফুল আনিনি পুষ্প। আমার মনেও ছিল না ‘আজ ভালোবাসা দিবস’। যখন শুনলাম এই সারা গার্ডেন খুঁজেছি,যা পেয়েছি,পছন্দ হয়নি, তাই কিনিনি। এই যে দ্যাখো, আমার হাত খালি। আজ এই দিনে তোমাকে ফুল না দেয়ার অপ*রাধে তুমি কি রা*গ করবে? ক*ঠিন শা*স্তি দেবে আমায়?’

কী অনাড়ম্বর স্বীকারোক্তি! পুষ্পর কানে তরঙ্গের মত বাজল। এর থেকে নিষ্পাপ,অকলুষিত কিছু নেই যেন। জড়ো হওয়া দুই ঠোঁট আপনা-আপনি সরে গেল দুদিকে।
বলল ‘ আমাকে তোমার এমন মনে হয়?’

ইকবাল দ্বিধান্বিত। জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে জানাল,
‘ প্রেমিক পুরুষ তো,প্রেয়সীর ক্রো*ধ নিয়ে আ*তঙ্ক থাকাই কি স্বাভাবিক নয়?’
পুষ্প চোখা করে তাকাতেই হেসে বলল
‘ মজা করেছি মাই লাভ। ‘

পুষ্প কিছু বলল না। কাঁধ ব্যাগের চেইন খোলায় ব্যস্ত হলো হঠাৎ। ভেতর থেকে দুটো গোলাপ বের করে ইকবালের সামনে ধরে বলল,
‘ এগুলো কেনা নয়,আমার বারান্দায় যে গাছ গুলোকে বাচ্চার মত পেলেপুষে বড় করেছিলাম সেখান থেকে এনেছি। আমার এক প্রিয় মানুষের জন্যে আরেকটি প্রিয় জিনিসের ব*লি দিলাম। এখানে দুটো ফুল আছে ইকবাল। এক কাজ করি চলো,এর থেকে একটা আমি তোমাকে দেই অন্যটা তুমি আমাকে দাও। হলোনা বরাবর?’

ইকবাল আপ্লুত চোখে তাকায়। চাউনী ছি*ড়ে-খুঁ*ড়ে যেন মুগ্ধতার বর্ষন। মাথা নামিয়ে ঠোঁট কাম*ড়ে হাসে। এই লক্ষী,এই সরল,আর মায়াময়ী মেয়েটি ওর নিজের। একান্ত নিজের। যদি না হয় সে কী বাঁচবে? হবে না কেন,হতেই হবে। নাহলে জীবন ব্যর্থ, বেঁচে থাকা অর্থহীন।

‘ কী হলো,নাও।’
ইকবাল নিলো। দুটো ফুলই নিলো। শুধু দেয়া বলতে হাটুগেড়ে বসে গেল সামনে। সবিস্মিত পুষ্প। চোরা,জড়সড় নজরে একবার আশপাশটা দেখল। ওইত অনেকেই দেখছে তাদের। মেয়েটা আই-ঢাঁই করে চা*পা কণ্ঠে বলল,
‘ ককী করছো ইকবাল?’
সে মানুষের কোনও দিকে খেয়াল নেই। তার বশীভূত, মূঢ় নেত্র একধ্যানে তাকে দেখছে। পুষ্পর শরীর সংকোচন গাঢ় হয়। ওই চোখে তাকিয়ে থাকা যায় না।
ইকবাল পুরু, কালো দু ঠোঁট নেড়ে আওড়াল,
‘ ১৪ই ফেব্রুয়ারী তো একটা উপলক্ষ্য মাত্র। মাই লাভ,আমি তোমাকে প্রতিটা দিন,প্রতিটা ঘন্টা, প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ড ভালোবাসি।’

পুষ্প মোহগ্রস্ত, বিভোর। মূক হয়ে চেয়ে। ইকবালের নিখাঁদ, সুদৃঢ় কণ্ঠ শব্দ খুঁইয়ে দেয়। ভুলিয়ে দেয় পার্থিব সব কিছু ।
মন্থর গতিতে হাত এগিয়ে ফুলগুলো ধরে। কাছে এনে আকড়ে নেয় বুকের সাথে। আস্তে করে বলে,
‘ ওঠো,সবাই দেখছেত।’
ইকবাল উঠল, বাধ্যছেলের মত। তবে কাছে এসে দাঁড়াল। হলো ঘনিষ্ঠ। যৎকিঞ্চিৎ দূরুত্ব ঘুঁচে গেছে তখন। এত কাছাকাছি হওয়া, পুষ্পর হৃদয়ে তোলপাড় চালায়। ব্রীড়িত ঢেউ আঁছড়ে পরে বুকে।
ইকবাল সজীব,আকুল কণ্ঠে বলল,
‘ পুষ্প,তুমি আমার জীবনের প্রিয় প্রাপ্তি।’
‘ আর তুমি আমার ভুবনে সুখের তৃপ্তি। ‘
‘ কখনও ছেড়ে যাবেনা তো?’
ইকবাল হাত বাড়িয়ে দেয়। নিরবে চায় অঙ্গীকার। পুষ্প বিনা বাধায়, দ্বিধাহীনভাবে হাতের ওপর হাত রাখে। অধর নেড়ে আত্মবিশ্বাস সমেত জানায়,
‘ যাব না, কথা দিলাম।’

দুটো চড়ুই পাখির ন্যায় পাশাপাশি শরীর ওদের। মিশে একাকার অধীর,আকাঙ্ক্ষিত অক্ষিপট। প্রেমের বাঁধনে এক জোড়া মন বাঁধা পরেছে ঠিক,কিন্তু বৈধ বন্ধন আসতে কত বাকী আর? কবে ওপাশের মানুষটিকে একটু ছুঁয়ে দেখবে তারা? যাতে নিষেধ নেই,বারণ নেই, আছে ভালোবাসা। হবে যথোচিত স্পর্শ?

আচমকা পুষ্পর ফোন বেজে ওঠায় দুজনের ধ্যান ভাঁঙে। এক জোড়া দেহ নড়েচড়ে উঠল। বাড়ল দৈহিক দুরুত্ব। ইকবাল গলা খাকাড়ি দিয়ে আরেকদিক তাকাল। পুষ্প কানের পাশে চুল গুঁজে ফোন বের করে। যতটা নিরুদ্বেগ ছিল, স্ক্রিনে ‘ধূসর ভাইয়া ‘লেখা দেখেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। যেন সজো*রে,সবেগে একটা কুড়াল দিয়ে কো*প পরেছে। তৎক্ষনাৎ ভীত কণ্ঠে বলল,
‘ ভাইয়া ফোন করেছে?’
ইকবাল মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। শ*ঙ্কিত চেহারায় আশেপাশে তাকাল। সতর্ক কণ্ঠে বলল,
‘ ব্যাটা এখানেই কোথাও নেইত?’
কথাটায় পুষ্পর হৃদপিণ্ড থমকায়। হাত পা কাঁ*পুনি শুরু হয়। যেন এক্ষুনি থার্মোমিটার বিদীর্ণ করে জ্বর আসবে গায়ে। এলোমেলো পাতা ফেলে যতদূর চোখ যায় মিছেমিছি খোঁজে।
মুখমন্ডল ভ*য়ে লাল। ইকবাল খেয়াল করতেই নিজেকে স্বাভাবিক করল। চা*পা দিল স্বীয় আ*তঙ্ক। ওকে সহজ করতে বলল,
‘ আরে আগেই এরকম করছো কেন? ফোন ধরে দ্যাখো কী বলে?’
পুষ্প ঢোক গি*লে বলল ‘ যদি ব*কে?’
‘ আহহা! ধরেই দ্যাখো না।’

পুষ্প ভ*য়ে ভ*য়ে রিসিভ করল। কানে গুঁজতেই ধূসরের প্রথম প্রশ্ন,
‘ কোথায় তুই?’
ত্রা*সে মেয়েটার কলিজা ছ*লাৎ করে ওঠে। ক*ম্পিত কণ্ঠে জবাব দেয়,
‘ এইত ভভাইয়া,এককটু ববেরিয়েছি। ককেন?’

***
মারিয়া ‘সিকদার বাড়িতে’ রয়ে গেল আজ। দুপুরে না খাইয়ে তাকে ছাড়া হবেনা, এই সিদ্ধান্তে উপনীত সকলে। সেও দোনামনা করে হার মানল শেষে। মেনে নিয়ে বলল ‘ আচ্ছা, তাই হবে।’
আজমলের জন্যে বিশেষ আয়োজনে আরো দুটো আইটেম যোগ হলো। আজকে জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া হবে। সবাই বাড়িতে। ধূসরকেও বলা হয়েছে তাড়াতাড়ি ফিরতে। এইত,এলো বলে।
মারিয়া এতক্ষণ রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ছিল। মিনা বেগম সুনিপুণ রান্নাবান্নায়। সে নিজেও জানে,তবে টুকিটাকি। এত পাঁকা হাত নয়। তবে রান্না শেখার ঝোঁক বেশ। মনোনিবেশ দিয়ে কয়েক পদ দেখল। বেগুন ভাজার জন্যে কড়াইয়ে তেল বসানোর পর বেরিয়ে এলো। ভাবল,একবার পিউয়ের ঘরে যাবে। বাড়িতে ও ছাড়া কথা বলার মত এখন কেউ নেই। পুষ্পকে তো আসা থেকে দেখছেনা। শুনেছে বেরিয়েছে। স্কুলজীবনের কিছু বন্ধুরা আসবে,দেখা করবে সবাই। মারিয়া দোতলার দিকে রওনা হয়। নিঃসন্দেহে সিড়ি বেয়ে উঠতে হবে তাতে। মাঝপথে আসতেই সাদিফ সামনে পরে। আশ্চর্যজনক ভাবে দুজনেই থেমে দাঁড়াল। একে অন্যকে দেখে পাশ কা*টাতে গেল। কিন্তু হলোনা। মারিয়া যেদিক যাচ্ছে,সাদিফ সেদিকে যায়। ডানে গেলে ডানে,বামে গেলে বামে। বামে গেলে বামে,ডানে গেলে ডানে। কী বি*শ্রী ব্যাপার!
শেষমেষ হতা*শ হয়ে দুজনেই দাঁড়িয়ে যায়। মারিয়া কিছু বলতে গিয়েও থামল। লোকটা অতীতে তার উপকার করেছিল কী না! অথচ অশিষ্ট ছেলেটা খ্যাক করে বলল,
‘ কী সমস্যা? হয় এক জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়ান,আমাকে নামতে দিন। নাহলে সরুন সামনে থেকে।’
মারিয়া বিকৃ*ত করে ফেলল মুখবিবর। এই ছেলেকে ভালো ভাবা আর টয়লেট ক্লিনার কে জুস ভাবা এক রকম না? সে বির*ক্ত হয়ে বলল,
‘ আমি আগে উঠেছি সিড়িতে,আগে আমি যাব। আপনি সরে দাঁড়ান।’

সাদিফ অবাক চোখে তাকায়। তার ধারণা মতে সে যথেষ্ট নরম ভাবে কথা বলেছে। অথচ দ্যাখো, এই মেয়ে কী অভদ্র! কী বেয়া*দব! কী গর্হিত! মোটা কণ্ঠে বলল,
‘ এটা আমার বাড়ি। সো আমি আগে যাব।’
‘ বাড়িটা আপনার একার নয়,অনেকের। সেই অনেকের ওসিলায় আমি একটা বড় অংশ পাচ্ছি,আপনি পাচ্ছেন শুধু নিজের অংশ।তাই আমার রাস্তা আপনার আগে ছাড়া উচিত।’

বুদ্ধিহীন প্রতর্কে হাসি পেল সাদিফের। বলল,
‘ আপনি উকিল হলে আসামী বাঁচাতে পারতেন না। নির্দোষ হলেও ফাঁ*সি হয়ে যেত।’
মারিয়া বুঝতে না পেরে বলল ‘ মানে?’

তার স্পষ্ট জবাব,
‘ মানে, আপনি একজন অত্যন্ত খা*রাপ এবং বিকল যুক্তিবিদ। ‘

মারিয়া দাঁত চেপে ধরে, বলে,
‘ আর আপনি একজন খা*রাপ মানুষ। যার কাজ হলো মেয়েদের সাথে গায়ে হুমড়ি খেয়ে ঝ*গড়া করা।’
সাদিফের বিশেষ কিছু এলো গেল না কথাটায়। চোখের চশমা খানিক ওপরে ঠেলে বলল,
‘ মেয়ে মানুষ হয় মোমের মত। গলে গলে পরা তাদের অভ্যেস। সেখানে যদি কাঠের মত দেখি, আমার কেন সবারই ইচ্ছে করবে হাতুড়ি দিয়ে পে*টাতে।’

মারিয়া তেলে-বেগুনে জ্ব*লে বলল
‘ আজেবা*জে কথা বলা ছাড়া আপনার কি আর কাজ নেই ? আপনি আদৌ জানেন আমি কেমন?’
সাদিফ সোজাসুজি বলল,
‘ আপনি হলেন রাস্তার পারে বিক্রি করা এক গ্লাস বেলের শরবতের মত। দেখতে ভালো কিন্তু খেতে অতিশয় বি*শ্রী। প্রায় অর্ধেক লোক অল্প খেয়ে ড্রেনে ফেলে দেয়। ‘

মারিয়া দমে গেল না। পালটা জবাব দিল,
‘ ও তাই? আর আপনি হলেন রাস্তার সেই বিশেষ প্রানীর লেজের মত,যেটা টানলেও সোজা হয়না।’
সাদিফ হতভম্ব। নিমিষে অভিব্যক্তি বদলে গেল। ইঙ্গিত ধরতে একটুও সময় ব্যয় হয়নি। শ*ক্ত হয়ে এলো চোখমুখ। কিছু বলতে নিলে পিউ নাঁচতে নাঁচতে হাজির হলো সেখানে। ওকে দেখেই কথা গি*লে নিল সে। পিউ দুজন কে একবার একবার দেখে বলল,
‘ একী! তোমরা দুজন এখানে স্ট্যাচু হয়ে আছো কেন? হয় নিচে নামো,নাহলে ওপরে ওঠো।’

মারিয়া বলল ‘ আমিও সেটাই বলছিলাম ওনাকে। যে সরে দাঁড়ান আমি পিউয়ের ঘরে যাই,কিন্তু উনিতো সরছেনই না।’

পিউ চোখ ছোট করে বলল ‘ সরছেন না কেন?’
সাদিফ, মারিয়ার প্রতি কট*মট করে এক সাইড হয়ে দাঁড়াল।
জয়ের হাস্যে অধর ভরে উঠল তার। মিটিমিটি হাসি দেখে নাক ফোলায় সাদিফ। পিউ অধৈর্য চোখে একবার সদর দরজা দেখল। তারপর দেখল দেয়ালে টাঙানো বিশাল ঘড়িটা। তার চাউনী উদগ্রীব। সেখানে প্রতীক্ষা লেপ্টে। মানুষটা ফিরবে কখন?
সাদিফ শুধাল,
‘ কাউকে খুঁজছিস?’
‘ হু? না,মানে হ্যাঁ, আব্বুরা এখনও ফিরছেনা কেন?’
‘ আসবে সময় হলে। ‘
বলতে বলতে সাদিফ নিচে নেমে গেলো। মারিয়া বলল,
‘ চলো পিউ,তোমার রুমে যাই। তোমার বেলকোনি দিয়ে না কি সুন্দর আকাশ দেখা যায়? ‘
পিউ বলল,
‘ হ্যাঁ যায়ত৷ এসো দেখাই।’
তারা পা বাড়ানোর মধ্যে রাদিফ ছুটে এলো। হাতের ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এই তুমি ফোন কোথায় কোথায় রেখে ঘোরো আপু? এই নাও,ফোনের ভেতর থেকে পুষ্পপু চিৎকার দিচ্ছে।’

হড়ভড় করে বলল,সাথে ফোনটা ধরিয়ে দিল। নিজের ট্যাবে গভীর মনোযোগ তার। গেমস খেলছিল বসে। এই সময় ফোন আসাও একটা ডিস্টার্ব।
‘ ফোনের ভেতর থেকে পুষ্প চিৎকার দিচ্ছে? তার মানে?’
‘ কল করেছে আর কী।’
‘রাদিফ যেভাবে বলল,আমি ভাবলাম কী না কী!’
‘ ওর কথাবার্তাই এমন।’
ফোন তখনও বাজছে। পিউ রিসিভ করে বলল,
‘ হ্যাঁ আপু বল।’
‘ কী করছিস?’
‘ কিছু না। তুই কোথায়? আসবি কখন? ভাল্লাগছে না।’
‘ ওইজনেই তোকে ফোন করলাম। আমার বন্ধুরা তোকে দেখতে চাইছে। চটপট তৈরি হয়ে বের হ তো।’
পিউ অবাক হয়ে বলল,
‘ এখন? আমাকে দেখার কী আছে? আমিত ওদের চিনিওনা।’
‘ তুই না চিনলেও ওরাতো চেনে। স্কুল ফ্রেন্ড না আমার? আজকে চিনবি। আয় এখন, দেরী করিস না।’

‘ কিন্তু…. ‘
‘ প্লিজ, বনু আমার, ভালো না তুই? আয়। সুন্দর করে সেজেগুজে আসিস কেমন?’
পিউ ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল
‘ আচ্ছা। কিন্তু কোথায় আসব?’
‘ উম,তুই বের হ, আমি লোকেশন পাঠাচ্ছি। ‘
‘ আম্মু বের হতে দেবে এখন?’
‘ দেবে,আমি আম্মুকে বলেছি। আম্মুর একটা লাল শাড়ি আছেনা? ওটা পরে আয়।’
পিউ মুখ কুঁচকে বলল ‘ বিয়ে করতে যাব না কি? শাড়ি পরে হাঁটতে আমার ক*ষ্ট হয়। সামলাতে পারিনা।’
‘ আচ্ছা তাহলে সাদা চুড়িদার আছেনা, ওটা পরিস কেমন? ‘
‘ ঠিক আছে। ‘

লাইন কা*টতেই মারিয়া বলল ‘ কোথাও যাবে?’
‘ হ্যাঁ, আপু ডাকল,ওর বন্ধুদের সাথে দেখা করব।’

সে ঠোঁট উলটে বলল,
‘ তুমি গেলে আমি একা হয়ে যাব।’

‘ তাহলে তুমিও চলো। ‘
পিউয়ের কণ্ঠ উজ্জ্বল।
‘ না না,সমস্যা নেই। তুমি যাও।’
‘ একা হবে কেন,সাদিফ ভাইয়া আছেনা? ওনার সাথে গল্প করবে।’
মারিয়া বিদ্বিষ্ট হয়ে বিড়বিড় করল ‘ মানুষ আর পেলোনা।’
মুখে বলল ‘জবা আন্টিত ঘরেই, ওনার সাথে গল্প করব না হয়।’
‘ আচ্ছা,আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব। যাই এখন তৈরি হই?’
‘ যাও। ‘

পিউ সত্যিই সাজল। সাদা চুরিদার পরল। কপালে টিপ দিল, ঠোঁটে মাখল একটু লিপস্টিক। চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে গুছিয়ে আটকাল। সবশেষে পার্স ব্যাগ হাতে নিয়ে হেলেদুলে বের হলো।
বসার ঘরে আসতেই সাদিফ সামনে পরে। টেলিভিশনে বিপিএলের হাইলাইটস দেখছে সে। ওকে দেখতেই ডেকে উঠল,
‘ কোথায় যাচ্ছিস?’
পিউ হাঁটা-পথে জবাব দেয় ‘ একটু বাইরে। আপুর বান্ধুবিরা আসবেতো, সেখানে।’
‘ আমি আসব?

পিউ দাঁড়িয়ে গেল।
‘ মেয়েদের মধ্যে আপনি গিয়ে কী করবেন?
সাদিফ থতমত খেয়ে বলল ‘ না এমনি।’
পিউয়ের আদল তমসায় ছেঁয়ে গেল। তার জানা মতে সাদিফ ভাইয়া পুষ্পকে পছন্দ করেন। এখনও নিশ্চয়ই সেজন্যে যেতে চাইলেন? ও নিজেওত মনে মনে তাকে দুলাভাই ধরে বসেছিল। মাঝখান থেকে আপুটাই ইকবাল ভাইয়ের প্রেমে পাগল! অবশ্য ইকবাল ভাই মানেই জহরত। সে মানুষটার শালী হওয়াও ভাগ্য!
পিউ মনে মনে বলল
‘ থাক ভাইয়া! আপনি ক*ষ্ট পাবেন না। আপনার জন্যে বিশ্বসুন্দরী খুঁজে আনব আমরা। ইকবাল ভাইয়ের মত দুলাভাইয়ের জন্যে না হয় আপনাকে একটুখানি সেক্রিফাইজই করলাম।’
তখন সাদিফ শুধাল,
‘একা যেতে পারবি?’
পিউয়ের ধ্যান ছোটে। বলে,
‘ হু? পারব।’
‘ আচ্ছা, সাবধানে যাস। তাড়াতাড়ি ফিরিস।’
‘ ঠিক আছে। ‘

পিউ চলে গেল। সাদিফের মন খা*রাপ হয়। বাসায় আছে, তাও আজকের এমন সুন্দর দিনে। বিকেলে পিউকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হবে ভেবেছিল। অথচ মেয়েটাই বাইরে যাচ্ছে। ফিরে এসে ক্লান্তিতে আর নড়তেও চাইবেনা।

সাদিফ রু*ক্ষ মেজাজে টিভি বন্ধ করে দেয়৷ ফিরে যায় কামড়ায়। পিউ ছাড়া নিজের বাড়িতেই তার মন টেকেনা। শূন্য শূন্য লাগে। কী ভয়া*বহ ব্যধি, হায় রে!

****
বাড়িতে আপাতত একটা গাড়ি অবশিষ্ট। তাছাড়া আছে সাদিফের বাইক। পিউ সব উপেক্ষা করে একবারে পায়ে হেঁটে গেট থেকে বের হলো। শেষ বার ফোন চেক করল,পুষ্প লোকেশন পাঠিয়েছে কি না দেখতে।
না পাঠায়নি। হয়ত পাঠাবে। জায়গা বেশি দূরে হবে না। ও যে একা একা অত কিছু চেনেনা তার বোন জানে। ধারে-কাছে হওয়াই স্বাভাবিক।
একটা রিক্সা ডাকুক বরং।
সে মেইন রোডের দিক এগোতে থাকল। সামনে থেকে বহু রিক্সা আসছে, যাচ্ছে। কিন্তু মানুষে ভর্তি। তার দু সেকেন্ড বাদেই সামনে থেকে খালি রিক্সা আসে। সে ডাকার আগেই চালক থেমে গেলেন। বললেন,
‘ যাবেন? ‘
পিউ মাথা দোলায়। তিনি বললেন
‘ ওডেন।’
পিউ উঠল,ঠিকানা বলার আগেই চালক টান বসালেন প্যাডেলে। সে বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
‘ কোথায় যাব শুনলেন না,ভাড়াও তো ঠিকঠাক হলোনা মামা।’
‘ যাইতে যাইতে কইয়েন। হুনুমনে। ভাড়াতো বাড়বে না,যা দেন সব সময় তাই থাকব। ‘
পিউ আর কথা বাড়াল না। ফোন বের করে পুষ্পকে কল দিতে চাইল। বলবে সে বের হয়েছে, ঠিকানা পাঠাতে। রিক্সা পাঁচ মিনিটের পথ ও অতিক্রম করেনি,আচমকা থেমে গেল। পিউ স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে বলল
‘ কী হলো? থামলে….’
বলতে বলতে অর্ধেক পথে আটকে গেল সে। ওপাশ থেকে ধূসরকে এগিয়ে আসতে দেখে কয়েক পল থমকে রইল। ব্যগ্রতায় পল্লব ঝাপ্টাল। এটা কি সত্যিই ধূসর ভাই? উনি না অফিসে? এই সময় এখানে?
তার চিন্তার ফাঁকে ধূসর কাছে আসে। পরপর উঠে পরে রিক্সায়। চালককে নরম স্বরে আদেশ করে,
‘ চলুন।’
রিক্সায় টান পরতেই পিউ পরে যেতে নেয়। ধূসর অতিদ্রুত হাটু চে*পে ধরল। হুশে এলো সে। চমকে তাকাল তার দিকে। এর মানে উনি সত্যিই পাশে বসে?
পিউয়ের চোখেমুখে লেপ্টে যায় অবিশ্বাস। হতবিহ্বলতা মাত্রা ছাড়ায়। প্রকান্ড অক্ষিযূগল নি*ক্ষেপ হয় ধূসরের শ্যামলা মুখে। তারপর দেখে নেয় তার হাত,যা শক্ত*পোক্ত বাঁধনে ধরে রাখা তার উরুদ্বয়।
পিউ হা করে তাকিয়ে রইল। মস্তিস্কটা আবার শূন্য। সেখানে কিচ্ছু ঢুকছে না। ধূসর ভাই স্বয়ং এক গোলকধাঁধা। যার ভেতরটা ভরপুর সকল অমী*মাংসিত রহস্যে। এই রহস্য ভেদ করার সাধ্য ওর নেই।
ধূসর বরাবরের ন্যায় উদ্বেগহীন ,ভ্রুক্ষেপমুক্ত। পাশে বসা কিশোরির মাথা ব্য*থার কারণ হয়েও তার রা নেই,শব্দ নেই। সে নিরুৎসাহিত। হঠাৎ কিছু সময় পর নিজেই ঘাড় ফেরাল। চক্ষু দিল পিউয়েতে।
এই যে মেয়েটার বোকা বোকা চাউনী,এই যে জিজ্ঞাসু চোখমুখ, এগুলো তাকে ভালো থাকতে দেয় না। এই স্নিগ্ধ মুখস্রী, হিং*সে করে তার শান্তির নিদ্রাকে।
ধূসর বিস্মিত পিউয়ের চুল থেকে অচিরাৎ পাঞ্চ ক্লিপ খুলে দেয়। সব ঝাপটে পরে পিঠে। হাওয়ার বে*গে উড়ে আসে মুখমন্ডলে। পিউয়ের হা বৃহৎ হয় আরো। হতচেতন,বিমুঢ় সে। কণ্ঠনালি বন্ধ। চোখের চারদিক ঘিরে থাকা কেশরাশি ধূসর সরিয়ে দিল। পরপর গেঁথে দেয় কানের পশ্চাতে। সেই আগের মত দু-আঙুল দিয়ে বন্ধ করে দিলো, পিউয়ের ফাঁকা অধরদ্বয়। বলল,
‘ মশা ঢুকবে।’

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।