এক সমুদ্র প্রেম

সাদিফ, ধূসরের চেয়ে তিন বছরের ছোট। আর পুষ্প তার ছোট, পাঁচ বছরের। মধ্যকার গ্যাপটা ধূসরের অতিকায়,স্বভাবে সে নিরেট, এত সব কারণে পুষ্প তার সাথে মিশেছেও কম। কথাটা সে মিশেছে বললে ভুল হবে,তার বারো বছর বয়স থেকেই ধূসর বাড়িতে থাকেনি। বোধশক্তি হবার পর কাছে পেয়েছে সাদিফকেই। ধূসর দেশে ফিরতেই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হলো। বাপ-চাচাদের সাথে চলল তার ঠান্ডা, বরফ যু*দ্ধ। বাড়িতে থাকতো কম,আসতো কম। এইসবের মাঝে পিউ-পুষ্পর মনে নিজের জন্যে জায়গা করল প্রবল আ*শঙ্কার।
পিউ লক্ষ্য-কোটি ধম*ক খেলেও সে খেয়েছে হাতে গোনা। যা না ধরলেও চলে। কিন্তু ধূসরের গা ঝাড়া ধরনের চলাফেরা,বাবা- চাচার মুখের ওপর জবাব দেয়া, তার বিরাট হস্তের যোগাযোগ ব্যবস্থা, এসব দেখে সে নিজেই ভ*য়ে সিটিয়ে থাকতো। জড়োতা আর সঙ্কোচে ধারে-কাছে ঘিষতোনা।
তাদের মধ্যে আজ অবধি নিজেদের নিয়ে কথা হয়নি। যা কথা,যত কথা সব পিউ সম্পর্কে,ওকে নিয়ে।

অন্যদিকে সাদিফের সঙ্গ ছিল ঠিক তার বিপরীত । দুজনের মেলবন্ধন চমৎকার । এই কথা বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই মেনে নেবেন। ওদের মধ্যকার দারূন সম্পর্কে প্রভাবিত হয়েই তো জবা বেগম এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তেমনই সাদিফের প্রতি পুষ্পর ভরসা ছিল। আস্থা ছিল,ছিল বিশ্বাস। তার এমন সংকীর্ণ সময় সবার প্রথমে সে পাশে দাঁড়াবে এমনই ছিল ধারণা। সেজন্যেই সাহস করে মনের কথা সবার আগে তাকে জানিয়েছে। অথচ ফিরল শূন্য হাতে, রিক্ত মস্তকে। এইভাবে সাদিফ ভাই আশাহত করবেন সে কল্পনাও করেনি। এতটা স্বার্থপর তিনি হতে পারলেন? এখানে অন্য কেউ হলেওতো,সাহায্য করতেন। যদি কেউ অবগত হয়,সে যাকে বিয়ে করবে তার মনের রাজ্যে অন্য কারো প্রভুত্ব চলছে,তারপরেও সে মানুষ কী করে নির্লিপ্ত থাকে? সাদিফের প্রতি অভিমান, ক্ষো*ভে তার ভেতরটা বির্বজিত হয়। নিদারূন ঘৃনায় শিরশির করে শরীর।
ছুটে এসে ঘরের দোর চাপায় সে। অদ্ভূত,উৎকট শব্দের উদ্ভব হয় তাতে। পুষ্প দৌড়ে গিয়ে, হুমড়ি খেয়ে বিছানার গায়ে লুটিয়ে পরল। হাউমাউ করে কাঁদল। ভাগ্য এরকম কেন? সে চেয়েও কেন কিছু করতে পারছে না? কার কাছে যাবে,কার কাছে সাহায্য চাইবে? মাথাটা এত এলোমেলো লাগছে কেন?

তার মন বলছে একবার ধূসর ভাইয়ের দ্বারপ্রান্তে যেতে। মানুষটা যে কোনও অংশেই সাদিফ ভাইয়ের মত নন,সে জানে। কিন্তু, ওই যে ভ*য়! পারছেনা। সঙ্কোচ,ত্রাস,ঘিরে ব*ন্দী করেছে তাকে। আ*তঙ্ক দাপ*ট চালাচ্ছে বক্ষে। পুষ্প নিজেকেই দোষারো*প করছে আজ,কেন সে ভাইয়ের বন্ধুকে ভালোবাসতে গেল? কেন জড়াল সম্পর্কে?
ঠিক সেই সময় ফোন বাজল। পুষ্পর কা*ন্না কমছেনা। লাগাতার রিংটোনের শব্দ একটা সময় বাধ্য করল মুখ তুলতে। নিরন্তর আওয়াজে সে চোখ তোলে। বালিশের পাশে রাখা ফোনের স্ক্রিনে চোখ বোলায়। অচেনা,তবে পরিচিত সেই নম্বরের ডিজিট গুলো তার বক্ষে উত্থাল-পাতাল শুরু করে নিমিষে।
পুষ্প চোখ মুছে উঠে বসল। রিসিভ করে বলল ‘হ্যালো।’
ওপাশের মানুষটি উত্তে*জিত। ধৈর্যহীনতায় খেয়ালও করল না প্রেয়সীর ভগ্ন স্বর। উলটে রে*গে-মেগে বলল,
‘ কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কতক্ষণ ধরে ফোন করছি আন্দাজ আছে তোমার? কটা বাজে দেখেছো পুষ্প? ব্যস্ত থাকলে আমাকে একবার জানাবে না? আশ্চর্য মেয়ে তো তুমি!’ ‘

পুষ্পর মন-মানসিকতা ভালো না। তার মধ্যে ইকবালের চোট*পাট মেজাজ বিগড়ে দেয়। রীতিমতো ব্রক্ষ্মতালু অবধি দাউ*দাউ করে জ্ব*লে উঠল। হিতাহিতজ্ঞান ভুলে বলল,
‘ সমস্যা কী তোমার ইকবাল? যাস্ট কয়েকবার ফোন করে মাথা কিনে নিয়েছো আমার? এভাবে কথা শোনাচ্ছো! আমিত বলেছি,আমি নিজে কল না দিলে রাতে আমাকে কল দেবেনা। তাও নির্লজ্জের মত একই কাজ করছো। উঠতে,বসতে,গি*লতে সবেতে তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হয়। আমার জীবন নিজের মত চালানোর স্বাধীনতা আমার আছে। তাহলে তুমি ডোমি*নেট করবে কেন? কে তুমি? ‘

ইকবাল থমকে গেল কথাগুলোয়। পুষ্পর মত নম্র মেয়ের মুখে এমন কিছু শোনাও কল্পনাতীত। বিহ্বল হয়ে বলল,
‘ আমি তোমাকে ডোমি*নেট করছি পুষ্প?’
পুষ্প মুখের ওপর বলে ফেলল,
‘ হ্যাঁ করছো। রীতিমতো ট*র্চার বলে এটাকে। তোমার জন্যে আমার লাইফটা হ্যে*ল হয়ে যাচ্ছে ইকবাল। প্লিজ,লিভ মি আলোন। অসহ্য!’
ইকবাল বিস্ময়াহ*ত, স্তব্ধ। অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য গুলোয় থিতিয়ে গেল হৃদয়। পুষ্প দুম করে লাইন কে*টেছে,অথচ সে কথা বলতে পারছে না। শব্দবাক্য খুঁইয়ে ওভাবে অনড় সেজে,একভাবে বসে রইল। নিজেকেই শুধাল,
‘ আমি সত্যিই পুষ্পকে ট*র্চার করছি?’

পুষ্প অনুতপ্ত। পরিতাপে ডু*বে মর*ছে এখন। ইচ্ছে করে বলেনি ওসব। জ্ঞানহীন হয়ে,ভুল করে রা*গ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সাদিফের ক্ষোভটাই ঝেড়ে ফেলেছে ইকবালের ওপর। আর বোঝার পর কা*ন্না বেড়েছে আরো। না জানি ইকবালটা কত ক*ষ্ট পেল! ক্ষমা চাওয়া দরকার। তার ভুলের বোঝা ও কেন বইবে? সে তড়িঘড়ি করে আবার ডায়াল করতে যায় ইকবালের নম্বরে।
এর আগে,আচমকা কাঁধে পেল উ*ষ্ণ, নরম হাতের স্পর্শ। সে চকিতে তাকাল। পিউকে দেখতেই স্ক্রিন বন্ধ করে ফোন রেখে দিলো পাশে। হন্তদন্ত ভাবে চোখ মুছে,হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ কখন এলি?’
পিউ মনোযোগ দিয়ে বোনের মুখস্রী দেখল। কয়েক ঘন্টায় কেঁ*দে কী বেহাল অবস্থা হয়েছে! গোলাপি গাল দুটো ফ্যাকাশে এখন।
এসব দেখে পিউয়ের বুকে ব্য*থা করে। খা*রাপ লাগে।
সে শান্ত গলায় বলল,
‘ ইচ্ছে করলেই অনেক কিছু লুকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু কোথাও না কোথাও তার চিহ্ন রয়ে যায়। এই মুহুর্তে তোর চোখের জলটা ঠিক সেরকমই। ‘

পুষ্প বোনের মুখের দিকে হা করে চেয়ে থাকল। কথাটা পিউয়ের ব্যক্তিত্বের সম্পূর্ন বিপরীত। তার চপল, চঞ্চল, বোনের এমন ভারি কথা তাকে বিস্মিত, বিভ্রান্ত করে।

পিউ জেনে-শুনেও শুধাল
‘ কাঁদছিলি কেন?’
পুষ্প দুদিকে মাথা নেড়ে মিথ্যে বলতে গেল। এর আগেই পিউ প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ তুই ইকবাল ভাইয়াকে ভালোবাসিস, তাইনা?’
পুষ্প চমকে যায়। ভূত দেখার মত বিকট চোখে তাকায়,
‘ ততুই… তুই কী করে জানলি? ‘
পিউ স্মিত হাসে,
‘ কেন? তুই না বললে বুঝি জানার উপায় নেই?আকাশে চাঁদ উঠলে কতক্ষণ লুকিয়ে রাখা যায় আপু?’

তার কণ্ঠে আদ্র অভিমান। হলদেটে মুখটাও অনুরা*গে কালো।
পুষ্প মাথা নামিয়ে নিলো। ছোট বোনের কাছে ভালোবেসে ধরা পরার পরিস্থিতি হয়ত সবচেয়ে বিব্রতকর।
আস্তে করে জবাব দিল,
‘ ভ*য় পাচ্ছিলাম। যদি বাবা বা ধূসর ভাইয়ার কানে যায়! তাই চেয়েও কাউকে বলতে পারিনি রে।’

বলতে বলতে তার চোখের টলমলে জল উপচে আসে। ক ফোঁটা গাল অবধি এসে থেমে যায়। পিউ তুলতুলে হাতে মুছিয়ে দিয়ে বলল,
‘ কাঁ*দলে কি সমাধান হবে? ভা*ঙতে পারবি বিয়েটা?’

পুষ্প ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,
‘ কী করলে পারব? তুই একটা কিছু উপায় বল না পিউ।আমি সাদিফ ভাইয়ার কাছেও গিয়েছিলাম জানিস?ওনাকে বলেছি। অথচ সব শোনার পর উনি জানিয়ে দিলেন কিছুই করতে পারবেন না।’

পিউ খুব বির*ক্ত হলো। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ সাদিফ ভাইয়ের কাছে কেন যাবি? উনি যে কিছু করবেন না সেতো জানা কথা।’
পুষ্প বুঝতে না পেরে বলল,
‘ কেন?’
‘ কেন আবার? ওনার তোকে পছন্দ,আর দ্বিতীয়ত উনি এ বাড়ির বাধ্য,ভদ্র সন্তান। কোনও দিন দেখেছিস? কারোর মুখের ওপর না বলেছে? ‘

তার প্রথম কথাটুকু পুষ্পর মাথায় তুখোড় ভাবে ঢুকল। প্রগাঢ় বিস্ময়ে মিলিয়ে গেল কপালের গুটিকয়েক ভাঁজ। সাদিফের ওকে পছন্দ? কই, সেত কোনও দিন বোঝেনি। হাবভাব,তাকানোর ধরন দিয়েওতো নারীগুনে বোঝার কথা। ভ্রান্ত হয়ে বলল,
‘ তোর কোথাও ভুল হচ্ছে,সাদিফ ভাই আমাকে কেন পছন্দ করবেন?’
‘ কেন করবেন না? তোর মতো সুন্দরী মেয়েকে পছন্দ করাতো অস্বাভাবিক নয়। ‘

‘ কিন্তু… ‘
পিউ মৃদূ চেঁ*তে বলল,
‘ আজব! তোকে পছন্দ করেন না তো কী আমাকে করেন?’
সে ভ্রুঁ বাঁকায়,
‘ আমি তা কখন বললাম?’
‘ তাহলে আমি যা বলছি তাই শোন। উনি যে তোকে পছন্দ করেন, এটা আমি আরো আগে থেকে জানি।’

‘ করলে করুক। আমার যায় আসেনা। ইকবাল ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করতে পারব না,ম*রেই যাব।’
পিউ প্রতিবাদ করল,
‘ ছি! এসব বলে না। ‘
পুষ্প আবার কেঁ*দে ফেলল। শরীর ভে*ঙেচূড়ে এলো কান্নায়।
পিউ বিমর্ষ নেত্রে চেয়ে থাকে। মনঃদ্বিধায় ভোগে। ধূসর ভাইতো কিছু বলতে মানা করেছেন। কিন্তু সে পারছেনা হাত গুঁটিয়ে বসে থাকতে। ইতোমধ্যে হাজার বার বোনের ঘরে উঁকিঝুঁকি মে*রেছে। এতটা সময়ে পুষ্পর কা*ন্নাকা*টি স্বচক্ষে দেখেছে। শেষ মেষ নিজেকে রুখতে বিফল হয়েই তো হাজির হলো এখানে। আর এত কিছুর পর তার পক্ষে চুপচাপ থাকাও অসম্ভব।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখ খুলল,
‘ ধূসর ভাইকে বলে দ্যাখ।’

পুষ্পর কা*ন্না বিদ্যুৎ বেগে থেমে যায়।
হতবাক হয়ে বলে,
‘ কী বলছিস?’
পিউ মাথা দোলাল,
‘ ঠিকই বলছি। এই সময় তোকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে তবে উনিই পারবেন।’
পুষ্প ঘন ঘন মাথা নেড়ে আওড়াল,
‘ না না। উনি জানলে আমায় মে*রেই ফেলবেন। ইকবাল বলেছিল ভাইয়াকে আস্তে-ধীরে বোঝাবে। হঠাৎ আমার মুখে এসব শুনলে উনি কী না কী ভাববেন। ওনাদের বন্ধুত্বটাও নষ্ট হবে। আমি এসব কী করে হতে দেই পিউ?’

বোনের আকুল,ব্যগ্র, চিন্তিত চোখমুখ দেখেও পিউয়ের হাসি পেলো। বোকা মেয়েটা তো জানেনা,ধূসর ভাই আগেই সব জেনে বসে আছেন।

সে প্রযন্তে হাসি চে*পে রাখল। চেহারায় রা*গী রা*গী ভাব ফুটিয়ে বলল,
‘ এত কিছু প্রেম করার বেলায় মনে ছিল না?’
পুষ্প নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ বড়দের মত কথা বলবি না।’
পিউ ফুঁ*সে উঠল,
‘ তাহলে কী করব? কেঁ*দেকে*টে এইটুকু সময়ে কী অবস্থা করেছিস চেহারার? ইকবাল ভাইয়াকেও যা নয় তাই শোনালি। দোষ কি তোর না ওনার? নিজে কিছু সামলাতে পারিস না। ভালোর জন্য বলছি,যদি জীবনে ইকবাল ভাইকে পেতে চাস,তবে ধূসর ভাইকে গিয়ে বল। এছাড়া আর উপায় নেই। আর যদি না পারিস তাহলে বসে থাক। একটু পর খেতে ডাকবে,পেটপুড়ে খেয়ে এসে আবার কাঁ*দিস। বাকী জীবনে কাঁ*দার কথাতো বাদই রইল। আমি আর এসবে নেই। যা মন চায় কর গে। যত্তসব!’

হড়বড় করে ভেতরের রা*গ, ক্ষো*ভ উগলে দিলো পিউ। পেটটা ভীষণ ক্রোধে ফাঁটছে। ভালোবাসার আগে এসব মাথায় থাকেনা এদের? বিয়ের কথা উঠলেই হাজারটা চিন্তা দেখা দেয়। কই, সেতো এরকম নয়। ধূসর ভাইকে ভালোবেসেছে যখন,পৃথিবীর সাথে লড়া*ই করতেও সে প্রস্তুত। তবুও ওই মানুষকেই চাই ওর। জীবন দিয়ে হলেও চাই। বোনের ওপর রা*গে গজগজ করে বেরিয়ে গেল সে। পেছনে রেখে গেল মর্মা*হত পুষ্পকে। মেয়েটা নির্বোধ,নিহ*ত চোখে বোনের যাওয়া দেখল। বিভ্রমে মস্তিষ্ক শুষ্ক। কী করবে, জানেনা। প্রচন্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
ধূসর ভাইয়ের কাছে যাবে? অথচ সাহসে কূলোচ্ছে না।

কিন্তু পিউয়ের কথাগুলো ক্রমশ মাথায় ঘুরছে। মনে হচ্ছে সেই ঠিক। এই বাড়িতে বো*ম ব্লা*স্ট করার মত দুঃ*সাহস ওই একজনেরই আছে । নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাকে নড়ানোর সাধ্যি এ বাড়ির কারোর নেই। সিকদার বাড়ি যার ভ*য়ে তটস্থ থাকে সেই আমজাদ সিকদার অবধি বহুবার সারেন্ডার করেছেন তার সিদ্ধান্তের নিকট। সে মানুষটি ধূসর ভাই। একবার ওনাকে বলেই দেখা যাক না! ভাগ্য সহায় হলেও তো হতে পারে।

পুষ্প দোনামনা করে উঠে দাঁড়াল। বিচলিত ভঙিতে দরজা অবধি গিয়ে আবার ফিরে এলো। ওড়নার কোনাটা আঙুলে প্যাচাতে প্যাচাতে দাঁড়িয়ে রইল। পিউয়ের বলে যাওয়া ,
‘ বাকী জীবনতো কাঁদার জন্য বাদই রইল।’
সে আঁ*তকে উঠল কথাটা মনে পড়তেই। এক বিন্দু মিথ্যে নেই এতে। ইকবাল কে না পেলে ম*রার আগ অবধি সে কাঁদ*বে। হাহা*কার করবে। তার থেকে ধূসর ভাইয়ের মুখোমুখি হওয়াও ঢেড় ভালো। পুষ্প দোয়া ইউনিস পড়ে বুকে ফুঁ দিলো। বুক ফুলিয়ে,দৃঢ় চিবুকে বাইরে গেল। উদ্দেশ্য, ধূসর ভাইয়ের কক্ষ। যা হবার হবে। হয় এসপাড় নয় ওসপাড়।

ঠিক ধূসরের রুমের সামনে এসে ব্রেক কষল সে। পুনরায় বিড়বিড় করে দোয়া পড়ল। সহস্র ঝাড়ফুঁকে ভরিয়ে ফেলল বুকটা। এই ছোট্ট জীবনে ধূসরের শ*ক্ত হাতের চ*ড় খাওয়ার দূর্ভাগ্য তার হয়নি। আজ হয়ত সেই রেকর্ডটাও ভে*ঙে যাবে। হয়ত কি? ভা*ঙবেই ভা*ঙবে। কথাটা শোনামাত্র ধূসর ভাই এমন ভাবে থা*বড়া দেবেন সে উলটে পরবে। জ্ঞান ও হারিয়ে ফেলতে পারে কয়েকবার।
পুষ্প ছাদের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করল,
‘ ইয়া মা’বূদ! এবারের মত বাঁচিয়ে নাও।’

ধূসরের ঘরের দরজা চাপানো। পুষ্প আস্তে করে ঠেলল। মাথাটা ঢুকিয়ে উঁকি দিল। ধূসর উল্টোঘুরে কথা বলছে ফোনে। তার মেজাজ ভালো না। রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপারে মাথা গ*রম। ওপাশের ব্যক্তিটি অনর্গল কথা বলছে। ধূসর এক ফাঁকে ধম*ক দিল,
‘ এত বেশি বুঝতে কে চলেছে তোকে? রাবিশ! আমাকে জিজ্ঞেস না করে কোনও কাজে হাত দিবিনা। ‘
পুষ্পর সঞ্চিত সাহস ওমনি ফুস করে উড়ে গেল। কলিজা ছলাৎ করে ঝাঁ*প দিলো কূয়োয়। তড়িৎ বেগে মাথাটা বাইরে বের করে আনল আবার।

ধূসরের একেকটা উঁচু কণ্ঠে বুক ধড়াস ধড়াস করছে তার। এদিক সেদিক,দ্বিগবিদিক লাফাচ্ছে। অনবরত চলছে কাঁ*পা-কাঁ*পি। না বাবা,এখন গিয়ে লাভ নেই। ধূসর ভাইয়া এমনিই রে*গে আছেন। পরে আসবে না হয়। সে কেবল পা বাড়াল প্রস্থান নিতে,সেই মুহুর্ত গম্ভীর ডাক ভেসে এলো,
‘ পুষ্প?’
তার চোয়াল ঝুলে যায়। কদম স্থিতি পায় সেখানে। অক্ষিযূগল প্রকট হয়। ধূসর ভাই দেখে ফেলেছেন?
ঘনঘন জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনও মতে উত্তর দেয়,
‘ জজি।’
‘ ভেতরে আয়।’
পুষ্পর গলা শুকিয়ে গেল।
ঢোক গি*লতে গি*লতে মৃদূ হস্তে দরজা ঠেলল। ভেতরে ঢুকল বিনম্র পায়ে।
ধূসর কান থেকে ফোন নামায়। লাইন কে*টে টেবিলের ওপর রেখে শুধায়,
‘ কিছু বলবি?’
সে জোরে জোরে দুপাশে মাথা নাড়ল। বোঝাল ‘ না’। ধূসর দৃষ্টি চোখা করে বলল,
‘ তাহলে ওখানে কী করছিলি?’

‘ এমনি, দা দাঁড়িয়ে ছছিলাম।’
ধূসর মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
‘ এমনি দাঁড়ানোর জন্য আমার রুমটাই পছন্দ হলো?’
পুষ্প জবাব দিতে পারল না। তার সংকুচিত মুখচোখ ধূসর তীক্ষ্ণ নেত্রে দেখল। ঘুরে পানির গ্লাস তুলে মুখের সামনে ধরতে ধরতে বলল,
‘কিছু বলার থাকলে বল।’

পুষ্পর ঢোক গে*লার মাত্রা বাড়ছে। হাঁটু দুটো ভূমিক*ম্পের মতো কাঁপ*ছে। যেন এক্ষুনি ধ্ব*সে পরবে দেয়ালের ন্যায়। কপাল,নাক ঘামে একাকার। শ্বাস প্রঃস্বাস চলছে দ্রুত।

কিন্তু না, আজকে বলতেই হবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি। সে নিজেও এখন বিশ্বাস করে,এই সমস্যার সমাধান একমাত্র ধূসর ভাইয়াই।
পুষ্প চোখমুখ সুদৃঢ় করল।
সাদিফের সহিত বিয়ে,ইকবালের বিবর্ন মুখবিবর,তাদের বিচ্ছেদ এসব মাথায় আসতেই তার বক্ষস্পন্দন থমকায়। দৈব দুঃসাহস ভর করে সেখানে। মন,মস্তিষ্ক সজাগ, সচেতন হয়। নিজেই নিজেকে সাহস যোগায়,
‘ আজ বলতেই হবে পুষ্প। মা*র খেলে খাবি,ম*রে তো যাবিনা।’

ধূসর তাগাদা দিল ‘ কী? বলবি না দাঁড়িয়ে থাকতে এসছিস?’
পুষ্প তাকাল। তাড়াহুড়োতে মেরুদণ্ড সোজা করল। ফটাফট মুখ খুলল,
‘ আমি বিয়ে করব না ভাইয়া।’
ধূসর ভ্রুঁ উঁচায়,
‘ কেন? বিয়েতে কী সমস্যা? ‘
পুষ্প নিশ্চুপ। সে নিজেই বলল,
” সাদিফ তো ভালো ছেলে। তাছাড়া বিয়ের পর তোকে অন্যের বাড়িতেও যেতে হচ্ছেনা। ”

পুষ্প মাথা নামিয়ে নিলো। ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ আমি এসব কিছু চাইনা।’

ধূসরের বিলম্বহীন প্রশ্ন ‘ তাহলে কী চাস?’
পুষ্প নিরুত্তর। ভেতরে দ্বিধাদ্ব*ন্দের পাহাড়টা তখনও দৃশ্যমান। ধূসরের সাথে সামান্য আলাপ যেখানে হয়নি কখনও, সেখানে এসব নিয়ে আলোচনা করা ক*ঠিন। ভ*য়ের পাশাপাশি গাঢ় অস্বস্তিতে অন্তঃপুট ডুবু*ডুবু।
সে প্রয়াস চালায় দ্রুত বলার। কিন্তু ধূসরের সামনে জ্বিভ থেকে কথাটা বের করাই দুঃসাধ্য যেন।
বহু ক*ষ্টে, টেনেহিঁ*চড়ে শব্দ আনল ভেতর থেকে। জানাল,
‘ আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি, তাকে চাই।’
বলতে বলতে গলা ভে*ঙে এলো তার। বুজে গেল কণ্ঠ।
শোনা গেল ধূসরের ভারী স্বর
‘ কাকে?’
পুষ্পর বুক কাঁ*পুনি বৃদ্ধি পায়। সীমানা ছাড়ায় আকাশ-বাতাস ।
ভীষণ আত*ঙ্কে, কাঁ*পতে কাঁপ*তে খিঁ*চে নেয় চোখ। গড়গড়ে ভঙিতে জানায়,
‘ ইকবাল কে।’
‘ কী?’
ধূসরের চমকিত, চকিত আওয়াজ। পুষ্প ভ*য় পেলো, গুটিয়ে গেল। তাকিয়ে মুখোমুখি হলো এক জোড়া নিরেট,শীতল চাউনীর। গ্রা*সে অর্ধডু*বন্ত অবস্থা তখন। শ্বাসরুদ্ধ*কর পরিস্থিতি। অবিন্যস্ত জ্ঞানশক্তিতে অচিরাৎ ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলল সে। কে*দেকে*টে অস্থির,অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ ওর কোনও দোষ নেই ভাইয়া। সব দোষ আমার। ওকে তুমি কিছু বোলোনা।’

ধূসর চোখমুখের পরিবর্তন হলো না। অনমনীয়তা পরতে পরতে। ভাইয়ের কাছে ছোট বোন ভালোবাসার কথা জানাতে এলে যেমন থাকা দরকার, ঠিক তাই।
অথচ দরজার আড়াল থেকে নাকমুখ কোঁচকায় পিউ। ধূসরের প্রতি কটমট করে ভাবে,
‘ এই লোকটা আস্ত একটা বদ! সব জেনেশুনেও আমার বোনটাকে কাঁ*দাচ্ছে কেন?’

ধূসর গুমোট,গুরুভার কণ্ঠে বলল,
‘ তোরা আমার আড়ালে এসব করছিস তাহলে? কতদিন ধরে চলছে?’
পুষ্পর কান্না বাড়ল। কম্পিত স্বরে জানাল,
‘ দু বছর। ‘
‘ এখন আমার কাছে কেন এসছিস? বি*পদে পড়ে তাইত? আজকের এই পরিস্থিতি না এলে আজও বলতিনা নিশ্চয়ই। ‘

পুষ্পর হৃদয়পুরে আমাবস্যা নামল। অপ*রাধবোধ হানা দিলো ভেতরে। মুখমণ্ডল ছেঁয়ে যায় কৃষ্ণবর্ন কাদম্বীনিতে। হতা*শায় কালো মুখখানা কালবৈশাখির ন্যায় আঁধারে মেলালো। কথাটুকুন ছু*ড়ির ন্যায় বুকে বিঁ*ধল। ধূসর যেন বলেনি,প্রকাশ করেছে বোন আর বন্ধুর প্রতি তার আকাশসম অভিমান।
পুষ্প ছুটে এসে ধূসরের পায়ের কাছে বসে পরল। সে চমকে,ভড়কে পিছিয়ে গিয়ে বলল,
‘ কী করছিস?’

পুষ্প থামল না। হুহু করে কেঁ*দে বলল,
‘ আমাকে ক্ষমা করে দিন ভাইয়া। আমি জেনেবুঝে এরকম করিনি। আপনার ভ*য়েই সবটা লুকিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন।’

পিউয়ের কা*ন্না পেয়ে গেল বোনের অবস্থা দেখে। চোখে টলটলে জল। ইশ! ভালোবাসলে মানুষ কত কী করে?
সে উদ্বীগ্ন চোখে ধূসরের দিক তাকিয়ে থাকে। আপুটা কীভাবে কাঁ*দছে! উনি কেন বলছেন না কিছু?

এতটা সময় চোখমুখ পাথরের ন্যায় শ*ক্ত রাখার চেষ্টায় ছিল ধূসর। পুষ্পর কা*ন্না দেখে নরম হলো পেশী।
দুপাশে মাথা নেড়ে ফোস করে শ্বাস ফেলল। পুষ্পর দুবাহু ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘ সামান্য কারণে এত কাঁ*দার কী আছে? আমি কিছু বলেছি তোকে?’

পুষ্পর হেঁচকি উঠেছে। ধূসর ফিনফিনে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ চোখ মোছ।’
পুষ্প নিলো। কিন্তু মুঠোয় মুচ*ড়ে ধরে রাখল। তার ভেতর সহ মাথাটাও নুইয়ে আছে কুন্ঠায়,অভিশঙ্কায়।

ধূসর বলল,
‘ বিয়ে করবিনা,তখন বললেই পারতি। ভালোবাসলে বুকে সাহস রাখতে হয়। ভীতুরা কখনও ভালোবাসতে পারেনা।’

পুষ্প কিছু বলতে চায়। হেঁচকির দমকে কথা ফোটেনা। নাকের জল,চোখের জলে চেহারাটা একশেষ। পিউয়ের মায়া হলো খুব।
ধূসর গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলো। সে হাতে নিতেই অনতিবিলম্বে ফাঁকা হলো গ্লাস। নিজেকে সামলাতে দেরী হয়। ধূসর তাড়া দেয়না,স্থির থাকে। আত্মস্থ হতে সময় দেয় ওকে।
পুষ্প ঠিকঠাক হয়ে,অনুতাপ নিয়ে বলল,

‘ আমি বুঝতে পারিনি ভাইয়া। ভুল হয়ে গিয়েছে।’
‘ এখন কী চাইছিস?’

‘ সবাইকে একটু বোঝাবেন?’
তার ভীত,সংশ*য়ী আবেদন। সাদিফের মত ধূসর ভাইও না বলবেন কী? তবে যে ওর একূল ওকূল দু-কূলই শেষ। তার বিভ্রমের মাঝে জবাব এলো,
‘ বোঝাব। ‘

পিউয়ের ঠোঁট দুদিকে সরে গেল তৎক্ষনাৎ। রীতিমতো বড় বড় চোখ ছোট হয়ে এলো হাসিতে। পুষ্প অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
‘ সত্যি বোঝাবেন ভাইয়া?’

ধূসর এ পর্যায়ে হাসল।
বলল ‘ হু।’
পুষ্পর চাউনীতে অগাধ শ্রদ্ধা লেপ্টে গেল। পরমুহূর্তে কা*ন্না পেল। অধরযূগল ভে*ঙে এলো তাতে। এতগুলো দিন অযাচিত ভ*য়ে গুটিয়ে ছিল সে। ভাইয়া কত ভালো মানুষ! একটুতেই বুঝে ফেললেন। আর সে কী না!
তার র*ক্তাভ আঁদল দেখেই
ধূসর হুশিয়ারি দিলো,
‘ আমি না যেন এ নিয়ে তোকে আর কাঁ*দতে না দেখি। ‘

পুষ্প মাথা কাত করল। চোখে জল এলেও সামলে নিলো তা। এতটা সময়ের পান্ডুর মুখমন্ডলে এখন চকচকে ভাব স্পষ্ট। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার একটুখানি আশা,পথ্যের ন্যায় একজন অসুস্থ মানুষের রো*গ সাড়ানোর ক্ষমতা রাখে হয়ত।

ধূসর একটু ভেবে বলল,
‘ ইকবাল কে বলবিনা আমি জানি। আর আমি না বলা অবধি এই বিষয়ে ওর সাথে কোনও আলোচনা করবি না।’
পুষ্প সামান্যতম দ্বিরুক্তি করল না। বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে বলল,
‘ ঠিক আছে ভাইয়া। ‘
‘ যা। ‘
পুষ্প উলটো ঘুরতেই পিউ সরে গেল। সে আবার ফিরে তাকায়। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে বলে,
‘ সব ঠিকঠাক হবে তো?’

ধূসর উত্তর দিলো না। অথচ তার চাউনী দেখেই পুষ্প নিজে নিজেই বলল,
‘ না না হবে। জানি আমি, হবে।’

এরপর খুব দ্রুত ঘর ছাড়ল সে।
ধূসর বিড়বিড় করে বলল ‘ কেউ কারো থেকে পিছিয়ে নেই। দুই বোনই সমান সমান গাধা।

পিউ দেয়ালের সাথে লেপ্টে থাকায় পুষ্প খেয়াল করেনি। সে আনন্দ সমেত ঘরে ঢুকে যায়। পিউ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বোনের খুশিতে তার মুখমণ্ডলও উজ্জ্বল। মনে মনে স্বস্তি পেল ধূসরের কথায়। ওনার ওপর অগাধ বিশ্বাস যে! পিউ বুক ভরে শ্বাস নেয়। চোরাপথে আরেকবার উঁকি দেয় ধূসরের কামড়ায়। বুঝতে চায় তার পরবর্তী পদক্ষেপ। মানুষটার অভিব্যক্তি। কিন্তু দেখা যাচ্ছেনা কেন? কোথায় তিনি?
সে আরেকটু এগোয়। দরজায় দুহাতের ভর দিয়ে পুষ্পর মত মাথাটা ঢোকাতে যায়। অকষাৎ দরজা টান মে*রে খুলে ফেলল ধূসর। পিউ হো*চট খেল। ব্যর্থ হলো নিজেকে সামলাতে। রীতিমতো হুম*ড়ি খেয়ে পরে গেল মেঝেতে। হকচকাল,হতভম্ব হলো। ধূসরের সটান দাঁড়ানো দুটো পা এসে ভিড়েছে তার সম্মুখে। পিউ কনুইয়ে ব্য*থা পেয়েছে। হাত দিয়ে আহ*ত স্থান ডলতে ডলতে পা থেকে চোখ নিয়ে ধূসরের মুখের ওপর ফেলল।
তার শৈলপ্রান্ত বেঁকে আছে। তামাটে চিবুক অভঙ্গুর। সে তাকাতেই পুরূ ভ্রুঁ নাঁচিয়, নিম্নভার কণ্ঠে বলল,
‘ অন্যের ঘরে আড়িপাতার জন্য তোকে ঠিক কী শা*স্তি দেয়া উচিত ?’

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।