লাজুকপাতা | পর্ব – ৩

6 Min Read

নাবিদ দের বাড়িটা পুরোনো আমলের। তিনতলা বাড়ি। একতলা আর তিন তলাটা ভাড়া দেয়া। দোতলায় নাবিদ রা থাকে। আমার শ্বশুর আরামপ্রিয় লোক। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়ি আর একখানা দোকান ছাড়া নিজে কিছুই করে উঠতে পারেন নি। সেই আরামপ্রিয় স্বভাব পেয়েছেন আমার ভাসুর জামিল
বাড়িতে আসার দুদিনের মধ্যেই টের পেলাম আমার শাশুড়ী রাগী মানুষ। তার মেজাজ সম্ভবত সবসময় ই খারাপ থাকে। তার কাছ থেকে তার বড় ছেলে আর বউয়ের গল্প শুনলাম।
জামিল ভাই মানে আমার ভাসুর বিয়ে করেছিলেন ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে। তখন তেমন কিছু করতেন না। অথচ ভাবী বেশ অবস্থাপন্ন ফ্যামিলির মেয়ে। বিয়ের পর পর ভাবী জমজ সন্তানের জন্ম দিলেন। দুটো ফুটফুটে দুষ্ট মেয়ে। ওদের নাম টাপুর টুপুর। আর ভাবীর নাম টুম্পা। টাপুর, টুপুরের বয়স এখন পাঁচ। জামিল ভাই এখনো কিছু করেন না। আজ করব, কাল করব বলে পাঁচ টা বছর কাটিয়ে দিলেন। উল্টো ভাবীর টিউশনির টাকা নিয়ে বাইরে খরচ করে বেড়ান।
মাস দুয়েক আগে চূড়ান্তরকম ঝগড়া করে ভাবী বাড়ি ছাড়েন। আমার বিয়ের আগের দিন জামিল ভাইকে তালাকনামা পাঠিয়েছেন। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন যে টাপুর টুপুর এর দায়িত্ব সে নিবে না।
***
এই বাড়িতে দুটো সপ্তাহ কাটিয়ে ফেললাম। নাবিদ একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যায়, ফিরে সন্ধ্যেবেলা। সন্ধ্যেবেলা যখন ফিরে তখন তার মেজাজ থাকে বিক্ষিপ্ত। আমাকে আম্মা শিখিয়ে দিয়েছেন নাবিদ এলে যেন শরবত, তোয়ালে এগুলো এগিয়ে দেই। প্রথম দিন শরবতের গ্লাস দেখে নাবিদ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“এই শীতে কেউ শরবত খায়?”
আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। পরের দিন চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম। দারুচিনি, এলাচি দিয়ে চা। সেটা দেখে আগের দিনের মতো কপাল কুঁচকে বলল,
“এখন চা খেলে ভাত কখন খাব?”
আমি গতদিনের তুলনায় আরও দ্বিগুণ বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। নাবিদও কেমন যেন অন্যচোখে তাকিয়ে থাকে কিছুসময়।
**
এই বাড়িতে নাবিদ আর জামিল ভাই ছাড়া আর একটা ফোন আমার আম্মার কাছে থাকে। সেই ফোনে মা আর পরী আপা একদিন পর পর ফোন করেন। আম্মা সামনেই থাকেন বেশীরভাগ সময়। মা ফোন করেন, কেমন আছস! কি দিয়া ভাত খাইছ! জামাইর সাথে সব ঠিক আছে। মায়ের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি লজ্জায় পড়ে যাই। আম্মা বিরক্ত হন সম্ভবত। এখনো ওনার রাগ কিংবা মেজাজ আমার সঙ্গে দেখান নি। তবে অন্যদের সঙ্গে দেখিয়েছেন। বিশেষ করে মনির সঙ্গে।
মনি মুক্তা দুজনের আমি আলাদা নাম দিয়েছি। মনির নাম কুটিলা আর মুক্তার নাম জটিলা। মুক্তার নাম জটিলা দেবার কারণ হলো ওরও প্রায় সময়ই নাবিদের মতো কপাল কুঁচকানো থাকে। সামনেই এসএসসি পরীক্ষা। দিন রাত পড়াশোনা করে। মাঝরাতেও গুনগুন করে পড়ার শব্দ পাই আমার ঘর থেকে।
আর মনির নাম কুটিলা দেয়ার কারণ হলো ওর স্বভাব। কোনো এক বিচিত্র কারণে ও আমাকে পছন্দ করছে না। ওদের সঙ্গে ভাব করতে গিয়েও আমি বিশেষ পাত্তা পাই নি।
এই বাড়িতে যাদের সঙ্গে আমার গলায় গলায় ভাব হয়েছে তারা হলো টাপুর টুপুর। কী যে দুষ্ট বাচ্চা দুটো। আমার শাশুড়ী সামলাতে গিয়ে অস্থির হয়ে যায়। ওদের সঙ্গে আমার ভালোই ভাব হয়েছে। ওরা আমার ঘরে এসে হুটোপুটি করেও আনন্দ পায়, আমারও তেমন খারাপ লাগে না।
***
আমার ঘর টা ছোট। তবে ছোট্ট একটু বারান্দা আছে। ঘরে মাঝারি সাইজের দুজনের ঘুমানোর মতো খাট, আলমারি আর একটা টেবিল। টেবিল টা অবশ্য নাবিদের। সেখানে ওর কম্পিউটার, চার্জার, বইপত্র এসব থাকে। ওর কালেকশনে বেশ ভালো বইও আছে। অলস দুপুরে কিছু করার না থাকলে তখন বই পড়া হয়।
নাবিদের সাথে আমার সম্পর্ক এখনো অতটা আন্তরিকতার না। আমি চেষ্টা করি সকালে উঠে চা’টা করে দেবার। চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে নাবিদ প্রতিদিনই বলে,
“এতো সকালে ওঠার তো দরকার নেই জরী। তুমি ঘুমাতে।”
এই বাড়িতে সকালের খাবারে ভাত হয়। পাতলা মসুর ডাল, আলুভর্তা আর ডিম। একটা ডিম কে তিন ভাগ করা হয়। নাবিদ যাওয়ার সময় বক্সে করে ভাত নিয়েও যায়। গতরাতের তরকারি থেকে একটু তরকারি আর ডাল।
রান্নাবান্না আম্মা করেন। একটা দুটো তরকারির বেশী করেন না। তরকারিও প্রায় দিন একইরকম। কাজের একজন লোক আছে। সে এসে কাপড় ধোঁয়া, ঘর মোছা, থালাবাসন ধোঁয়া এগুলো করেন।
আমাকে এখনো কোনো কাজ আম্মা করতে দেন নি। কিছু করার কথা বললেও বলে,
“আর কয়টা দিন যাক। নাইলে তো বাপের বাড়িতে মোবাইল কইরা বলবা যে শাশুড়ী এরমধ্যে ঘরের কাজে লাগাই দিছে। ”
আমিও আর কিছুতে যাই না। আমার শ্বশুর মুখচোরা মানুষ। তিনি আমার সঙ্গে অতো সহজ হতে পারেন নি। একটু দূরে দূরে থাকেন।
জামিল ভাই সকালে খেয়ে বেরিয়ে যান আর রাতে ফিরে নি:শব্দে খেয়ে ঘুমাতে যান। তবে তাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমাকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করেন,
“জরী ঘুমাও নাই? আসলে একটু কাজ ছিলো বুঝলা… একটা কাজের কথা চলতেছে। আল্লাহ চাইলে একটা বন্দোবস্ত হবে।”
আমি স্মিত হাসি। মনে মনে বলি, আল্লাহ সব সহজ করে দিক। টাপুর টুপুরের মা ফিরে আসুক। মেয়েদুটো আক্ষেপ নিয়ে বড় না হোক।
***
প্রায় পনেরো দিন পর নাবিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার কিছু লাগবে?”
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
“কী?”
“কিছু লাগবে কি না!”
আমার তখন পরী আপার কথা মনে পড়ে। আপা বলেছিল পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলতে। কিন্তু আমি বলতে পারি না। আমার ভয় হয়।
নাবিদ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে কী ভাবে কে জানে! আলমারি থেকে চারটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে হাতে দেয়। বলে,
“এটা রাখো। ”
আমি লাগবে না বলতে গিয়েও বলতে পারি না। যন্ত্রের মতো টাকাটা নেই। নাবিদ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ ফিরে এসে বলে,
“তুমি পড়তে চাও আরও? ”
আমি তাকিয়ে রইলাম। নাবিদ আমার প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায় আছে। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
“তোমার আপা বলল। তুমি নাকি ভয়ে বলতে পারছ না। এতে ভয়ের কি আছে! আজব তো!”

চলবে…

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।