জামিল ভাইয়ের মনে যে ঠিক কী চলে তা আমি বুঝে উঠতে পারি না। যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছে তারও এটা দ্বিতীয় বিয়ে। দেখতে চুপচাপ লাগলো। অবশ্য এক দেখায় মানুষ কে আর কতটুকুই চেনা যায়। উনি বাড়িতে এসে চুপচাপ রইলেন, খুব বেশী নাটকে গেলেন না। ওনার নাম লিপি। লিপি ভাবীকে নিয়ে আম্মার খুশি যেন ধরে না, হাবভাব এমন যে তিনি আগে থেকেই জানতেন যে জামিল ভাই তার জন্য বউ আনতে যাচ্ছেন।
মুক্তা আর জুয়েল ভাইও এলো। জুয়েল ভাই মিষ্টি নিয়ে এলো অনেক। জামিল ভাইকে দেখে কিছু বোঝা গেল না। তবে টাপুর টুপুর এসব থেকে দূরে রইলো। ওরা গিয়ে নাজমা ভাবীর ওখানে বসে রইলো এই বাচ্চা মেয়ে দুটো অনেক কিছু বোঝে। ওদের মা জীবনে না থেকে বয়সের আগেই খানিকটা বড় বানিয়ে দিয়েছে।
আমি বুঝলাম বাড়িতে আরও একজন লোক এসেছে যে আমাকে ঠিকঠাক পছন্দ করতে পারবে না। মা, চাচীমার সম্পর্ক ছিলো লোক দেখানো। সবাই জানতো যে এরা একে অন্যকে পছন্দ করে না। কিন্তু সামনাসামনি দেখে বোঝার উপায় নেই।
পরী আপা জামিল ভাইয়ের বউয়ের কথা শুনে আমাকে একটু সতর্ক হতে বলে। আম্মার অতিরিক্ত খাতির, যত্নের কথা শুনে বলে এটা নাকি আমাকে দেখানোর জন্য। আমারও তাই মনে হলো। আমাকে শায়েস্তা করার জন্য কিছুদিন এই নাটক চলবে।
নাবিদ এই ব্যাপার টা নিয়ে খুব রাগ দেখাল জামিল ভাইয়ের উপর। লিপি ভাবীর বংশ তেমন উঁচু না। পড়াশোনাও নাইন পর্যন্ত। নাবিদ তো বলেই ফেলল,
“কোথায় টাপুর টুপুর এর মা আর কোথায় উনি। ভাইয়া এইটা কী করলো!”
জামিল ভাই কী ভেবে করেছেন আমি জানিনা, তবে ওনার মেয়েদের দিকটাও একবার দেখা উচিত ছিলো।
চার, পাঁচ দিন যাবার পর আমি বুঝলাম যে লিপি ভাবী সম্পূর্ণ আমার উল্টা। তিনি অনেক কথা বলেন। কাজের হাতও বেশ চালু। দুই হাতের কাজ দেখে আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। আম্মা তো ভীষণ খুশি, এমন ঘরোয়া কাজের মেয়েই তো সে চেয়েছিলেন এতকাল। কাক ডাকা ভোরে উঠে এক চুলায় চা আরেক চুলায় ভাত বসিয়ে হাড়ি পাতিল সব ধুয়ে ফেলে। অন্যরা ঘুম থেকে উঠতে উঠতে তার অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যায়। আমি অবশ্য একদিন বললাম যে আপনার এতো কাজ করার দরকার নেই। খালা তো আসেই, সে করবে এসব।
টাপুর টুপুর এর সঙ্গে তেমন ভাব জমাতে পারলো না। ওদের কাছে গেলে দৌড়ে পালায়। এমনকি জামিল ভাইয়ের সঙ্গেও মেয়েরা কথা বলা বন্ধ করে দিছে।
একদিন লিপি ভাবী টাপুর কে বলল, যাও তোমার আব্বাকে ডাইকা আনো।
টাপুর দাঁত, মুখ খিচিয়ে বলল,
“আমার নাম বলবেন না। টুপুর রে বলেন। ”
টুপুর পাশেই ছিলো। ও দৌড়ে গিয়ে টাপুরের চুল ধরে ঝুলে পড়লো। বলল, আর বলবি আমার নাম বলতে।
এই ঘটনায় উনি মুখ চেপে হাসলেন। আমি খানিকটা বিরক্ত হলাম। বললাম,
“আপাতত দূরে থাকেন ওদের থেকে। পরে আমি বুঝিয়ে বলব ওদের।”
উনি হেসে বললেন,
“ওরা জীবনেও বুঝবে না। আমার ছেলেও এমন। বাপের কাছে যাইতে চায় না। এক দুদিনের জন্য যায়। সৎ মায়ে তেমন কিছু বলে না। তবুও দেখতে পারে না। ছোট পোলাপানের মধ্যে ঢুকে গেছে যে সৎ মা খারাপ হয়। ”
লিপি ভাবীর থেকে শুনলাম বিয়ে ভাঙার কাহিনী। খুব তুচ্ছ কারণে তাদের বিয়ে ভেঙেছে। ওনার প্রাক্তন স্বামী ঢাকায় ব্যবসা করেন। সপ্তাহে দুদিন বাড়িতে যেতেন। একদিন না জানিয়ে গিয়ে দেখলেন ওনারা বাসায় নেই। উনি ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির আরও দুজনের সঙ্গে হলে সিনেমা দেখতে গেছে। বাড়ি ফেরার পর খুব মার খেলেন। শরীর ভর্তি ব্যথা নিয়ে বাপের বাড়ি গেলেন ছেলেকে নিয়ে। দুদিন পর ভরা মজলিশে তাকে তালাক দিলো। উনি ভেবেছিল কিছুদিন গেলে ওনার প্রাক্তন স্বামীর রাগ পরে যাবে। তাকে নিতেও আসবে। কিন্তু ভদ্রলোক দুই সপ্তাহের মধ্যেই ঘরে নতুন বউ তুললেন।
ওনার ধারণা প্রাক্তন স্বামীকে কেউ তাবিজ করেছে। উনি নাকি ভালো মানুষ ছিলেন।
পরী আপা, নাবিদ এরা বলেছিল ওনার সঙ্গে কম মিশতে। আমিও তাই প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলতাম না। কিন্তু উনি ভীষণ মিশুকে স্বভাবের। রান্নাঘরে কাজ করার সময় কথাবার্তা বলেন। আমার খাওয়ার খোঁজ নেন। চাইলেও তাকে এড়াতে পারি না। তবে আমার সঙ্গে তার এতো খাতির আম্মা মানতে পারেন না। তবে তিনি কিছু করতেও পারছেন না। কারণ এই মুহুর্তে তার মাথায় অন্য টেনশন। জুয়েল ভাই কে উনি খাটি হিরা ভেবেছিলেন। এখন দেখছেন হিরের বদলে কয়লা। জুয়েল ভাই মুক্তাকে দিয়ে কাজ করায়। কাজে ভুল হলে সেই কাজ আবার করান। মুক্তা কোনো কাজ করতে অস্বীকার করলে তিনি আরও কাজ বাড়িয়ে দেন।
এই ঘটনা শুনে মামা আর নাবিদ বলেছে আম্মাকে মুক্তার সংসারে নাক না গলাতে। ওদের সংসার ওরা বুঝুক। কিন্তু মুক্তার কান্নাকাটিতে সে অস্থির হয়ে গেছে৷ সারাদিন আফসোস করেন। বলেন,
“এই শীতে সকালে উঠে দুনিয়ার কাজ করে। এতো কাজ কী আমি আমার মেয়েরে করাইছি?”
নাবিদ এই কথার জবাবে বলে, টুম্পা ভাবীও কোনোদিন রান্নাঘরে কাজ করেনাই। তারে দিয়েও তুমি অনেক কাজ করাইছ। এখন এইগুলা বলা বন্ধ করো। তুমি বেশী বুঝলে মুক্তার সমস্যা।
আম্মা ছেলেদের কথা শোনেন না। তিনি তার বোনের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন যে মুক্তার বাসায় গিয়ে ক’টা দিন থাকবে।
আম্মা তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তার বাসায় চলে যান। ছেলেদের কথা শোনে না। তিন, চার দিন থাকেন। এরমধ্যে মুক্তা একদিন জুয়েল ভাইয়ের হাতে ঘুষি খায়। আম্মার সামনেই ঘুষি মারে, তার হাবভাবে মনে হয় মেরে ধরে, হাত পা ভেঙে হলেও মুক্তাকে সংসারের কাজ শিখিয়ে ছাড়বে।
চলবে…