অর্ক বিষন্ন মনে এনজিও থেকে বেড়িয়ে সোজা মেহেনূরদের বাড়িতে চলে আসে।তারপর ওখান থেকে রাওনাফকে নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যায়।এইদিকে মেহেনূর আর রোশনি শপিং শেষ করে শপিং কমপ্লেক্স থেকে বেড়িয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক তখনই মেহেনূরের মনে পড়ে ওর চশমাটা কেনা হয় নি।তাই রোশনিকে গাড়িতেই বসতে বলে মেহেনূর আবার শপিং কমপ্লেক্সের ভেতরে চলে যায়।কিচ্ছুক্ষণ পরেই চশমা নিয়ে চলে আসে মেহেনূর।মাকে দেওয়া কথা রাখতে সন্ধ্যার আগেই ওরা বাড়ি চলে আসে।বাড়িতে এসে দেখে রোশনির বাবা মা চলে এসেছে।অবশেষে বাসায় এসে বাবা মাকে সারপ্রাইজটা দিয়েই দেয় মেহেনূর।মেহেনূরের এই পরিবর্তনে রেনুফা বেগম আর মেহরাব সাহেব আসলেই অবাক হয়েছেন তার সাথে অনেক খুশিও হয়েছে।খুব ছোট বেলায়ই মেহেনূরের চোখের সমস্যা ধরা পড়ে।কাছের জিনিস ক্লিয়ার দেখতে পেতো না।আর দূরের জিনিস তো একদমই দেখতে পারতো না।মেহরাব সাহেব কত চেষ্টা করেছেন মেহেনূরের চোখে অপারেশন করাতে।কিন্তু মেহেনূর খুব ভয় পেতো।অপারেশন করাতে দেয় নি।পরে তো রাওনাফের সাথে কানাডাতেই চলে যায়।তাও মেহেরাব সাহেব আর রেনুফা বেগম বলেছিলেন,বিদেশের উন্নত চিকিৎসায় মেহেনূর যাতে ওর চোখের অপারেশনটা করিয়ে নেয়।কিন্তু মেহেনূর তখন রাজি হয় নি।ওর নাকি চশমা ব্যবহার করতে কোনো সমস্যাই হয় না। বরং চমশা পড়তে ওর ভালোই লাগে।যাইহোক এত বছর পর মেয়ের সম্মতি হয়েছে এটাই তাদের কাছে অনেক।
সন্ধ্যার পরে মেহেনূরদের বাসার সবাই ড্রয়িং রুমে জড়ো হয়েছে।রাওনাফ আর রোশনির বিয়ের আলাপ আলোচনা করার জন্য।আকাশ সাহেব আর আয়েশা বেগমও এসেছেন।তাদেরকেও নিয়ে আসা হয়েছে।কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁদের ছেলের উপর খুব রাগ হচ্ছে উনাদের।রাওনাফ বললো,এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর অর্ক রাওনাফ বললো রোশনির বাবা মাকে নিয়ে বাড়ি চলে আসতে আর ওর নাকি এয়ারপোর্টে কি কাজ আছে তাই ও এয়ারপোর্টেই রয়ে গেছে।কিন্তু এখন, রাওনাফ যখনই অর্ককে কল দিচ্ছে তখনই শুধু বলছে আসছি।কিন্তু এখনো ওর আসার নাম গন্ধ নেই।আকাশ সাহেব ছেলের এমন ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে আয়েশা বেগমের কানে কানে ফিসফিস করে বললেন,
– তোমার ছেলের কি কোনোদিনও বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না?এতগুলো মানুষকে এইভাবে বসিয়ে রাখার কোনো মানে হয়?
আয়েশা বেগমও দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলেন,
– ছেলে কি শুধু আমার একার নাকি?তোমারও তো ছেলে।আর তুমি কাকে কি বলছো?ছেলে তো হয়েছে তোমারই মতো!
– আমার মতো মানে?আমি কি করেছি?
– কেন?মনে নেই আমার ভাইয়ার জন্য বউ দেখতে যাওয়ার সময় কি করেছিলে?
– বেশ করেছি!আমার বন্ধু,আমি যা খুশি তাই করবো।তুমি বলার কে শুনি?
– তাহলে এখন ছেলেকে বকছো কেন?ওরো তো বন্ধুর বিয়ে!
আয়েশা বেগমের সাথে যে উনি কথায় পেরে উঠবেন না সেটা খুব ভালোভাবে জানেন।তাই বউয়ের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে মেহরাব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– মেহরাব ভাই,আপনারা আলোচনা শুরু করেন।অর্ক না হয় পড়ে এসে জয়েন করবে।
– না আঙ্কেল!যে পর্যন্ত অর্ক না আসছে সে পর্যন্ত বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা যাবে না।ও আসলেই ডেইট ফিক্সড করা হবে।
রাওনাফ বেঁকে বসে আছে। ও অর্ককে ছাড়া বিয়ের কথা শুরু করবে না।আকাশ সাহেব রাওনাফের কথায় হেসে দিয়ে বলেন,
– আরে বাবা আলোচনা করা কি মানে বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা নাকি? একটা বিয়েকে কেন্দ্র করে আরো কতকিছুর আয়োজন করতে হয়।আমরা না হয় এখন ওইগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনাটা সেড়ে নিই।অর্ক আসলে তারপর না হয় তোমরা বিয়ের ডেইটটা বলে দিও।
আকাশ সাহেবের কথায় যথাযথ যুক্তি আছে।তাই রাওনাফ আর মানা করতে পারলো না।বড়রা সবাই মিলে বিয়ের অনুষ্ঠান কোথায় কিভাবে করা হবে, বিয়েতে কতজন গেস্ট থাকবে এইসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছেন।তাদের এইসব আলাপকালেই আগমন ঘটে অর্কের।রাওনাফের ইচ্ছা অনুযায়ী অর্ক আসার পরেই আগামী শুক্রবার রাওনাফ আর রোশনির বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হয়।তবে বিয়ের অনুষ্ঠান বাহিরের কোনো রিসোর্ট বা কমিউনিটি সেন্টারে করা হবে না।রাওনাফের বিয়ের রিসেপশনের আয়োজন বাড়িতেই করা হবে।কিন্তু সমস্যা হলো রোশনিদের নিয়ে। এখানে রোশনিদের কোনো আত্মীয়স্বজন নেই যে, ওদের বাসা থেকে রোশনির বিয়েটা হবে।তাই রোশনির বাবা মা ঠিক করলো তারা বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য রিসোর্ট বুক করবেন।তাদের এমন ধারা কথা শুনে আকাশ সাহেব ফিচেল হেসে উঁচু গলায় বললো,
– আরে ভাই সেটা কি করে হয়!আমার এত বড় বাড়ি থাকতে আপনাদের রিসোর্টে যেতে হবে কেন?আর আপনাদের তো এখানে কোনো আত্মীয়ও নেই যে গেস্টদের ঝামেলা আছে।বরযাত্রী যারা আসবে ওদের আপ্যায়নটা করার জন্য শুধু শুধু রিসোর্ট বুক করার কোনো দরকার নেই।রোশনিকে আমাদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে দেওয়া হবে ব্যাস, ডিসিশন ফাইনাল।এর মধ্যে কোনো কিন্তু নেই।কেউ কোনো কথা বলবেন না।আমি যা বললাম তাই হবে।এখন উঠুন ব্যাগপত্র নিয়ে আমাদের সাথে চলুন।বিয়ের বাকি আছে আর মাত্র তিন দিন।মেয়ের বিয়ে বলে কথা অনেক কাজ করতে হবে সে খেয়াল আছে?
আকাশ সাহেব জোর গলায় বললেন কথাগুলো।তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারোর নেই।তাই তার এক কথাতেই সবাই রাজি হয়ে গেছে।অর্ক বাবার এমন উদারতা দেখে মনে মনে বেশ প্রশান্তি পাচ্ছে।ছেলের মনের কথাগুলোই বলে দিয়েছেন আকাশ সাহেব।বাবা দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায় অর্ক।অর্ককে দাঁড়াতে দেখে রেনুফা বেগম উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– আরে অর্ক তুমি উঠছো কেন?খাওয়া দাওয়া শেষ করে তবেই যাবে।
– উঠছি না আন্টি।বর এখানে থাকলেও কনেকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।যাই একটু তার সাথে দেখা করে আসি।
– ও আচ্ছা,ঠিক আছে যাও।
অর্ক রাওনাফকে নিয়ে উপরে মেহেনূরের ঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেলো।ওরা সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই রাওনাফের ফোনে কল আসে।রাওনাফ অর্ককে যেতে বলে একটু সাইডে গিয়ে কলটা রিসিভ করে।অর্ক মেহেনূরের ঘরে গিয়ে দেখে ঘর ফাঁকা,কেউ নেই।অর্ক ঘর থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য উদ্যত হতেই কারোর উচ্চ স্বরে হাসির শব্দ ওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করে।হাসিটা অপরিচিত লাগলো অর্কের কাছে।থেমে যায় অর্ক।হাসির শব্দ অনুসরণ করে পেছনে পেছনে পা ফেলে হাটছে অর্ক।হাসির আওয়াজটা ব্যালকনি থেকে আসছে।অর্ক পিছন ফিরে এগোয় ব্যালকনির দিকে।ব্যালকনির দরজাটা লাগানো,তবে পুরোপুরিভাবে নয়।অনেকটাই ফাঁক হয়ে আছে।অর্ক দরজার কাছে যেতেই আধখোলা ওই দরজার ফাঁক দিয়ে মেহেনূরের হাস্যউজ্জ্বল মুখটা স্পষ্ট ধরা পড়ে অর্কের চোখে।কোনো এক অন্যজগতের ভাবনায় চলে গেছে অর্ক।মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মেহেনূরের দিকে।এ কোন মেহেনূরকে দেখছে ও?এর আগে মেহেনূরকে এই রূপে কোনোদিন দেখে নি অর্ক।রাওনাফের সাথে ওর দূরত্ব তৈরি হওয়ার সময় মেহেনূর খুব ছোট ছিল।কিন্তু যখন রাওনাফের সাথে সম্পর্কটা ভালো ছিল তখন ওদের বাসায় যাওয়া আসার প্রায় সময়ই দেখতো মেহেনূর ওর রুমেই চুপচাপ বসে থাকতো।নয়তো মায়ের সাথে থাকতো।চোখে চশমা পড়তো বিদায় অর্ক ওকে চাশমিশ বলে ডাকতো।মেহেনূর খুব বেশি অর্কের সামনে আসতো না। লজ্জায় নাকি রাগে কারণটা মেহেনূরই ভালো জানে।তারপরে কানাডায় চলে যাওয়ার পরে অনেক দিন পর পর মেহেনূর ওদের বাড়িতে আসতো।আয়েশা বেগমের মুখে শুনতো মেহেনূর নাকি দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর হয়েছে।কিন্তু অর্ক মায়ের কথায় কোনো দিনই সেইভাবে পাত্তা দেয় নি।রাস্তায় চলা ফেরায় অনেকবার দেখা হতো মেহেনূরের সাথে।যদি কখনো চোখাচোখি হয়ে যেতো তাহলে মেহেনূর শুধু সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতো।কেমন অদ্ভুত যেন মেয়েটা।সবসময় কেমন জানি চুপচাপ থাকে।দশ কথার প্রত্যুত্তরে একটার উত্তর দেয়।মেয়ের মুখে হাসি নেই বললেই চলে।তাই মেহেনূরকে বরাবরই বোরিং লাগতো অর্কের।কিন্তু আজ যেনো এই মেয়ের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।আজকে চোখের সেই কালো মোটা ফ্রেমের ভারী গ্লাসের চশমাটা নেই।চশমা ছাড়া তো ওকে চেনাই যাচ্ছে না। চুলে বেনুনিও নেই।খোলা চুলগুলো হাসির সুরের ঝংকারে যেনো ঢেউ তুলছে।দেখতে অপরূপ সৌন্দর্য্য লাগছে।এই মেয়ে এতো হাসতে পারে?এই গুণের করা অর্কের জানা ছিল না।অর্ক নিজের মনে অজান্তেই হাত বাড়িয়ে দরজাটা আরেকটু খুলে দেয়।দরজার ফ্রেমটায় হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মেহেনূরের দিকে।হঠাৎ করেই দরজার দিকে চোখ পড়ে রোশনির।অর্ককে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোশনি আশ্চর্য হয়ে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– আরে অর্ক যে!তুমি কখন এলে?
রোশনির গলার আওয়াজ পেয়ে ঘোর কাটে অর্কের।চটজলদি নিজেকে সামলে নিয়ে এগোয় সামনের দিকে।মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– এইতো মাত্রই।আপনারা কথা বলছিলেন তাই ডিস্টার্ব করি নি।সবাই নিচে আপনাদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করছে আর আপনারা এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন?
অর্ককে দেখে ঠিকঠাক হয়ে দাঁডালো মেহেনূর।রোশান পাশ কাটিয়ে বোনের সাথে গিয়ে দাড়ালো। রোশনি মিষ্টি হেসে বললো,
– মেহেনূর আর রোশান ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড। আসলে অনেক দিন পর রোশান এসেছে তো তাই মেহেনূর ওকে পেয়ে রাজ্যের আলাপ জুড়ে দিয়েছে।ওদের আলাপচারিতাই শুনছিলাম। আর নিচে যাই নি কারণ বড়রা যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই হবে।এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
– তা আপনি কি জানেন এই বাড়ি থেকে আপনার বিয়েটা হচ্ছে না?
আঁতকে উঠে রোশনি।অর্কের এই কথার মানে কি?রোশনি উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– মানে?
অর্ক সবার দিকে চোখ বুলিয়ে রোশনি আর রোশানের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখতে পেয়ে উচ্চ স্বরে হেসে দেয়।আকস্মিক অর্কের এমন হাসির কারণ বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রোশনি আর রোশান।অর্কের কথার মানে ওরা না বুঝলেও মেহেনূর বুঝতে ঠোঁট টিপে হাসছে।রোশনিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আরে ভাবী এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই।তোমার বিয়েটা এই বাড়ি থেকে হচ্ছে না মানে এই না যে বিয়েটাই আর হচ্ছে না!উনার কথার মানে হলো,আমাদের বাড়ি থেকে তোমার বিয়েটা দেওয়া হবে না।ভাইয়া বরযাত্রী নিয়ে অন্যকোথাও থেকে তোমাকে আমাদের বাড়িতে তুলে নিয়ে আসবে।বুঝতে পেরেছো এবার?
রোশনি মেহেনূরের কথা শুনে মনে স্বস্তি পেলো। নরম গলায় বললো,
– ও আচ্ছা তাই বলো।অর্ক, ভাই তুমি তো আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে!
– এত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।এই জন্ম সহ আগামী ছয় জন্ম পর্যন্ত তোমাকে আমি ছাড়ছি না!
প্রিয় মানুষটির চিরচেনা কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই চকিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকায় রোশনি।তড়িৎ বেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে।রাওনাফ তাল সামলাতে না পেরে কিছুটা পিছিয়ে যায়।তবে যথাসময়ে নিজেকে সামলে ঔ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রোশনিকে।রোশনি এবার কেঁদেই দিয়েছে।মেহেনূর আর রোশান ওদের একটু স্পেস দেওয়ার জন্য ব্যালকনি থেকে বেড়িয়ে আসে।কিন্তু আহাম্মককে মতো দাঁড়িয়ে আছে অর্ক।রাওনাফ ওকে চোখে ইশারা করলো চলে যাওয়ার জন্য।অর্ক কিছুক্ষণ রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে স্মিত হেসে চলে আসে।
_________________
মেহেনূরদের বাসা থেকে একটু আগেই সবাই চলে আসে অর্কদের বাসায়।অর্ক নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার টা নিয়ে ব্যালকনিতে চলে যায়।আজো নেশার ঘুরে গা ভাসাতে মন চাইছে।সিগারেট টা মুখে পুরে লাইটার দিয়ে আগুন ধরাতে গেলেই ওইদিন মেহেনূরের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল অর্কের।সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক!অর্ক মুখে থেকে সিগারেটটা নামিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্যে হাসে।এই নেশা ওর স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক নয়।বরং যে নেশায় ও আসক্ত হয়েছে ওই নেশায় বিভোর হতে না পারায় ওর জীবন ধীরে ধীরে বিষাদে রূপান্তরিত হচ্ছে।কিছুতেই ওর ধরা ছোয়া পাচ্ছে না।বার বার ওর চোখে ধূলো দিয়ে সে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে।অবাক করার বিষয় হলো আজকে এয়ারপোর্টে অর্ক খুঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারে গত দু’মাসেও কিরণ চৌধুরী নামে কোনো প্যাসেঞ্জার দেশের ভেতরে বা বাহিরে যায় নি।যদিও একই নামের একজনকে পেয়েছিল।কিন্তু তিনি একজন বয়স্ক মহিলা,যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।গতকাল সন্ধ্যার ফ্লাইটে উনি চলে গেছেন।হতাশ হয়ে চলে আসলেও অর্কের মনে সন্দেহের বীজ বুনছে আরো তীব্র ভাবে।তাহলে কিরণ চৌধুরী কি ওর ছদ্মনাম?তবে আসল নাম কি? হুট করেই সকালের কিরণের ওই চেকটার কথা মনে পড়ে অর্কের।দিহাদকে কল দিয়ে বলে ব্যাংকে যাওয়ার জন্য।কিন্তু আরেক দফায় অবাক হয় অর্ক।ব্যাংকে কিরণ চৌধুরীর নামে একাউন্ট আছে,আর দিহাদ চেকটা দিয়ে টাকা’টাও তুলেছে!অর্কের মাথা কাজ করছে না।এটা কিভাবে সম্ভব?ও কিভাবে এই রহস্যের গন্ডি অতিক্রম করে সত্যের মুখোমুখি হবে?হাতে থাকা সিগারেটটা ফেলে দিয়ে দ্রুত গতিতে ঘরে চলে আসে অর্ক।ভাবতে হবে!গভীর থেকে গভীরত ভাবে চিন্তা করতে হবে।ওর অগোচরে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর হিসাব মেলাতে হবে।এতো রাতে অর্কের রুমের লাইট অন দেখে আয়েশা বেগম এসে দেখেন অর্ক সারা ঘর জুড়ে পাইচারি করছে।কেমন যেন অস্থিরতা ভাব ওর মধ্যে।আয়েশা বেগম ছেলের কাছে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
– এত রাত হয়ে গেছে তুই এখনো ঘুমোস নি কেন?
মায়ের গলার স্বর সেই সাথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে হকচকিয়ে যায় অর্ক।এত রাতে ওর মা এ ঘরে আসবে ভাবতে পারে নি।তবে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।কারণ বরাবরের মতো অর্ক আজো ওর রুমের দরজা বন্ধ করে নি।অর্ককে চুপ থাকতে দেখে আয়েশা বেগম ফের বলেন,
– কি হলো কথা বলছিস না কেন?
– ঘুম আসছিল না।
অর্কের মুখে যা এসেছে তাই বলে দিয়েছে।কিন্তু আয়েশা বেগমের কাছে অর্কের উত্তরটা যুক্তিসঙ্গত মনে হলো না।অর্কের জেগে থাকার কারণটা অন্যকিছুই মনে হচ্ছে উনার।তিনি তার ছেলেকে খুব ভালো করেই চেনেন।সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললেন,
– কেউ কি এইভাবে হেটেচড়ে ঘুমায়?বিছানায় না শুলে ঘুমাবি কি করে?
মায়ের কথা শুনে আমতা-আমতা করতে থাকে অর্ক।এবার মাকে কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে গেছে।মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো,
– আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ছি।তুমি যাও গিয়ে দেখো গেস্টদের কিছু লাগবে কি না।
– যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।আমি লাইট অফ করে দিয়ে গেলাম।
আয়েশা বেগম চলে যেতেই ফোঁস করে দম ছাড়ে অর্ক।মায়ের সামনে মিথ্যে বলার দুঃসাহস ওর নেই।দরজার দিকে সেকেন্ড দুয়েক তাকিয়ে থেকে তারপর গিয়ে শুয়ে পড়ে।কিন্তু পনেরো মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও অর্কের চোখে ঘুম আসছে না।বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে অর্ক।কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না।চোখ বন্ধ করতেই মেহেনূরের ওই হাস্যউজ্জ্বল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।নিজের মন মস্তিষ্কের উপর থেকে মনে হচ্ছে ওর কন্ট্রোল ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।এইসবের মধ্যে মেহেনূর কত্ত থেকে এলো?ওকে নিয়ে তো ও ভাবছে না,তাহলে? অর্কের সাথে এইসব কি হচ্ছে ও বুঝতে পারছে না।জোর করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে ও।কিন্তু ব্যর্থ হয় অর্ক।বরাবরের মতো আজো একটি নির্ঘুম রাত কাটবে অর্কের।
চলবে…