অগোচরে তুমি | পর্ব – ২২

16 Min Read

ঘড়ির কাটা বলছে দশটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট।কাজী অফিসের ভেতরে বসে আছে কলি আর তনিমা।আর দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছটফট করছে মেহেনূর।সূর্যের প্রখরতার জন্য চোখ ধরা যাচ্ছে না।ডান হাতে থাকা মোবাইলটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতটা কপালের উপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে রাস্তার দিকে তাকালো।সারা রাস্তায় একটা গাড়িও দেখা যাচ্ছে না।ওইদিকে কাজী সাহেব তাড়া দিচ্ছে বার বার।উনাকে আবার অন্যকোথাও নাকি বিয়ে পড়ানোর জন্য যেতে হবে।মেহেনূর একটু উঁকি দিয়ে কাজী অফিসের ভেতরটায় দেখে নিলো।কলি চুপচাপই বসে আছে।তনিমা সারা ঘর জুড়ে হাটছে আর একটু পর পর কাজী সাহেবকে বাচ্চাদের মতো এটা ওটা জিজ্ঞাস করে উনার মাথা বিগড়িয়ে দিচ্ছে।কাজী সাহেব ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যখন বিরক্ত তখন এক ধমক দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে বসিয়ে রাখে।এমনিতেই তার দেরি হয়ে যাচ্ছে তারউপর তনিমার যত আজগুবি কথাবার্তা।তনিমা কাজীর দিকে মুখ ভেংচি দিয়ে কলির পাশে গিয়ে বসে।মেহেনূর ঠোঁট টিপে হেসে আবার দৃষ্টি সড়িয়ে নেয়।অদূরেই একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে।হাতে থাকা গোল্ডেন ফিতের ঘড়িটায় এক পলক তাকিয়ে সময়টা দেখে নিলো মেহেনূর।দশটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট।কাজী অফিসের সামনে পর পর দুইটা গাড়ি এসে থামলো।প্রথম গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলো রাওনাফ আর রোশনি।অপর গাড়ি থেকে অর্ক, দিহাদ, অয়ন আর রোশান।মেহেনূর সবাইকে নিয়ে কাজী অফিসের ভেতরে চলে যায়।
– কলি তুই বিয়ে করছিস?
উৎকন্ঠিত স্বরে অয়নের বলা কথাটা শুনতে পেয়ে সবাই চকিতে তাকালো অয়নের দিকে।অয়নের দৃষ্টি স্থির দরজার বাম পাশে পেতে রাখা সোফাটায়।অয়নের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই তাকালো সেদিকে।কলি লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে।দিহাদ,অর্ক, অয়ন বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে কলির দিকে।অর্ক, অয়ন দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় কলির দিকে।ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো দিহাদ।ওর হৃদপিণ্ডটা কাজ করছে না।মনে হচ্ছে শরীরটা ক্রমশ দূর্বল হয়ে যাচ্ছে।বুকের ভেতরটায় চিনচিনিয়ে ব্যাথা করছে।গলা শুকিয়ে আসছে।
– কাকে বিয়ে করছিস তুই?
অর্ক অবাক হয়ে কলির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল।সবার উপস্থিতিতে অর্কের এই প্রশ্নে কলি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
– কি হলো বল?
কলির নীরবতায় অধৈর্য হয়ে অর্ক ফের বললো।কলি ইতস্ততভাবে আঙুল উঁচিয়ে দরজার দিকে ইশারা করলো।অর্ক দরজার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
– দিহাদকে?
নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো দিহাদ।চটজলদি মুখ তুলে তাকালো কলির দিকে।চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় কলি।দিহাদ বিস্মিত হয়ে তাকায় মেহেনূরের দিকে।মেহেনূর মাথা উপর নিচ নেড়ে দিহাদকে আশ্বস্ত করে যে,ও যেটা শুনতে পেয়েছে সেটা সত্যি।দিহাদ চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস টানে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুখে হাসি ফুটিয়ে সম্মুখে এগোয়।
_________________
মাহবুব সাহেবকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করছে কলি।এই মানুষটা ওর বাবার অভাবটা কিছুটা হলেও পূরণ করেছেন।ওর দুঃসময়ে একমাত্র এই মানুষটাই তো ওর পাশে ছিল।ওর জন্মদিনে ওকে রাত বারোটায় ঘুম থেকে তোলে সারপ্রাইজ দিতেন প্রতিবার।কলি রেজাল্টে খুশি হয়ে পাড়ার সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতেন।অনেক সময় কলি না চাওয়া সত্ত্বেও অনেক কিছু পেয়েছে এই মানুষটার কাছ থেকে।কলির কাছে মাহবুব সাহেব ওর বাবার সমতুল্য। একজন বাবা তার সন্তানের জন্য যতটা করেন, মাহবুব সাহেবও নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন।কলি এই মানুষটার কাছে চিরঋণী।মাহবুব সাহেবও কলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখের জল ফেলছেন।কলিকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।যদিও তিনি অনেক ক্ষেত্রে অপারগ ছিলেন। তাও তিনি সাধ্যমতো কলিকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন।
আজ যেন কলির কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।কিছুতেই ওর কান্না থামছে না।আকলিমা বেগমও (মাহবুব সাহেবের স্ত্রী) এসেছেন।তিনিও নীরবে চোখের জল ফেলছেন।এই অনাথ মেয়েটার প্রতি এতটা নির্দয় না হলেও পারতেন।হয়তো সেটাই ভেবেই কাঁদছেন।মেহেনূর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে অমায়িক হাসি।কাউকে হাসি খুশি দেখলে ওরো ভালো লাগে।দিহাদের চোখে মুখে কৃজ্ঞতামিশ্রিত তৃপ্তির হাসি।মেহেনূর এমন কিছু করতে চলেছে এটা দিহাদের কল্পনাতেও ছিল না।
অর্ক হতভম্ব হয়ে শুধু দাঁড়িয়েই রইলো সারাটাক্ষণ।এখানে কি ঘটলো এতক্ষণ সবটা এখনো ওর কাছে ধোঁয়াশা।সকালে অয়ন গিয়ে ওকে ডেকে তুলে বলে যে,কাজী অফিস যেতে হবে।অর্ক কারণ জানতে চাইলে অয়ন বলল,মেহেনূর বলেছে কার যেনো বিয়ে আছে, কয়েকজন সাক্ষী লাগবে।নিজের ঘুম নষ্ট করে কার না কার বিয়ের সাক্ষী হতে ওর বয়েই গেছে।আর, মেহেনূর বলেছে বলেই কি কারোর বিয়ের সাক্ষী হওয়ার জন্য কাজী অফিস চলে যেতে হবে নাকি!অর্ক অয়নের কথায় পাত্তা না দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। পরে আবার রাওনাফ ওকে ডেকে সজাগ করে জোর করে নিয়ে আসে।রাওনাফকে বার বার জিজ্ঞাস করেছিল কার বিয়ে?মেহেনূরের কি হয়? কিন্তু রাওনাফ বললো ও নিজেও জানে না,মেহেনূর শুধু ওদেরকে যেতে বলেছে।ওরা আসার পথে দিহাদকে ওর বাসা থেকে নিয়ে এসেছে।দিহাদও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল!অর্কের যতটা মনে হচ্ছে, দিহাদ নিজেও জানতো আজ ওর বিয়ে।মেহেনূর কেন করলো এটা?দিহাদ টু শব্দটাও উচ্চারণ করলো না?চুপচাপ বিয়েটা করে নিলো?ওদের মধ্যে প্রেম ছিল?তাহলে দিহাদ কেন এত আশ্চর্য হয়েছিল?যদি তাই হয়,তবে মেহেনূর কিভাবে জানলো সে কথা?ও কিভাবে কি করলো?
তবে অর্ক এটা ভেবে খুব অবাক হচ্ছে যে,এইটুকু একটা মেয়ের মাথায় এত বুদ্ধি আর এত ক্যাপাবিলিটি কিভাবে থাকে?কলি আর দিহাদের বিয়ে পড়ানোর ঠিক আগ মুহুর্তে কলির মা বাবা এখানে এসে উপস্থিত হন।তারাও নির্দ্বিধায় বিয়েটা মেনে নেন,কিচ্ছু বলেন নি।দিহাদের বাবা মা স্বশরীরে এখানে উপস্থিত না থাকতে পারলেও মেহেনূর ভিডিও কল করে তাদেরকেও এই বিয়ের সাক্ষী হিসেবে রেখেছে।উনারাও হাসি মুখে ছেলের বিয়ের মোনাজাতে হাত তুলেছেন,কিচ্ছু বলেন নি।কিভাবে পসিবল এটা?
অর্কের মাথায় কিছুই ঢুকছে না।অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়।ওর সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মেহেনূরই দিতে পারবে।অর্ক পুরো রুমে একবার চোখ বুলালো। কিন্তু কোথাও মেহেনূরকে দেখতে পেলো না।তনিমা,অয়ন আর রোশান ওদেরকেও দেখতে পাচ্ছে না।রাওনাফের কাছ থেকে জানতে পারলো ওরা নাকি চলে গেছে।অদ্ভুত!কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে?
___________________
আজকে রাওনাফ আর রোশনির বিয়ের রিসেপশন।বাসায় কত কাজ।সকাল সকাল বাড়ির ছেলে,মেয়ে, বউ সবাই মিলে কোথায় চলে গেল?এখনো ওদের ফেরার নাম গন্ধ নেই।প্রায় বিকাল হয়ে এলো বলে।একটু পর গেস্টরাও আসতে শুরু করবে।গেস্টরা এসে দেখবে যাদের বিয়ের জন্য এত আয়োজন তাঁরাই বাসায় নেই।
রেনুফা বেগম মেহেনূরকে কল দিয়ে এককুঁড়ি কথা শুনিয়েছেন।মেয়ের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।ভাইয়ের বিয়ে, আর ও বাড়ির বাইরে গিয়ে বসে আছে।রেনুফা বেগম কল করলে মেহেনূর ওর মাকে বলল,বর কনে বাসায় চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আর ওর একটু কাজ আছে,সেটা শেষ করে সন্ধ্যা আগেই বাসায় ফিরে আসবে।
অর্ক,রাওনাফ আর রোশনি এক গাড়িতে আসছে।আর অর্কের গাড়িটা দিহাদকে দিয়ে এসেছে।কলি আর দিহাদ আপাতত মেহেনূরদের বাসায়ই যাচ্ছে।মেহেনূরই বলেছে ওদের বাসায় যাওয়ার জন্য।দিহাদ ড্রাইভ করছে আর কলি ওর পাশে বসে এখনো নীরবে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে।মাঝে মধ্যেই ফুঁপিয়ে উঠছে।কলির এত কান্না করাটা দিহাদের সহ্য হচ্ছে না। কলিকে কি বললে ওর কান্না থামাবে দিহাদ সেটাও বুঝতে পারছে না।দিহাদ কলির মাথাটা আস্তে করে ওর কাঁধে রেখে কলিকে এক সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।কলি যেনো এতক্ষণ এটারই অপেক্ষায় ছিল।কলিও দিহাদকে জড়িয়ে ধরে আবার হুহু করে কেঁদে দেয়।দিহাদ কলির মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শুধু শান্ত করার চেষ্টা করছে।কিন্তু কি বলে সান্ত্বনা দেবে ওর শব্দভান্ডারে যতেষ্ট শব্দ মজুদ নেই।মিনিট দুয়েক পরেই দিহাদ গাড়ির ব্রেক কষে।কলি মুহূর্তেই কান্না থামিয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকায় দিহাদের দিকে।দিহাদ একটা রুদ্ধশ্বাস ফেলে কলির দুগাল ধরে কপালে একটা চুমো দিয়ে করুন স্বরে বললো,
– প্লীজ আর কাঁদিস না।তোর কান্না আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।
ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসার প্রথম চুম্বন।মনে এক অন্যরকম শিহরণ,ভালো লাগা।বুকের ভেতরটা ধুকপুক ধুকপুক করছে।রগে রগে শীতল কিছু ছুটাছুটি করছে তীব্রভাবে।মনে হচ্ছে সারা শরীর থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।ওরা যতই পূর্বপরিচিত, বন্ধুই হোক না কেন, এখন ওদের মধ্যে সম্পর্কটা আলাদা।লজ্জা ভয় দুটোই খুব করে ঘিরে ধরেছে কলিকে।দিহাদের দিক থেকে চোখ সড়িয়ে মাথা নিচু করে নেয়। দিহাদ মৃদু হেসে বললো,
– আর কাঁদবি না, ঠিক আছে।
কলি মুখে কিছু বলল না। মাথা নেড়ে সায় দিলো,ও আর কাঁদবে না।দিহাদ কলির লজ্জা পাওয়া দেখে মুচকি হেসে ফের গাড়ি স্টার্ট দেয়।কলি লজ্জায় আর দিহাদের দিকে তাকাতে পারছে না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে।
___________________
রাত দশটা।ড্রাইভিং সীটে বসে আছে মেহেনূর,ড্রাইভ করছে।ঠিক ওর পাশেই বসে আছে কলি।আর ওদের পিছনে বসে আছে দিহাদ,অয়ন,আর তনিমা।সবাই দিহাদের বাসায় যাচ্ছে ওদের দিয়ে আসার জন্য।দিহাদ চেয়েছিল কলি যাতে ওর পাশে বসে।কিন্তু তনিমা বাগড়া দিয়ে নিজে বসে পড়ে।বেচারা দিহাদ ভেবেছিল, বউয়ের হাত ধরে রোমান্টিক মুডে একটু খোশগল্প করবে।কিন্তু তনিমা আর অয়নের জন্য সেটা পারলো না বিধায় মুখ গোমড়া করে বসে আছে।অয়ন,তনিমা যা-তা বলে ওকে খেপাচ্ছে।দিহাদ শুধু সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে।নেহাতি এখানে মেহেনূর আছে,নয়তো এই দুটো বাদড়কে ঘাড় ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতো সেই কখন।কলি দিহাদের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছে।মেহেনূরও হাসছে তবে মনে মনে।ভালোবাসারা পূর্ণতা পেলে মেহেনূরের খুব ভালো লাগে।”বিচ্ছেদ অনেক কষ্ট দেয়,মোমের মতো মনটাকে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দেয় এক নিমিষেই।অথচ যখন এই ভালোবাসারাই পূর্ণতা পায় তখন মনে হয় জীবনের সেরা প্রাপ্তি হয়তো এটাই।”
মেহেনূর দিহাদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামায়।তনিমা, অয়ন সবার আগে গাড়ি থেকে নেমে আসে,তারপর মেহেনূর।দিহাদ নেমে এসে সামনের দরজাটা খুলে হাত বাড়িয়ে দেয়। কলি দিহাদের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে আসে।তনিমা কলির কাছে গিয়ে ছটফট করে খুশিতে গদোগদো হয়ে। বললো,
– কলি, চল বাসায় চল।জানিস আজ কি করে…..
তনিমা ওর পুরো কথা শেষ করার আগেই অয়ন এসে ওর মুখ চেপে ধরে।মেয়েটার একদমই কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই।কত করে বলেছে ওর মুখটা যাতে একটু বন্ধ রাখে।কিন্তু তা না করে সারাক্ষণ শুধু বকবক করেই যাচ্ছে।তনিমার মুখ চেপে ধরায় দিহাদ কলি দুজনেই অবাক হয়ে তাকায় অয়নের দিকে।অয়ন মেকি হেসে তনিমার মুখটা ছেড়ে দিয়ে তনিমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– তুই আজ কি করেছিস না করেছিস সেগুলো কি এখনই বলতে হবে তোর?
অয়ন চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে তনিমার দিকে।তনিমা কিছু একটা আন্দাজ করে সবাইকে তাড়া দিয়ে বললো,
– চল তো তোরা ভেতরে চল।
– না তনিমা আপু।
মেহেনূরের কথা শুনে সবাই দাঁড়িয়ে যায়।সবাই মেহেনূরের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালে মেহেনূর মৃদু হেসে বললো,
– অনেক রাত হয়ে গেছে আপু।তোমাকে আর অয়ন ভাইয়াকে ড্রপ করে দিয়ে আমাকে আবার বাসায় ফিরতে হবে না।আমার ভাইকেও তো বাসর ঘরে পাঠাতে হবে।
– তাই বলে গেইট পর্যন্ত এসে বাসায় না গিয়ে চলে যাবে?
দিহাদের প্রশ্নে মেহেনূর সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
– অন্যদিন আসবো ভাইয়া।আজ আসি।
মেহেনূর গিয়ে কলিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– তোমাদের নতুন জীবনের জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা আর ভালোবাসা।আল্লাহর কাছে দোয়া করি তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক।আসছি,ভালো থেকো।
কলিও মেহেনূরকে জড়িয়ে ধরলো।তনিমা এগিয়ে আসলে মেহেনূর সড়ে দাঁড়ায়।কলি তনিমাকেও জড়িয়ে ধরলো।কলি অয়নকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভিমানী স্বরে বললো,
– এখন থেকেই পর করে দিচ্ছিস?
অয়ন স্মিত হেসে এগিয়ে এসে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো কলি আর তনিমাকে।তিন বন্ধু ওইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ হলো।দিহাদ তনিমা আর অয়নকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
– অনেক হয়েছে ভাই।এবার আমার বউটাকে ছাড় তোরা।যা এখন বাসায় যা।
দিহাদের কথা শুনে কলি গোলগোল করে ওর দিকে তাকায়।দিহাদ সেইসবে পাত্তা না দিয়ে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– মেহেনূর বোন আমার।তুমি যাও তো এই মিচকে শয়তান দুটোকে গিয়ে বাসায় রেখে আসো।নয়তো দেখবে শেষে এরা আমার বাসরটাই ভেস্তে দিয়েছে।
দিহাদের এমন মুখ কাটা কথা শুনে কলির চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।ছিঃ, এই ছেলে কি বলে এসব।লজ্জা শরম সব কি পুড়ে খেয়ে ফেলেছে নাকি?মুখে কিচ্ছু আটকায় না।তনিমা আর অয়ন চোখ রাঙিয়ে তাকায় কলির দিকে।ওদের চোখ বলছে,শুনলি তোর জামাইয়ের কথা শুনলি?কলি ওদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।কলির চোখের চাহনি বলছে,আমিও তো সেটাই ভাবছি,ও তো আগে এরকম ছিল না।মেহেনূর সবার মুখের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হেসে তনিমা আর অয়নের দিকে চোখ পাকিয়ে বললো,
– এই যে মিচকে শয়তানের দল,বাসায় চলো।
মেহেনূরের কথার ভঙ্গিমা দেখে সবাই হেসে দেয়।তারপর সবাই চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই দিহাদ ডাকল,
– মেহেনূর।
দিহাদের ডাকে পিছনে ফিরে তাকায় মেহেনূর।দিহাদ কলিকে নিয়ে এগিয়ে যায় মেহেনূরের দিকে। কলিকে এক হাতে জড়িয়ে রেখে কৃতজ্ঞচিত্তে বললো,
– তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।কিন্তু আজ তুমি যেটা করলে সেটা আমরা কোনোদিনও ভুলতে পারবো না।
– আমি কিছুই করি নি।যা কারার উপরওয়ালাই করেছেন।আমি তো শুধু মাত্র উছিলা।আসছি আমরা।বেস্ট অফ লাক।
_______________
– Welcome to your home and congratulations for your newly life.
দারোয়ান গেইট খুলে দিয়ে কলির হাতে একটা ফুলের তোড়া দিয়ে উক্ত বক্তব্য পেশ করে।দিহাদ দারোয়ানের কথা আর কাজে টাশকি খেয়ে যায়।ও নিজেই জানতো না যে,আজ ওর বিয়ে।সেই জায়গায় দারোয়ান কিভাবে জানলো?আবার ইংলিশে ওয়েলকাম করছে?এই ইংলিশই বা কবে শিখলো?কলি ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দিহাদের দিকে তাকালে,দিহাদ ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে বুঝায় ও কিছু জানে না।দিহাদ দারোয়ানের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,
– রহিম চাচা,তুমি কি জানলে এসব।
– হেইডা হরে কইতাছি।আগে এইডা কওছে হুনি,আমার ইংরেজিডা কেমন অইছে?
– তোমাকে এইসব করতে কে বলেছে?
– ভালা অইছে না?ওই ছেড়িডা তো ভালা মতোই কইছিন,আমারই মনে থাহে না।বার বার ভুইল্লেয়া যাই।আসলে হগলে তোমরারে যে ছেড়িডা গাড়িত্তে নামাইয়া তুইয়া গেছে এই ছেড়িডাই আমারে কইছিন,তোমরা যে বালা বাড়ির ভিত্রে ঢুকবা তহন এই কথাডা কইতাম।
দিহাদ বুঝতে পারছে দারোয়ান মেহেনূরের কথা বলছে।তাও দিহাদ প্রশ্ন করলো,
– মেহেনূর?ও কখন এসেছিল?
দারোয়ান দ্রুত মাথা ঝাকিয়ে বললো,
– হ,হ,মেহেনূর,দুপুরে আইছিন।
মেহেনূর দুপুরে এখানে এসেছিল শুনে কলি আর দিহাদ দুজনেই খুব অবাক হলেও দারোয়ানের সামনে কেউ কিছু না বলে বাসার ভেতরে চলে আসে।বাসার মেইন দরজাটা খুলতেই উপর থেকে শত শত গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। কলি আর দিহাদ আশ্চর্য হয়ে সেইদিকে তাকায়।হঠাৎ করেই কলির নজর পড়ে সিঁড়ি কাছে একটা হৃদয়াকৃতির সাইনবোর্ডে।সেটায় লেখা “ওয়েলকাম মিস্টার এন্ড মিসেস।” দিহাদ আর কলি উভয়েই রীতিমতো অবাক।ওদেরকে এইভাবে কেউ সারপ্রাইজ দিবে এটা ভাবতেও পারে নি।কলি একদৃষ্টে তাকিয়ে ওই লেখাটার উপর হাত বুলাচ্ছে।দিহাদ হুট করেই কলিকে কোলে তুলে নেয়।আকস্মিক এমন হওয়ায় কলি চমকে উঠে।পরমুহূর্তেই লজ্জায় মুখ লুকায় দিহাদের বুকে।দিহাদ কলিকে কোলে নিয়েই সিঁড়ির বেঁয়ে ওর ঘরে চলে যায়।দিহাদ ঘরে গিয়ে কলিকে ঠিক বিছানার মাঝখানটায় বসিয়ে দেয়।দরজাটা আগে থেকেই খোলা ছিল তবে একটু ভিড়ানো ছিল।ঘরের ভেতর শুধু একটা ড্রিম লাইট জ্বলছে।রুমের লাইট জ্বালানোর জন্য সুইচ টিপতেই দিহাদ আর কলির চক্ষু চড়াকগাছ।পুরো রুমটা রকমারি ফুল দিয়ে ডেকোরেশন করা।কলি বিছানা দেকে নেমে ঘুরে ঘুরে পুরো ঘরটা দেখছে।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কিছু একটা দেখতে পেয়ে দিহাদ এগিয়ে যায় সেইদিকে।আয়নায় একটা চিরকুট লাগানো।দিহাদ চিরকুটটা হাতে নেয়।ওটায় লিখা,
“কি সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?অবশ্য আমি জানি,আপনাদের খুব ভালো লেগেছে!বেশি কিছু করতে পারি নি।ওইটুকু সময়ের মধ্যে এতটুকুই করতে পেরেছি।দুজনে মিলে একটু মানিয়ে নিবেন,কেমন।ড্রেসিং টেবিলের বাম পাশে দেখুন একটা বক্স রাখা আছে।ওইটায় ফ্লাইটের দুটো টিকিট আছে।এটা আমার ভাইয়া এবং আপুর জন্য, আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা গিফট।কাল দুপুর সাড়ে বারোটায় ফ্লাইট।এখন আপতত কক্সবাজার থেকে হানিমুনটা সেড়ে আসেন।তারপর না হয় হানিমুন ট্রিপ দিতে মালদ্বীপ গেলেন।”

চলবে…

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।