চারদিকে শুনশান নীরব নিঃস্তব্ধতায় ঘেরা।ফাঁকা রাস্তায় খুব ধীর গতিতে ড্রাইভ করছে মেহেনূর।মাঝে মধ্যে দু একটা গাড়ি ক্রস করছে।গাড়ির ভেতরের লাইটগুলো অফ করে দিয়ে সামনের জানালাগুলো খোলাই রেখেছে।চারদিকে ফুরফুরে সতেজ হাওয়া বইছে।জোনাকিরা দল বেঁধে রাস্তার দু’পাশে শোকসভা বসিয়েছে।দেখে মনে হচ্ছে,এক আকাশ তারা বোধহয় মাটিতে নেমে এসেছে।মেহেনূর একবার ভেবেছিল গাড়ির হেডলাইট গুলো অফ করে দিবে।জোনাকির আলোয় বাকি রাস্তাটা অনায়াসেই চলে যেতে পারবে।আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে শেষে থানায় গিয়ে এই সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বোকামিটা আর করলো না।লাইটগুলো থাক,তাও এইভাবেই বেশ লাগছে।আজ যদি এই গাড়িটা সাথে না থাকতো তাহলে নিশ্চিত ও এই ফাঁকা রাস্তায় হাটতো।এমন মনোরম স্নিগ্ধ মায়াবী রাতে খোলা আকাশের নিচে হাটতে কার না ভালো লাগে।অবশ্য এটা যদি কানাডা হতো তাহলে আর গাড়ির দোহাইও দিতো না।নিজের মনের তীব্র ইচ্ছাটাকেই প্রশ্রয় দিতো।তবে এই মুহুর্তে গুনগুনিয়ে একটা গান গাইলে মন্দ হয় না।এই ওয়েদারে এই গানটায় ওর মাথায় আসলো?মেহেনূর মুচকি হেসে সুর তুললো,
নীল আকাশের নিচে আমি
রাস্তা চলেছি একা!
এই সবুজের শ্যামল মায়ায়
দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা
শনশন বাতাসের গুঞ্জণ চঞ্চল করে মন!
ডাক দিয়ে যায় এ দুটো চোখ!
আহা ও ও হো……..
গান গাইতে গাইতে লুকিং গ্লাসে এ ঝলক নজর পড়তেই ভ্রু কুঁচকে আসে মেহেনূরের।গান থামিয়ে গ্লাসের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে তাকায়।কেউ একজন বাইক নিয়ে ওর গাড়ির পিছন পিছন আসছে।মেহেনূর তুলনামূলক অনেক কম স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছে।আর এই হিসেবে ওই বাইকার ওকে ক্রস করে চলে যাওয়ার কথা।কিন্তু মেহেনূরের কেন জানি মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করে বাইকটাও আস্তে আস্তে চালানো হচ্ছে।তবে কি ওকে কেউ ফলো করছে?পরখ করে নেওয়ার জন্য মেহেনূর গাড়ির ব্রেক কষে।সাথে সাথে পিছনের বাইকটাও দাঁড়িয়ে পড়ে।আশ্চর্য,মেহেনূর অবাক হয়ে মাথা ঘুড়িয়ে পিছনে তাকায়।ও কিছু দেখে উঠার আগেই বাইকের হেডলাইটটা বন্ধ করে ফেলে।মেহেনূর কিছুক্ষণ সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে আবার গাড়িটা স্টার্ট দেয়।পরমুহূর্তেই মেহেনূর লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বুঝতে পারে বাইকটা আবার ওর পিছুপিছু আসছে।মেহেনূর স্বাভাবিকের চেয়েও দ্রুত ড্রাইভ করছে।তবে ভয় পেয়ে নয়।পুরোপুরি কনফার্ম হওয়ার জন্য যে,বাইকটা ওকেই ফলো করছে।হুট করেই মেহেনূর আবার গাড়ি থামিয়ে দেয়।মুহূর্তেই বাইকটাও দাঁড়িয়ে পড়লো।মেহেনূর স্মিত হেসে ফের গাড়িটা স্টার্ট দেয়।সাথে সেই বাইকও।মিনিট দুয়েক পর মেহেনূর আবার সেই একই কাজ করলো।সেই সাথে ওর বাইকারও।মেহেনূরের কাছে এই বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে।অনেকবার একই ঘটনা রিপিট করে।ও বার বার এমন করছে দেখে আরেক বার ওই বাইকার ওকে ক্রস করে চলে যায়।মেহেনূর কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।পরমুহূর্তেই ওই বাইকারকে বিরক্ত করতে পেরে শব্দ করে হেসে উঠলো।
__________________________
ছাদে এসে দ্রুত পায়ে পাইচারি করছে অর্ক।সেই সকাল থেকে ওর মনটা অস্থির হয়ে আছে।কবে একটু মেহেনূরকে একা পাবে আর ও ওর মনে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।রাওনাফকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েই ছাদে চলে এসেছে অর্ক।ওর হাতে থাকা ফোনের বাটন চেপে সময়টা দেখে নিলো।এখন সময় একটা বেজে সাতাশ মিনিট।ঘড়ি ধরা সময়,এখন থেকে পঁচিশ মিনিট আগে অর্ক ছাদে এসেছে।মেহেনূর রাতে ঘুমানোর আগে প্রতিটি ছাদে আসে এ কথা অর্ক জানে।মেহেনূরই একদিন ওকে বলেছিল।তাছাড়া অর্ক৷ নিজেও বেশ কয়েক দিন দেখেছেও।এখন দেড়টা বাজে তো কি হয়েছে?রাত তিনটে বাজলেও মেহেনূর ছাদে আসবে।এ ক’দিনে মেহেনূরকে এতটুকু চিনতে পেরেছে অর্ক।
প্রায় আরো পাঁচ মিনিট পর মেহেনূরের দেখা মিললো।এক হাতে আড়াইশো মি.লি’র দুটো কোকের বোতল অন্য হাতে মোবাইল।মোবাইলের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো অর্কের পাশে।একটা কোক অর্কের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এটা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করে তারপর ধীরেসুস্থে প্রশ্ন করুন।
মেহেনূরের কথা শুনে অর্ক কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।মেহেনূর কিভাবে জানলো ও প্রশ্ন করবে বলে এখানে দাঁড়িয়ে আছে?আর ও যে ছাদে আছে মেহেনূর সেটাই বা জানলো কি করে?
– কি হলো কি ভাবছেন?আপনি ছাদে এটা আমি কি করে জানলাম?
মেহেনূরের কথা শুনে টাশকি খেয়ে যায় অর্ক। অর্ক অবাক হলেও বাহিরের ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন করলো না।অর্ক মেহেনূরের হাত থেকে কোকটা নেয়।মেহেনূর নিজের কোকটা থেকে এক ঢোক খেয়ে স্মিত হেসে বললো,
– ফ্রিজে একটাও কোক নেই।খালা মনি বললো,জীম সব খেয়ে ফেলেছে।খালুজান কোনো কারণে দোকানে গিয়েছিলেন।তাকে বললাম আমার জন্য যাতে কোক নিয়ে আসে।কারণ আমার সব কোক তার ছেলে সাবাড় করে দিয়েছে।আপনি যখন ছাদে আসছিলেন তখন আমি দেখেছিলাম।এখানে এসে আমি একা একা কোক খাবো আর আপনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন পরে যদি আমার পেট ব্যাথা করে!তাই আপনার জন্যও একটা নিয়ে আসলাম।এখন বলুন, আপনি কি জানতে চান?
মেহেনূর যে খুব চালাক সেটা অর্কের আর বুঝতে বাকি নেই।তাই এতো ভনিতা না করে গলা খাঁকারি দিয়ে সোজাসাপটা প্রশ্ন করলো,
– সকালে কাজী অফিসে এটা কি করলে তুমি?
অর্কের প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মেহেনূর।অবাক হয়ে বললো,
– কি করেছি?
– তুমি দিহাদের অনুমতি ছাড়াই ওর বিয়ে দিয়ে দিলে?আর দিহাদও কোনো আপত্তি জানালো না কেন?
অর্কের প্রশ্ন শুনে মেহেনূর হতভম্ব,হতবাক।এতো কাছের বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও অর্ক কিছুই টের পেল না।শুধু অর্কই না,তনিমা আর অয়নও জানতো না।রাওনাফের বিয়ের জন্য তনিমা আর কলি মেহেনূরদের বাসায় এসেছিল।মেহেনূর,তনিমা আর কলি এক রুমেই ছিল।কাল রাতে ছাদ থেকে চলে যাওয়ার পর রুমে গিয়ে সবার আগে মেহেনূর তনিমাকে সবটা বলে।তনিমা সবটা শুনে পাঁচ মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল।তারপর কলিকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল।আর আজ বিয়ে পড়ানোর পর যখন মেহেনূররা দিহাদের বাসায় যাচ্ছিলো তখন তনিমা অয়কেও সবটা বললো।তনিমার মতো অয়নও বিস্মিত হয়েছিল সবটা শুনে।এখন সবটা শুনার পর অর্কেরও একই হাল হবে সেটাও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মেহেনূর।কিন্তু অর্ক ওকে কেন এই কথা জিজ্ঞাস করছে?মেহেনূর অর্কের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো,
– আপনার এই প্রশ্নটা তো দিহাদ ভাইয়াকে করা উচিত।আমাকে কেন করছেন?
– আমি তোমার কাছ থেকে সবটা শুনতে চাই বলে ওদেরকে কিচ্ছু জিজ্ঞাস করে নি।কারণ আমি জানি এই সবকিছুর পিছনে তুমি আছো।
– বাব্বাহ্!এত জানেন আপনি।
– দেখো মেহেনূর,একদম ভনিতা করবে না।
– ওকে রিল্যাক্স।রেগে যাচ্ছেন কেন।আগে কোকটা শেষ করেন তারপর বলছি।
মেহেনূরের কথাটা বলতে দেরি অর্কের কোক শেষ করতে দেরি নেই।রুদ্ধশ্বাসে পুরোটা কোক শেষ করে বললো,
– বলো এবার।
মেহেনূর অর্কের তাড়াহুড়ো দেখে মুখ টিপে হেসে একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে।তারপর কলির অতীত বর্তমান, দিহাদ-কলির একে অপরকে ভালোবাসা,ও কিভাবে জানলো,সব অর্ককে বললো।মেহেনূরের প্রত্যেকটা কথায় অর্ক চমকিয়েছে,অবাক হয়েছে,বিস্মিত হয়েছে।হওয়ারই কথা।এতো বছর ওদের বন্ধুত্ব অথচ ওরা কেউই জানতো না কলির জীবনটা এতটা নির্মম,মর্মান্তিক।দিহাদ আর কলির আচরণেও কখনো মনে হয় নি ওরা একে অপরকে ভালোবাসে।তাহলে কিভাবে বুঝবে ওরা?অর্ক ফের প্রশ্ন করলো,
– আর দিহাদের আব্বু আম্মু?
– দিহাদ ভাইয়া বললো উনার আব্বু আম্মু কানাডায় থাকেন।আমরাও ওইখানেই থাকি।যদিও এক জায়গায় নয়।তবে ভার্চুয়াল জগতে কারো ঠিকানা খুঁজে বের করতে এখন আর খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না।উনারা কলি আপুকে তো আগে থেকেই চিনেন,জানেন।ছেলের পছন্দই উনাদের পছন্দ।কলি আপু অনাথ, এটা জানার পর অবশ্য একটু আপত্তি করেছিলেন।
– তখন তুমি তাঁদের রাজি করিয়েছো।
মেহেনূরকে বলতে না দিয়েই অর্ক বললো।মেহেনূর চুপ রইলো।অর্ক ওর জবাব পেয়ে গেছে।মেহেনূর একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে ছাদের কার্নিশে গিয়ে উঠে বসলো।অর্ক ওর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।তবে মেহেনূরকে ও যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে।এই মেয়েটা কিভাবে সবদিক এতো ইজিলি সামলে ফেলে?ওর কথার পৃষ্ঠে কেন কেউ কিছু বলতে পারে না?নাকি বলতে চায় না?এই মেয়ে কি সবজান্তা?এতটাই নিখুঁত ও?অর্ককে এই প্রশ্ন গুলো বরাবরই খুব ভাবায়।
– বাইক নিয়ে আমায় ফলো করছিলেন কেন?
নির্বিকার চিত্তে প্রশ্ন করলো মেহেনূর।ছাদ থেকে চলে আসার পা বাড়াতেই মেহেনূরের এহেন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়ায় অর্ক।বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফেলে তাকালো মেহেনূরের দিকে।কপালে চিন্তার ভাঁজ।অর্ক যে ওকে ফলো করছিল সেটা মেহেনূর কিভাবে জানলো?হুডি হেলমেটের আড়ালে ওটা অর্কই ছিল সেটা এত আত্মবিশ্বাসের সাথে কি করে বলছে ও?
– আপনার পারফিউমের স্মেলটা খুব ভালো।জানেন, আপনি আমাকে ক্রস করে চলে আসার অনেকক্ষণ পরেও স্মেলটা ছিল।কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম ইউজ করেন?কোনো বিদেশী ব্র্যান্ডই হবে হয়তো।আচ্ছা বাদ দিন,বললেন না তো কেন ফলো করছিলেন।
মেহেনূরের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অর্ক।কাচুমাচু মুখ করে বললো,
– একই ব্র্যান্ডের পারফিউম কি আর কেউ ব্যবহার করে না নাকি?
মেহেনূর ঠোঁট টিপে হাসছে।অর্ক ওকে যুক্তির কায়দায় এড়িয়ে যেতে চাইছে।অর্কের দিকে আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে ফের বললো,
– আমার কাছে সবসময়ই চুইংগাম থাকে।গাড়িতে কিছু আলপিনও ছিল।যখন গাড়ি থামিয়ে ছিলাম?তখন রাস্তায় চুইংগাম আর আলপিন ফেলে দিয়ে ছিলাম।যাইহোক,সকালে বাইকের টায়ারগুলো পরিষ্কার করে নিয়েন।
মেহেনূর কথাটা শেষ করেই হাসতে হাসতে ছাদ থেকে চলে যায়।অর্ক বিস্মিত হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলো।পরমুহূর্তেই মেহেনূর বলা কথাটার মানে বুঝতে পেরেই বুক চিঁড়ে একটা রুদ্ধশ্বাস বেরিয়ে আসে।এ তো ভারী ধুরন্ধর পাজি মেয়ে।ওর মাথায় সবসময় কিছু না কিছু চলে,সেটা অর্ক জানে। তাই বলে, এত দুষ্টুবুদ্ধিও গিজগিজ করে এই মেয়ের মাথায়?শেষে কিনা ওর শখের বাইকটার বারোটা বাজিয়ে দিলো?ও তো মেহেনূরের ভালোর জন্যই ফলো করছিল।আর এটাকে তো ফলো করা বলে না!প্রটেক্ট করা বলে।রাতের বেলা একটা মেয়ে একা একা বাসায় ফিরবে।তাই অর্ক একটু এগিয়ে দেখতে গিয়েছিল।কারণ মেহেনূর এইদিকের রাস্তাঘাট তেমন ভালো চিনেও না।এখন এটা কি ফলো করা হলো?তবে হ্যাঁ, ও চাইলে মেহেনূরের সাথে দেখা করতে পারতো।কিন্তু সেটা কেন করলো না এটার উত্তর অর্কের কাছেও নেই।হয়তো তখন মেহেনূরের পিছন পিছন চুপিচুপি আসতেই খুব ভালো লাগছিল ওর কাছে।বাসার কাছাকাছি চলে আসায় অর্ক তখন মেহেনূরকে ক্রস করে আগেই চলে আসে।মেহেনূর খুব চালাক,অর্ক সেটার প্রমাণ প্রতিবারই পেয়েছে।তবে মেহেনূর এইভাবে ওকে ধরে ফেলবে বুঝতে পারে নি।
_____________________
অর্ক মেহেনূরদের বাসা থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে সবে একটু শুইয়েছে।শরীরটা বেশ ক্লান্ত।সকালে দিহাদ কলির বিয়ে তারপর সারাদিন এটা সেটা করতে হয়েছে, সন্ধ্যার পরে আবার রিসেপশনের ঝামেলা সব মিলিয়ে শরীরটা এক্কেবারে ছেড়ে দিয়েছে।এইমুহূর্তে মনে হচ্ছে, কেউ একজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে মন্দ হতো না।
– আসতে পারি সাহেব?
আমেনা বেগম অর্কের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে কথাটা বললেন উনাকে দেখে মনে হচ্ছে যে, সদ্য বিবাহিত মধ্যযুগীয় এক রমনী তার বরের কাছে অত্যন্ত বিনীতভাবে আরজি জানাচ্ছে।আমেনা বেগমের স্বর শুনতেই হাসি ফুটে অর্ককের মুখে।চোখ বন্ধ রেখেই নরম গলায় বললো,
– বিবি তাঁর সাহেবের ঘরে আসলে অনুমতি চাইতে হবে এটা কোন সংবিধানে লেখা আছে বিবিজান?
– আসবো তাহলে?
– না।
আমেনা বেগম ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছেন।অর্ক বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আমেনা বেগমকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়।আমেনা তখনও নির্লিপ্ত চোখেই অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।
– বিবিজান এই মুহূর্তে আমি মনে হয় তোমাকেই চাইছিলাম।
অর্ক আমেনা বেগমের কোলে মাথা রেখে কথাটা বললো।আমেনা বেগম অর্কের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ভারী কণ্ঠে বললো,
– আমার তো অন্য কিছু মনে হচ্ছে।
অর্ক শুয়ে থেকেই মাথাটা হালকা কাত করে চোখ উল্টে আমেনা বেগমের দিকে তাকায়।অর্কের অবুঝ চাহনি দেখে আমেনা বেগম বললো,
– চারদিকে বিয়ের মরশুম।এই মুহূর্তে তোর দুই বন্ধু বাসর ঘরে আছে।হয়তো বউয়েরা পরম যত্ন করে ওদের মাথায়ও হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।এখন এটা ভেবে হয়তো তোরও তো ইচ্ছা জাগছে,“ইশ আজ যদি আমার একটা বউ থাকতো তাহলে আমিও হয়তো তাঁর আদর পেতাম!”
– সত্যিই আমার এই ক্লান্তি অবসান দূর করার জন্য এই দুটো হাতের খুব দরকার ছিল।
অর্ক আমেনা বেগমের হাতদুটোয় চুমো দিয়ে কথাটা বললো।
– ভাবমূর্তি খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।এবার দেখছি স্থানী দুটো হাতের বন্দোবস্ত করতেই হবে।তা সাহেবের মনে কি কেউ আছে?
এতক্ষণে আমেনা বেগম আসল কথাটা জিজ্ঞাস করলেন।অর্কের মনে কি আছে সেটা জানার জন্যই তিনি অর্কের রুমে এসেছেন।অর্ক চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুটস্বরে বললো,
“আমার হৃদয় হরনী,বিদেশিনী
নীলাক্ষী নয়নে ছিল অগ্নিঝরা চাহনি
তাঁর মসৃণ ঠোঁটের অমায়িক হাসিতে
আমি তো ডুবেছি সেই কবে
হারিয়েছি তাকে ক্ষনিকের ভুলে
আজও আমি মনের দরজা খুলে
অপেক্ষায় থাকি অন্তিম প্রহরে
হয়তো সে একদিন আসতেও পারে
আমার এই এলোমেলো নীড়ে!”
আমেনা বেগম অর্কের কথা শুনে অবাক হয়ে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছেন।পরমুহূর্তেই গলার স্বর নিচু করে নরম গলায় বললো,
– আচ্ছা বুঝলাম!আমি কি তাকে চিনি?
– হু!
অর্কের স্বর ক্ষীণ হয়ে গেছে।হয়তো ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাবে এক্ষুনি।আমেনা বেগম অর্কের প্রশ্নের উত্তর শুনে শুধু মৃদু হাসলেন।কোনো কথা বললেন না।চুপচাপ অর্কের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।কিছুসময় পরেই বুঝতে পারেন অর্ক ঘুমিয়ে পড়েছে।অর্কের মাথাটা বালিশে রেখে আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে আসেন।অর্কের পায়ের কাছে থাকা কম্বলটা কোমড় অবধি টেনে দিয়ে আমেনা বেগম চলে আসেন।
চলবে…