একটা স্টেজ শো তে কিরণকে বলতে শুনেছিলাম,“মানুষ আবহাওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত!মানুষ তার চরিত্রের সাথে মুড অনুযায়ী পাল্টায়!” কিরণের বলা সেই কথাটার মানে আমি কখনই বুঝতে পারতাম না।আমরা জানি সময়ের সাথে সাথে প্রতিটা মানুষই পরিবর্তনশীল।কেউ কখনো ঠকে পরিবর্তিত হয়।আবার কেউ কাউকে ঠকিয়ে তাঁর পথ পরিবর্তন করে।তবে আজ কিরণের বলা সেই কথাটার মানে বুঝতে পারলাম।
অয়নের কথা শুনে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা অর্ক সহ কেবিনে উপস্থিত থাকা প্রত্যেকে বিস্মিত হয়ে অয়নের দিকে তাকায়।অর্কের মলিন মুখে শীতল চাহনি দেখে অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– এখন পাগলামি করলে কি হবে?নিজেকে কষ্ট দিলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে?ওইদিন মেহেনূরকে প্রত্যাখ্যান করে তুই নিজেই ঠকে গিয়েছিলি।খাঁটি হিরাকে হাতের কাছে পেয়েও চিনতে পারিস নি।তুই ওর এতো কাছে থেকেও ওকে চিনতে পারলি না।সবাই বার বার করে বলেছিলাম,এমন করিস না মেহেনূর খুব ভালো মেয়ে।কিন্তু তুই কারোর কথাই শুনিস নি।যাকে বিবিজান বিবিজান বলে ডেকে সারাবাড়ি মাথায় তুলতিস,সেই বিবিজানকেই কষ্ট দিয়েছিস।তাঁর মুখের কথার কোনো দামই রাখলি না।নিজের বাবা মায়ের মুখ ছোট করেছিস।আর তোর মামা?লোকটাকে সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখে এসেছি।কত ভালোবাসতেন তোকে।তুই তাকেও বাদ রাখলি না!এখন তুই কোন মুখে তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবি?তাঁদের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল,তাদের পছন্দ সঠিক ছিল না!সেটার প্রমাণ কি আদৌও আছে তোর কাছে?
অর্ক মাথা নিচু করে বসে আছে।ও যা করেছে তার জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে একটু আধটু কটুবাক্য ওর শোনাই উচিৎ।পরমুহূর্তেই কি মনে করে যেন হুট করে মাথা তোলে তাকালো অর্ক।পুরোরুমে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার।কলি,দিহাদ আর অয়ন ছাড়া অন্য কেউই নেই এখানে।অর্ক অয়নের এতোগুলো প্রশ্নের একটারো জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– আমাকে হসপিটালে কে নিয়ে এসেছে?
– এম্বুল্যান্স এর ড্রাইভার!
অয়নের উত্তর শুনে ফিক করে হেসে দেয় দিহাদ আর কলি।অর্ক ওদের দিকে এক পলক তাকিয়ে অয়নের দিকে চোখ রাঙিয়ে ফের বললো,
– অয়ন একদম ফাজলামি করবি না।যা জিজ্ঞাস করেছি সেটা বল।আরে….
অয়নের কেন যেন বিরক্ত লাগছে,আবার খুব রাগও হচ্ছে।অর্কের পুরো কথা না শুনেই অয়ন রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।অর্ক ক্ষণকাল আশ্চর্য হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।কলি আর দিহাদ একটু দূরে পেতে রাখা সোফাটায় বসে আছে।অর্ক জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালে দিহাদ বললো,
– মেহেনূর কাল রাতে ওর ব্যাপারে সবকিছু আমাদের বলেছে।অবশ্য মেহেনূর নিজের ব্যাপারে কখনোই কাউকে কিছু বলতে চায় না।কিন্তু ও মিথ্যা কথাও বলে না।কালকে জাস্টিন ট্রুডোকে দেখে আমাদের একটু না অনেকটাই কৌতুহল জাগে যে,সাধারণ একটা মেয়ের জন্মদিন পালন করতে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট চলে আসলো?অবশ্য জাস্টিন ট্রুডোর অমায়িক আচার আচরণের কথা সবাই জানে।যাইহোক, যখন এই প্রশ্নের উত্তর মেহেনূরের কাছে জানতে চাইলাম তখন মেহেনূর সবটা বললো।মেহেনূর যে অন্যদের থেকে আলাদা সেটা আমরা জানতাম।কিন্তু ওই যে কিরণ চৌধুরী সেটা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি,এই যা।কিন্তু বিশ্বাস কর ভাই,আমরা সত্যিটা জানার পর এতোটাও রিয়েক্ট করি নি যতটা রিয়েক্ট করলে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়!
– তুই কি আমাকে খুঁচা দিয়ে কথাটা বললি?
– তোকে খোঁচা দিতে আমার বয়েই গেছে।
কথাটা শেষ করেই দিহাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।অর্ক অবাক না হয়ে পারছে না।ও যেটা জিজ্ঞাস করছে সেটার উত্তর তো দিচ্ছেই না উল্টো সবাই মুখ ভেংচি দিয়ে চলে যাচ্ছে।অর্ক কলির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখ করে বললো,
– কলি,আমার উত্তরটা কিন্তু পেলাম না।
অর্কের কথায় স্মিত হাসলো কলি।কলি বরাবরই ঠান্ডা মেজাজের আর চুপচাপ।হুটহাট রাগ দেখানো ওর স্বভাবে নেই।তবে অর্কের উপর ওর যে রাগ নেই তেমনটা কিন্তু নয়।ওরো রাগ আছে তবে ও এতো সহজে সবার মতো রাগ দেখাতে পারে না।কলি ক্ষুদ্র একটা শ্বাস টেনে ধীর কন্ঠে বললো,
– কাল মেহেনূরই তোকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।সারারাত তোর পাশে মেহেনূরই ছিল।তোর ঘুম ভাঙার একটু আগেই বাসায় গিয়েছে।
অর্ক কলির কথা শুনে শুধু মৃদু হাসলো।কলি যে ঘুরে ফিরে মেহেনূরের কথা বলবে সেটা যেন ও আগে থেকেই জানতো।পরমুহূর্তেই কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
– তোরা বাসায় যাস কেন?তোরাও তো সারারাত এখানে ছিলি।
– তোকে কে বলেছে আমরা সারারাত এখানে ছিলাম?
কলির কথা শুনে অর্ক কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
– মানে?
– আমরা তো জানতামই না তুই হসপিটালে ভর্তি!সকালে রোশনির কাছে সবটা শুনে আমরা কিছুক্ষণ আগে এসেছি।আমরা আসার পরেই মেহেনূর এখান থেকে বাসায় গিয়েছে।
কলির কথা শুনে অর্ক আশ্চর্য হয়ে গলায় স্বর উঁচু করে বললো,
– কি!
অর্ককে বিস্মিত হতে দেখে কলি শীতল কণ্ঠে বললো,
– আমি সবটা বলছি তো,তুই চুপ করে শোন।
– বল শুনি তোদের কি এমন কাজ ছিল যার জন্য তোরা আমার খবরটুকুও নিতে পারিস নি।আমি যদি মরেও যেতাম তাহলেও তো তোরা দেখতে আসতি না!
– অর্ক!
কলি চোখ পাকিয়ে অর্কের দিকে তাকায়।কলির ধমকে অর্ক থতমত খেয়ে যায়।মুখ ভার করে বললো,
– সরি,মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।বল কি বলবি।
– তুই তো জানিসই শান্ত আর তনিমার বিয়ের প্রায় এক মাস হতে চলল অথচ এখনো ওদের মধ্যে তেমন কোনো ঘনিষ্ঠতা হয় নি।শান্ত বেচারাকে এখনো আলাদা ঘরে ঘুমাতে হয়।বউয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য বাসর নামক শব্দটি ওর ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারি নি।তনিমা শান্তর উপর রাগ করে শান্তকে ওর ঘরে অবধি ঢুকতে দেয় না।কাল রাতে ওদের বাসর ছিল।মেহেনূরই সবটার আয়োজন করেছে।আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে মেহেনূর আমাদেরকে রাতে বলে নি যে তুই হসপিটালে আছিস।তনিমাদের স্পেশাল রাতটা স্পয়লার হয়ে যাবে বলে রাতে ওদেরকে কিছু জানানো হয় নি।
– ও আচ্ছা এই ব্যাপার!
– হ্যাঁ।আচ্ছা একটা কথা বল তো।
– কি কথা?
– মেহেনূরের ঘরে থাকা ওই সিক্রেট লিফটের কথা তুই কিভাবে জানলি?
কলি প্রশ্নটা করে অর্কের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে।অর্ক ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,
– সে এক লম্বা কাহিনী।পরে একসময় বলবো।এখন বাসায় চল।
অর্ক পরমুহূর্তেই হাসি থামিয়ে অসহায় মুখ করে ফের বললো,
– সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে।কিভাবে সবটা সামলাবো বুঝতে পারছি না।আমাকে একটু সাহায্য কর প্লীজ।
– কি করতে হবে?
…………..
_____________________________
শান্ত আর তনিমা গিয়েছে সুইজারল্যান্ড,হানিমুনে।সুইজারল্যান্ড এ চলে যাওয়ার আগে তনিমা ওহিকে ওর ফোনটা দিয়ে গিয়েছে।ওহি সিঁড়িতে বসে ডগিরাকে কোলে নিয়ে একের পর এক ছবি তুলছে।ছবি তোলার এক পর্যায়ে ওর ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়।ফোনটা পড়ার সাথে সাথে ডগিরাও ঘেউঘেউ করে উঠলো।
রোশনি দুপুরের রান্না করছে।রান্নাঘরে এতক্ষণ মেহেনূরই ছিল।অর্ধেক রান্না মেহেনূর করেছে আর বাকিটা রোশনি করছে।তিন্নিও ছিল মেহেনূরের সাথে।মেহেনূর শাওয়ার নিতে গিয়েছে।বাড়িতে ওহি ছাড়া আর কেউ নেই বলে তিন্নি রোশনির সাথে রান্নাঘরেই আছে।কারণ ও ওহির মুখোমুখি হতে চায় না।ওহিকে ওর একদম সহ্য হয় না।কিন্তু আচমকায় ডগিরার চিৎকার শুনে তিন্নি রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে আসে।তিন্নিকে দেখা মাত্রই ডগিরা দৌঁড়ে গিয়ে ওর কোলে উঠে পড়ে।ঘটনা কি ঘটলো বুঝতে না পেরে তিন্নি ডগিরার মাথা আর শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– কি হয়েছে ডগিরা?তুমি…….
তিন্নি ওর কথা শেষ করার আগেই ওহিকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে কপাল সংকুচিত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।ওহি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।তিন্নি ওহির দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখে ওর কাছ থেকে তিন চার ফুট দূরত্বে ওহির ফোনটা পড়ে আছে।তিন্নির আর বুঝতে বাকি রইলো না এখানে কি ঘটেছে।ফিক করে হেসে উঠলো তিন্নি।তিন্নির হাসির শব্দ শুনে মৌনতা ভেঙে মুখ তুলে তাকালো ওহি।প্রথমে তিন্নির দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেও রাগটা বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না।তিন্নির হাসি মাখা মুখটা দেখতেই ওহির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।নিজের অজান্তেই ডান হাতটা গালে দিয়ে এক ধ্যানে অতিবাহিত করলো কয়েক মুহূর্ত।একপর্যায়ে ওহির দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলো তিন্নি।ওহিকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি থামিয়ে দেয়।ওহির ওইরূপ চাহনিতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে ওর।ভ্রুকুটি করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ভেংচি দিয়ে তিন্নি ওখান থেকে চলে যায়।
– ওহি?
মেহেনূরের ডাকে ওহির ভাবনায় সুতো ছিড়ে।তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ালো ওহি।চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো তিন্নি অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে।মেহেনূরের দিকে ঘুরে মৃদুস্বরে বললো,
– জ্বি আপু,কিছু বলবেন?
– এখানে ওইভাবে বসে আছো কেন?
– না আসলে ডগিরাকে নিয়ে ছবি তুলছিলাম……..
ছবির কথা বলতেই ফোনের কথা মনে পড়ে ওহির।হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে এসে ভাঙা ফোনটা হাতে নিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো,
– ডগিরাকে নিয়ে ছবি তুলছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে ফোনটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে।
মেহেনূর উপর থেকে নেমে এসে ওহির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে এপিঠ-ওপিঠ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে স্মিত হেসে বললো,
– কোনো ব্যাপার না!যাও গিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো।দুপুরের খাবার খেতে হবে না?
ওহির মন খারাপ দেখে মেহেনূর গলা খাঁকারি দিয়ে চাপা স্বরে বললো,
– কনসার্ট দেখবে?
ওহির চোখ চকচক করে উঠলো।মেহেনূরের কথার প্রত্যুত্তরে শুধু উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– লাইভ কনসার্ট?
– সারপ্রাইজ!
মেহেনূর ফিসফিস করে বললো।মেহেনূরের কথা শুনে ওহি মুখ ছোট করে কিছু একটা ভাবতে লাগলো।ওহি এই কদিনে এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে,মেহেনূরের সারপ্রাইজ মানেই বেশ বড়সড় কোনো ধামাকা।তাই ও মেহেনূরকে ফিরতি কোনো প্রশ্ন না করে নির্বিকার ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।মেহেনূর ওহির মুখের অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হেসে চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই ওহি অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
– আপু ফোনটা দিয়ে……
– এটা দিয়ে তোমার কোনো কাজ নেই।সব সময় এত ফোন ফোন করো কেন হুম?যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।
মেহেনূরকে কড়াগলায় কথা বলতে শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ওহি।মেহেনূর ওহির অগোচরে মুখ টিপে হাসছে।মেহেনূরের এমন হুট করে রেগে যাওয়ার উৎস সন্ধানে বিভোর হয়ে আছে ওহি।মেহেনূর ওহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ পাকিয়ে ফের বললো,
– কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও।
ওহি আর কিছু বলতে পারলো না।চুপচাপ সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে চলে যায়।মেহেনূর ওর হাতে থাকা ফোনটার দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।ফোনটা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে।মেরামত করালেও পুরোপুরি ঠিক হবে না।পরমুহূর্তেই আরেক দফায় দীর্ঘ শ্বাস টেনে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– ভাবী লাঞ্চের জন্য রোশানকেও ডেকে নিও।আমার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছি না তাই ওকে কল দিতে পারি নি।আর শোনো আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ফিরতে দেরি হতে পারে।
_____________________________
সময় দুপুর আড়াই’টা।মেহেনূর সবে বাসায় ফিরেছে।ডাইনিং টেবিলের দিকে নজর পড়তেই ভ্রু কুঁচকে আসে মেহেনূরের।অর্ক ছাড়া সবাই নিজের মতো করে খাচ্ছে।সবার খাওয়া কতদূর দেখার জন্য টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো মেহেনূর।সবার খাওয়া মাত্র অর্ধেক হয়েছে।টেবিলে খালি থালাটা উপুড় করে রাখা মেহেনূরের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে অর্ক খেতেই আসে নি?সবাইকে খেতে বলে মেহেনূর ওর ঘরে চলে যায়।
ওহি সবার আগে খাওয়া শেষ করে উঠে যায়।এতে ভীষণ অবাক হয় তিন্নি।যদিও মুখে কিছু বলে নি তবে মনে মনে ঠিকই ভাবছে,ওহি আজ এতো চুপচাপ কেন?ফোনটা ভেঙে গিয়েছে বলে?হবে হয়তো!তিন্নি এতকিছু না ভেবে নিজের পাতের অবশিষ্ট খাবারটুকু শেষ করে টেবিল ছেড়ে উঠে যায়।এক এক করে সবাই খাওয়া শেষ করে উঠে যায়।
আজকে মেহেনূরের একটা কনসার্ট আছে।কনসার্টটা টরেন্টো শহর থেকে একটু দূরে।বাসা থেকে একটু তাড়াতাড়িই বের হবে যাতে পরে ওইখানে পৌঁছাতে দেরি না হয়।ঘরে এসে মেহেনূর নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছে।তারপর টেবিলের উপর রাখা একটা কালো রঙের প্যাকেট নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।
ওহি আবার ডগিরার সাথে দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে।দরজার আড়াল থেকে ডগিরা আর ওহির কান্ড দেখে মেহেনূর মিটিমিটি হাসছে।এই ডগিরার সঙ্গ নিতে গিয়েই ফোনটা ভেঙেছে এখন ফের সেই ডগিরার সঙ্গই নিচ্ছে।মেহেনূর বেশ বুঝতে পারছে এখন ওহি কারো কাছেই যেতে পারবে না।দিহাদ বউ নিয়ে ব্যস্ত,অয়ন রোশানকে নিয়ে একটু বেরিয়েছে।রোশনি বাবার বাসায় গেছে।তিন্নির সাথে আড্ডা দেওয়ার তো প্রশ্ন আসে না।বাকি রইলো মেহেনূর।ঘন্টা দুয়েক আগে মেহেনূরের কাছে যে ঝাড়ি খেয়েছে তাতে বেচারা বেশ লজ্জা পেয়েছে।তার ক্ষানিকটা নমুনা ডাইনিং টেবিলেই দেখেছে মেহেনূর।খাওয়ার সময় চুপচাপ ছিল।
মেহেনূর গলা খাঁকারি দিয়ে ওহির ঘরে ঢুকলো।মেহেনূরকে দেখতে পেয়েই ডগিরা দৌঁড়ে গিয়ে মেহেনূরের কোলে উঠে পড়লো।ওহি ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
– আপু,ডগিরাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।ওর শরীরটা খুব গরম,জ্বর এসেছে।গলাটাও কেমন শব্দ করছে,মনে হয় ঠান্ডা লেগেছে।
– আমি ওকে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি,ঠিক হয়ে যাবে।ডগিরার সাথে তো তোমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে দেখছি।
ওহি মেহেনূরের কোল থেকে ডগিরাকে নিজের কোলে নিয়ে স্মিত হেসে বললো,
– ডগিরা দেখতে এতোটাই কিউট যে,যেকেউ ওর সাথে সখ্যতা করতে চাইবে।
ওহির কথার প্রত্যুত্তরে হাসলো মেহেনূর।হাতে থাকা প্যাকেটটা ওহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এটা ধরো।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে চলে আসো।আমরা একটু পরেই বের হবো।আর শোনো,
তখন যে আমি তোমাকে বকা দিয়েছিলাম তার জন্য কি তুমি আমার উপর রাগ করেছো?
– আরে না,কি বলেন আপু।রাগ?তাও আবার আপনার উপর?আপনার উপর কেউ রাগ করতে পারবে?আপনি তো আপনার উপর রাগ করার মতো কারণ বা সুযোগ কোনোটাই আপনি রাখেন না,তাহলে কিভাবে রাগ করবো বলুন তো।
– তাহলে নিশ্চয়ই লজ্জা পেয়েছো?
– হ্যাঁ,একটু!
ওহির অপকটে সত্যি কথা শুনে হেসে দেয় মেহেনূর।পরমুহূর্তেই মেহেনূর কোমল স্বরে বললো,
– এতো লজ্জা পেতে হবে না।ভাই বোনদের সম্পর্ক গুলো এমনই হয়।টক,মিষ্টি,ঝাল মিলিয়ে দুষ্টু মিষ্টি একটা সম্পর্ক।আমিও তো তোমার বোনই হই।তখন তোমার সাথে একটু দুষ্টুমি করেছিলাম।আচ্ছা আসছি আমি,তুমি জলদি রেডি হয়ে চলে আসো।
– প্যাকেটে কি আছে আপু?
– আমার ভাইয়ের মুখের এক টুকরো হাসি!
মেহেনূর চলে গেছে।দরজার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে ওহি।এই মেয়েটা কিভাবে যেকোনো বিষয় খুব সহজেই সামলে নেয়?ছোট থেকে বড়,সবার দিকে তার নজর।কি সুন্দর করে আমার ভাই বললো।যদি কেউ ওদের দেখতো তাহলে অবলীলায় বলে দিতো,তারা হয়তো সত্যিই আপন ভাই বোন।ওহি হাতের প্যাকেটটা দেখে ফিচেল হাসলো।মেহেনূর তাহলে ওর ফোনটা মেরামত করে ফেরত দিয়েছে!ফোনটা তো সরাসরি ওর হাতে দিলেই হতো।বক্সের ভেতরে করে দেওয়ার কি দরকার ছিল!প্যাকেটের ভেতর থেকে বক্সটা বের করতেই ওহির চক্ষু চড়াকগাছ।মেহেনূর ওকে নতুন একটা ফোন দিয়েছে।বক্সের উপরে ছোট একটা নীল রঙের চিরকুট লাগানো।ওহির চিরকুটটা হাতে নিয়ে থম মেরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।“কেউ ভালোবেসে কিছু দিলে সেটা নিতে হয়,আপত্তি করতে নেই”লেখাটা চোখে পড়তেই ওহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে পড়লো।এই কথার প্রত্যুত্তরে আর কোনো কথাই থাকে না।ওহি আজ জীবনের প্রথম একটা বোনের অভাব ফিল করছে।ওরো যদি মেহেনূরের মতো একটা বোন থাকতো তাহলে কতো ভালো হতো!ওকে কত আদর করতো,ভালোবাসতো।
চলবে…