অঙ্গারের নেশা | পর্ব – ৯

7 Min Read

প্রতিদিনের তুলনায় আজ একটু দ্রুতই ফিরে এলো বাড়িতে সুফিয়ান। মিসেস অদিতি ড্রইংরুমে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। সুফিয়ানকে বাসায় তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। মনে মনে ভয় পাচ্ছেন তিনি, সুফিয়ানকে প্রানেশা বলে দেয়নি তো?
সে ভেবেছিলো এসে তাকে সবার প্রথমে ধরবে সুফিয়ান। কিন্তু, সুফিয়ান ভেতরে ঢুকে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক প্রানেশা তাহলে কিছু বলেনি!
সুফিয়ান সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় নিজের রুমে ঢুকতেই দেখলো রুম ফাঁকা। ভ্রু কুচকে খানিক এদিক ওদিক তাকালো। ওয়াশরুমের দরজাও তো খোলা। তাহলে, কী প্রাণ তাকে ছেড়ে চলে গেলো! ভেবে সুফিয়ানের মুখ হিংস্র হয়ে উঠলো। এই মুখ যদি প্রানেশা তাহলে হয়তো তার ভয়ে কলিজা বেরিয়ে যেতো। সুফিয়ানের কপালের রগ টানটান হয়ে উঠলো। রুম থেকে বেরোনোর জন্য উদ্যত হতেই বারান্দার থেকে কিছু পড়ার শব্দ এলো। মাথা ঘুড়িয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখলো প্রানেশা দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজ মনেই ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। প্রানেশা তাকে ছেড়ে যদি যায় তাহলে সেদিনই হবে প্রানেশার শেষ দিন। বারান্দায় নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিরবির করে বললো –
‘ প্রাণ,আমি তোমায় এমন ভাবে নিজের সঙ্গে জড়াবো যে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পথ পেয়েও তুমি যেতে পারবেনা অথবা এই সুফিয়ান তোমায় যেতে দেবে না’
হাস্যজ্জল ভঙ্গিতে সেদিকে পা বাড়ালো সুফিয়ান। প্রানেশা দোলনার ফাঁক গলিয়ে বাহিরের মৃদুমন্দ হাওয়া উপভোগ করছিলো। গায়ে গোলাপি রঙের সুতি থ্রি পিস। এক পাশে ওরনা জড়ানো। বাতাসে পিঠে বিছিয়ে থাকা চুলগুলো থেমে থেমে উড়ছে। সুফিয়ান এসে দোলনায় বসতেই কারো অস্তিত্ব অনুভব করলো প্রানেশা। কিন্তু কিছু না বলে চুপচাপ মাথাটা সুফিয়ানের বুকের উপর রাখলো। সুফিয়ান একটু নয় বেশ খানিকটা অবাক হলো। প্রানেশা, কারো উপর যতই রাগ থাকুক, ঘৃণা করুক, কথা না বলে কখনোই থাকে না। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে বাচ্চাদের মতোন হাঁপিয়ে ওঠে। ভাঙ্গা রেকর্ডারের ন্যায় বাজতেই থাকে। আজ কোনো কথা বললো না এতে অবাক হওয়ারই কথা। সুফিয়ান বার কয়েক ডাকলো-
‘প্রাণ? ‘
‘প্রাণ, কথা বলবেনা? ‘
প্রানেশা চোখ বন্ধ করে নিরুত্তর বসে রইলো। সুফিয়ানের সঙ্গে কথা বলার পর অনেকটা সময় তার মনটা ফুরফুরে ছিলো। ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘর থেকে কফি করতে গেছিলো। সেসময়ই রেয়ানও এসেছিলো। প্রানেশা কোনো কথা না বলে চলে আসতে নিলেই, রেয়ান তার পা ধরে বসে পড়লো। প্রানেশা হকচকিত হয়ে দুই কদম সরে গেলো।
‘এসব কী রেয়ান! সরো বলছি’
রেয়ান হুহু করে কাঁদলো। পায়ে দুবার ঠোঁট ছুঁইয়ে অনুতপ্ত ভরা ভাঙা কন্ঠে বললো –
‘ক্ষমা করে দাও প্রানেশা, আমি সেসময় খুব রেগে গেছিলাম। তোমায় প্রতিদিন ওর সাথে দেখলে আমার ভেতর জ্বালাপোড়া হয়, কলিজা ছেড়ার মতোন ব্যাথা হয়। তাই, হানিমুনের কথা শুনে খুব রেগে গেছিলাম। ক্ষমা করে দাও। আমার কাছে ফিরে এসো প্লিজ, আমি তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো ‘
প্রানেশা চোখ জ্বলা শুরু হলো। সত্যি সত্যি মনে পড়ে গেলো, সেই রাত জেগে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেমালাপ। প্রথম গান শোনানো, হাজারো পথ পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখা, বিয়ের পর ঘোরাঘুরি করতে যাওয়ার পরিকল্পনা। একের পর এক চোখে ভাসতে লাগলো স্মৃতির পাতা। হঠাৎ করেই মনে পড়লো, সে বিবাহিত। এখন একজনের স্ত্রী। তাকে জড়িয়ে আছে অনেক গুলো সম্পর্ক। ভালোবাসার একজন মানুষ। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দ্রুত পদে নিজের রুমে এসে পড়ে প্রানেশা। নরম হলে তার চলবেনা, আজকের ঘটনা তার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছে৷ নতুন করে সব শুরু করার জন্য কয়েক পা এগিয়েছে প্রানেশা, ফিরে আসার পথ নেই। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে ঘরে এসে দোলনায় বসেছিলো তারপর তিন ঘন্টা হয়ে গেছে সেভাবেই বসে আছে সে৷
সুফিয়ান খেয়াল করলো তার শার্টের পাশটা ভেজা ভেজা লাগছে। চমকে প্রানেশার গাল উঁচু করে দেখতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো । চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে, আর জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে দু পাশ বেয়ে৷ ভীষণ বিচলিত হয়ে উঠলো সুফিয়ান৷ এমন ভাবে কান্না তখনই করে যখন খুব কষ্ট পায় প্রানেশা। চঞ্চল বৈশিষ্ট্যের হলেও ভেতরে বেশ চাপা স্বভাবের সে। সবার সামনে নিজের দুঃখ প্রকাশ করেনা কখনো।প্রানেশা গাল মুছে দিয়ে ব্যাথিত গলায় সুফিয়ান বললো –
‘কী হয়েছে প্রাণ? এমন করে কান্না করছো কেনো! কেউ কিছু বলেছে তোমাকে! নাম বলো, শেষ করে দেবো তাকে ‘
প্রানেশা সেভাবেই চোখ বন্ধ করে অশ্রু ঝড়াচ্ছে।সুফিয়ান ব্যস্ত হয়ে প্রানেশাকে আদর করে বললো –
‘কী হয়েছে প্রাণের? আমাকে বলবেনা? ‘
প্রানেশা ছোট বাচ্চার ন্যায় সুফিয়ানের গলা জড়িয়ে কোলে বসলো। সুফিয়ান দুই হাতে জাপটে ছোট পাখির মতো৷ কিছুক্ষনের মধ্যেই কান্না থামিয়ে সোজা হয়ে বসলো প্রানেশা। সুফিয়ানকে অবাক করে আদুরে বিড়াল ছানার মতো মাথা গুঁজে শুয়ে পড়ে সুফিয়ানের কোলের উপর। সুফিয়ান সযত্নে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। প্রানেশা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো –
‘ফ্রেশ হননি?’
সুফিয়ান বুঝতে পারলো প্রানেশা কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। পুরোনো কোনো কথা আর মনে করিয়ে দিতে চাইলো না। তাই সেও স্বাভাবিক ভাবে বললো –
‘না, মাত্রই এলাম। এই শীতে এভাবে বসে আছো কেনো?’
প্রানেশা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো-
‘আর কিছু বললেন না তো!’
‘কিসের ব্যাপারে?বালি?’
‘হু’
‘সব যদি বলেই দেই তাহলে গিয়ে কী লাভ! কালই সব দেখো ‘
প্রানেশা লাফিয়ে উঠলো, বাচ্চাদের মতোন তালি দিয়ে বললো –
‘সত্যিই! কাল কখন যাবো? ‘
সুফিয়ান হেসে বললো –
‘কাল সকাল সাতটায় রওনা হবো, বালিতে গেলে পাসপোর্টের কোনো ঝামেলা নেই। যত আগে বুকিং দেয়া যায় তত ভালো, যদিও আমি মাত্র তিন দিন আগে দিয়েছি। আমরা সিঙ্গাপুর ট্রেনজিটে যাবো, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি বালির কোনো ফ্লাইট নেই তাই ‘
প্রানেশা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো –
‘কাল সকালে গেলে তো অনেক কাজ বাকি! আমি তাহলে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নেই ‘
‘হ্যা যাও, আমি ফ্রেশ হয়ে এসে হেল্প করছি ‘
প্রানেশা লাফিয়ে চলে যাচ্ছিলো কী মনে করে যেনো পিছিয়ে এসে বললো-
‘শুনুন ‘
সুফিয়ান সামনে তাকিয়ে দেখতেই প্রানেশা ফট করে গাল চুমু খেয়ে ‘থ্যাংক ইউউ’ বলে এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। সুফিয়ান হা করে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে হেসে উঠলো। অস্ফুটস্বরে বললো –
‘আমার পাগলী’

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।