এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা | পর্ব – ৫৪

9 Min Read

সময় টা শীত কাল।কচুপাতার নিচে শীতের আগমণ মাত্রই শুরু হয়েছে।কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে শীত একটু একটু করে প্রবেশ করছে শহরে।সকালে দূর্বাঘাসের উপরশিশিরের বিন্দু বিন্দু জল জমতে শুরু শুরু হয়েছে, রোজ সকালে প্রকৃতি কুয়াশার স্রোতে গোসল করে স্নিগ্ধ হচ্ছে।সময় টা বড্ড ই মিষ্টি।ছয়তলাবিশিষ্ট বাড়িটার তিনতলার পশ্চিমপাশের ফ্যাট টা ভাড়া নিয়েছি আমরা।নিজের স্বপ্ন সত্যি করতে নিজের স্বপ্নের শহর নড়াইল ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছি আমি আর রিয়া।কত শত স্মৃতির সাক্ষি নড়াইল শহর।কোলাহলপূর্ণ যান্ত্রিক শহর টা এসেই মানিয়ে নিতে পারছি না।ভীষণ মিস করছি ফেলে আসা গাছে বাঁধা দোলনা টা,ছুটে ছুটে মামির কাছে চলে যাওয়া,কাজিন দের নিয়ে বিশাল আড্ডার আসর, ঘোরাঘুরি। এখানে এসছি সাতদিন হয়েছে আম্মু আর কাকিমনি ও এসছে কিছুদিন থাকার জন্য।হঠাত করে নতুন জায়গা এক থাকা সম্ভব হবে না আর সব কিছু গুছিয়ে নিতেও কষ্ট হবে আর হুট কফ্রি অচেনা শহরে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার ও আছে। চারপাশের মানুষ গুলাকে দেখে মাঝে মাঝে লজ্জা ও পাচ্ছি আবার লজ্জায় ও পড়ছি মানুষ এখানে কত স্মার্ট তাদের সাজ গোজের ধরণ ই আলাদা সেখানে রিয়া আর আমি অতি সাধারণ দুইটা মেয়ে।কিছু কিছু আল্ট্রা মডার্ণ মেয়ের পোশাক দেখে লজ্জায় নাক কাটা যাচ্ছে।দুনিয়ায় কত ধরণের রুচির মানুষ আছে তা এই রঙিন শহর ঢাকায় না আসলে বুঝতাম না।আমাদের ফ্ল্যাটের পাশেই বিহান ভাই এর ফ্ল্যাট।পাশাপাশি একটা বিল্ডিং এ উনি থাকেন।আমাদের বেলকণি থেকে উনাকে দেখা যায় উনার বেলকণি।খুব একটা দূরত্ব না।কথা বললে শুনতে পাবেন বেলকণি থেকে চোখাচোখি হয় উনার সাথে।
আজ প্রথম মেডিকেল কলেজে আমাদের ক্লাস।রিয়া গোসল করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে গিয়েছে আমিও রেডি হয়ে গিয়েছি।অনেক এক্সাইটেড দুজনেই প্রথম ক্লাস দুজনেই ভীষণ নারভাস।বাসার পাশেই কলেজ।ক্লাস শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগেই রওনা হয়েছি আমরা দুজন।রাস্তায় যেতেই রিয়া বিভোর ভাই কে ভিডিও কল দিলো।বিভোর ভাই এর মন টা ভীষণ খারাপ।সাত দিন রিয়াকে দেখে না বিভোর ভাই।সারাদিন দেখা হয়েছে ঝগড়া করেছে আবার প্রেম করেছে অনেক ভাল ভাল স্মৃতি রয়েছে দুজনের।এই কষ্ট টা হওয়াটা স্বাভাবিক।বিভোর ভাই এর মুখ টা মেঘাচ্ছন্ন কালো গুমট আকাশের মতো।মনে হয় রুমেই সুয়ে আছেন বিভোর ভাই।
রিয়া শান্ত কন্ঠে বললো,ভাল আছেন আপনি?
বিভোর ভাই চাপা কাঁন্না আটকে বললেন হুম।তুমি?
আপনি ছাড়া আমি কেমন থাকি জানেন না।কথাটা বলেই রিয়া চোখের পানি ছেড়ে দিলো।গত সাতদিনে রিয়ার ও ভীষণ কষ্ট হয়েছে বিভোর ভাই এর জন্য।দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া আর মান অভিমানের গল্প ওদের দুজনের।
বিভোর ভাই এক নজরে তাকিয়ে আছেন রিয়ার দিকে।রিয়া আবার ও বললো আপনি কি কিছুই বলবেন না।এইভাবে থাকলে আমি প্রথম ক্লাস টা করতে পারবো নাহ।প্লিজ কিছু বলুন।
তোমায় ভীষণ মিস করছি রিয়া।গত সাত দিন মনে হয়েছে এ শহর অনুভুতি হীন।এ শহরের প্রাণ নেই।ভালবাসাহীন হয়ে পড়েছে এ শহর।তোমার শূণ্যতা আমাকে কাঁদাচ্ছে রিয়া।তোমাকে দেখার এই ভীষণ ইচ্ছা নিয়েই বোধহয় আমার মৃত্যু হবে।আমি যেদিকে তাকাচ্ছি মনে হচ্ছে এই বুঝি তুমি এসেই কোমরে হাত বেঁধে ঝগড়া শুরু করবে।চোখ অফ করলেই তোমাকে দেখছি।তোমাদের বাড়িতে যত বার গিয়েছি প্রতিটি কোনায় কোনায় মনে হয়েছে তুমি দাঁড়িয়ে হাসছো।
রিয়া বললো আমি আছি কখনো একা ভাববেন না নিজেকে।আমি বাস্তবেও আছি আর কল্পনাতেও আছি।আপনাকে ঘিরে আমার যে অনুভূতি তা কখনো শূন্য হবে না।প্লিজ মন খারাপ করবেন না।
তোমার মুখ টা দেখার পর সব মন খারাপ শেষ হয়ে গিয়েছে।তুমিও কখনো মন খারাপ করো না।মন দিয়ে লেখাপড়া করবে রিয়া।আমি তোমার পাশে আছি অলওয়েজ আছি রিয়া।খুব শিঘ্রই ঢাকা আসবো রিয়া।
আই লাভ ইউ বিভোর
আই লাভ ইউ ঠু রিয়া।
ফোন টা কেটে রিয়া আমার দিকে তাকাতেই বললাম,আমার মতো সিঙ্গেল এর সামনে এইভাবে প্রেম করিস না রিয়া।আমার খুব ই জ্বলে।
“তুই সিঙ্গেল দিয়া।”
“আমাকে দেখে বুঝিস না।”
“বিহান ভাই কে তাহলে।”
“তোদের বিহান ভাই ওর সাথে রিলেশন এ থাকা আর কলাগাছের সাথে রিলেশন এ থাকা এক ই কথা।আমাকে কি তার প্রেমিকা বলে কোনো কেয়ার করে।সে এখন মারাত্মক বিজি।আচ্ছা রিয়া বয়ফ্রেন্ড হবে বয়ফ্রেন্ড এর মতো সে এত বিজি থাকবে কি জন্য। দেখ আমাদের রুমের পাশের রুমে যে একটা আপু আছে সারাদিন উনার বয়ফ্রেন্ড এসে দাঁড়িয়ে থাকে।আর বিহান ভাই কে দেখ এই যে এসছি সাত দিন আম্মুর সাথে কথা বলছে, বাসায় আসলো আমার সাথে কি একটু পারসোনাল কথা বলেছে।আমি যে ঢাকায় এসছি তার মধ্য বাড়তি ফিলিংস কই।”
“বিহান ভাই আনকমন মানুষ। উনি দেখিয়ে কিছু করেন না।যা করেন উনার সময় মতো।তোর চান্স পাওয়াতে উনি যে ভাবে সেলিব্রেশন করলেন বাবাহ।দশ পাউন্ড কেক আনলেন সবাইকে খাওয়ালেন, কত মানুষ কে ইনভাইট করলেন কত খুশি ছিলেন দুই দিনে ভুলে গিয়েছিস।”
“ভুলি নি উনাকে মিস করছি তাই রাগ করছি।”
“বিহান ভ্যাই ম্যাজিকের সাহায্য রাগ পানি করে দিবেন।”
কলেজে প্রবেশ করেই চোখে তাক লেগে গেলো।ওয়াও এত টা সুন্দর বিহান ভাই এর শহর।এই কলেজ টা মানেই আমার কাছে বিহান ভাই এর দেশ।ক্লাস রুমে প্রবেশ করেই শুনি এখানে একজন প্রফেসর আছে অনেক হ্যান্ডসাম আর ইয়াং।প্রফেসর টা নাকি নতুন এবং এই কলেজের ই স্টুডেন্ট ছিলেন।ঠিক বুঝতে পারছি না কোন প্রফেসর এর কথা বলাবলি হচ্ছে।লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসলাম আমি আর রিয়া।ক্লাস রুমের সবাই তাদের হ্যান্ডসাম প্রফেসর কে নিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে।কেউ কেউ বলছে জীবনে কোনো হিরোকেও এতটা কিউট দেখিনি আমি।স্যার তো না পুরাই ড্যাশিং আগুন একটা।উনি কি ম্যারেড উনার কি গফ আছে বিভিন্ন সমালোচনা চলছে।আমি আর রিয়া অবাক হয়ে প্রফেসর কে নিয়ে তাদের এই অদ্ভুত সমালোচনা শুনে যাচ্ছি।
এমন সময় ক্লাস রুমে ম্যাম এসে প্রবেশ করলেন।এই ম্যামকে দেখে আমার মাথা চক্কর মেরে উঠলো প্রেয়সী আপু।উনি আমাদের ক্লাস নিবেন।ওহ মাই গড। রিয়া আর আমি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই প্রেয়সী আপুতো আমাকে সহ্য ই করতে পারেন না।উনার ক্লাসে দেখে না জানি কত রিয়্যাক্ট করবেন।প্রেয়সী আপু সবার নাম জিজ্ঞেস করে পরিচয় নিলেন।সবার লাস্টে আমার কাছে এলেন আমার দিকে ঈর্ষাত্মক নয়নে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইলেন।আমি উঠে দাঁড়িয়ে রইলাম উনি আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করছেন না।বাকিরা হা করে তাকিয়ে আছে। সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন তোমার নাম?
ম্যাম দিয়া খাঁন।
ক্লাস শেষে দেখা করো আমি লাইব্রেরীতে থাকবো।
স্বভাবসুলভ একটা হাসি দিয়ে বললাম জ্বী ম্যাম ঠিক আছে।
প্রেয়সী ম্যাম ক্লাস টা নিয়ে বেরিয়ে গেলে আমি রিয়াকে বললাম উনি আবার আমাকে উলটা পালটা বলবেন নাতো।
আরে বললেই বা কি।হাইয়ার অথোরিটি বিহান ভাই এর কাছে অভিযোগ দিবো না।চিন্তা কিসের।
এমন সময় ক্লাসে প্রবেশ করলেন প্রফেসর বিহান ভাই।পরণে কালো জুতা,কালো জিন্স, কালো শার্ট,গায়ে সাদা এপ্রোণ, এক হাতে ঘড়ি বাঁধা আরেক হাতে একটা বই।ক্লাসে ঢুকেই সালাম দিলেন।আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি কয়েকশ ভোল্টেজ এর ক্রাশ খেয়ে ফেল্লাম তার ঠিক নেই।মুহুর্তের মাঝেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি।উনার ক্লাস আছে উনি তো বললেন না।উনার ক্লাসে তো ফাঁকি ও দেওয়া যাবে না।ক্লাসের ছেলে মেয়ে উভয় ই হা হয়ে তাকিয়ে রইলো বিহান ভাই এর দিকে।মেয়ে গুলোর চোখে মুখে কি এক্সপ্রেসন সব টাই যেনো বিহান ভাই দিকে।মেয়েরা কি ক্লাসে মন দিতে পারবে।সবাই বলাবলি করছে এই সেই স্যার।মানে তারা বিহান ভাইকে নিয়ে এত কিছু বলছিলো।এইদিকে বিহান ভাই এর কোনো পাত্তাই নেই কে তার দিকে কিভাবে তাকিয়েছে সে ব্যাপারে।উনি উনার গম্ভীর মুডেই আছেই।বিহান ভাই সবাইকে সালাম দিলেন।বাকিরা সালামেএ উত্তর দিলো।আমার সামনে বেঞ্চের মেয়েটা যেনো আল্ট্রা মডার্ণ।উনি বিহান ভাইকে বলছেন হাউ কিউট,সো হট,আই লাইক ইট।বিহান ভাই সমার নাম জিজ্ঞেস করে আমার সামনে বেঞ্চের মেয়েটার কাছে এসে বললেন,আপনার নাম কি?
অনিকা সিকদার স্যার?সবাই অনি ডাকে আপনিও প্লিজ অনি ডাকবেন।কথা টা শুনেই বিহান ভাই ভীষণ বিরক্ত হয়ে গেলেন।বিহান ভাই রাগান্বিত মুডে তাকিয়ে বললেন সবাই কি আপনার কলেজের প্রফেসর। সবাই কি বলে ডাকলো সেটা কি আপনার কলেজের প্রফেসর ও ডাকবে?নেক্সট টাইম আমার ক্লাসে অযাযিত কথা বলবেন না।নাউ সিট ডাউন।
“এরপর ই বিহান ভাই আমার সামনে এলেন।এপ্রোনের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন।ভ্রু যুগল কিঞ্চিত উঁচু করে বললেন স্ট্যান্ড আপ।”
“উনার দিকে হা করে তকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি।”
“আপনার নাম কি?”
“দি দি দিয়া স্যার।”
“দি দি দিয়া?”
“না স্যার শুধুই দিয়া।”
“এত নারভাস কেনো আপনি?কিছু হয়েছে।”
“না না না স্যার কিছু হয় নি।এমনি নারভাস।”
“টিচার ক্লাসে আসলে আর টিচারের সাথে কথা বলার সময় উঠে দাঁড়াতে হয় জানেন না।”

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।