অফিডিয়ান | পর্ব – ২৮

20 Min Read

৩২. সূর্য পশ্চিম দিকে ডুবে যেতে শুরু করেছে। পাখিরা নিজেদের ভেতর কলহ বিবাদ শেষে যার যার নীড়ে ফিরছে। কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আযানের সাথে সাথে রাতের আরম্ভের সুচনা হবে।
রুমাইশা বসে আছে তার রুমের বিছানায়। মন টা ভালো নেই ওর। সেই ঘটনার পর তিন দিন পার হয়ে গেছে। এই তিন দিনে শামসুল বা আয়েশা কেউই ওর সাথে ভালো করে কথা বলেননি। প্রচণ্ড খারাপ লাগছে ওর। বাবা মায়ের ওর ওপর এই অভিমান ও আর নিতে পারছে না৷ বার বার মনে হচ্ছে বাবা বকুক, মা মারুক, তবুও কথা বলুক। কিন্তু তা হচ্ছে না। আয়েশা শামসুল দুজনেই ওর সাথে অপরিচিতের মতো আচরণ করছেন। রুমাইশা ও কোনো উপায় না পেয়ে চুপচাপ হয়ে আছে।

গতকাল ও আয়েশার সাথে কয়েক বার কথা বলতে গেছে। কিন্তু আয়েশা গুটিকয়েক কথা ছাড়া আর কিছুই বলেননি।
তাছাড়া আজ সকালে রাফসানের সাথে আয়েশা এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাফওয়ানের এমন কাজে রাফসান ও প্রচন্ড রেগে আছে। সাফওয়ানের থেকে বেশি রাগ লেগেছে ওর রুমাইশার ওপর।

সকালে ফোন টা লাউডে রেখে রুমাইশা কে শুনিয়ে শুনিয়ে রাফসানের সাথে কথা বলেছেন আয়েশা, যেন রাফসানের বকা গুলো রুমাইশা ভালো ভাবে শুনতে পায়, আর ভাইয়ের রাগ টাও ভালো ভাবে টের পায়।

রুমাইশা ও শুনেছে সব নিজের রুমে বসে বসে৷ কিন্তু কিছুই বলেনি। সাফওয়ান কে কিছু কিছু জানিয়েছে। কিন্তু সাফওয়ান বলেছে কোনো কথা না বলে চুপচাপ থাকতে, ও-ও সেটাই করছে। নিরাবতা পালন করে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করছে। বাবা মা কে মানানোর চেষ্টা করছে।

রাফসান বাসায় আসবে আগামী পরশু। এসে এসবের একটা বিহিত করবে সে৷ যা-ই করুক সাফওয়ানের সাথে কখনোই রুমাইশার বিয়ে হতে দেবে না৷

রুমাইশা নিজের রুমে বসে মনে মনে শুধু প্রার্থনা করছে যেন এই সমস্যা গুলো দ্রুতই সমাধান হয়ে যায়, সবাইকে নিয়েই যেন ও সারাজীবন সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। কারো সাথে যেন ওর বা ওর পরিবারের সম্পর্ক নষ্ট না হয়, সব কিছু যেন ভালোয় ভালোয় হয়ে যায়। সাফওয়ান যে কয়টা দিন বেচে আছে সে কয়টাদিনের সম্পুর্ন সময়টা যেন ও সাফওয়ান কেই দিতে পারে, ওর জীবনে যেন কোনো অপুর্ণতা না থেকে যায়। কোনো আফসোস নিয়ে যেন ও এই পৃথিবী ত্যাগ না করে!

এসব ভাবতে ভাবতে চোখ দুইটা ঝাপসা হয়ে এলো ওর। মাগরিবের আযান পড়লো এমন সময়ে। দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাড়ালো রুমাইশা। বাইরে কলপাড়ে গেলো ওজু করতে৷ ওজু করে এসে নামাজে দাড়ালো৷

“””

রাত এখন আট টা বেজে পয়তাল্লিশ। সাফওয়ান গত কয়েক দিন ধরে খুব ভালো ফিল করছে। স্মৃতিভ্রমের যে সমস্যা টা হচ্ছিলো সেটাও কয়েকদিন আর হয়নি৷ আজ কালের ভেতরেই ওর খোলস ছাড়ার কথা, সেদিন ও চামড়া খসখস করছিলো, কিন্তু আজ কে সেটা ফিল করছে না। ব্যাপার টা কি দেখার জন্য সাফওয়ান ওর রুমের ভেতর রাখা ফুল ভিউ মিররের সামনে গিয়ে দাড়ালো, তারপর নিজের পরনের ফুল স্লিভ টি শার্ট টা খুলে ফেললো।

নিজেকে আয়নায় দেখে অবাক হয়ে গেলো সাফওয়ান। ওর গায়ের চামড়ার খসখসে অবস্থা টা আর বোঝা যাচ্ছে না! সাফওয়ান একবার নিজের কব্জির উপরের অংশ পরখ করলো, খসখসে হয়ে ওপরে ভেসে থাকা চামড়া গুলো সাফওয়ান কে বিস্মিত করে দিয়ে নাই হয়ে গেছে। সাফওয়ান ভেবে পেলো না কি হলো হঠাৎ করে৷

কনুইয়ের দিকটাতে অল্প একটু ভেসে ওঠা চামড়া দেখতে পেলো ও।
সেটা ধরে টান দিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করলো সাফওয়ান৷ কিন্তু উঠলো না, উলটো ব্যাথা পেলো ও৷ চামড়া গুলো আবার গায়ের সাথে লেগে গেছে, স্বাভাবিক চামড়ার মতো। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? এর আগে তো কখনো এমন হয়নি! সাফওয়ান ভ্রু দুইটা কুচকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো, কিভাবে হলো এমন? তারপর দ্রুত গতিতে খাতা কলম নিয়ে বসে গেলো স্টাডি টেবিলে।

একে একে লিখতে থাকলো গত কয়েক সপ্তাহে ও কি কি খেয়েছে।
সবগুলো দিন মায়ের হাতের রান্নাই খেয়েছে, একদিন শুধু রিমু দের বাসায় খেয়েছে৷ রিমু বাড়ি যাওয়ার আগের রাতে হাঁসের মাংস খেয়েছে, কিন্তু সেটা তো ও আগেও একদিন খেয়েছে, সেদিন তো কিছু হয়নি। তারপর, তারপর!
ও কি কোনো মেডিসিন নিয়েছে এর ভেতরে? না মনে পড়ছে না তেমন কিছু, ওর তো রোগ বালাই হয় না বলতে গেলে। ইমিউন সিস্টেম ওর পুরো ম্যাক্স লেভেলের। কোনো মেডিসিন নেওয়া হয়নি এর ভেতর। তাহলে কি?
কোনো কিছু ইনহেল করেছে এর ভেতর? নাহ, কোনো পারফিউম ইউজ করেনি, কোনো ইনহেলার ও নেয়নি, তাহলে কি? কি হলো? এরপর একদিন রিমু দের বাসায় খেয়েছে। কিন্তু সেটা তো অনলি মাংস! তাহলে কি? তাহলে আর কি?

রিমু কে চুমু খেয়েছিলো ও। হ্যা, ও রিমু কে চুমু খেয়েছিলো, যা এই জীবনে এই প্রথম বার! তাহলে কি! তাহলে……
কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? চুমু তে কি কেউ কখনো ঠিক হয়? এর মাঝে কাহিনী আছে কোনো নিশ্চই, সেটা সিউর হতে ওর এখনি রিমুর সাথে দেখা করা লাগবে৷

সাফওয়ান উঠলো চেয়ার ছেড়ে, তারপর মা কে কল লাগিয়ে বলল,
— মা, আমি একটু বেরোচ্ছি। আমার খাবার টা আমার রুমের ভেতরে রেখে যেও, আমি এসে খেয়ে নেবো।

রুনিয়া সম্মতি জানাতেই কল কেটে দিলো সাফওয়ান। তারপর ড্রয়ার থেকে গাড়ির চাবি টা নিলো। ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে বাইরে বেরোলো। তারপর গাড়ি নিয়ে সোজা গেলো ওর ল্যাবের রাস্তায়৷ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুর্ব দিকে গাড়ি নিয়ে চলল সাফওয়ান। গন্তব্যে পৌছে গাড়িটা উত্তরের জঙ্গলের একপাশে পার্ক করে রেখে পায়ে হেটে ঢুকলো জঙ্গলের ভেতর। দশ মিনিটের ভেতরেই চলে গেলো কাঙ্ক্ষিত স্থানে৷

টিনের বেড়া দেওয়া একটি ছোটখাটো ভাঙাচোরা ভুতুড়ে ঘর। ঘর টার হুলিয়া দেখলে কেউ ভয়ে এটার কাছেও আসবে না৷ সাফওয়ান নিঃশব্দে ঢুকলো তার ভেতর। ঘরের ভেতর ঢুকে মেঝের ওপর থেকে শুকনা পাতার আস্তরণ সরালো। সরাতেই বেরিয়ে এলো একটি চারকোনা লোহার দরজা। দরজা টার ওপর হাত রেখে চাপ দিতেই দরজাটা থেকে বের হয়ে এলো একটি টাচ স্ক্রিন।
সেখানে আঙুলের ছাপ চাইলো। সাফওয়ান সেখানে হাত দেওয়ার সাথে সাথেই দরজা টা ক্ষীণ মেটালিক শব্দ করে সরে গেলো একপাশে। দরজা টা সরে গেলে সেখানে ভেসে উঠলো স্টীলের স্টেয়ারওয়ে। সেটা বেয়ে নিচে নামলো সাফওয়ান।

সাফওয়ান নিচে নামতেই চার কোণা দরজা টা আবার আগের মতো শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেলো। এরপর ল্যাবের মেইন দরজা দিয়ে ভেতরে পা দিতেই একটা লেজার রশ্মি স্ক্যান করে নিলো সাফওয়ান কে। ল্যাবের প্রথম অংশটা সাফওয়ান নিজের রুমের মতো করেই সাজিয়ে রেখেছে। বাম পাশের দেয়াল ঘেসে একটা ডাবল বেড বিছানা, বিছানার পাশেই স্টাডি টেবিল, আর তার পাশে রাখা একটি বুক শেল্ফ। বিছানার পায়ের দিকটাতে রাখা আছে একটা সু র‍্যাক আর আলনা। ডান সাইডে একটি ফুল ভিউ মিরর আর বাকি দেওয়াল টা জুড়ে ওয়াল আলমিরা।

সাফওয়ান গিয়ে ওর বুকশেলফের সামনে দাঁড়িয়ে একটা নির্দিষ্ট বই উঠিয়ে টান দিতেই আলমিরা টা মাঝখান থেকে দু খন্ড হয়ে দুদিকে সরে গেলো। আর তারপর ই বেরিয়ে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত ল্যাব। সাফওয়ান ভেতরে পা রাখার সাথে সাথে একটা এআই ভয়েস ওয়েল্কাম জানালো ওকে। সাফওয়ান ভেতরে ঢুকে ল্যাবের টেকনোলজি কম্পার্টমেন্টের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা ডিভাইস নিলো, তারপর অন্য কম্পার্টমেন্ট থেকে নিলো আর একটি ডিভাইস যেটা আগের টার তুলনায় কিছু টা বড়।

এরপর অন্য আর একটা কম্পার্টমেন্ট থেকে নিলো একটি নতুন সিরিঞ্জ। আর ছোট ছোট কয়েক টা কৌটা যার ভেতর কটন বাডের মতো একটি করে কাঠি বিদ্যমান। তারপর সেগুলো একটা ছোট ব্রিফকেসে ভরে বেরিয়ে এলো ল্যাব থেকে।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আবার গাড়ির কাছে এলো সাফওয়ান৷ তারপর ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ঘুরিয়ে গাড়ি হাকালো রুমাইশা দের বাড়ির রাস্তায়।

“””

রাত বাজে এগারোটা। রুমাইশা শুয়ে আছে নিজের রুমে। শুয়ে শুয়ে ফোন চাপছে। রাতে খায়নি ও। সাফওয়ান ওকে আংটি পরিয়ে দিয়ে যাওয়ার পর থেকে খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো হচ্ছে না। আয়েশা ও ডাকছেন না খেতে আর৷ নিজেদের মতোই খাচ্ছেন, কথা বলছেন, ঘুরছেন; কিন্তু রুমাইশা কে সর্বদাই এড়িয়ে চলছেন৷ রুমাইশার প্রথম দুদিন অনেক খারপ লাগলেও এখন ওর বিরক্তি এসে যাচ্ছে। আয়েশা নিজে তো কথা বলছেনই না, রুমাইশা কথা বলতে গেলেও কেমন জানি দূর দূর করছেন৷ শামসুল ও তাই। আর এসব যে রাফসানের বুদ্ধিতে হচ্ছে সেটাও রুমাইশা বেশ ভালোভাবেই বুঝছে৷ তাই ও-ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কাউকে কথা বলার জন্য সাধবে না।

আয়েশা শামসুল ঘুমিয়ে গেছেন। শামসুলের নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ি মাথায় তুলে নাক ডাকছেন তিনি। আয়েশা যে এত শব্দেও ঘুমিয়ে থাকতে পারে এতে সবচেয়ে বেশি অবাক হয় রুমাইশা। রুমাইশা ফোন চাপতে চাপতে এসবই ভাবছিলো।

তখনি ফোনের ওপরের নোটিফিকেশন বারে একটা মেসেজে চোখ আটকে গেলো রুমাইশার৷ সাফওয়ান মেসেজ দিয়েছে,
— রিমু, ছাদে এসে দরজা খোল।

মেসেজ টা দেখে রুমাইশার পিলে চমকে গেলো, এই ছেলে টা ওকে কবে মহা বিপদে ফেলবে, এমনিতেও তো বিপদ শেষ হচ্ছে না, লেগেই আছে, আর এ এসে বিপদের ইঞ্জিনে তেল দিচ্ছে। রুমাইশা ফোন টা হাতে নিয়েই সিড়ি বেয়ে ছাদের দিকে এগোলো। সন্ধ্যার পর ছাদে উঠতে ভয় লাগে ওর। কেমন যেন গা ছম ছম করে৷ আর এখন বাজে এগারোটার বেশি। ভয় কে জলাঞ্জলি দিয়ে ওর এখন যেতে হচ্ছে সেই ছাদে৷

পা টিপে টিপে ছাদে ঢোকার দরজার কাছে গেলো ও৷ দরজা টা লোহার। সামান্য টোকা লাগলেও ঘর বাড়ি কাপিয়ে তুলে, আর তার ওপর এখন রাত। রুমাইশা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে দরজা টা খুলল। দরজা টা খুলে সামনে তাকালো রুমাইশা। রুমাইশা কে নিজের সামনে পেয়েই হুট করে জড়িয়ে ধরলো সাফওয়ান, নিজের সাথে একদম মিশিয়ে নিলো।

সাফওয়ানের কাজে হকচকিয়ে গেলো রুমাইশা। এই ছেলেটা যে কি দ্রুত করে সবকিছু! ধুম ধাম করে শুধু জড়িয়ে ধরবে, ভাবনা চিন্তার ও সময় দিবে না৷
রুমাইশার মাথা টা নিজের বুকে চেপে ধরে রইলো সাফওয়ান৷ রুমাইশা ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সাফওয়ানের বুকে কান পেতে৷ সাফওয়ানের হৃৎযন্ত্র টা দিড়িম দিড়িম করে লাফাচ্ছে, আর সে কম্পন টা যেন রুমাইশার চোয়ালে এসে বাড়ি খাচ্ছে৷ রুমাইশাকে কিছুক্ষণ এইভাবে জড়িয়ে রেখে সাফওয়ান যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।

কিয়ৎক্ষণ পরই রুমাইশা কে ছেড়ে দিলো সাফওয়ান। তারপর রুমাইশার চোখে চোখ রেখে বলল,
— নিচে চল, কাজ আছে কিছু।

রুমাইশা সম্মতি জানিয়ে ছাদের দরজা টা খোলা রেখেই সাফওয়ান কে নিয়ে নিজের রুমে এলো৷ রুমে ঢুকে আস্তে করে দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর ডিম লাইট টা দিলো৷ সাফওয়ান রুমেএসেই নিজের মুখের মাস্ক আর গগলস খুলে রাখলো রুমাইশার পড়ার টেবিলে তারপর বিছানার ওপর ব্রিফকেস টা রেখে ওপেন করলো, এরপর ওর ভেতর থেকে ল্যাব থেকে আনা ছোট্ট ডিভাইস টা বড় ডিভাইস টার মাথায় লাগালো৷

রুমাইশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাফওয়ানের কার্যকলাপ দেখছে আর বোঝার চেষ্টা করছে সাফওয়ান ঠিক কি করতে চলেছে।

নিজের কাজ শেষে সাফওয়ান রুমাইশার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো কাছে আসতে৷ রুমাইশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে আসলো সাফওয়ানের নিকট।
রুমাইশা কাছাকাছি আসলে বাম হাতে রুমাইশার কোমর টা আলতো করে আকড়ে ধরে নিজের সাথে লাগিয়ে নিলো সাফওয়ান। তারপর রুমাইশার মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে ধীর স্থীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— আমাকে তুই কত খানি বিশ্বাস করিস রিমু?

রুমাইশা নিজের মুখ খানি আর একটু সাফওয়ানের মুখের কাছাকাছি নিয়ে এসে মৃদু গলায় উত্তর করলো,
— যত খানি বিশ্বাস করলে এত রাতে কোনো পুরুষ মানুষ কে নিজের ঘরে নিয়ে আসা যায়৷

সাফওয়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তারপর রুমাইশাকে বাম হাত টা দিয়ে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে ওর পিঠ টা নিজের সামনে নিয়ে আসলো, তারপর মৃদু স্পর্শে ঘাড়ের ওপর থেকে রুমাইশার চুলের বেণি আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুচো চুল গুলো কে বাম দিকে সরালো, এরপর ঘাড়ের ঠিক মাঝখানে নিজের হাতে থাকা ডিভাইস টা ছোয়ালো৷
ডিভাইস টার ট্রিগার চাপতেই ডিভাইসের মাথায় লেগে থাকা ছোট্টো ডিভাইস টা খিচ জাতীয় শব্দ করে ঢুকে গেলো রুমাইশার ঘাড়ের চামড়ার ভেতর।
আকস্মিক এমন ব্যাথায় রুমাইশার মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো। ছিটকে কিছু রক্ত বেরিয়ে এলো ঘাড় থেকে। সাফওয়ান সেগুলো তার পকেটে থাকা তুলা বের করে মুছে দিলো।
তারপির বলল, চুল দিয়ে ঢেকে রাখবি, আর মাথায় সব সময় ওড়না দিয়ে বেড়াবি, যেন কেউ না দেখে।

রুমাইশা জিজ্ঞেসও করলো না সাফওয়ান কে, যে সে আসলেই কি সেট করলো ওর শরীরে। রুমাইশা কে এমন নিশ্চুপ দেখ্ব সাফওয়ান ধীর গলায় বলল,
— জিজ্ঞেস করলি না, কি দিলাম তোর শরীরে?

রুমাইশা মাথা নাড়ালো দুদিকে৷
সাফওয়ান কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,
—কি হবে যদি তুই কিছুদিন পর বিষক্রিয়ায় মারা যাস? বা আমি যেদিন মারা যাবো সেদিন তুই ও মারা যাস?

রুমাইশা ঘাড় টা কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে নির্বিকার গলায় বলল,
— কপালে মৃত্যু লেখা থাকলে তো আর সেটা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তাই যখনি আসুক, যার কারণেই আসুক, সাদরে গ্রহণ করবো। আর মৃত্যু টা যদি হয় আপনার সাথে সাথে তাহলে সেই মৃত্যু কে আমি নিজেই আলিঙ্গন করবো।

রুমাইশার কথাতে আবার ও হাসলো সাফওয়ান৷ তারপর রুমাইশা কি নিজের দিকে ফিরিয়ে বিছানায় বসালো। ব্রিফকেস থেকে সিরিঞ্জ টা বের করলো, এরপর রুমাইশার কবজি তে সিরিঞ্জের সুচ ফুটিয়ে বের করে আনলো এক সিরিঞ্জ তাজা রক্ত। রক্ত নেওয়ার সময় সাফওয়ান বলল,
— তোর শরীরের ফ্লুইড গুলো টেস্ট করতে হবে, কেন করতে হবে সেটা টেস্ট করার কারণ সফল হলে জানতে পারবি, নইলে পারবি না৷

রক্ত ভরা সিরিঞ্জ টা ব্রিফকেসে রেখে ছোট ছোট কৌটা গুলো বের করলো ও৷ এরপর একটা কৌটা খুলে তার ভেতর থেকে কটনবাড সদৃশ স্টিক টা বের করে রুমাইশা কে ইশারা করলো মুখ খুলতে।
রুমাইশা মুখ খুললে মুখের ভেতর থেকে স্টিক টা দিয়ে খানিক টা স্যালাইভা সংগ্রহ করলো সাফওয়ান।
এরপর অন্য আর একটা কৌটাতে রুমাইশার চোখের কোণায় স্টিক ছুইয়ে কিছুটা ফ্লুইড নিলো।

সেগুলো ব্রিফকেসে ভরে রেখে দিলো, আর এরপর আর একটা কৌটা বের করলো সাফওয়ান। কৌটা টা হাতে নিয়ে রুমাইশার দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে গলা খাকারি দিলো। রুমাইশা কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো সাফওয়ানের দিকে। সাফওয়ান কিছু বলবে বলবে করেও বলছে না দেখে রুমাইশা মুখের অভিব্যক্তি তে বোঝালো, ‘যা বলতে চান, তাড়াতাড়ি বলুন৷’

সাফওয়ান এবার নিজের হাত টা মুঠি করে নিজের মুখের সামনে ধরে আর ও একবার গলা খাকারি দিয়ে বলার প্রস্তুতি নিলো, কিন্তু বলে উঠতে পারলো না৷ সাফওয়ানের বার বার গলা খাকারি দিতে দেখে রুমাইশা এগিয়ে এসে অধৈর্য হয়ে বলল,
—এত নকশা করলে মা কখন চলে আসবে শব্দ শুনে, তখন দেইখেন৷

সাফওয়ান না পেরে নিজের ফোন টা হাতে নিলো তারপর রুমাইশা কি ইশারা করলো ফোন দেখতে। রুমাইশা ফোন টা হাতে নিলো। কিন্তু এরপর সাফওয়ানের মেসেজ দেখে চোখ গরম করে তাকালো সাফওয়ানের দিকে।
সাফওয়ান সেটা দেখে তাড়াতাড়ি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, তারপর হাতে থাকা কৌটা টা বাড়িয়ে দিলো রুমাইশার দিকে।
মুখ ফেরানো অবস্থাতেই আর একবার গলা খাকারি দিয়ে বলল,
—টেস্টের জন্য লাগবে। ইমারজেন্সি।

রুমাইশা কৌটা টা ঝামটা মেরে হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো ওয়াশ রুম থেকে। তারপর হাতের কৌটা টা সাফওয়ানের হাতে দিলো৷ সাফওয়ান সেটা নিয়ে ব্রিফকেসে ভরে রাখলো।

সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে নিয়ে সাফওয়ান উঠে দাড়িয়ে রুমাইশাকে নিজের কাছে ডাকলো। রুমাইশা কাছে এলে ওর কোমর টা দুহাতে জড়িয়ে ধরে নিচু হয়ে ওর কপালে ঠোঁট ছোয়ালো সাফওয়ান। এরপর শব্দ করে চুমু খেলো কপালে। তারপর রুমাইশার ডান হাত টা টেনে নিয়ে হাতের অনামিকার মাপ নিলো।

সাফওয়ানের কাজ কর্ম দেখে রুমাইশা বুঝে গেলো সাফওয়ান ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনি এখনি চলে যাবেন?

সাফওয়ান ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে বলল,
— হ্যা, অনেক কাজ আছে, অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

সাফওয়ানের উত্তরে রুমাইশা সন্তুষ্ট হলো না৷ ভ্রু দুইটা ওপরের দিকে উঠিয়ে ঠোট নামিয়ে ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
— আর একটু থাকুন না হয়!

রুমাইশার এমন চেহারা দেখে সাফওয়ানের আক্কেলগুড়ুম। বুকের ভেতর অদ্ভুত রকম অনুভূতির উদ্রেক হতে শুরু করলো যেন। হঠাৎ করেই অন্যরকম বাসনা জেগে উঠছে মাথার ভেতর৷ হাত পা গুলোর ভেতরে কিছু একটা যেন কিলবিল করছে। ভেতরের আদিম সত্তা টা লাফালাফি করে বাইরে বেরিয়ে এসে রূপ দেখাতে চাচ্ছে। থেকে যেতে ইচ্ছা করছে ওর ভিষণ! রিমু যে ওকে এমন ইনোসেন্ট মুখ করে ঘায়েল করে দিতে পারবে তা ও ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি।

দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো সাফওয়ান৷ ডান হাত দিয়ে রুমাইশার চিবুক ধরে জড়ানো গলায় বলল,
— বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত এই শয়তানের নানির মতো চেহারা টা মোটেও ইনোসেন্ট করে রাখবি না, এসব ট্রিক্স বিয়ের পরে অ্যাপ্লাই করবি৷ নইলে তোর অবস্থা আমি খারাপ করে ফেলবো, তখন আমার দোষ দিলে কিন্তু মেনে নিবো না৷

শয়তানের নানি বলায় রুমাইশা সাথে সাথেই নিজের ইনোসেন্ট মুখ সরিয়ে আসলেই শয়তানের নানির মতো লুক দিলো সাফওয়ানের দিকে।

সাফওয়ান সেটা খেয়াল করে দুষ্টু হাসি দিয়ে রুমাইশা কে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে মাস্ক আর গগলস পরতে পরতে নির্বিকার গলায় বলল,
— ইয়াপ, ন্যাও ইট’স পা’ফেক্ট।

তারপর বিছানায় থাকা ব্রিফকেস টা উঠিয়ে নিয়ে রুমাইশার চোয়াল টেনে দিলো দুই আঙুল দিয়ে, এরপর বলল,
— ছাদের দরজা টা দিবি, আয়।

সাফওয়ান আগে আগে চলল, রুমাইশা পেছন পেছন৷ সিড়ি বেয়ে ছাদের দরজার কাছে গিয়ে সাফওয়ান দরজা পার হয়ে ওপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রুমাইশার মুখোমুখি। তারপর রুমাইশা কে ইশারা করলো দরজাটা দিয়ে দেওয়ার জন্য৷
রুমাইশা দরজা দিতে যাবে তখনি হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে এসে নিজের মাস্ক টা মুখের থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রগাঢ় এক চুম্বন বসিয়ে দিলো রুমাইশার ঠোটে। এমন আক্রমণে রুমাইশার মুখ থেকে অস্ফুট ধ্বনি বের হলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই চোখ দুইটা বন্ধ করে নিলো ও।

আধা মিনিটের মাথায় এসে ছেড়ে দিলো সাফওয়ান ওকে। আর তারপরই ভূতের মতো দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে যেন অদৃশ্য হয়ে গেলো সাফওয়ান।

রুমাইশা সাফওয়ানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা। তারপর নিঃশব্দে দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লো।

(রিচেক করার সময় পাইনি, ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 💙)

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।