অফিডিয়ান | পর্ব – ৪৩

18 Min Read

সাফওয়ানের বুকের ভেতর টা ভেঙে গুড়িয়ে গেলো যেন। বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও রুমাইশার মুখ পানে৷ তীব্র ব্যাথায় বুকটা ঝাঝরা হওয়ার উপক্রম হলো ওর!
শেষ বারের মতো রুমাইশার ওই নিস্তেজ হয়ে যাওয়া মায়া ভরা মুখটাকে মন ভরে দেখে নিয়ে দুই হাত দিয়ে রুমাইশার মুখে হাত বুলালো সাফওয়ান!
কিন্তু ওর হাত দুইটা অস্বাভাবিক ভাবে কাপতে লাগলো, প্রাণ ভরে ওর রিমু কে ও একটু ছুয়ে দিতে পারলো না! হাত দুটো যেন কোনো ভাবেই রিমু কে স্পর্শ করার সমাপ্তি টানতে চাইছে না! কোনো ভাবেই তারা তৃপ্ত হতে চাইছে না। চোখ ফেটে পানি আসতে চাইলো সাফওয়ানের।

কাপা হাতটা রুমাইশার সারা মুখে বুলিয়ে দিয়ে, শরীর টা ঝুকিয়ে রুমাইশার কপালে চুমু খেলো ও। আর তখনই রুমাইশার মুখের ওপর টুপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো সাফওয়ানের চোখ থেকে। রুমাইশার চোয়াল বেয়ে সেটা গড়িয়ে পড়লো বিছানার ওপর৷

তারপর আবার সোজা হয়ে বসল সাফওয়ান। রুমাইশার নির্লিপ্ত মুখ খানায় আরও একবার কাপা হাত টা বুলিয়ে দিয়ে স্ট্রেচার থেকে উঠে দাড়ালো ও।

আর এরপর ধীর পায়ে ল্যাব এর পাশেই দাউদাউ করে জ্বলা আগুনের উদ্দ্যেশ্যে পা বাড়ালো ও। কয়েক পা যাওয়ার পর সাফওয়ানের চোখের পানি আর বাধা মানলো না! অঝোর ধারায় সেগুলো সাফওয়ানের রুক্ষ চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকলো নিচে, মুখে ফুটে উঠলো ওর বেদনার নিদারুণ ছাপ, চোখ দুইটা এমন বিচ্ছেদ মানতে না পেরে যেন তীব্র ব্যাথায় কুচকে গেলো!

কিন্তু সাফওয়ানের সে বুকফাটা কান্নায় কোনো শব্দ হলো না। সমস্ত কান্নার আওয়াজ গুলো গলা পাকিয়ে ঠেলে উঠে গলাতেই রয়ে গেলো। অসহ্য রকম যন্ত্রনা শুরু হলো সাফওয়ানের বুকের মাঝখানটাতে।

মন টা খুব করে চাইলো রুমাইশার ওই স্নিগ্ধ মুখ টার দিকে আর ও একবার চোখ টা ঘুরাতে, কিন্তু ওর দেহ টা ঘুরলো না। চোখ মুখ শক্ত করে দৃঢ় পায়ে হেটে চলল ও সেই স্বহস্ত রচিত দাবানলের দিকে৷

রেপটাইলের ল্যাবে ঢোকার আগ মুহুর্তে এসে দাঁড়িয়ে গেলো সাফওয়ান। তারপর মাথা তুলে ছাদের দিকে দৃকপাত করলো ও সৃষ্টি কর্তার উদ্দ্যেশ্যে! চোখ দুইটা বন্ধ করে ক্ষমা প্রার্থনা করলো ও! নিরবে সৃষ্টিকর্তার নিকট শুধু এই কথা গুলোয় আওড়াতে থাকলো,
— ইয়া রব, আমার প্রয়োজন নেই আর এই জীবনের! এই হাত দুটকে আর কোনো মৃত্যুর জন্য দ্বায়ী করতে চাইনা আমি! আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, আমার রিমু আজ আমার কারণে এই পৃথিবী ছেড়েছে! যাকে এত এত ভালোবেসেছি, আজ তাকেই আমি শেষ করে ফেললাম নিজের হাতে! খুন করেছি আমি ওকে! আমার কোনো ক্ষমা হয় না! আর এখন আমি যা করতে চলেছি তার জন্য জাহান্নাম চিরকালের জন্যই নির্ধারিত হয়ে যাবে আমার জন্য। কিন্তু আমি আর চাইনা এ জীবন! অনেক সহ্য করেছি। আর পারছিনা ইয়া রব, আর ধৈর্য নেই আমার। ক্ষমা করবেন আপনি আমাকে!

সৃষ্টিকর্তার দেওয়া জীবন টাকে নিজের হাতে শেষ করতে এগিয়ে চলল সাফওয়ান। জীবনের ওপর আর কোনো মায়া কাজ করছে না ওর। পরিবারের কারো কথাই ওর মনে আর দাগ কাটতে পারছে না!সব শেষ হয়ে গেছে ওর! আর কিছুই বাকি নেই!

আকাশের দিক থেকে ধীর গতিতে চোখ নামালো সাফওয়ান। এই পৃথিবীর কাছে ওর আর কিছুই চাওয়ার নেই৷ এই জায়গাটার প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে ওর। প্রয়োজন নেই আর ওর এমন পৃথিবীর।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেষ বারের মতো নিজের মনের তৃষ্ণা মেটাতে দূর থেকে একবার নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী, নিজের ভালোবাসার দিকে চোখ ফেরালো সাফওয়ান।
আর ফিরেই হতভম্ব হয়ে গেলো ও।

কম্পিউটার স্ক্রিনে বয়ে চলা সরলরেখা টা আবার ও উচু নিচু হয়ে তালে তালে বয়ে চলে রুমাইশার প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে৷
আর সেটা দেখেই সাফওয়নের ছুটে যাওয়া প্রাণ যেন ধড়ে ফিরে এলো! খুশিতে আত্মহারা হয়ে ডুকরে কেদে উঠলো ও!
স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে মেঝেতে হাটু গেড়ে ওইখানেই বসে পড়লো সাফওয়ান! তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
— ইয়া আল্লাহ, ইয়া রহমানুর রহিম! অসীম দয়া আপনার! কোটি কোটি শুকরিয়া আপনার প্রতি! সারাজীবন শুকরিয়া আদায় করলেও আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কখনোই শেষ করতে পারবো না। আমাকে ক্ষমা করবেন আপনি! আমার করা সমস্ত পাপকর্ম ক্ষমা করবেন আপনি! আমার কোনো অপকর্মের প্রভাব যেন আমার রিমুর ওপর না পড়ে ইয়া রব! আমার স্ত্রী, আমার কলিজা কে আপনি ফিরিয়ে দিয়েছেন আমার কাছে, আপনার অশেষ রহমত! তাকে আপনি দীর্ঘ হায়াত দান করুন, ইয়া রব! আমিন!

আর এরপরেই মেঝে থেকে উঠে ও দৌড়ে চলে গেলো স্ট্রেচারের নিকট। আর তারপর শয়ন রত রুমাইশাকে জুড়িয়ে ধরে উন্মাদের মতো চুমু খেতে লাগলো ওর সমস্ত মুখে!

রুমাইশার শ্বাস চলছে আবার স্বাভাবিক ভাবে। হৃদযন্ত্র স্পন্দিত হচ্ছে আবার রিদ্মিক গতিতে। স্বল্প সময়ের জন্য হৃদস্পন্দন থেমে গেছিলো ওর, কিন্তু মস্তিষ্ক সচল ছিলো৷ খানিকক্ষণ হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে আবার ও গতি ফিরে পেয়েছে!

সাফওয়ান নিজের মুখ খানা রুমাইশার মুখের ওপর রাখলো, রুমাইশার ঠান্ডা নিঃশ্বাস টাকে নিজের মুখের ওপর অনুভব করতে থাকলো ও। তারপর নিজেও এক সময় স্ট্রেচারের ওপরে উঠে রুমাইশার পাশে রুমাইশা কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। শরীর মন সবই ক্লান্ত ওর!

রুমাইশার হাত টা নিজের মুঠিতে নিয়ে নিজের ঠোটের ওপর রিমুর হাতের উপরিভাগ টা চেপে ধরে রইলো। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ও যে ওর রিমুর প্রাণনাশের কারণ হতে চলেছিলো তার জন্য নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিতে লাগলো ও। আর অপর পাশে এত দিনের যত্নে পেলে পুষে রাখা রেপটাইলের বাগান টা জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হতে থাকলো!

৪৪. বাড়িতে রুনিয়া পাগলপ্রায়, তার সাফওয়ানের সাথে কোনো ভাবেই কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি। সেই দুপুর বেলা লাস্ট সাফওয়ানের ফোনে কল ঢুকেছে। এর পর থেকে সাফওয়ান, রুমাইশা, দুজনের ফোন ই বন্ধ দেখাচ্ছে!
ইশতিয়াক আহমেদ থমথমে মুখে বসে আছেন। ছেলের কথা কাউকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছেন না, কারণ ওর ছেলে কারো বাড়িতেই যায়নি কখনো, আর ছেলেকেও কেউ দেখেনি কোনোদিন!
তার ওপর ওর সাথে রুমাইশা আছে! কোথায় আছে, কি করছে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকলেন তিনি।

ও বাড়িতে আয়েশাও মেয়ের শোকে বুক ভাসাচ্ছেন! রুমাইশার সাথে তাদের রাফসান চলে আসার পর থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। ফোনেও পাচ্ছেন না! রুনিয়ার কাছে কল দিলে শুনলেন যে সাফওয়ান কেও পাচ্ছেন না তারা! আর সেটা শোনার পর থেকেই আয়েশা কে আর ঠেকানো যাচ্ছে না!

রাফসান তাদের কাউকেই বলেনি যে আমেরিকা থেকে একদল মাফিয়া এসেছে সাফওয়ান কে খুজতে, কিন্তু ওর মনে মনে ভিষণ রকম চিন্তা হচ্ছে! মন বার বার বলছে সাফওয়ান কোনো বিপদে পড়েছে! কিন্তু ও কি করবে? ওর তো কিছুই করার নেই, যদি সাফওয়ান ধরাশায়ী হয়ে যায় তাদের কাছে, তাহলে রাফসান তো ওদের কাছে কিছুই না৷ এত সন্দেহ হওয়ার পর ও রাফসান কাউকে কিছুই জানালো না, নিজের মনেই রাখলো সব কথা!

ও বাড়িতে শাফিন মন খারাপ করে বসে আছে! ভাইয়ের ওই অবস্থার কথা চিন্তা করেই ভয় লাগছে ওর। ভাইয়া ঠিক হয়েছে তো?
সাফওয়ান আর রুমিকে ফোনে না পেয়ে শাফিন আবার ও একবার সবাইকে লুকিয়ে এসেছিলো ভুতুড়ে কুড়েঘর টার কাছে, কিন্তু পূর্বের যে পাসওয়ার্ড দিয়ে ওরা দরজা টা খুলতে পেরেছিলো সেটাতে আর কাজ হয়নি! পাসওয়ার্ড ইনকারেক্ট বলছে।
তাই ভেতরে আসলেই কি হচ্ছে তা ও জানতে ব্যর্থ হয়েছে! আবার কাউকে বলতেও পারছে না সাফওয়ানের ল্যাবের কথা! কারণ সেটা খুবই গোপনিয় বিষয়! এই ল্যাবের কথা কাউকে বলা মানেই সাফওয়ান ভাইয়া কে বিপদে ফেলা! তাই মুখ বুজে পড়ে রইলো ও।

রুনিয়া ছেলের শোকে বিলাপ করছেন। এখনো পর্যন্ত এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন সাফওয়ান তার সাথে কোনো কথা বলেনি, কিন্তু কাল সকাল থেকে সাফওয়ানের সাথে তার কোনোরকমের কোনো যোগাযোগ হয়নি। চব্বিশ টা ঘন্টা পার হয়ে গেছে এর মাঝে। কিন্তু তার ছেলে, ছেলে বৌএর কোনো খোজ পাচ্ছেন না তিনি। থেকে থেকে ডুকরে কেদে উঠছেন রুনিয়া। ইশতিয়াক পাশে বসে স্বান্তনা দিচ্ছেন, কিন্তু ওনার নিজের ও গলা ভারী হয়ে আসছে।
শাফিন বসে আছে মুখে হাত দিয়ে মায়ের পাশে৷

.

সকাল বেলা সাফওয়ানের ঘুম ভাঙলো। সারারাত রুমাইশা কে জড়িয়েই কেটে গেছে ওর। শরীরটা দুর্বল লাগছে ওর অনেক, গত চব্বিশ ঘন্টায় কিছুই খাওয়া হয়নি ওদের দুজনের। ক্ষিদেতে পেটের ভেতর টা গরগর করছে।

রুমাইশার এখনো জ্ঞান ফেরেনি একবার ও। সাফওয়ান শোয়া থেকে উঠে বসলো৷
ফ্লুইড গুলোর প্রভাব রুমাইশার শরীরে কেমন পড়বে সেটা নিয়ে এখনো সন্দিহান সাফওয়ান। ও এখন শুধু রুমাইশার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায়৷

সাফওয়ান স্ট্রেচার থেকে নেমে বেডরুমে গেলো। বেডরুমে সবসময় কিছু শুকনা খাবার রাখে ও, কাজ করতে করতে ক্ষিদে পেলে সেগুলোই খায়৷
সাফওয়ান এসে কাবার্ডের ওপর থরে থরে সাজিয়ে রাখা শুকনা খাবারের কৌটা গুলো নামালো৷ তারপর সেগুলো নিয়ে বিছানার ওপর রাখলো।

বন্ধ হয়ে যাওয়া ফোন টা বিছানার ওপরেই ছিলো৷ সেটা হাতে নিয়ে সুইচ টিপলো সাফওয়ান। ফোন টা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে৷ চার্জার টাও তো এইখানে নেই। বাসার সবাই হয়তো চিন্তা করছে।

নিজের স্টাডি টেবিলের কাছে গেলো ও৷ একটা বাটন ফোন ও সবসময় এখানেই রেখে দেয়, ইমারজেন্সি হিসেবে৷ যদিও এখনো পর্যন্ত কাউকেই এই ফোন টা দিয়ে কল দেওয়া হয়নি৷ স্টাডি টেবিলের ডান কোনায় রাখা বাটন ফোন টা উঠিয়ে অন করলো সাফওয়ান। তারপর শাফিনের ফোনে কল লাগালো।

শাফিন বসে ছিলো মায়ের পাশে। মা কে সামলানো দায় হয়ে পড়েছে৷ কান্না কাটি করছেন তিনি রাত থেকে৷ সারা রাতে দুচোখের পাতা এক করেননি তিনি। ক্লান্ত হয়ে গেছেন, তারপর ও কেদে চলেছেন৷
হঠাৎ অচেনা নম্বর থেকে কল আসায় শাফিন কেটে দিলো। এখন ওর মোটেই কোনো কল ধরতে ইচ্ছা করছে না!

কিন্তু পর পর আর ও কয়েক বার একই নম্বর থেকে কল আসায় শাফিন এইবার বাধ্য হয়ে মায়ের পাশ থেকে উঠে গেলো ফোন টা রিসিভ করার জন্য৷ ডাইনিং টেবিলের কোণার দিকে গিয়ে ফোন রিসিভ করে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে সাফওয়ানের গলা শুনে লাফিয়ে উঠলো শাফিন।
তার পর উত্তেজিত গলায় বলল,
— ভাইয়া, তোমরা কোথায়? তোমাদের কে আমি কোনো ভাবেই ফোনে পাচ্ছিনা, মা কেদে কেদে শেষ হয়ে যাচ্ছে, আমি যদিও বলিনি যে তোমরা ল্যাবে আছো! আমি একবার গেছিলাম ল্যাবের ওখান টায়, পাসওয়ার্ড ও দিয়েছিলাম, কিন্তু দরজা টা খোলেনি। তোমরা কি ওখানেই আছো? নাকি অন্য কোথাও গেছো? তুমি এখন ঠিক আছো? রুমি আপু কোথায়?

সাফওয়ান কে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেললো শাফিন। এত গুলো প্রশ্ন একসাথে করায় সাফওয়ান কোনটার উত্তর আগে দিবে ভেবে পেলো না। কিছুক্ষন নিরব থেকে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
— আমি ঠিক আছি। রিমু আমার সাথেই আছে৷ আমরা এখানো ল্যাবের ভেতরেই আছি। আর ল্যাবের দরজা খোলেনি কারণ একবার ল্যাবের পাসওয়ার্ড ক্র‍্যাক করলে পরের বার নতুন পাসওয়ার্ড নিজে থেকেই সেট হয়ে যায়। একই পাসওয়ার্ডে দ্বিতীয় বার আর দরজা খোলা যায় না, বাইরে থেকে। ফোন টা মায়ের কাছে দে আমি কথা বলছি।

শাফিন ঠিক আছে বলে দ্রুত পায়ে ফোন টা নিয়ে রুনিয়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
— মা, সাফওয়ান ভাইয়ের ফোন।

রুনিয়া শাফিনের দিকে একবার বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে সাথে সাথেই ফোন টা শাফিনের হাত থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কাদতে কাদতে জিজ্ঞেস করলেন,
— এই তুই কোথায় হ্যা? গত চব্বিশ ঘন্টার ভেতরে তোর কোনো খোজ নেই! ফোন তো ধরিস ই নি, একটা কল করার ও প্রয়োজন মনে করিস নি! কি এমন কাজে ব্যাস্ত আছিস তোরা যে একটা কল ধরার সময় পাস না! হ্যা?

সাফওয়ান মা কে শান্ত করার জন্য গলা যতটা সম্ভব নরম করে বলল,
— মা আমরা একটু বেরিয়েছিলাম, ফোন সাইলেন্ট ছিলো আমাদের দুজনের ই, তাই কল রিসিভ করতে পারিনি। আর চার্জার টাও ভুলে ফেলে এসেছি বাড়িতে, তাই পরে যে তোমাদের কল ব্যাক করবো সেই উপায় ও ছিলো না। তুমি মন খারাপ করো না মা! এইরকম ভুল আর হবে না। আমরা রাতের ভেতরেই ফিরে আসার চেষ্টা করবো, কোনো প্রয়োজন হলে এই নম্বরে কল দিও তুমি।

সাফওয়ানের কথায় কান্না থেমে গেলো রুনিয়ার, ফোপাঁতে ফোপাতে বললেন,
— রুমি কই? ওর কাছে দে, আমি কথা বলবো ওর সাথে। ও কেন আমাকে একটু বলে গেলো না আমি শুনবো ওর কাছে!

সাফওয়ান আবার আগের মতো করেই বলল,
— ও তো ঘুমাচ্ছে মা, আর ওর কোনো দোষ নেই, আমিই ওকে কাউকে বলতে মানা করেছিলাম। ও ঘুম থেকে উঠলে আমি তোমার সাথে ওকে কথা বলিয়ে দেবো মা, তুমি আর হাইপার হইয়ো না। আর আয়েশা মামি দের কেও জানিয়ে দিও একটু নইলে ওনারাও চিন্তা করবেন৷ আমরা রাতের ভেতরেই ফিরে আসার চেষ্টা করবো মা। তুমি আর মন খারাপ করো না!

রুনিয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,
— ঠিক আছে, আমি আয়েশা কে ফোন করে জানাচ্ছি। আর তোরা আয় একবার বাড়িতে। এইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ির লোক গুলোকে টেনশনে ফেলে ঘোরাঘুরি তোদের আমি বের করবো৷ আয় শুধু একবার।

সাফওয়ান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
— ঠিক আছে মা, আমরা ফিরে আসি, তারপর তুমি যা শাস্তি দাও মাথা পেতে নেবো। এখন তুমি আর কান্না করো না। ফোন রেখে ঘুমাও একটু, শাফিন বলল তুমি নাকি ঘুমাওনি সারারাত! ঘুমিয়ে নাও একিটু মা, আমরা শীঘ্রই চলে আসবো৷

রুনিয়া আচ্ছা বলে ফোন কেটে দিলেন। আর তারপর ফোন লাগালেন আয়েশার কাছে, সাফওয়ান আর রুমাইশার কীর্তি কলাপের বিবরণ দিতে।

রুনিয়া কল কেটে দিলে সাফওয়ান হাপ ছেড়ে বাচলো। রুমাইশা ল্যাব এ একা আছে। ফোন টা আবার টেবিলের ওপর রেখে রুমাইশা কে একবার দেখা আসার জন্য ল্যাব এ ঢুকলো সাফওয়ান। তারপর ধীর পায়ে হেটে এগিয়ে এলো স্ট্রেচারে শয়নরত রুমাইশার দিকে৷ খুব ভালো করে লক্ষ্য করলো সাফওয়ান রুমাইশা কে।

গলার কামড়ের দাগ গুলো আগের মতো আর স্পষ্ট নেই। ক্ষত গুলো যেন অল্প সময়ের ভেতরেই অনেক খানি সেরে উঠেছে। ক্ষতের আশেপাশের নীল হয়ে যাওয়া শিরা উপশিরা গুলোর নীলবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে আছে।
আঙুল গুলো নড়ছে ওর মাঝে মাঝে। চোখের পাপড়ি গুলোতেও কম্পনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে৷ খুব দ্রুতই হয়তো জ্ঞান ফিরে আসবে রুমাইশার৷

একটা দীর্ঘশাস ফেলে রুমাইশার পাশে মেঝেতে পা ঠেকিয়ে বসলো সাফওয়ান৷ রুমাইশা কে আর ও একবার ভালো করে দেখে নিয়ে ওর কপালে শব্দ করে চুমু খেলো একটা।
কাল রাতেও রুমাইশার মুখে এক অসহায়ত্বের ছাপ দেখেছিলো ও, কিন্তু সেটা এখন আর নেই। ঘুমন্ত রুমাইশা কে ঘুমের মাঝেই বেশ প্রানবন্ত লাগছে। চোখ মুখের শুকিয়ে যাওয়া ভাব টাও অনেক টাই কেটে গিয়েছে।

সাফওয়ান রুমাইশার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। রিমুর হয়তো জ্ঞান ফিরবে খুব দ্রুতই। ক্ষিদেও লাগবে খুব ওর৷ বেডরুমে চিড়া রাখা আছে, কুকিজ আছে কয়েক রকমের, আর আছে চা পাতি আর কফি।
ল্যাবের ছোট্ট ডিপ ফ্রিজ টাতে আইসক্রিম, টক দই, মিষ্টি দই সবই আছে৷ রিমু খেতে চাইলে দিবে৷ ওর নিজের ও তো খাওয়া দরকার৷ খানিকক্ষন ভাবনা চিন্তা করে বেডরুমে যাওয়ার জন্য স্ট্রেচার থেকে নেমে পা বাড়ালো সাফওয়ান। আর তখনি পেছন থেকে হাতে টান পড়লো ওর।

চকিতে পেছন ফিরে চাইলো ও৷ রুমাইশা পিটপিট করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মুখে ওর মিষ্টি হাসি!

রুমাইশা কে এইভাবে সজ্ঞানে, সুস্থ সবল দেখে উচ্ছসিত হয়ে উঠলো সাফওয়ান। আর তারপরই প্রবল আনন্দে প্রাণখোলা হাসি হেসে রুমাইশার বাহু তলে হাত দিয়ে বাচ্চাদের মতো করে কোলে তুলে নিলো ওকে৷
আর তারপর নিজের মুখ টা রুমাইশার গলার কাছে ওর খোলা চুলের ভেতর লুকিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে একেবারে পিষে ফেললো যেন।

সাফওয়ানের এমন কান্ড কারখানায় রুমাইশা খিলখিল করে হেসে উঠলো। সাফওয়ানের এই আনন্দে আটখানা হওয়া চেহারা দেখে ওর প্রচন্ড ভালো লাগছে৷ ওই হিংস্র গম্ভীর মুখ খানাও যে এত হাসতে পারে সেটা ওর ধারনাতেই ছিলো না। রুমাইশা নিজেও তার হাত দুখানা সাফওয়ানের কাধের ওপর দিয়ে সাফওয়ানকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে নিলো।

অনেক অনেক ক্ষন ওরা এভাবেই কাটালো। যেন কেউ আর কাউকে ছেড়ে দিবেনা, বাকি জীবন এভাবেই পার করে দিবে! সাফওয়ান রিমুকে ওভাবেই কোলে নিয়ে সমস্ত ল্যাবের এ পাশ থেকে ওপাশে হেটে বেড়ালো অনেক সময় ধরে।
আর রিমু ও নিশ্চিন্ত মনে সাফওয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে সাফওয়ান কে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো সাফওয়ানের কোলে বসে রইলো। দুজনের কেউ ই কোনো কথা বলল না এত সময়ের ভেতর। শুধু অনুভব করলো একে অপরকে৷

হারিয়ে যেতে নিয়েও না হারানো দুই কপোত-কপোতীর অনিন্দ সুন্দর ভালোবাসায়, সারাজীবন রসকষহীন এক্সপেরিমেন্ট দেখে আসা ল্যাব টাও যেন পুলোকিত হয়ে উঠলো!

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।