ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ১৫

19 Min Read

সুহাস নামীকে একঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিল নিধি৷ এরপর প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে সৌধ, আইয়াজ আর ফারাহর সঙ্গে খুঁড়িয়ে নিচে চলে এলো। তাকে সাহায্য করল সৌধ। সুহাস, নামীর মধ্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। বদ্ধঘরে এবার দু’জন মা’রামারি করুক, কা’টাকা’টি করুক। বা প্রেম, ভালোবাসায় হাবুডুবু খাক। এটা সম্পূর্ণ ওদের ব্যাপার। তবু দু’জন কাছাকাছি থাকুক। অচেনা, অজানা দু’টো ছেলেমেয়ে। অল্প বয়সে বিয়ের মতো একটি সম্পর্কে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে। বিয়েটা যেভাবেই হোক, যে কারণেই হোক। পরিবারের উচিত ছিল ওদের একে অপরকে বোঝাপড়ার সময় দেয়ার। তা না করে মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বাঁধা নয় ছেলেমেয়ে দুটোর মনে এমন বিষ ঢেলেছে যে তারা একে অপরকে শত্রুর চোখে দেখে৷ বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে ইমম্যাচিওর সুহাস। ফলে মা ভক্তি তাকে আরো বেশি ইমম্যাচিওর করে তুলেছে। তবে বন্ধুদের বিশ্বাস সুহাস যেটা দেখাচ্ছে এটা আসলে ও নয়৷ সে দুরন্ত মনের ছেলে হলেও অনেক দিন ধরে চেনে তারা। গড়মিল তো আছেই। সেই গড়মিলের সমাধান আজকের রাতেই মিলবে। নিজেদের পরিকল্পনায় সফল হলো ওরা। ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসল সকলে। নিধি বলল,
‘ ফারাহ কফি বানাতে পারো?’
ফারাহ মাথা নাড়াল সে পারে। নিধি বলল,
‘ আচ্ছা, আমাদের জন্য কফি করে নিয়ে এসো। আমিত সাহায্য করতে পারব না৷ তাই আইয়াজ তোমাকে সাহায্য করবে।
কথাটা বলেই তাকাল আইয়াজের দিকে। বলল,
‘ আমাদের সব বন্ধুর প্রতিই যত্নশীল হওয়া উচিত। ‘
আইয়াজ থতমত খেলেও খুশি হলো। প্রচণ্ড ভদ্র, সভ্য বন্ধুর এই খুশিটা দেখতে চেয়েছিল নিধি। পাশের সোফায় বসে থাকা ফারাহ প্রচণ্ড লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে দাঁড়াল। চলে গেল রান্নাঘরে পিছন পিছন গেল আইয়াজও৷
এদিকে সম্মুখে আয়েশি ভঙ্গিতে বসা সৌধ নিধির কথার পাল্টা জবাব দিল,
‘ হ্যাঁ আমাদের সব বন্ধুর প্রতিই যত্নশীল হওয়া উচিত। এই যে তুই একা একা এখানে বসে আছিস। আর আমি সঙ্গ দিচ্ছি। এটাও যত্ন৷ ‘
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল নিধি। বন্ধুদের মধ্যে সবাই জানে একাকী ঘরে থাকতে পারে না সে৷ ভয় পেয়ে প্রচণ্ড খারাপ অবস্থা হয়। একবার জরুরি প্রয়োজনে প্রাচী বাড়ি গিয়েছিল। সে একা ছিল বাসায়। মাঝরাতে কারেন্ট চলে যাবার পর ভয়ে প্যানিক এট্যাক হয়েছিল। খুব কষ্টে ফোন চেপে শুধু কল করতে পেরেছিল সুহাসকে৷ এ শহরে তার আপন বলতে এরাই। নিজের সমস্যা গুলোর কথা পরিবারে জানাতে না পারলেই এই চার বন্ধুকে অবলীলায় জানাতে পারে। নিধির পরিবার কখনো চায়নি সে ডাক্তারি পড়াশোনা করুক৷ নিজ মেধায় মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার পরও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বাবা। চার কন্যার মধ্যে সে দ্বিতীয় জন। বড়ো বোন ডিভোর্সি। বাবা, চাচারা চেয়েছিল সে অনার্স ভর্তি হয়ে বিয়ে করে সংসারি হোক। শক্ত মনোবলের মেয়ে হয়ে বাবা, চাচাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি নিধি। মাকে বুঝিয়ে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে৷ মায়েরা আর যাইহোক মেয়ের স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না৷ নিধির মাও পারেনি। তাই স্বামীর সঙ্গে লড়াই করেছে। রাগ করে পড়াশোনার জন্য নিধির পিছনে একটা টাকাও খরচ করে না বাবা। নিধির মাও স্বামীর সহায়তা আশা করেনি। সে তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সম্পত্তি ভাইয়ের নামে লিখে দিয়েছে। বিনিময়ে ভাই নিয়েছে নিধির পড়াশোনার দায়িত্ব। পারিবারিক এই জটিলতা গুলোর জন্যই নিধি নিজের জীবনের কোনো সমস্যার কথাই মাকে জানায় না৷ কপাল গুণে কিছু বন্ধু পেয়েছে। তারা জীবনে আসার পর জীবন যতটা কঠিন ভেবেছিল ততটা কঠিন মনে হয়নি আর। সেদিন মধ্যরাতেই উপস্থিত হয়েছিল সুহাস। সঙ্গে সৌধ আর স্মৃতি আপুকে নিয়ে। যতই বন্ধু হোক, যতই সৌধ এমপির ছেলে হোক৷ বাড়িওয়ালা মধ্যরাতে তাদের ঢুকতে দেবে না৷ তাছাড়া নিধিকে সামলাতে একজন মেয়ে লাগবেই। তাই বুদ্ধি করে বড়ো বোনকে নিয়ে এসেছিল সৌধ। স্মৃতি আপু সৌধর জীবনের প্রথম বেস্ট ফ্রেন্ড। তাই সে খুব সুন্দর ভাবেই সামলে নিয়েছিল সবটা। নিধির সঙ্গে স্মৃতি আপুর বন্ধুত্বের সূচনা সেখান থেকেই। সেদিনের পর থেকে সবাই জানে অতিরিক্ত ভয় পেলে প্যানিক এট্যাক হয় নিধির। ঠিক সেটা ভেবেই সৌধ মিটিমিটি হাসছিল তখন। কারণ সে জানে, জরুরি কথা বাহানা মাত্র৷ সেদিনের পর থেকে অন্ধকারেও এলার্জি নিধির। এই মেয়ে নাকি পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ডাক্তারি পড়ছে। বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হয় সৌধর।
কফি বানানো কী এমন কঠিন কাজ যে আইয়াজের সহায়তা নিতে হবে? তাই নরম সুরে ফারাহ বলল,
‘ আপনার কিছু করতে হবে না। আমি করতে পারব।’
কথাটা শুনে আইয়াজ একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ পর ফারাহ তাকাল তার দিকে। তাকানোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠল,
‘ কিছু করতে হবে না যখন তখন দাঁড়িয়ে না থেকে ওখানে গিয়ে বসুন। ‘
নড়েচড়ে ওঠল আইয়াজ। প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ফারাহর দিকে। বলতে চাইল,
‘ তুমি কফি বানাও, আমি এখানেই থাকি। একসঙ্গে ওদের কাছে যাব৷ ‘
কিন্তু বলে ফেলল,
‘ তুমি কফি বানাও, আর আমি তোমাকে দেখি!’
কথাটা শুনতেই দেহ শিউরে ওঠল ফারাহর। সহসা দৃষ্টি ঘুরিয়ে কাজে মন দিল সে। আইয়াজ হতভম্ব হয়ে গেল। এটা কী বলে ফেলল সে? হয়েছে টা কী তার? এমন উল্টাপাল্টা করলে ফারাহ তাকে কী মনে করবে? নিজেকে ধাতস্থ করে নিল আইয়াজ। বড়ো বড়ো করে দু’বার নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বদলাতে হবে৷ কিন্তু কী বলা যায়… ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল তারা ম্যাসেজে অনেক কথাই বলেছে। পড়াশোনা নিয়ে, নিজেদের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে। এর বাইরে কিছু বলা বা জানা হয়নি। তাই বলল,
‘ তোমার পরিবারে কে কে আছে? ‘
‘ আমি আপু, দুলাভাই, আর ভাগ্নি। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল আইয়াজের। বলল,
‘ বাবা, মায়ের সাথে থাকো না? ‘
মুখে মেঘ জমল ফারাহর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমার বাবা, মা নেই। আমি এতিম! ‘
আমি এতিম! বাক্যটিতে আহত হলো আইয়াজ। তার দুচোখে মেয়েটির জন্য অদ্ভুত মায়া জেগে ওঠল। বুকের ভেতর অনুভব করল চিনচিনে ব্যথা। অপরাধীর ন্যায় মস্তক নত করে বলল,
‘ আই এম সরি। ‘
নিজের ঝাপসা চোখ চশমার আড়ালে রেখেই মৃদু হাসল ফারাহ৷ বলল,
‘ সরি বলছেন কেন? আপনি কোনো ভুল করেননি। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন আমার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর বাবা মারা যায় তিন বছর আগে। তাই বড়ো বোনের কাছেই থাকি আমি। ‘
নিজের দূর্ভাগ্যের কথা শুনে আইয়াজের মুখ ব্যথিত হলো বলে খারাপ লাগল ফারাহর। তাই নিজের কথার ইতি টেনে জিজ্ঞেস করল ,
‘ আপনার পরিবারে কে কে আছেন? ‘
আইয়াজ তাকাল ফারাহর মলিন মুখটায়। ঈষৎ হেসে বলল,
‘ মা, বাবা, বড়ো ভাই, ভাবি আর ছোটো বোন। ‘
***
প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে নামীর৷ বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়েছে ওরা। আজ এই ত্যাঁদড় ছেলে সুহাসের সাথে রাত কাটাতে হবে। বিছানার এক কোণে বসে হাসফাস করছে মেয়েটা৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নামীর কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেল সুহাস। এরপর তাকাল নিজের দিকে। আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। আর ভাবল, সে নিঃসন্দেহে সুদর্শন। গায়ের রঙ, হাইট দু’টোই ঠিকঠাক তবে কমতিটা কী? সৌধ অনেকবার তাকে বলেছিল তার সঙ্গে জিমে যেতে৷ নিয়মিত ব্যায়াম করতে। সে কথা শুনেনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সৌধর কথা শোনা উচিত ছিল৷ আগে শুনেনি তাতে কী হয়েছে? এবার থেকে শরীর চর্চা করবে সে। সুহাসের কেন জানি মনে হলো তার গার্লফ্রেন্ডদের তুলনায় নামী অনেক বেশি স্মার্ট। উন্নত মনের মেয়ে। অরিনকে সে সবচেয়ে স্মার্ট মনে করত। অথচ অরিনও কোনোদিন তাকে শরীর চর্চা করতে বলেনি। নিজের হ্যাংলা, পাতলা শরীরটা বিরক্ত লাগল সুহাসের। কল্পনায় আঁকল নিজের ব্যায়ামপুষ্ট শরীর। বাহ দারুণ, শরীর তাহলে ফিট করতেই হবে। ভেবেই আয়নায় তাকাল। নামীকে দেখে দিল দুর্ভেদ্য হাসি। বলল,
‘ কী নামীদামি? ভয় করছে? ‘
চকিতে তাকাল নামী। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,
‘ কেন ভয় পাব কেন? ‘
প্রশ্নটি করে নিজেকে স্থির রাখতে পারল না সে। পা দুলাতে শুরু করল ক্রমাগত৷ সুহাস সেদিকে খেয়াল করে ঘুরে দাঁড়াল। কেন জানি মনে হলো অতিরিক্ত টেনশনে নামীর মুখটা চুপসে গেছে৷ আর এই যে পা দুলাচ্ছে এটাও অতিরিক্ত চিন্তার ফল। নামীর মুখে ভয়, দুঃশ্চিতার ছাপ দেখে তার মনে সুড়সুড়ি লাগল। চনমনে চিত্তে বলল,
‘ এই ফকফকা চেঙ্গিস খান এখন তোমার সব অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে। তবুও ভয় লাগছে না? ‘
‘ তার মানে স্বীকার করলেন আপনি ফকফকা চেঙ্গিস খান? ‘
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সুহাস বলল,
‘ তোমার ভাষ্যে। ‘
কথাটা বলেই ধীরপায়ে এগুতে লাগল সে। তার ভাবমূর্তি আর আগানো দেখে নামী আতঙ্কিত হলো। মনে মনে বিপদের দোয়া পড়ে আশপাশে তাকাল সচেতন চোখে৷ চিৎকার দিতে উদ্যত হয়েও থেমে গেল৷ কী লাভ চিৎকার করে? সুহাস তার স্বামী। সম্পর্কে জটিলতা আছে ঠিক। কিন্তু সুহাস যদি তার ওপর অধিকার ফলায় সে কি সত্যি বাঁধা দিতে পারে? হ্যাঁ পারে কিন্তু সেটা সকলের চোখে অশোভন দেখাবে। কিন্তু নিজের চোখে না। তাই ধাতস্থ হয়ে কাঁপা গলায় বলল,
‘ সুহাস, আপনি আমার কথাটা শুনুন। ‘
সুহাস হাসল। হাসিটা কেন যেন বিকৃত দেখাল নামীর চোখে। সে ভীতিগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পা তুলে বসল। ততক্ষণে সুহাস কাছাকাছি এসে গেছে। নামীর শরীর কাঁপতে শুরু করল। পিছিয়ে গেল তড়াক করে। সুহাস হো হো করে হেসে ওঠল। বসল বিছানায়। বিদ্রুপ করে বলল,
‘ এ কী কাণ্ড! নামীদামি যে ভয় পাচ্ছে। ‘
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে বড়ো বড়ো করে শ্বাস টানল নামী। সুহাস ভ্রু কুঁচকে অকস্মাৎ বলল,
‘ অ্যাজমা কি ছোঁয়াচে রোগ? ‘
সুহাস জানে হাঁপানি ছোঁয়াচে রোগ না৷ তবু নামীকে চটাতে বলল কথাটা৷ কিন্তু নামী অদ্ভুত চোখে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ পড়াশোনা করে নিজের গরজে মেডিক্যালে চান্স পেয়েছেন? নাকি বাবা, মা টাকার জোরে জোর পূর্বক ওখানে ভর্তি করিয়েছে? ‘
ক্ষেপে গেল সুহাস। চোখ, মুখ শক্ত করে বলল,
‘ মানে? আমার মেধা নিয়ে তুমি প্রশ্ন তুলছ! ‘
ঢোক গিলল নামী। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল মুহুর্তেই। ভাবল কথার প্যাঁচে ফেলে সুহাসকে বাগে আনতে হবে৷ তাই বলল
‘ শুধু আপনার মেধা নিয়ে নয় মেরুদণ্ড নিয়েও আমি সন্দিহান। ‘
‘ হোয়াট! ‘
‘ হ্যাঁ। আপনি একটা মেরুদণ্ডহীন পুরুষ। এজন্যই বাবার আদেশে বিয়ে করেছেন, মায়ের আদেশে বিয়ে অস্বীকার করেছেন৷ ‘
‘ নামী! ‘
‘ ধমকালেই সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে না সুহাস। আর আপনি যাকে সহ্য করতে পারেন না, নির্লজ্জের মতো তার কাছাকাছি আসছেন কেন? বিবেকে বাঁধছে না? নিজেই ভাবুন তো এসব দেখে আপনাকে নিয়ে আমার ধারণা এছাড়া আর কী হবে? ‘
‘ এটা একটা গেম। শর্ত অনুযায়ী সারারাত মাথা টিপে দেবে আমার। ‘
চমকাল নামী। তার মানে সে যা ভাবছে অমন কিছু নয়? তাহলে সুহাস ওভাবে কেন বলল সব অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে? মনের প্রশ্ন মুখে বেরিয়ে এলো তার। সুহাস টের পেল কথাটা শুনে নামী ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাই এমন করছে। তৎক্ষনাৎ আবার সুহাস পূর্বের রূপ ধারণ করল। আজ এই নামীদামিকে একটা শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে৷ ভাবনা অনুযায়ী হাত বাড়াল সে। নামী ছিটকে সরে গিয়ে চাপা ক্রোধে বলল,
‘ আমাকে স্পর্শ করবেন না আপনি। ‘
সুহাস শুনল না সে কথা। হেঁচকা টান দিয়ে নামীকে নিজের কাছাকাছি নিয়ে এলো। একহাতে নামীর বাহু অন্যহাতে নামীর কোমর চেপে ধরল শক্ত হাতে। মুখ খিঁচিয়ে রইল নামী৷ নিজেকে সুহাসের বাঁধন থেকে ছুটাতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। শাসাতে লাগল অসংখ্য বাক্য দ্বারা৷ কিন্তু সুহাস সেসবের ধার ধারল না৷ সন্তর্পণে নামীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাক ঘষতে শুরু করল। নামী দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করল অপ্রিয় স্বামীর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো। সুহাস তার নরম শরীর ছুঁয়ে বদ্ধ দৃষ্টিজোড়ায় তাকিয়ে মাতাল সুরে বলল,
‘ এই চেঙ্গিস খানের এটুকু শক্তির সঙ্গেই কুলোতে পারছ না নামীদামি? তাহলে আজ কী হবে ভাবো একবার। ‘
শাসাল বাক্যটি শুনে শরীর কাঁপতে শুরু করল নামীর। চোখের পাতা, ঠোঁটজোড়াও কেঁপে কেঁপে ওঠল। সুহাস খুব কাছ থেকে দেখল সেই কম্পন। যতটা বোঝাল ততটা করবে না সে। তবু তার এটুকু স্পর্শেই যে নামী ঘৃণায় মূর্ছা যাচ্ছে। এতেই আত্মতৃপ্তি মিলছে৷ বাঁকা হাসল সুহাস। একেবারে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রও সে নয়। কিছু একটা ঘটানো উচিত। ভেবেই চট করে নামীর গলা জুড়ে থাকা ওড়নাটা খুলে ফেলল। চোখের সামনে ভেসে ওঠল শ্যামলাটে নামীর লাস্যময়ী রূপ। মস্তিষ্কই এলোমেলো হয়ে গেল সুহাসের৷ নামী কাচুমাচু হয়ে নিজেকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করল। সুহাস বক্র হাসি ঝুলিয়েই ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘ মেয়ে, তোমার রূপে আগুন না থাকলেও কথায় আগুন আছে। আজ এই নরম বিছানায় প্রমাণ করব
তোমার ঐ অগ্নিবাণ কথার ক্ষমতা বেশি নাকি
এই হ্যাংলা, পাতলা সুহাসের ক্ষমতা বেশি। ‘
সুহাসের এহেন কথায় থমকে গেল নামী৷ তার দুচোখ বেয়ে গড়াল নোনাপানির ধারা। সুহাসের কাঁধ ভিজে ওঠল। নামীর হঠাৎ চুপসে যাওয়া, নোনা পানির স্পর্শে চুপসে গেল সুহাস। বলল,
‘ আর ইউ ওকে? ‘
নামী রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল৷ রক্তবর্ণ চোখে তাকাল সুহাসের চোখে। কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে স্পর্শ করল সুহাসের গালে। সুহাস অবাক হলো। হঠাৎ নামীর এই অদ্ভুত আচরণে হিমশিম খেয়ে গেল সে। কিছু বলতে উদ্যত হবে তৎক্ষনাৎই নামী ভাঙা কন্ঠে বলল,
‘ আমরা স্বামী-স্ত্রী সুহাস। আপনি স্বীকার করুন বা না করুন। আমাকে স্পর্শ করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আপনার৷ কিন্তু কি জানেন? মন থেকে আমি আপনার স্পর্শ গুলো গ্রহণ করতে পারব না৷ আফসোস টা আমার এখানেই। মনের বিরুদ্ধে কোনো পুরুষকে শরীর দিয়ে দেওয়া খুব যন্ত্রণার। যে ছেলে আমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেনি, সে ছেলে আমার এই শরীরটাকে কত সহজে গ্রহণ করতে চাইছে। ‘
শেষ বাক্যে প্রচণ্ড তাচ্ছিল্যতা প্রকাশ পেল। সুহাসের মুখের আকৃতি বদলে গেল নিমেষে৷ বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠল তার। নামী ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে পুনরায় বলল,
‘ নারীকে ছোঁয়া সাধনার বিষয় সুহাস। নারীর শরীর ছুঁয়ে নারীকে ছুঁয়েছি ভাবা ঘোলকে দই ভেবে খাওয়া একই কথা৷ দইয়ের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে পুরুষরা নিজেদের শক্তিমান, ক্ষমতাবান মনে করে৷ কিন্তু তারা জানে না তাদের সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা এখানেই। কারণ তারা নারীর হৃদয় ছুঁতে পারেনি। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল সুহাসের। বলল,
‘ তার মানে তোমার শরীর ঘোল? আর হৃদয় দই? ‘
ম্লান হাসল নামী। আফসোস হলো সুহাসের অপরিপক্ক মানসিকতার কথা ভেবে৷ এই ছেলে কবে বড়ো হবে? কোনোদিন কি এই ছেলে বুঝবে ভালোবাসা কী? সম্পর্ক কী? নাকি সবটা বোঝার আগেই মিসেস উদয়িনী তাদের সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে দেবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। নিজেকে সুহাসের দুই হাতের বন্ধনে আবদ্ধ দেখে নিয়ে পুনরায় চোখ রাখল ধূসর রাঙা চোখ দুটোয়। বলল,
‘ শুনেন নির্বোধ পুরুষ, নারীর হৃদয় না ছুঁয়ে দেহ ছোঁয়া পুরুষকে ধর্ষক বলে। ‘
সহসা নামীকে নিজের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিল সুহাস। মুক্তি পেয়েও কোনো ভাবান্তর হলো না নামীর। বরং সে ভয়ানক এক কাণ্ড করে বসল। শরীর ছেড়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। শরীরে ওড়না না থাকায় ঘনঘন নিঃশ্বাসের সাথে গলা এবং উদরের মধ্যবর্তী আকর্ষক অংশটুকু উঠানামা করছে। সুহাস দৃষ্টি সংযত করল এবার। নামী সেসব খেয়াল করল না। তীব্র জেদি কণ্ঠে বলল,
‘ নিজেকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে মেলে দিলাম। আমাকে ভোগ করুন সুহাস। নাম মাত্র বিয়ের বদৌলতে আজকের রাতটার জন্য আমার শরীরটাকে দিয়ে দিলাম। বিনিময়ে একটা জিনিস চাই আপনার থেকে। ‘
থমকানো দৃষ্টিতে নামীর অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকাল সুহাস। ঈষৎ হেসে নামী বলল,
‘ ডিভোর্স চাই। ‘
বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠল সুহাসের। হতভম্ব মুখে পলক ফেলতে ভুলে গেল সে৷ নামী পুনরায় বলল,
‘ ভয় নেই। আপনার মা, বাবার সংসার নষ্ট হবে না। ডিভোর্সটা গোপন থাকবে সাড়ে পাঁচ বছর বা ছ’বছর। পড়াশোনা শেষ করে দেশে চাকরি করার ইচ্ছে নেই আমার। ইন্টার্ন শেষে লাইসেন্স পেয়ে গেলেই আমেরিকায় চলে যাব। আর তখনি সবাই জানবে আমাদের ডিভোর্সের কথা। এরজন্য আপনাকে কোনোভাবেই দায়ী করা হবে না। সম্পূর্ণ দায় আমার ঘাড়ে নিব৷ এতে আশা করি আংকেল আপনার বা আপনার মায়ের ওপর অহেতুক রাগ ঝাড়বে না। আপনার হয়তো মনে হতে পরে এখুনি কেন ডিভোর্স চাইছি। কয়েক বছর পরে ডিভোর্স নিলেও তো চলবে। না সুহাস চলবে না। ডিভোর্স আমার এখুনি চাই৷ আপনার বউ হওয়ার পর থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরছি আমি। অপমানে, অসম্মানে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার আত্মসম্মানে আঘাত পড়ছে। যে ছেলে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি। যে জনসম্মুখে স্বীকার করে না আমাকে, গোপনে তার বউ হয়ে থাকাটা তীব্র যন্ত্রণার। এই অসহ্য যন্ত্রণা আর অসম্মান থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করুন প্লিজ। ‘
সমাজের এক অমোঘ সত্য নারীরা শরীর বেঁচে সম্মান খোয়ায়। আজ আরো এক সত্যির সম্মুখীন হলো সুহাস। কেউ শরীর বেঁচে সম্মান খোয়ায়। কেউ বা সম্মানের বিনিময়ে শরীর বেঁচতে চায়। হ্যাঁ নামী এক রাত তার স্বামীর দৈহিক চাহিদা মিটিয়ে চিরদিনের জন্য নিজে সম্মানের সাথে বাঁচতে চাইছে৷ তীব্র ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠল সুহাসের৷ এতটা অধঃপতনও হয়নি তার। নামী কী করে পারল তাকে এতটা নীচ ভাবতে? সে তো শুধু ভয় দেখাচ্ছিল! জব্দ করছিল দেমাকি নামীদামিকে। তীব্র ক্রোধে দপদপিয়ে ওঠল মাথাটা। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। নিধি দরজা লক করে দিয়েছে। তাই বাথরুমে ঢুকে প্রচণ্ড শব্দ করে দরজা আটকে দিল। টিশার্ট খুলে আছড়ে ফেলল মেঝেতে। এরপর শাওয়ার ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নিচে দাঁড়িয়ে রইল। নামীর দৃষ্টি ছাদের দিকে। নিশ্চল দেহে একধ্যানে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কর্ণে ঠিকই শুনতে পেল শাওয়ারের শব্দ!

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।