বাইরে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক বৃষ্টি দেখছিল উদয়িনী। সোহানের নাম্বার নিয়েছে কিছুদিন আগে। অথচ ফোন বা টেক্সট কিছুই করা হয়নি। অপেক্ষার সমাপ্তি টানতে বাধ্য হলো সে। বুঝে ফেলল সোহান আজো আসবে না। তাই কল করল স্বামীর নাম্বারে। দু’বার রিং বাজতেই কল রিসিভ হলো। উদয়িনী সাবলীল কণ্ঠে শুধাল,
‘ কেমন আছো? ‘
সেদিন সুহাসের ম্যাসেজ পেয়ে বিরক্ত হয়েছিল সোহান। তবু ছেলের অনুরোধ ফেলে দিতে চায়নি৷ অপেক্ষা করছিল উদয়িনীর ফোনকলের। দিন পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এলো। উদয়িনী কল করল না। সোহান খন্দকারও অপেক্ষা করা বন্ধ করে দিল। ব্যস্ত সময় কাটাতে লাগল একাগ্রচিত্তে। এরই মধ্যে আজ হঠাৎ করে অপ্রিয় স্ত্রীর ফোন পেয়ে একটুও অবাক হলো না। সহজ গলায় বলতে উদ্যত হলো,
‘ বলো কী বলবে? ‘
তার পূর্বেই উদয়িনীর বিস্ময় করা কণ্ঠের স্বাভাবিক প্রশ্ন শুনে বলল,
‘ সৃষ্টিকর্তা যে হালে রেখেছেন সে হালেই আছি। ‘
ব্যস থেমে গেল সোহান। উদয়িনীকে পাল্টা জিজ্ঞেস করল না সে কেমন আছে? একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের মন ওঠে গেলে সে ভালো আছে কিনা জানতে চাওয়া কি সত্যি সম্ভব? অন্যকারো দ্বারা সম্ভব হলেও সোহান খন্দকারের পক্ষে সম্ভব হলো না। উদয়িনী বোধহয় আশা করেছিল। তাই নিশ্চুপ ছিল কয়েক পল। অপরপ্রান্তেও নীরবতা অটুট থাকলে থমথমে কণ্ঠে বলল,
‘ বাড়ি আসবে কবে? ‘
সোহান খন্দকারের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল। বলল,
‘ তুমি কি এটা জিজ্ঞেস করতেই ফোন করেছ? ‘
‘ না। ‘
‘ যে কারণে ফোন করেছ সে কারণটাই বলো। ‘
‘ আমি জানি তুমি বিরক্ত হচ্ছো। ‘
‘ এরপরও কেন কল করেছ? ‘
গলা কেঁপে ওঠল উদয়িনীর। আকস্মিক কেঁদে ফেলল। ওপাশে চমকাল সোহান। উদয়িনীর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যে নারী এতকাল কখনো ভাঙেনি আজ সে এত অল্পতেই ভেঙে পড়বে? বিশ্বাস হলো না। শক্ত মুখে বসে রইল সোহান৷ কানে ধরে রইল ফোন। বোঝার চেষ্টা করল ভাবগতিক। উদয়িনী নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,
‘ সোহান, একটা দিন কি আমাকে দেয়া যায় না? তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন সোহান, ভীষণ। ‘
‘ আমি শান্তিতে থাকলে তোমার সহ্য হয় না? আর কতভাবে অশান্তিতে রাখবে? আর কী প্রয়োজন আমাকে? আমার জীবন, যৌবন সবটাই তো ধ্বংস করে দিয়েছ৷ আর কী ধ্বংস করার আছে? আমার ছেলেটার জীবন ধ্বংস করতেও ওঠে পড়ে লেগেছ। সফল হতে পারছ না বলে নতুন ছক কষছো? ‘
চ্যাঁচিয়ে কথাগুলো বলল সোহান৷ উদয়িনী কয়েক পল স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে রইল। পরোক্ষণেই স্তব্ধতা কাটলে বলল,
‘ আর কারো জীবন ধ্বংস হবে না সোহান। তুমি প্লিজ একটা দিন সময় দাও আমাকে। ‘
উদয়িনী হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়। সোহান ভেবেছিল বরাবরের মতোই তর্ক দেবে উদয়িনী। এরপর প্রচণ্ড কথা-কাটাকাটি করে ফোন রেখে দেবে। কিন্তু উদয়িনীর তরফ থেকে এমন একটি উত্তর পেল যে আর কোনো কঠিন কথা শোনাতে পারল না। শত হোক সে ভদ্রলোক। আর উদয়িনী তার স্ত্রী এবং তাদের দু’টো সন্তানের মা। তাই ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিল,
‘ আমার পক্ষে সম্ভব না। ‘
‘ এটা যদি আমার শেষ চাওয়া হয় তবু না? ‘
চুপ হয়ে গেল সোহান। দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ ঠাট্টা করছ? ‘
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল উদয়িনী। বলল,
‘ সে বয়সটা আর নেই সোহান। ‘
বাক্যটির সমাপ্তি ঘটিয়ে আকস্মিক কেশে ওঠল উদয়িনী। কাশতে কাশতে হাঁপিয়ে ওঠল। ধীরপায়ে ঘরে এসে বিছানায় বসল আধশোয়া হয়ে। ওপাশে চুপচাপ সমস্তই শুনছে সোহান। কল কেটে দেয়নি বলে উদয়িনী একটু স্বস্তি পেয়ে বলল,
‘ কবে ফ্রি থাকবে? ‘
‘ কেন? ‘
‘ তুমি না আসতে পারলে আমি যাব। ‘
দমে গেল সোহান। উদয়িনী আসতে চাইলে নিষেধ করার উপায় নেই। কারণ তার সবকিছুই উদয়িনীর মাধ্যমে পাওয়া। এই যে ক্লিনিকটায় সে অবস্থান করছে এটা তার নিজের হলেও এর সূত্রপাত হয়েছে উদয়িনীর মাধ্যমেই। উদয়িনীর পারিবারিক সাপোর্ট না থাকলে আজ সে এভাবে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারত না। সবকিছু বিবেচনা করে সে বলল,
‘ দিনে সময় দিতে পারব না। সন্ধ্যায় বাড়ি আসছি। ‘
উদয়িনী হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। এক চিলতে হাসি ফুটল তার অধর কোণে। বলল,
‘ থ্যাংকস অ্যা লট সোহান। ‘
ফোনে কথা বলা শেষ হতেই কাজের মেয়ে সেলিনা এসে খবর দিল, সৌধ এসেছে। সিমরানকে নিয়ে যাবে তাদের বাড়ি৷ চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে লেগেছে। তারা সবাই আমন্ত্রিত। সুহাস, সিমরান কয়েকদিন আগে চৌধুরী বাড়ি যাবে। কথা হয়েই ছিল। আজ
সিমরানকে নিতে আসবে এটাও স্বাভাবিক। যেহেতু সৌধ নিতে এসেছে একবিন্দু আপত্তিও করল না উদয়িনী। তাছাড়া আজ সোহান আসবে। তাই সিমরান ও বাড়ি চলে গেলে সোহানের সঙ্গে একাকী দীর্ঘ সময় কাটানো যাবে। ভেবেই সেলিনাকে বলল,
‘ সিনুকে তৈরি হতে বলো। আমি নিচে যাচ্ছি। ‘
কথাটা বলেই গলায় ওড়না ঝুলিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সেলিনাকে পিছু ডেকে আবার বলল,
‘ তাড়াতাড়ি এসে দু’কাপ কফি করে দাও। সৌধ কফি ছাড়া কিছু খাবে না। ‘
সেলিনা মাথা কাত করে সিমরানের ঘরে চলে গেল।
.
.
রেইনকোট আর হেলমেট খুলে টি টেবিলের ওপর রাখল সৌধ। নিঃশব্দে বসল সোফায়৷ উদয়িনী এলো এক মিনিটের মাথায়। সৌধ তার সঙ্গে প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষ করল। ততক্ষণে সেলিনা এসে কফি তৈরি ফেলেছে। উদয়িনী সৌধ দু’জনই কফি খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক গল্প করে সময় কাটাল। সবাই উদয়িনীর সামনে বেশ অস্বস্তি নিয়ে থাকলেও সৌধর মধ্যে অস্বস্তির ছিটেফোঁটাও নেই। উদয়িনী সবার অস্বস্তি টের পায়, টের পায় কেউ তাকে পছন্দ করে না৷ তার সামনে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। কিন্তু সৌধ আলাদা। সে উদয়িনীকে আলাদা চোখে দেখে না। সবার চোখে যা কঠিন, অস্বাভাবিক সৌধর চোখে যেন তাই সহজ আর স্বাভাবিক। মোটকথা উদয়িনীর কলহপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে এড়িয়ে চলে সৌধ। ঠিক এই জিনিসটাই ভালো লাগে উদয়িনীর। ব্যক্তিগত ভাবে সৌধকে ভীষণ পছন্দ তার। তাদের পারিবারিক সম্পর্কটাও বেশ মধুর৷ যা থেকেই সুপ্ত একটি ইচ্ছে অনেক আগে থেকেও বুকের ভেতর দানা বেঁধেছে। আজ সোহান এলে এ বিষয়েও কথা বলতে হবে। সুজা চৌধুরী তাকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে। সিমরানকেও চোখে হারায় ও পরিবারের লোকগুলো। আত্মীয়ে আত্মীয়ে পরম আত্মীয়ের ইঙ্গিতটা তানজিম ভাবিই প্রথম দিয়েছে তাকে। তখন এ বিষয়ে ভাবা না হলেও এবার ভাবতে হবে। হাতে সময় খুবই অল্প। আলাপচারিতার মাঝেই লাগেজ নিয়ে সিমরান নিচে নেমে এলো৷ বুক ধুকপুক করে ওঠল সৌধর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির দৃঢ় চোয়ালদ্বয় দেখে। সিমরানকে দেখে উদয়িনীর মুখে হাসি ফুটে ওঠল৷ মেয়েকে কাছে ডেকে কপালে চুমু খেল সে৷ এরপর সৌধ দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা। ‘
সৌধ বিব্রতবোধ করল। সিমরান দীপ্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে৷ সৌধ মাথা নাড়াল। বলল,
‘ সিয়র আন্টি , বাড়িতে সবাই ওর খেয়াল রাখবে৷ টেনশন করো না। ‘
উদয়িনীকে কথাটা বলেই সিমরানের দিকে তাকাল। বলল,
‘ হেলমেট কই? ‘
হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে সেলিনা আপাকে ডেকে হেলমেট আনাল সিমরান৷ পরনে হলদু রঙের রেইনকোট আর মাথায় কালো হেলমেট পরে তৈরি সে৷ সৌধও রেইনকোট আর হেলমেট মাথায় দিয়ে বিদায় নিল উদয়িনীর থেকে৷
ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে রমণীর বুকের ভেতর অনাসৃষ্টি চলছে। তার মনের পুরুষটি ভয়াবহ সুদর্শন। যার পেছনে বসে তার বলিষ্ঠ কাঁধ স্পর্শ করে বাইকের মৃদু গতিতে সে যাচ্ছে স্বপ্নের বাড়ি৷ স্বপ্ন পুরুষটির বাড়িই তার স্বপ্নের বাড়ি৷ একদিন যে বাড়ির ছোটো বউরানি হবে সে। আপন গতিতে বাইক নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে সৌধ। সিমরান সুহাসের ছোটো বোন৷ প্রচণ্ড আদরের সম্পদ। এই বাচ্চা মেয়েটা শুধু সুহাসেরই নয়৷ তাদের পরিবার, বন্ধু -বান্ধবী প্রত্যেকেরই ভীষণ আদরের৷ সৌধ নিজেও যথেষ্ট আদর করে সিমরানকে। মেয়েটা এখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তবু তাদের কাছে মনে সিমরান যেন ঠিক ঐ আট বছরের আঁটকে আছে। সৌধর পেছনে দু’পা দুদিকে দিয়ে বসে সিমরান৷ একহাত সৌধর কাঁধে, অন্যটি নিজের ভাজকৃত হাঁটুর উপরে রাখা। পাঁচ মিনিট অতিক্রম করতেই হঠাৎ সৌধ বলে ওঠল,
‘ ভালোভাবে ধরে বোস। স্টাইল দেখাতে গিয়ে বিপত্তি ঘটবে। ‘
আকস্মিক কথায় ভড়কে গেল সিমরান। সে স্টাইল দেখাচ্ছে? কীভাবে, কখন? চোখ দু’টো ছোটো ছোটো করে সৌধকে ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকাল। এতক্ষণ তার মধ্যে ভীষণ জড়তা কাজ করছিল। সৌধ তাকে স্রেফ বন্ধুর বোন, ছোটো বোনের নজরে দেখলেও সে তো তা দেখে না। তাই তো একটুখানি স্পর্শ করতেই অদ্ভুত শিহরণে পাগলপ্রায় লাগছিল। সব অনুভূতি তুচ্ছ করে দৃঢ়ভাবে কাঁধ ধরল সিমরান। কিছুটা ঘেঁষেও বসল। ঠান্ডা প্রকৃতি, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, পছন্দের পুরুষটার বাইকের পেছনে বসে তাকে ছুঁয়ে অল্প পথ ভ্রমণেই মনটা রোমান্টিক হয়ে ওঠল। আলগোছে চোখ বুঝে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আই ফিল ইউ সৌধ ভাই , ডিপলি ফিল ইউ! ‘
‘ কিছু বললি? ‘
গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল সৌধ। সিমরান চমকাল। ঈষৎ হেসে বলল,
‘ না কিছু বলিনি। ‘
এরপর হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,
‘ অনেক কিছু বলি আমি, অনেক কিছু অনুভব করি। তুমি কি শুনতে পাও? পাও না তো। তোমার মতো এটিটিউড বয় কি এসব শুনতে পাবে? ‘
মনে মনে কথাগুলো বলে সিদ্ধান্ত নিল অনেক হয়েছে আড়ালে আবডালে ভালোবাসা। অনেক হয়েছে অপেক্ষা। এবার সে সৌধকে মনের কথা জানাবে। এতদিন অপেক্ষা করছিল সৌধ নিজে থেকেই তাকে প্রেম নিবেদন করবে৷ একটা সময় সে ধারণা করেছিল তার মতো করেই সৌধও তাকে মনে মনে ভালোবাসে। সে ধারণা থেকেই এতগুলো বছর অপেক্ষা। কিন্তু সৌধ তেমন কিছু বলেনি। অথচ তার হাবভাব সিমরান ঠিক বুঝতে পেরেছিল সে তাকে ভালোবাসে। এই যেমন সিমরান টিকটক করত। সেগুলো আবার ফেসবুকেও ছাড়ত৷ এটা নিয়েই একদিন ফোন করে শাসাল,
‘ সিনু এরপর যদি ফেসবুকে তোর একটা টিকটক পাই বাসায় এসে ঠাটিয়ে এক থা প্প ড় লাগাব। সবগুলো টিকটক ডিলেট করবি। ‘
এরপর আরেকদিন সে তার ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে মহেরা ঘুরতে গিয়েছিল। এই নিয়েও শাসন করেছে। কোন কোন ছেলে ভালো না, কার ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছে। এরপর থেকে আর তাদের সাথে মেশেনি সে। মোটকথা তার যেসব কর্মকাণ্ড সৌধর পছন্দ না সবই এড়িয়ে চলেছে। সৌধর জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো সিমরান কথা মান্য করত না৷ সে এতটাও বাধ্য মেয়ে নয়৷ কিন্তু সৌধ যখন এসব বলেছে ওর মনে হয়েছে সৌধ চায় না তার ব্যক্তিগত নারী অন্য কোনো ছেলের সাথে চলাফেরা করুক বা পাবলিকলি সহজলভ্য হয়ে যায়। নিজের পোশাকআশাকেও যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছে৷ আগের মতো শার্ট, প্যান্ট এখন খুব একটা পরে না। সৌধর পছন্দ অনুযায়ী ঢিলেঢালা পোশাকই পরার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে স্মৃতি আপুকে অনুসরণ করে খুব। এতকিছু করার পরও সৌধর থেকে ইতিবাচক কোনো বার্তা পায়নি৷ তাই এখন তার মনে হচ্ছে শক্ত ব্যক্তিত্বের ছেলেরা ভালোবাসার মানুষটার কাছে ভালোবাসার আবেদন নিয়েও ছ্যাবলামি করতে পারে না৷ সৌধ আলাদা ধরনের। এজন্যই সিমরান তাকে ভালোবাসে। থাকুক না মানুষটা তার আলাদা ব্যক্তিত্ব নিয়ে৷ নাইবা বলল নিজে থেকে ভালোবাসার কথা। তাদের ভালোবাসাটা না হয় ভিন্ন ধারার হবে৷ সেই না হয় আগে ভালোবাসা প্রদান করবে।
বাড়ির প্রায় কাছাকাছিই এসে পড়েছে। এমন সময় আকস্মিক বাইক থামাল সৌধ৷ চমকে ওঠল সিমরান। বাইক থামিয়ে সিমরানকে নামতে বলল সে। সিমরান অবাক হয়ে নেমে দাঁড়াল। নেমে দাঁড়াল সে নিজেও৷ এরপর আশপাশে তাকিয়ে দেখল হেলমেট খুলবে কিনা৷ ফাঁকা রাস্তা। একটা, দু’টো গাড়ি যাচ্ছে। অনেক ভেবেচিন্তে আর হেলমেট খুলল না। পাছে কে দেখে চিনে ফেলল। সুজা চৌধুরীর ছোটো পুত্র একটি মেয়ে নিয়ে রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই তো আর জানে না সিমরান তার বন্ধুর বোন। পারিবারিক আত্মীয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। মন, মেজাজ তার খুব একটা ভালো নেই। কারণ নিধির মধ্যে ভয়াবহ ধরনের পরিবর্তন খেয়াল করেছে সে৷ আজকাল আর রাত দশটার পর ওকে খুঁজে পাওয়া যায় না৷ দিনেও বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে। এই ব্যস্ততার কারণ কী বুঝে ওঠতে পারে না। বুঝতে পারে শুধু নিধি তাকে এড়িয়ে চলছে। কিছুদিন আগেও এই এড়িয়ে চলাটা ছিল না। বরং কিছুটা আশকারা ছিল। হঠাৎ সব কেমন যেন হয়ে গেল। দু’দিন হলো কথা হয় না। রাগারাগি করেছে সে নিজেই৷ কিন্তু নিধি আর রাগ ভাঙায়নি। বলা যায় সে হয়তো রাগ ভাঙানোর সময় করে ওঠতে পারেনি। রাগ, অভিমান, খারাপ লাগা সবকিছুর পরও মেয়েটাকে ভালোবাসে সৌধ। তাই আর নিজেকে আটকাতে পারল না। সাহায্য নিল সিমরানের। বলল,
‘ একটা হেল্প কর তো। ‘
বুক ধক করে ওঠল সিমরানের। উত্তেজনায় ঠোঁট কাঁপছিল তার। মন বলছিল সৌধ বুঝি কাঙ্ক্ষিত কিছু বলার জন্যই এভাবে মাঝরাস্তায় বাইক থামিয়েছে। কিন্তু না সে তো হেল্প চাইছে! কী হেল্প? মনের প্রশ্ন মুখেও বেরিয়ে এলো,
‘ কী হেল্প? ‘
‘ নিধিকে তোর ফোন থেকে একটা কল কর। আর জিজ্ঞেস কর কবে আসবে। ‘
সৌধর চিন্তান্বিত দু’টি চোখে তাকিয়ে ঘনঘন পলক ফেলল সিমরান৷ নিধি সৌধ ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। শুধু সৌধ না তার ভাই সুহাসেরও বেস্ট ফ্রেন্ড। তারা সবাই সবার প্রতি খুব পজেসিভ। ঠিক যেন গল্পটা বন্ধুত্বের নাটকের মতো ওদের বন্ধুত্বের বন্ডিং। সবই জানে সিমরান৷ সেই সাথে নিধির পারিবারিক সমস্যার কিছু কথা শুনেছে। স্মৃতি আপুর বিয়েতে সবাই আসবে। নিধি আসবে কিনা এ নিয়ে সকলের মধ্যে সংশয়৷ সংশয় সৌধর চোখে, মুখেও ফুটে ওঠেছে৷ ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসল সিমরান। বলল,
‘ আচ্ছা ফোন দিচ্ছি। তুমি টেনশন করো না। নিধিপু ঠিক আসবে। ‘
কথাটা বলেই কল করল নিধির ফোনে। সৌধ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখনো। একবার রিং হলে ধরল না৷ সৌধ অধৈর্য হয়ে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে গেলে রিসিভ হলো সিমরানের ফোন। ওপাশ থেকে ভেসে এলো ঘুম কাতুরে এক পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
‘ হ্যালো কে বলছেন? ‘
আঁতকে ওঠল সিমরান। চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করেই ফোন কেটে দিল। ঢোক গিলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
‘ সৌধ ভাই, ছেলে মানুষ ফোন ধরেছে। ‘
ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলো সৌধ। হাত বাড়াল ফোন চেয়ে। সিমরান ফোন এগিয়ে দিলে সে নিজেই কল করল। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো। শোনা গেল নিধির শান্ত গলা,
‘ হ্যালো সিমরান? ‘
সৌধ সঙ্গে সঙ্গে সিমরানের হাতে ফোন দিল। সিমরান ফোন কানে দিয়ে হ্যালো বলতেই নিধি বলল,
‘ কেমন আছো? ‘
‘ এইতো ভালো আপু তুমি কেমন আছো? কে ফোন ধরেছিল? ‘
নিধি কথাটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,
‘ কিছু বলবি? ‘
‘ কবে আসবে তুমি? সবাই জানতে চাচ্ছে। ‘
সবাই বলতে কে ঠিক বুঝে নিল নিধি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুচকি হাসল। বলল,
‘ সৌধকে বল আমি ইদের পরেরদিনই যাব। এত ফোন দিতে হবে না৷ একবার যখন বলেছি যাব তো যাবই। ‘
ফোনে কথা শেষ করে সৌধকে সবটা বলতেই বাইক স্টার্ট দিল সৌধ। এরপর তারা পৌঁছাল নিজেদের গন্তব্যে। বাড়ির সদর দরজায় পা রাখতেই সৌধর মা তানজিম চৌধুরী এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল সিমরানকে। এরপর সিমরানের কোমল থুতনি ছুঁয়ে কপালে চুম্বন এঁটে বলল,
‘ আমার ছোটো আম্মা হাজির। এইবার আমার ঘরের খুশি কানায় কানায় পূর্ণ। ‘
স্মৃতি আপু চোখ ছোটো ছোটো করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল৷ বড়ো ভাবিকে তার মা, বাবা বড়ো আম্মা বলে ডাকে। সিমরানকে ছোটো আম্মা ডাকল কেন? তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে অন্য রকম গন্ধ পৌঁছাল। ঠিক সেই মুহুর্তে সৌধ এসে সিমরানের পাশে দাঁড়াল। এক মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল স্মৃতি। পরোক্ষণেই মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবনার ইতি টানল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ ধূরর কী সব মাথায় আসছে। পাঁচ বছর যাবৎ সৌধ নিধিকে ভালোবাসে। আর আম্মা হয়তো এত ডিপলি চিন্তা করে কিছু বলেনি। আর যদি চিন্তা করে বলেও থাকে এটা কখনোই সম্ভব না। আমার ভাই যা জিনিস! ‘
মাথা ঝাঁকিয়ে দুঃশ্চিতা সরিয়ে দিয়ে সিমরানকে গিয়ে চেপে ধরল স্মৃতি । প্রাণ চঞ্চল মেয়েটা যখন হাজির৷ এবার বাড়িতে বিয়ে বিয়ে অনুভূতি ঠেকায় কে?
Leave a comment