ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৪৩

18 Min Read

সেদিন কথোপকথন শেষ করে গভীর ভাবনায় পড়ে তানজিম চৌধুরী। এরপর বেশ তাড়াহুড়ো করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় সিমরানকে৷ কারণ সে সময় সৌধ, সুহাস ছাড়াও ওদের আরো বন্ধু, বান্ধবী বাড়িতে উপস্থিত ছিল। সিমরান চলে যায়। কেউই টের পায় না, জানতে পারে না সেদিন সিমরানের চৌধুরী বাড়িতে আসার খবর৷ এরপর স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন তানজিম চৌধুরী। স্বামীর অনুমতি নিয়েই দু’দিন পর ডেকে পাঠান ছেলে সৌধ আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুহাসকে। তারা দু’জন প্রস্তুত ছিল। সুহাসের পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, সৌধর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যই ডেকে পাঠিয়েছেন আন্টি। সুহাস খুশিই হলো। দু’দিন আগেই তারা বন্ধুরা মিলে নিধিকে দেখতে গিয়েছিল। প্রাচী বুঝিয়েছে মেয়েটাকে। সারাজীবন বাস্তবতা আঁকড়ে ধরা মেয়েটা জীবনের এমন পর্যায়ে এসে আবেগে যেন গা না ভাসায়৷ হুশিয়ারি দিয়েছে। সেই সঙ্গে নিয়েছে একটুখানি মিথ্যার আশ্রয়৷ সৌধ এনগেজড। খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে করবে সৌধ চৌধুরী। সৌধকে নিয়ে বলা এহেন কথা বিশ্বাস করতে পারেনি নিধি৷ তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা টের পায় কিছু একটা গড়বড় আছে। সে যে টের পেয়েছে সেটি বুঝতে দেয় না কাউকেই৷ বন্ধুরা তার সঙ্গে দেখা করে, স্বান্তনা দিয়ে, জ্ঞান মূলক বাণী আওড়ে ফিরে আসে। সেও ফিরে যায় স্বামী অর্পণের সঙ্গে তার বাসায়। নিধিকে বলা সেই মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণ করতে বন্ধুরা উদগ্রীব। তীব্র অনীহা সৌধর। সুহাস যতটা উৎসাহিত হয়ে তানজিম আন্টির সঙ্গে দেখা করতে এলো। সৌধ মায়ের কাছে এলো ততটাই নিরুৎসাহিত ভাবে।
.
.
অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বস্ত কথাগুলো শুনে দু’টো মস্তিষ্কে যেন বিস্ফোরণ ঘটল! সৌধ, সুহাস হতভম্ব মুখে একে অপরের দিকে চেয়ে রইল কয়েক পল। এরপর বিমূঢ় মুখে তাকাল তানজিম চৌধুরীর পানে। এই মানুষটা কখনো নড়বড়ে কথা শোনা পছন্দ করেন না৷ সেখানে নিজে নড়বড়ে কথা বলা তো অসম্ভব। সম্পূর্ণভাবে সঠিক তথ্য বিহীন আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া মানুষ নন মা। জানে সৌধ৷ মনে প্রাণে বিশ্বাসও করে। কিন্তু আজকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু বিশ্বাস নয় নিঃশ্বাস নিতেও কষ্টবোধ করছে। সিমরান! সিমরান তাকে ভালোবাসে? সেই ক্লাস নাইন থেকে ভালোবাসে সিমরান তাকে? অথচ সে টের পেল না আশ্চর্য! নাকি ওভাবে কখনো খেয়াল করেনি বলেই বুঝতে পারেনি। এসব কথা, প্রশ্নের মাঝেই আচমকা মনে পড়ল সেদিন সিমরানের বলা সেই কথাটি। সে যখন বলল, গোপন প্রেমিক আছে কিনা। সিমরান তখন সত্যি, মিথ্যার প্রশ্ন তুলল৷ তখন সে বলেছিল,
‘ আমি মিথ্যা সহ্য করতে পারি না। ‘
আর সিমরান উত্তর দিয়েছিল,
‘ তুমি সত্যিটাও সহ্য করতে পারবে না৷’
তবে কি সত্যি এটাই ছিল!
সৌধর মতো একই অবস্থা সুহাসেরও হলো। কিন্তু পরোক্ষণেই মাথায় আসল সেদিন সিমরানের দেয়া প্রতিক্রিয়াটি৷ শুধু সেদিন নয় গত কয়েকমাস ধরে সিমরানের সমস্ত আচরণ এক এক করে স্মরণ হতেই কেঁপে ওঠল অকস্মাৎ। থমকানো দৃষ্টিতে তাকাল সৌধর পানে। সৌধ অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
‘ আই কান্ট বিলিভ দিস। ‘
সুহাসেরও বিস্মিত স্বর,
‘ মি ঠু। ‘
ওদের প্রতিক্রিয়া দেখে তানজিম চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জানালেন পূর্বে করা তাদের পরিকল্পনার কথাটিও। এক পৃথিবীতে একই সঙ্গে এতবার বজ্রপাত হয়েছে কি কখনো? যতবার সৌধ আর সুহাসের মাথায় হলো? আর নিতে পারল না সুহাস। অতিআদুরে বোন তার। যাকে কোনোদিন একটা ধমক পর্যন্ত ঠিকভাবে দিতে পারেনি। তার উদ্দেশ্য এবার কড়া শাসনের সুর আওড়াল। সৌধ কেমন মানুষ খুব ভালো করেই জানে সে। বন্ধু সম্পর্কে ধারণাও কম নেই তার। তাই তাকে স্বান্তনার স্বরে বলল,
‘ আমি এক্ষুনি বাড়ি যাব আর সিমরানকে কড়া শাসন করব৷ এখন বুঝতে পারছি ওর কতটা শাসনের অভাব। কতবড়ো ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। আজ সপাটে কয়েকটা থা প্পড় মেরে বুঝিয়ে দিব। ‘
ক্রোধে জর্জরিত সুহাস। বিচলিত সৌধ। সে জানে রাগের বশে সুহাস এভাবে বললেও এতখানি করতে পারবে না। কিন্তু সেই জানার বাইরে গিয়ে যদি ঝোঁকের বশে করে ফেলে মারাত্মক বিপদ ঘটে যাবে৷ সিমরানকে তো কম দিন দেখছে না। সেই ছোট্ট সময় থেকে চেনে মেয়েটাকে। তাই সাবধানি বাক্য ছুঁড়ল,
‘ সুহাস মাথা ঠান্ডা কর। যা বলেছিস বলেছিস এসব করতে যাস না। বিপদ ঘটবে। ‘
বন্ধুকে কথাটা বলেই শান্ত মুখে শীতল দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাল। তানজিম চৌধুরী অত্যন্ত গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন। সুহাসকে দেখছেন জহরি চোখে। সৌধ তার দিকে তাকিয়েছে টের পেতেই দৃঢ় কণ্ঠে সুহাসকে প্রশ্ন করল,
‘ সুহাস, তোমার কি আমার ছেলে সৌধকে অযোগ্য মনে হয়? ‘
চমকে তাকাল সুহাস। বিব্রত কণ্ঠে বলল,
‘ এ কী বলছ আন্টি! সৌধ আমার কতটা ঘনিষ্ঠ, বন্ধু কম ভাই বেশি। অযোগ্য কেন মনে হবে? ‘
‘ তাহলে সিনু মাকে কেন শাসন করবে? কেন তার গায়ে হাত তুলবে? তার দোষটা কোথায়? ‘
দৃঢ় কাঁধ দু’টো নুইয়ে পড়ল সুহাসের। হতাশ কণ্ঠে বলল,
‘ জেনে বুঝে বোন আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইছে আন্টি। ভাই হয়ে আমি আটকাব না? ‘
চোখ দু’টো ছোটো ছোটো হয়ে গেল তানজিম চৌধুরীর। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
‘ আমার ছেলে আর এই পরিবার দু’টোই তোমার কাছে আগুন? ‘
আকস্মিক জিভ কামড়াল সুহাস। বলল,
‘ না, না এই পরিবার না। কিন্তু সৌধকে আমি যতটা চিনি ততটা এই পরিবারের কেউ চেনে না। আমার বোন সম্পর্কেও তো জানি আমি। বোন আমার উপর থেকে যেমনি দেখো ভেতরে ভেতরে খুব নরম, ঠান্ডা পানি একদম। সেখানে সৌধ! রাগ করো না আন্টি। সৌধ সত্যি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। ও নিধি ছাড়া আর কোনো মেয়ের জন্য মোমের চেয়েও নরম, বরফের চেয়েও ঠান্ডা হতে পারবে না। আমি সৌধকে খুব কাছ থেকে জানি৷ এমন জানা তোমরা কেউ জানো না। সিনু অবুঝ। বিশ্বাস করো, ও খুব অবুঝ আর আবেগি মেয়ে। ভালোবাসার কাঙাল। খুব বোকাও। নয়তো চোখের সামনে এতসব দেখে ও কেন তোমার কাছে আসবে। এভাবে আবদার করবে? আমার মনে হয় একা একা থাকতে থাকতে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ‘
সুহাসের কথা শুনে হাসল তানজিম চৌধুরী। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ শুধু সিনু নয় তার ভাইটাও খুব বোকা আর ভীতু। ‘
‘ হ্যাঁ আমি ভীতু আন্টি। আমার বোন অসুখী যেন না হয় সেই ভয়ে থাকি আমি। সারাজীবন দু ভাই বোন ভালোবাসার কাঙাল হয়ে বড়ো হলাম। বাবা, মায়ের দূরত্ব, বিবাদ দেখলাম। সেই একই অবস্থা বোনের জীবনে হোক চাই না। ‘
থামল সুহাস। শ্বাস নিল বড়ো বড়ো করে। তানজিম চৌধুরী একটু ভাবুক হলেন। তাকালেন সৌধর দিকে। সৌধ নিশ্চুপ। যেন ভাবছে গভীর কোনো ভাবনা। সে বললেন,
‘ সৌধ, সুহাসের বক্তব্য শুনলাম। আমার আর তোমার বাবার ইচ্ছে, আদেশ যাই বলো আমরা সিনুকে তোমার বউ করে আনতে চাই। সোহান ভাইয়েরও মত আছে। তোমার মত জানতে চাই। ‘
ভ্রু কুঁচকে ফেলল সৌধ। সে চিন্তিত সিমরানকে নিয়ে। কিন্তু সিদ্ধান্ত সেটা আবার কী? নতুন করে কী সিদ্ধান্ত দেবে সে। যা দেয়ার তা তো আগেই দিয়েছে।
‘ আমার সিদ্ধান্ত পূর্বে যা ছিল এখনো তাই আছে আম্মা। ‘
সহসা রেগে গেলেন তানজিম। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বললেন,
‘ তুমি সারাজীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবে? ‘
চোখ তুলে তাকাল সৌধ বিনয়ের সঙ্গে হাসল মৃদু। বলল,
‘ ইয়েস। এভাবেই কাটিয়ে দেব। ‘
‘ বিয়ে তোমাকে করতে হবে সৌধ। ‘
তীব্র জেদি কণ্ঠ তানজিম চৌধুরীর। মায়ের এমন জেদি রূপ এই প্রথম দেখল সৌধ। কড়া দৃষ্টি বরাবর নিজের দৃষ্টি রাখতে পারল না আর। মস্তক নত করল৷ ফেলল গভীর এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস। পাশ থেকে সুহাস বলল,
‘ এভাবে জীবন কাটানো যায় না সৌধ। সব সময় তো তুই নীতি বাক্য বলিস। আমাদের ভালো, মন্দ পরামর্শ দিস। আজ আমি দিচ্ছি, শোন উপরে একজন আছেন। যার নিয়মেই পৃথিবী চলে, মানুষ চলে। একটি গাছের একটি পাতাও তার আদেশ ছাড়া নড়ে না। সেখানে তুই আমি কিন্তু তুচ্ছ। বিয়ে কিন্তু আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় একটি অধ্যায়। আমি চাই নিজের জন্য যোগ্য পাত্রী নির্বাচন করে বিয়ে কর তুই। ‘
‘ জ্ঞান দিস না এসব তোর থেকে ভালো আমি জানি আমি বুঝি। আম্মা সামনে না থাকলে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতাম আরো। ‘
মৃদু ধমকে কথাগুলো বলল সৌধ। তানজিম চৌধুরী ছেলের আচরণ দেখে স্তব্ধ হয়ে রইলেন৷ বিমূঢ় স্বরে বললেন,
‘ বিয়ে তোমাকে করতেই হবে সৌধ৷ এরজন্য যদি আমার প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় দিব। ‘
সহসা হুমকিতে বুক কেঁপে ওঠল সৌধর। বিস্মিত গলায় বলল,
‘ আম্মা! ‘
সুহাসও ভয় পেয়ে গেল। তীব্র দুঃশ্চিতায় শরীর দুর্বল অনুভূত হলো তার। এমন সময় চোখ, মুখ শক্ত করে হঠাৎ সৌধ বলল,
‘ ওকে ফাইন, বিয়ে করা যদি তোমরা বাধ্যতামূলকই করো করব। কিন্তু সিনুকে না আম্মা। ও আমাদের সবার খুব স্নেহের, আদরের। জেনে-বুঝে ওর জীবন আমি নষ্ট করতে পারব না। আমি চাই না ও অসুখী হোক। স্বামীর ভালোবাসার অভাব নিয়ে জীবন কাটাক৷ ‘
একই চাওয়া সুহাসেরও। একই মতও সুহাসের। তানজিম চৌধুরী কড়া গলায় বললেন,
‘ তুমি চাও না সিনু অসুখী হোক। আর আমরা কেউ চাই না পরের বাড়ির পরের মেয়ে অসুখী হোক। নারী হয়ে আমি আরেক নারীর চরম সর্বনাশ করতে পারব না সৌধ। তাই তোমার জন্য সিনু ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে আনাও সম্ভব না। ‘
রাগান্বিত হলো সৌধ। সিমরান যদি তার প্রতি দুর্বল হয়েও পড়ে তার মা কেন দুর্বল হচ্ছে সিমরানের প্রতি? সে কি বুঝতে পারছে না এই দুর্বলতা সিমরানের জন্য ক্ষতিকারক! আর এক মুহুর্ত মায়ের সামনে বসে থাকার ধৈর্য্য হলো না সৌধর। তড়াক করে ওঠে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে প্রস্থান করল। এটুকু না করলে শ্রদ্ধেয় আম্মার সঙ্গে চরম বেয়াদবি করে ফেলত! বিয়ে করতে সম্মত হয়েছে শুধু মায়ের হুমকি শুনে নয় ওদিকে তার বন্ধুরা নিধিকে বলে এসেছে তার বিয়ে ঠিক। বন্ধুদেরকে মিথ্যাবাদি প্রমাণ করতে চায় না সে। আর না চায় ওই বেইমানটার সংসার ভাঙুক। প্রতারকটা দুশ্চরিত্রা রূপে সর্বমহলে পরিচিতি পাক। সবশেষে সে নিজেও সহ্য করতে পারবে না নিধির ওই ঘৃণিত চেহেরা। যে গুণে মানুষটাকে ভালোবেসে এত এত বিরহ বুকে পুষল সেই গুণ গুলোর সবটুকু এভাবে মিথ্যা, ধোঁয়াশায় পরিণত হতে পারে না৷ একদমই না।
সৌধর মায়ের কথায় তীব্র অসন্তুষ্ট সুহাসও। তাই বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না আর৷ কিন্তু তানজিম বললেন,
‘ সুহাস তুমি নিজেও কিন্তু প্রথমে নামীকে মেনে নিতে পারোনি। নামী তোমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একটা মেয়ে ছিল। এরপরও সৃষ্টিকর্তার রহমতে পবিত্র সম্পর্কের জোরে তোমাদের মধ্যে অপরিমেয় ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। যেখানে তোমাদের অসম্ভব সম্পর্ক সম্ভবে পরিণত হয়েছে। সেখানে সিনু আর সৌধর সম্পর্ক কিন্তু সম্ভব। সিনু সৌধকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর সৌধ সিনুর প্রতি সংবেদনশীল। প্রচণ্ড স্নেহ করে সিনুকে। সবচেয়ে বড়ো কথা অন্য একটা মেয়েকে সৌধর বউ করে আনলে তার প্রতি সৌধ অবিচার করতে দুবার ভাববে না৷ কিন্তু সিনুর প্রতি অবিচার করার আগে ওর বিবেক নড়ে ওঠবে। ‘
‘ ভুল বললে আন্টি। সৌধ কিন্তু সুহাস নয়। প্রথম দিকে নামীর প্রতি যে অন্যায়টা আমি করেছি সেটা সৌধ করবে না। তোমার ছেলেকে তুমিই চিনতে পারোনি আন্টি! ‘
থেমে গেল তানজিম। সত্যিই তো। তার সৌধ কক্ষণো কারো প্রতি অবিচার করতে পারবে না। সেভাবে ছেলেকে গড়েই তুলেনি সে৷ কিন্তু এই মুহুর্তে এই অস্ত্রটিই তো কাজে লাগবে তার। সবাইকে এটাই বোঝাতে হবে। তবেই না সবাই রাজি হবে সিনু আর সৌধর শুভ বিবাহের জন্য। তাই পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল,
‘ সুহাস তোমার কথা হয়তো ঠিক৷ কিন্তু বাবা যাকে বিয়ে করবে তার প্রতি বিবেকবান হয়ে লাভ কি যদি মন থেকে ভালোবাসতেই না পারে? ‘
‘ তুমি কী বলতে চাচ্ছ সৌধ সিনুকে ভালোবাসতে পারবে? ‘
‘ পারবে? ‘
‘ কীভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছ আন্টি? ‘
‘ আমি তো মা সুহাস। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি একজন নারী। নারী ভালোবেসে সব জয় করতে পারে। সিনু যদি সৌধকে এতটা ভালো না বাসত তাহলে এতখানি জোর করতাম না বাবা। যে ভালোবাসা আমি দেখেছি যে হৃদয় নাড়ানো কথা শুনেছি এরপর সিনুকে কষ্ট দেয়া সম্ভব না৷ এই মুহুর্তে সৌধ সিনুর ভালো ছাড়া আমি আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। ‘
এত বুঝিয়েও লাভ কিছু হলো না। সুহাস একদম নিরুত্তর হয়ে ওঠে পড়ল৷ বিদায় নিল একরাশ হতাশা ভরে। এরপর বাড়ি গিয়ে সর্ব প্রথম বোঝাপড়া করল সিমরানের সাথে। দু ভাই বোনের প্রথমে তর্ক, বিতর্ক হলো। এক পর্যায়ে তীব্র ক্রোধে আচমকা সুহাস থা প্পড় মেরে বসল সিমরানের গালে। সহ্য করতে না পেরে চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে নিজের ঘরে দৌড়ে চলে গেল সিমরান। দরজা আঁটকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল মেয়েটা। নিচ থেকে বোনের এমন করুণ দশা দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারল না সুহাস৷ ত্বরিত টেলিফোনের কাছে গিয়ে কল করল মা, বাবাকে৷ জানালো কী কঠিন পরিস্থিতিতে আছে তারা ভাইবোন। বাবা জানালো সে এক্ষুনি আসছে। মা আগামীকাল আসবে। এরপর সুহাস অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবল কী করা যায়। সিমরানকে কীভাবে বোঝানো যায়। কিন্তু কোনো সুরাহা মিলল না। নিজের এই কঠিন পরিস্থিতিতে নামীর সঙ্গে হওয়া সব রাগ, অভিমান ভুলে গিয়ে ছুটে গেল নামীর ফ্লাটে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কাক ভেজা হয়ে হঠাৎ সুহাসের আগমন। চোখ দু’টো রক্তিম, মুখ ভাড়। ভয় জেঁকে ধরল নামীকে। কী হয়েছে সুহাসের? এমন অস্বাভাবিক লাগছে কেন? ফারাহ আজকের জন্য পাশের রুমে চলে গেল। তারা দু’জন এখন বিরাট একটি ফ্লাট ভাড়া করে থাকে। আগে সুহাস আসত৷ রাগারাগি হওয়ার পর আসে না আর৷ আইয়াজ আসে মাঝে মাঝেই৷ এছাড়া পুরো ফ্লাটে তারা দুই বান্ধবীই রাজত্ব করে বেড়ায়। মাঝেসাঝে সিমরান এসেও থাকে অবশ্য। আজ হঠাৎ সুহাস আসাতে ফারাহ চলে গেল অন্য রুমে। বদ্ধ ঘরে সুহাস হাত, পা ছেড়ে ফ্লোরে ভেজা কাপড়ে বসে রইল। নামী ঠান্ডা গলায় বেশকিছু ক্ষণ সময় বলল,
‘ সুহাস কাপড় বদলে আসো ঘর ভিজে যাচ্ছে। ‘
সে কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না ছেলেটা। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু। প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল নামী৷ কাল পরীক্ষা আজ হঠাৎ সুহাস এলো। তাও এই বিধ্বস্ত অবস্থায়। চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে এলো। মোবাইল নিয়ে দ্রুত চলে গেল বেলকনিতে। ফোন করল সিমরানকে। চারবার রিং হলো অথচ ফোন রিসিভ হলো না। টেনশনের মাত্রা দ্বিগুণ হলো এবার৷ কাকে ফোন করা যায় ভাবতে ভাবতে ফোন করল সেলিনা আপাকে। সুহাসদের বাসার কাজের মহিলা। সেলিনা আপা ফোন রিসিভ করেই ভয় জড়ানো কণ্ঠে এক এক করে সবটা খুলে বলল নামীকে। সব শুনে শিউরে ওঠল নামী। বুকে সৃষ্টি হলো কম্পন। তড়িঘড়ি করে ফোন রেখে দিল সে। রাখার আগে সাবধান করে বলল,
‘ সিনুর খেয়াল রেখো। দরজা বন্ধ তাতে কী? জানালা তো খোলা, সব সময় খেয়াল রাখবে। কোনো বিপদ ঘটতে নিলেই ফোন করবে বাবা, মাকে। ‘
সেলিনা আপার সাথে কথা শেষ করেই সোহান খন্দকারকে কল করল। জানতে পারল সে বাসার পথে। এবার কিছুটা নিশ্চন্ত হয়ে ফোন কেটে দিল। রুমে গিয়ে ফোন রেখে নিজের ছোট্ট কাভার্ড থেকে ভাঁজ করে রাখা সুহাসের গরম কাপড় বের করল।
চটজলদি তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে এলো সুহাসের কাছে। যত্ন নিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে বলল,
‘ ঠান্ডা লেগে যাবে সুহাস৷ কাপড় চেঞ্জ করো। ‘
যেন কিছুই শুনেনি এমন একটা ভাব। আগের চেয়েও দ্বিগুণ জেদ ধরে, শরীরটা দৃঢ় করে বসে রইল। নামী ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর মুখটায় তাকাল একবার। মাথা মুছা শেষ। তাই বিছানার এক পাশে তোয়ালে রেখে। কাছাকাছি সম্মুখীন হয়ে বসে সুহাসের শার্টের বোতাম খুলতে লাগল এক এক করে। মনে মনে ভেঙচি দিয়ে বলল,
‘ যত তেজ আমার কাছেই। ‘
মুখে বলল,
‘ আরে বাবা শরীর শক্ত করে রাখলে শার্টটা খুলব কী করে? ‘
পরোক্ষণেই মনে মনে গজগজ করতে করতে বলল,
‘ এতদিন মুখে কথার খই ফুটিয়ে জ্বালিয়েছে। এখন এসেছে গম্ভীর, বোবা বনে গিয়ে জ্বালাতে। ‘
বেশ বেগ পেতে হলো শার্টটা খুলতে। ভেজা শার্ট ফ্লোরের একপাশে রেখে শরীর মুছে দিল। সুহাসের কোনো ভাবান্তর নেই৷ প্যান্টটাও ভেজা। বড্ড মুসিবতে পড়ল নামী। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
‘ প্যান্টটাও কি আমাকে খুলতে হবে? ‘
এ পর্যায়ে নড়চড় করল সুহাস। অন্য সময় হলে কতশত অসভ্য কথা বলে ফেলত এ মুহুর্তে। লজ্জা দিত সভ্য বউটাকে। কিন্তু আজ কিছুই বলল না। চুপচাপ ওঠে বের করে আনা পোশাক গুলো নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। এতেই বুকের ভেতর চিনচিন করে ওঠল নামীর। ভীষণ মায়াও হলো। ভালোবাসার মানুষটির একটুখানি কষ্টও যে সহ্য হয় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মনস্থির করল, আজ আর সিনু, সৌধ ভাই নিয়ে কোনো প্রকার কথা বলবে না। প্রশ্ন করবে না। কিছু বোঝাবেও না। রাগ অভিমান চলছে তাদের। কত্তদিন পর এলো মানুষটা। আজ একসঙ্গে সময় কাটাবে। মন ভালো করার চেষ্টা করবে। সুহাস যদি কিছু বলতেও চায় সে শুনবে না। বলবে,
‘ সব কথা আগামীকাল শুনব৷ আজ শুধু তোমার, আমার কথা চলবে। আজকের এই বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যা, দীর্ঘ রাতটা শুধু তোমার আর আমার জন্য।‘

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।