ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৫০

11 Min Read

এক সময়ের প্লেবয় খ্যাত সুহাস এখন বিবাহিত। এ সম্পর্কে সবাই অবগত। রোমিও সুহাস এখন আর আগের মতো নেই৷ বিয়ের পর বদল ঘটেছে বিস্তর।
আকস্মিক বদলে যাওয়া এই ছেলেটি যখন বহু বছর পর ইসমাকে ফোন করে। প্রচণ্ড অবাক হয় ইসমা। বিস্ময়াপন্ন হয়ে ফোন রিসিভ করে। এরপর ভালো, মন্দ কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। ইসমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। স্বামী বিরাট বড়ো বিজনেস ম্যান। নিজের প্রাক্তন সুহাসকে এ কথা জানাতে ভুলে না সে৷ এক সময় সুহাসের প্রতি ভীষণ দুর্বল ছিল ইসমা৷ সে জানত সুহাস তাকে প্রকৃত ভালোবাসে না৷ তবু ক্ষণিকের একটি সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল তারা। অগণিত প্রেমিকার ভীড়ে সেও ছিল একজন৷ চেষ্টা করেছিল সুহাসের হৃদয়ে পৌঁছাতে। কিন্তু পারেনি৷ সুহাস সম্পর্কে সিরিয়াস ছিল না কখনোই৷ কাপড় বদলানোর মতো গার্লফ্রেন্ড বদলানো স্বভাব যার তার কি আর সাধারণ ঘরের ইসমাতে মন আঁটকায়? এরপর আচমকাই একদিন জানতে পারে সুহাস বিয়ে করেছে। তার সাথে ব্রেকআপ বিহীন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল বহু আগেই। সুহাসের বিয়ের খবর শুনে সেদিন প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিল সে। রাত জেগে কেঁদেছিল খুব৷ সবচেয়ে অবাক হয়েছিল যখন সুহাসের বউকে দেখল। বিশ্বাস করতে পারছিল না গায়ের রঙ চাপা এমন একটি মেয়ে সুহাসের বউ৷ এত সুন্দরী, স্মার্ট মেয়েদের সঙ্গে টাইমপাস করে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করল শ্যামবতী নামীকে! পুরুষ মানুষের মন বোঝা খুব কঠিন৷ আর সুহাসের মন তো জিলিপির প্যাঁচকেউ হার মানায়৷ সেদিনের কষ্টকে স্মরণ করে প্রাক্তন প্রেমিককে কৌশলে অনেক কথাই বলে ইসমা৷ তার হবু বর দেখতে কেমন, বাড়ি কেমন, কয়টা গাড়ি আছে সবই বিবৃতি করে শোনায়। বোঝানোর চেষ্টা করে সুহাসের চেয়ে বহুগুণে গুণান্বিত কেউ তার জীবনে আসতে চলেছে। সুহাসও কম নয়। সে এখন কোথায় কী করছে, তার ওয়াইফ কী করছে সবটাই জানায়। নিজের বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্য বলে না৷ নামীর সঙ্গে সে যে রাগ করে আছে, তীব্র অভিমানে জর্জরিত হয়ে আছে সেটিও লুকায়। সে শুধু তার দাম্পত্য জীবনের ভালো ভালো কথাগুলো বিবৃতি করতে থাকে। নামী তাকে কত ভালোবাসে, কেয়ার করে সবই বলে। সুখের গল্প শেষে দুঃখের গল্পও করে। হঠাৎ করে মা চলে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারেনি৷ রাতে ঘুম আসে না। ঘুমালেই দুঃস্বপ্ন দেখে। এই রাতবিরেতে বন্ধুদের ফোন করে পেল না। তার স্ত্রীও অসুস্থ। তাই হঠাৎ ইসমাকে মনে পড়ল বলেই কল দেয়া। ইসমা শুনে হাসে। তারা আবারো তাদের গল্প জমে ওঠে। এভাবে রাত পেরিয়ে যায়। নামীর ঘুম ভাঙে। চকিতে ওঠেই প্রশ্ন করে সুহাসকে কার সাথে কথা বলছে? সুহাস উত্তর দেয় না৷ ইসমার সঙ্গে কথার সমাপ্তি টানে৷ ফোন কেটে বিছানা ছাড়তেই হঠাৎ নামী তার হাত টেনে ধরে। তীব্র ক্রোধে জর্জরিত হয়ে শুধায়,
‘ কতদিন ধরে চলছে এসব? ‘
‘ বলতে বাধ্য নই। ‘
নামী বরাবরের শান্তশিষ্ট। খুব সহজে রাগে না৷ আজ এই মুহুর্তে তার কী হলো কে জানে? নিজের ক্রোধটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না একদমই। আচম্বিতে ওঠে গিয়ে সুহাসের কলার চেপে ধরল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,
‘ কার সঙ্গে কথা বলছিলি? কতদিন ধরে চলছে এসব? বলতে বাধ্য নই মানে আলবাত বাধ্য।’
নামীর আচরণে যারপরনাই অবাক হলো সুহাস। সহসা নামীর হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে বাতি জ্বালালো সে। এরপর বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো নামীর অগ্নিদৃষ্টি আর ক্রোধে জর্জরিত মুখশ্রীর পানে। নিমেষে বুক কেঁপে ওঠল। ইতিপূর্বে নামীকে এই রূপে দেখেনি সে। আর ওর মুখে তুই তুকারি! সে তো দুঃস্বপ্ন। সুহাস হতভম্ব মুখে তাকিয়ে। নামী বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল। যেন কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। হাঁপানি রোগিদের মতো শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা। সুহাস হতবাক হয়ে তাকিয়ে। রাগ, অভিমানের ঊর্ধ্বে বুকের খুব গভীরে নামীর জন্য খারাপ লাগা অনুভব করল। দেখতে পেল কিয়ৎক্ষণ পূর্বে অগ্নিমূর্তি ধারন করা মেয়েটা
ধীরেধীরে শান্ত হয়ে গেল। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসল বিছানার একপাশে। মুখটা বিধ্বস্ত লাগছে ওর৷ এরপর সুহাসকে অবাক করে দিয়ে দু-হাত মুখে চেপে ডুকরে ওঠল নামী৷ সুহাসের ইচ্ছে করল ছুটে কাছে যেতে। কাঁধে হাত রাখতে। মাথায় হাত বুলাতে৷ বুকের ভেতর আগলে নিয়ে সান্ত্বনা দিতেও ইচ্ছে করল৷ ইচ্ছে করল বলতে,
‘ কাঁদছ কেন নামীদামি? এই তোমার মাথা ছুঁয়ে বলছি আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবি না৷ কতদিন ধরে না, জাস্ট আজকেই ফোন করেছি৷ বন্ধু হিসেবেই কথা বলছিলাম এর বাইরে কিচ্ছু না। তোমার সুহাস তোমারি আছে। ডোন্ট ক্রাই নামী, ডোন্ট ক্রাই। ‘
ইচ্ছে গুলোকে দমিয়ে নিল সুহাস। বুকের ভেতর যে পাথর চাপা আছে। সে পাথর যে পর্যন্ত সরে না যাচ্ছে। নামীর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারবে না সে৷ রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল সুহাস৷ মাথাটা ঘুরছে তার। নিজের খারাপ লাগাকে বুঝতে দিল না নামীকে। শার্টের কলার ঠিকঠাক করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মুহুর্তেই। নামী টের পেল সুহাস বেরিয়ে গেছে। যার ফলে তার কান্নার মাত্রা বাড়ল। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে মাথা চক্কর দিল। ক্ষণে ক্ষণে গা গুলিয়েও ওঠল৷ শেষ পর্যন্ত বাথরুমে গিয়ে বমি করে শান্ত হলো সে।
.
.
সূর্যদয় দেখতে ভীষণ ভালোবাসে সৌধ। ভোরের স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি গায়ে মাখাতে পছন্দ করে বেশ। আজ হসপিটালে যেতে হবে না। তাই জগিংয়ে বেরুলো। প্রকৃতি প্রেমী মানুষ সে। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চটজলদি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঝকঝকে সাদা রঙের রানিং সুজ, গাঢ় নীল রাঙা শর্টস আর সাদা রঙের টিশার্ট পরিহিত সৌধ। এখানকার স্থানীয় কিছু যুবক রয়েছে। যারা বয়সে তার ছোটো৷ কিন্তু রাজনীতির সাথে সংযুক্ত। সেই সুবাদেই সৌধর সঙ্গে তাদের বেশ খাতির। সৌধ যদিও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়৷ তবু বাবা, ভাইয়ের উছিলাতে সব জায়গাতেই রাজ করে বেড়ায়৷ আয়েশ করে কাটিয়ে দেয়৷ চট্রগ্রাম শহরেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি৷ সাতসকালে জগিংয়ে বের হলেও নয়, দশজন ছেলেপুলে সঙ্গ দিতে চলে আসে৷ সৌধ বুঝতে পারে এসবের পেছনে তার বাবা, ভাইয়ের সুকৌশল দায়ী। তবু চুপ রয়। উপভোগ করে বেশ।
যে বাসায় ভাড়া থাকে সৌধ। সে বাসার মালিকের কনিষ্ঠ কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। নাম আভিরা খান। এবার বাড়ি এসে প্রথমেই তার নজর পড়েছে ডক্টর সৌধ চৌধুরীর ওপর। প্রথম দেখা হয় বাড়ির গেটের সামনে। প্রথম কথোপকথনে জেনে নেয় সৌধর ব্যাকগ্রাউণ্ড সম্পর্কে। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে সৌধর ব্যক্তিত্ব। রূপ, লাবণ্যের কমতি নেই আভিরার। প্রথম দর্শনে যে কোনো পুরুষই কপোকাত হতে বাধ্য। গায়ের বর্ণ দুধ সাদা। চোখ দু’টি কাজল কালো নয় তবে আকর্ষণীয়। চোখের বর্ণ ধূসর। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত। স্বাস্থ্য মোটামুটি। সব মিলিয়ে শহরের সেরা দশজন সুন্দরীদের মধ্যে একজন হওয়ার মতোন। সেই আভিরার দিকে সৌধ একবার ছেড়ে দু’বার তাকায়নি। খেয়াল করে আভিরা। অত্যন্ত সুকৌশলে দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে সৌধ কেমন স্বল্প আলাপ করল তার সঙ্গে। যা তার যুবতী চিত্তকে অশান্ত করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে রাতের ঘুম। বাড়ি এসে বেলা করে ঘুমোনোর অভ্যাস বদলেছে। শুধুমাত্র সৌধ চৌধুরীকে এক পলক দেখার লোভে। কথা বলার তৃষ্ণায়। রোজ সৌধ যখন জগিংয়ে বেরোয় এই সময়টাতে আভিরাও বেরোয়৷ তার প্রিয় বিড়ালছানাকে কোলে নিয়ে পিছু নেয় সৌধর। দু’দিন খেয়াল করেছে সৌধ। তৃতীয় দিন খেয়াল হতেই মেজাজ বিগড়ে গেল। এসব ছ্যাঁচড়া ব্যক্তিত্বের মেয়ে তার একদম পছন্দ নয়। তারা একটি পার্কে ছিল। আভিরাকে দেখেই পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো সৌধ। অমনি পেছন থেকে ডাক শুনতে পেল,
‘ ডক্টর সৌধ চৌধুরী… ‘
সহসা থেমে গেল সৌধ। সে থেমেছে বলে আভিরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে এগিয়ে এলো। বিড়াল ছানাকে বুকে চেপে ধরে বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা নিয়ে সৌধর মুখোমুখি দাঁড়াল। আচমকা তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল সৌধর বলিষ্ঠ বুকে। নিমেষেই ঠোঁট দু’টি কেঁপে ওঠল। এই ছেলেটা তার বয়ফ্রেন্ড হলে সে তো সারাদিন ওই বুকেই একশখানা কিস করে দিবে। ঢোক গিলল আভিরা। উত্তেজনায় বুক কাঁপছে তার। ধীরেধীরে দৃষ্টি উঁচু করল। তাকাল সৌধর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আবৃত দৃঢ় চোয়ালের পানে। মনে মনে বলল, ‘ মাইন্ড ব্লোয়িং! ‘ তার বেশরম মনটা আকুপাকু করে ওঠল। শেষ দৃশ্যে যেন মরে যাওয়ার উপক্রম হলো। কোনো পুরুষ মানুষের ঠোঁটও বুঝি এত আকর্ষণীয় হয়? সবকিছুতে অদ্ভুত সৌন্দর্য আর দৃঢ়তা। এই ছেলেটা এতকাল কোথায় ছিল? কেন আগে দেখা পায়নি এর? আফসোস হলো ভীষণ। এই এত এত দেখার ভীড়ে একবারো সৌধর চোখের দিকে তাকাল না আভিরা৷ যদি একবারো তাকাতো। তাহলে সৌধ চৌধুরীর কঠোর দৃষ্টির কবলে পরে মোহময় হৃদয়টা তার শতসহস্র বার ফাঁসিতে ঝুলতে চাইত। তার মতো সুন্দরী মেয়েকে কোনো যুবক মুগ্ধ দৃষ্টির বাইরেও অন্য কোনো দৃষ্টিতে দেখতে পারে তাও কিনা ক্রোধান্বিত, দৃঢ় দৃষ্টিতে। এ যে অকল্পনীয়!
আভিরার ওপর চরম বিরক্ত সৌধ। শুধু তাই নয় আভিরার আচরণে ভয়াবহ ক্রোধও চেপেছে মাথায়। সেই ক্রোধ প্রকাশিত হলো আভিরা যখন তাকে বলল,
‘ আজ এখনি চলে যাচ্ছেন কেন সৌধ? আসুন না ওদিকে দাঁড়াই কিছুক্ষণ। ‘
প্রতুত্তরে চিবিয়ে চিবিয়ে সৌধ বলল,
‘ আপনি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছেন। অথচ নূনতম ভদ্রতা নেই আপনার মাঝে! না হলেও আমি আপনার ছ’বছরের সিনিয়র। সো, ইউ শুড হ্যাভ কলড মি ব্রাদার। ‘
অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেল আভিরার। বুকের ভেতর ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে ওঠল সৌধর বলা প্রতিটি বাক্য শুনে। সৌধ নিজের বক্তব্য দিয়ে এক মুহুর্তও সময় নষ্ট করেনি। চলে এসেছে। এদিকে আভিরা অপমান সহ্য করতে না পেরে বুকে আগলে রাখা বিড়ালটাকে অবচেতনে এত্ত জোরে চেপে ধরল যে। দম আঁটকে ছটফটিয়ে ওঠল বিড়ালছানা। মিউউউ শব্দে কেঁদে ওঠতেই আচমকা হাত দু’টো আগলা করে দিল আভিরা। বিড়ালছানা মাটিতে পড়ে জোরে জোরে মিউ মিউ করতে লাগল।
.
.
সকালবেলা বেরিয়েছে নামী। কোথায় গেছে কাউকে বলে যায়নি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অথচ বাড়ি ফেরার নাম নেই। সিমরান, সুহাস দু’জনই প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তা করছে৷ ঘনঘন ফোন দিচ্ছে। ধরছে না নামী। ওরা দুই ভাই যখন চিন্তায় অস্থির। চারিদিকে যখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে। তখন বাড়ি ফিরল মেয়েটা। তার চোখ, মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। ড্রয়িংরুমে পা দিতেই সুহাস যেন খাবলে ধরল তাকে। ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘ কোথায় ছিলে সারাদিন? ‘
নামীও ক্রোধানলে ফেটে পড়ল। কিন্তু সেটা মনে মনে। মুখটা একদম শান্ত। চোখ দু’টোও সুস্থির। সহসা মৃদু হাসল সে। সুহাসের ধূসর বর্ণীয় চোখ দু’টোয় দৃঢ় চোখে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,
‘ বলতে বাধ্য নই।‘

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।