ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৬০

15 Min Read

আজ সৌধ, সিমরানের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। সকাল থেকে তোড়জোড় চলছে৷ দু পরিবারে আলাদা আলাদা আয়োজন। চৌধুরী বাড়ি থেকে সৌধর কিছু কাজিন এসেছে খন্দকার বাড়িতে৷ তারা সিমরানের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের ফটোশুট, ভিডিয়োশুট করতে ব্যস্ত। পছন্দের মানুষটাকে বর হিসেবে পেতে চলেছে সিমরান। চারপাশে সুখ, সুখ সুবাস৷ কত মানুষ, কত আনন্দ ঘিরে রয়েছে তাকে৷ আব্বু, ভাইয়া, বন্ধু, বান্ধব এছাড়াও পরিচিত, অপরিচিত অনেক আত্মীয়-স্বজন বাড়ি জুড়ে। তার আশপাশে সর্বক্ষণ মানুষের ভীড়। এত সুখ, আনন্দ, মানুষের ভীড়ে একটিমাত্র শূন্যতা মনকে বিষাদে ডুবিয়ে দিচ্ছে। এত আয়োজন, সীমাহীন সুখ প্রাপ্তি, ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেয়ার পথে জন্মদাত্রীকে ভীষণ মিস করছে মেয়েটা। যখনই সুযোগ পাচ্ছে বারবার টলমল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আব্বু, আর ভাইয়ার দিকে। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। বেঁচে থাকাকালীন মাকে খুব বেশি কাছে পাওয়া হয়নি৷ জীবনের বিশেষ সময় গুলোতেও খুব কম পাওয়া হয়েছে মানুষটাকে। তবু মা আছে। এই মনোবলটাই সামনের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে৷ আগে কখনো পৃথিবীটাকে নিঃসঙ্গ লাগেনি। প্রতিষ্ঠিত মা এবং মায়ের সন্তানদের জীবনে প্রচুর সেক্রিফাইস করতে হয়৷ যার নিদারুণ উদাহরণ উদয়িনী আর সুহাস, সিমরান। শত ব্যস্ততায়ও বেলা শেষে একটিবার ফোন করে মেয়ের খোঁজ নিত উদয়িনী। আজ কতগুলো দিন হয়ে এলো। দূরান্ত থেকে কেউ ফোন করে খুঁজ নেয় না৷ বুকের ভেতরটা হুহু করে কেঁদে ওঠে সিমরানের৷ আম্মুর পাশাপাশি নামীকেও ভীষণ মনে পড়ছে। আজ ভাবি হিসেবে নামী তার পাশে থাকতে পারত! তীব্র অভিমান হয় নামীর প্রতি। প্রচণ্ড স্বার্থপর মনে হয় ভাইয়ের বউটাকে। তাদের খারাপ সময়, ভালো সময় কোনোটাতেই নামী থাকল না। পৃথিবীতে সব মানুষ একরকম হয় না৷ তার ভাইটা না হয় একটু বেখেয়ালি। তাই বলে ভয়াবহ কোনো অপরাধী নয়৷ সুহাস কেমন ছেলে প্রত্যেকেই জানে৷ নামীও নিশ্চয়ই এতবছরে কম চেনেনি নিজের স্বামীকে। দু’জনের মাঝে মনোমালিন্য হয়েছে। হতেই পারে। তাই বলে এভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আলাদা দেশে পাড়ি জমাতে হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান৷ মনে মনে পণ করল, ভাবি হিসেবে, বড়ো বোন এবং বন্ধু হিসেবে হৃদয়ের যে স্থানে নামী ছিল। আজকের পর সে স্থান শূন্য করে দেবে। আম্মু নেই, ভাবি থেকেও নেই৷ তার জীবনে বাবা, ভাইয়া আর স্বামী সৌধ চৌধুরী ছাড়া আর কোনো আপনজন নেই। ভাবতে ভাবতে অজান্তেই
দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ে। চারপাশে মিউজিক, গানের সুর, হৈচৈয়ে মুখরিত। বিয়ের পরিপূর্ণ আমেজ। দুপুর হওয়ার পূর্বেই কাঁচা হলুদ বাঁটা নিয়ে প্রাচী আর ফারাহ সিমরানের কাছে এলো। ড্রয়িং রুমের একপাশে ছোট্ট স্টেজ ডেকোরেট করা হয়েছে। স্টেজের মধ্যমণি গাঢ় হলুদ রঙের সারারা ড্রেস পরিহিত সিমরান৷ ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে হালকা জুয়েলারি পরেছে। ঠোঁটে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক, চোখে কাজল, মাথায় টিকলি সবমিলিয়ে একদম চোখ ধাঁধিয়ে ওঠা সৌন্দর্য ফুটে ওঠেছে সর্বাঙ্গে। প্রাচী, ফারাহ ঝটপট সিমরানের সাথে কিছু ফটোশুট করে নিল। এরপর শুরু করল গায়ে হলুদ লাগানো।
সৌধর বিয়েতে বরপক্ষ হিসেবে থাকার কথা ছিল সুহাসের। প্রাচী, ফারাহ এদেরও বরপক্ষ হবার কথা৷ ভাগ্যচক্রে এখন সবাই কনে পক্ষ। কারণ কনে সুহাসের ছোটো বোন৷ সুহাস বোন রেখে বন্ধুর তরফে চলে যেতে পারে না। ছোটোবোনের বিয়ে। কাঁধে তার বিরাট দায়িত্ব। মা নেই, বউ নেই৷ বাবাকে পাশে নিয়ে তাকে যেন সিমরানের মা, ভাবির সব দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় তাকে মানসিক ভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে প্রাচী, ফারাহ। আইয়াজ, আজিজ বাকি বন্ধুরা বর পক্ষ হিসেবে উপস্থিত আছে চৌধুরী বাড়িতে।
কনের মনে বিষাদ, চোখ দ্বয়ে মেঘ৷ ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি ঝড়ছে। ছবি তুলতে গিয়ে খেয়াল করল, শান। একদিকে সে ফটো তুলছে অপরদিকে সুযোগ বুঝে সেসব সৌধকেও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাচ্ছে।
গায়ে হলুদ নিয়ে সৌধর কোনো মাথা ব্যথা নেই। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী যতটুকু করলেই নয় ততটুকু করছে। দাদুনির বকবক বেড়েছে খুব৷ কারো থেকে সে খবর পেয়েছে সিনু সকালবেলা পার্লার থেকে সেজে এসেছে। এই নিয়ে যত অভিযোগ তার। নতুন বউ বিয়ের আগে কোনো কাজ করতে পারবে না। এটা তাদের বাড়ির নিয়ম। যদিও সিমরান কাজে অপটু। এমনিতেও সে কাজ পারে না। তার নিষেধ ছিল, বাইরে টাইরে যাওয়া নিয়ে। তাহলে সে কেন গেল? গজগজ করছে দাদুনি। শাশুড়িকে থামাতে পারে না তানজিম চৌধুরী। সৌধ মহাবিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে দৃঢ় চোখে তাকায়। তানজিম চৌধুরী চোখের ইশারায় ছেলেকে শান্ত থাকতে বলে নিজের কাজ সেরে কাছে আসে। আড়ালে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
‘ সিনুকে কল করে বলে দে আমরা পার্লারের লোক পাঠাব। মেহেদির সাজ, বিয়ে, বউভাতের সাজ সব বাড়িতেই সাজাবে। বাইরে যেতে হবে না। ‘
দাদুনির ওপর বিরক্ত হলেও আম্মার বলা কথায় সমর্থন দিল সৌধ। নিজের রুমে গিয়ে ফোন করল সিমরানকে। ইতিমধ্যেই ছোটো ভাই শানের পাঠানো ছবি গুলো দেখেছে সে। তাই প্রস্তুতি নিল হালকাপাতলা শাসন করার। বিয়ের আগের দিন বউ শাসন৷ এতদিন বন্ধুর বোন হিসেবে শাসন করেছে এখন করবে বউ হিসেবে। ভেবেই মনে মনে মুচকি হাসল। সবাই মিলে হলুদ লাগাচ্ছিল সিমরানকে। এমন সময় সৌধর কল। ফোন রিসিভ করে কাঁপা গলায় হ্যালো বলল সিমরান। দৃঢ় কণ্ঠে মৃদু ধমক মিশিয়ে সৌধ বলল,
‘ খুব বাজে দেখতে লাগছে সিনু। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ধরে বেঁধে বিয়ে ঠিক করেছে তোর বাপ, ভাই। চোখ ভর্তি নোনাজলে প্রকাশ পাচ্ছে, পছন্দের হিরো নয় অপছন্দের ভিলেনের বউ হতে যাচ্ছিস তুই। ‘
তীব্র বিষাদ অনুভূতিতে এক টুকরো প্রশান্তি ছিল সৌধর ফোন কল। আর মৃদু ধমকে, শাসনের সুরে ছিল সুখ সুখ অনুভূতি। সমস্ত যন্ত্রণা এক নিমেষে ভুলে গেল মেয়েটা। চোখের পানি মুছে, নাক টানতে টানতে বলল,
‘ সরি। ‘
‘ বিরহিণীর মা সেজে বসে থাকার দরকার নেই। রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমা। যদি প্রণয়ী হতে পারিস তবে যাওয়ার দরকার নেই। আমি প্রণয়ী সিনু চাই বিরহিণী না। ‘
এ পর্যন্ত বলে থামল সৌধ৷ একটু ভাবুক হয়ে পরোক্ষণেই বলল,
‘ আর পার্লারে যাওয়ার দরকার নেই। আমি লোক পাঠিয়ে দিব৷ বাড়ি গিয়েই সাজিয়ে দেবে। ‘
সিমরানকে কিছু বলার সুযোগ দিল না সৌধ৷ ফোন রেখে বেরিয়ে গেল রুম থেকে৷ নিচে তার জন্য হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। বন্ধুরা মিলে ফটোশুটে ব্যস্ত। দাদুনি গলা ছেড়ে ডাকছে তাকে। এত আয়োজন, এত নিয়মকানুন ভালো লাগছে না তার৷ বেশি অসহ্য লাগছে দাদুনির হাঁকডাক। স্বস্তি ভরে রুমে বসতেই পারছে না৷ বিয়ে করছে নাকি সদ্য জন্ম নিচ্ছে বুঝা মুশকিল। বাড়ির সব ক’টা যেন চোখে হারায়৷ সবচেয়ে বেশি চোখে হারাচ্ছে দাদুনি৷ এ মুহুর্তে দাদুভাইয়ের অভাব বোধ করছে সে। দাদুভাই থাকলে নিশ্চয়ই দাদুনিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত।
সৌধর ইচ্ছে ছিল সাদাসিধে ভাবে বিয়ে করবে। কিন্তু পারিবারিক ধারাবাহিকতা আর সিমরানের স্বপ্ন দু’টোয় বাঁধা পড়ে সবকিছু মেনে নিতে হচ্ছে। সিমরানের স্বপ্ন বিরাট আয়োজন করে বিয়ে করবে। ধুমধাম করে যাবে শশুর ঘরে। প্রতিটি অনুষ্ঠানই হবে ধুমধাম করে৷ কোনোকিছুতে কমতি থাকা যাবে না। বিয়ে নিয়ে প্রতিটি মানুষেরই আলাদা আলাদা স্বপ্ন থাকে। সিমরানের স্বপ্ন আর চৌধুরী বাড়ির ধারাবাহিকতা মিলে যাওয়াতে সৌধ হাসিমুখে মেনে নিয়েছে সব। কিন্তু নিজেকে নিয়ে টানাহেঁচড়া পছন্দ হচ্ছে না৷ জাস্ট তিন কবুল পড়ে বিয়েটা সম্পন্ন হোক। এরপর বউভাত ব্যস। পরবর্তীতে আর কারো নিয়মে বাঁধা পড়া যাবে না। কারো নিয়মে বাঁধা পড়া মানেই নিজের স্বস্তির বারোটা বাজানো। রুদ্ধশ্বাস ফেলল সৌধ। দাদুনির বাড়াবাড়ি দেখে আন্দাজ করল, সিনুকে বড্ড জ্বালাবে মানুষটা৷ মনে মনে কিঞ্চিৎ হেসে বলল, ‘ প্রিয় দাদুভাই এর বেগম তুমি যদি অগ্নিশিখা হও তোমার প্রিয় নাতির বেগম তবে বরফ টুকরো। লাভ নেই ডিয়ার লোকসান আছে প্রচুর। ‘
.
.
মেহেদি অনুষ্ঠান। সবাই তৈরি হয়ে যার যার মতো করে স্টেজে উপস্থিত হচ্ছে। সিমরান তৈরি। নিচে যায়নি এখনো৷ কারণ ফারাহ তার লাগেজ গুছিয়ে দিচ্ছে৷ সে বলে বলে দিচ্ছে কোনটা নিয়ে যাবে কোনটা রেখে যাবে। মেয়েটা শাড়ি পরতে পারে না। ও বাড়িতে শাড়ি পরা নিয়ে চাপ নেই। তাই সেলোয়ার-কামিজ ওঠাল শুধু। সেলোয়ার-কামিজ পরার অভ্যাসও কম সিমরানের৷ শশুর বাড়িতে গিয়ে পরতে হবেই। ফারাহ কম দিন দেখছে না ওকে। তাই সব গুছিয়ে বলল,
‘ টিশার্ট আর প্লাজো ওঠাই? ‘
চমকাল সিমরান। বলল,
‘ ও বাড়িতে তো এসব পড়া যাবে না আপু। ‘
নাকের ডগায় এসে পড়া চশমা ঠেকে ঠিকঠাক করে ফারাহ বলল,
‘ বাড়িতে পড়বে না তো। বেডরুমে পরবে। যখন শুধু তুমি আর তোমার বর থাকবে। আর কেউ থাকবে না। বর ছাড়া আর কেউ দেখবে না। ‘
সহসা লজ্জা পেল সিমরান। রক্তিম হয়ে ওঠা গালদুটো আড়াল করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
‘ থাক দরকার নেই। ‘
ফারাহ মানলো না কথাটি। দু’টো টিশার্ট আর প্লাজো ওঠিয়ে দিয়ে বলল,
‘ দুটো ওঠিয়ে দিলাম৷ প্রয়োজন হলে পরো। পরবর্তীতে না হয় নাইট ড্রেস কিনে নেবে। ‘
কিছু বলল না সিমরান৷ উশখুশ চিত্তে ভাবতে শুরু করল, কাল তার আর সৌধ ভাইয়ের বিয়ে। রাতে বাসর! হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠল অকস্মাৎ। তাদের কি কাল বাসর জাতীয় কিছু হবে? কী জানি!বাসরটাসর না হলেও তারা তো একসঙ্গে এক বিছানাতে ঘুমাবে। শরীরের লোমকূপ সজাগ হলো সিমরানের। দুরুদুরু বুকে ভাবতে লাগল, কাল থেকে তার জীবনটাই বদলে যাবে। সে ডক্টর. সৌধ চৌধুরীর বউ হবে৷ একসঙ্গে এক ঘরে, এক বিছানাতে ঘুমাবে। সৌধ ভাই কি একটুও আদর করবে না তাকে? কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসা দিতে লোকটা কি অনেক বেশি সময় নেবে? তার কী ধৈর্য্য হবে? সে কী পারবে ধীরে ধীরে মানুষটার হৃদয়ের সমস্তটা জুড়ে আধিপত্য করতে? একটু ভয় সীমাহীন লজ্জা, টালমাটাল হৃদয় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করল সিমরান।
সবাই মেহেদি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেছে। ফারাহ এখনো তৈরি হতে পারেনি৷ সিমরানকে নিচে পাঠিয়ে সে চলে গেল নামীর আলাদা ঘরটায়৷ এ ঘরে সে আর প্রাচীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সব জিনিসপত্রও এখানে রাখা। পোশাক বদলে ঝটপট তৈরি হয়ে নিল ফারাহ৷ অনেকদিন পর শাড়ি পরেছে সে৷ ভাবল নিচে গিয়ে আইয়াজকে ভিডিয়ো কল করবে একবার। ভীষণ মিস করছে আইয়াজকে। কনে পক্ষ হয়ে নিজের বরের থেকে আলাদা থাকতে হচ্ছে। আইয়াজ বলেছে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সিনুর সাথে তাকে আর প্রাচীকেও ও বাড়িতে নিয়ে যাবে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের ব্যাগপত্র একপাশে রেখে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে হঠাৎ খেয়াল করল, নামীর ওয়ারড্রবের নিচের ড্রয়ার একটু খোলা। তাই এগিয়ে এসে ড্রয়ারে ধাক্কা দিতে উদ্যত হয়৷ হঠাৎ হালকার ওপর ঝাপসা দৃষ্টি পড়ে নীল রঙের কভারের ওপর মা এবং শিশুর ছবির মতো কিছু দেখে। অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে ড্রয়ার খুলে সে। দেখতে পায় রিপোর্ট পেপার। বুক ধক করে ওঠে তার। এটা কার রিপোর্ট? দেখে তো মনে হচ্ছে প্র্যাগ্নেসির। ভেতরে দেখা প্রয়োজন। সহসা বুক কাঁপতে শুরু করল ফারাহর৷ ভেতরে চোখ বুলাতেই আঁতকে ওঠল! স্পষ্ট দেখতে পেল নামীর প্র্যাগ্নেসি রিপোর্ট। আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট। দু’মাসের প্র্যাগ্নেসির সময় করা হয়েছে টেস্ট গুলো। অর্থাৎ আরো তিন মাস আগেকার রিপোর্ট এটা৷ নামী তাহলে বর্তমানে পাঁচ মাসের প্র্যাগনেন্ট! সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল ফারাহর৷ বিস্ময়, উত্তেজনা, খুশি, ভয় সবমিলিয়ে যাচ্ছেতাই হয়ে গেল যেন। মনে পড়ে গেল, সে আর আইয়াজ দীর্ঘদিন যাবৎ বেবি নেয়ার ট্রাই করছে। দু’জনের কারোরি সমস্যা নেই। তবু আল্লাহ তায়ালা মুখ তুলে তাকাচ্ছে না৷ আর এদিকে তার প্রিয় বান্ধবী মা হতে চলেছে। আইয়াজের প্রিয় বন্ধু বাবা হচ্ছে। অথচ তারা কেউ জানেই না৷ এত বড়ো সুসংবাদ কীভাবে চেপে গেল নামী? নামী মা হচ্ছে… খুশিতে পাগলপ্রায় হয়ে গেল ফারাহ। পরোক্ষণেই আবার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু করল। নামী কেন রাগ করে চলে গেল? কেন তাদের কাউকেই খুশির খবরটা জানালো না। সুহাস ভাই! সে তো বাবা হতে যাচ্ছে। তীব্র উত্তেজনায় কাঁপছে ফারাহ। মেহেদী অনুষ্ঠানের কথা ভুলে গেল সে। এক হাতে রিপোর্ট গুলো ধরে অন্যহাতে ফোন নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কল করল আইয়াজকে। আইয়াজ ফোন রিসিভ করতেই হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আয়াজ, নামী প্র্যাগনেন্ট! আমি ওর ঘর থেকে প্র্যাগ্নেসি রিপোর্ট পেয়েছি। মেয়েটা কী বোকামি করল বলো তো? এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেল। আমার নামী, আমার বান্ধবী মা হতে চলেছে আমি এত দেরিতে জানলাম। হায় আল্লাহ, সুহাস ভাই জানলে কী খুশি হবে!’
আকস্মিক ফারাহর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আইয়াজ৷ রয়েসয়ে বলল,
‘ ফারাহ কান্না থামাও। শান্ত হয়ে বলো কী পেয়েছ তুমি৷ কী বলছ এসব? ‘
শান্ত হতে সময় নিল ফারাহ। কিন্তু নিজের খুশি, উত্তেজনা চেপে রাখতে পারল না৷ সবটা বুঝিয়ে বলল আইয়াজকে৷ সঙ্গে সঙ্গে আইয়াজ সমস্ত কথা জানালো সৌধকে। সৌধ সবটা শুনেই ফারাহকে বলল রিপোর্ট গুলোর ছবি পাঠাতে। ফারাহ ছবি পাঠালে তৎক্ষণাৎ সৌধ কল করল তাকে। রিসিভ করতেই বলল,
‘ ফারাহ বিষয়টা প্লিজ কষ্ট করে চেপে রাখো। আর এ মুহুর্তে কাউকে জানতে দিও না৷ পারলে রিপোর্ট গুলো তোমার কাছে লুকিয়ে রাখো। সুহাস কেমন জানোই তো? আপাতত বিয়ের ঝামেলা মিটে যাক। তারপর আমরা সুহাসকে জানাব৷ ‘
ফারাহকে বুঝিয়ে ফোন কেটে দিল সৌধ। তার বিচক্ষণ মাথায় প্রশ্ন জাগল, এদেশে শেষ সময় নিধির সাথে কাটিয়েছে নামী। নিধি কি জানত সুহাস বাবা হতে চলেছে? বিয়ের ঝামেলা মিটে যাক। নিধি তার বিয়েতে আসবে কিনা জানা নেই। কিন্তু নামীর ব্যাপারে নিধির সঙ্গে তার যোগাযোগ করতেই হবে৷ সুহাস জানে নামী তার বাবার কাছে রয়েছে। জানে না শুধু নামী নয় নামীর গর্ভে তার সন্তানও রয়েছে। যখন জানবে তখন ঠিক কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে আর ভাবতে পারছে না সৌধ। যা ক্ষ্যাপাটে সুহাস৷ বান্ধবী, পরের বউ এক বাচ্চার মা বলে ছেড়ে দেবে না৷ যে তার বউকেই ছাড় দেয় না সে বান্ধবীকে ছাড় দেবে আশা করা বোকামি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। সুহাসের জায়গায় সে কখনো যাবে না৷ তবু একবার নিখুঁত ভাবে ভাবার চেষ্টা করল, তার স্ত্রী গর্ভবতী।
অথচ তার স্ত্রী সেসব তাকে না জানিয়ে ভীনদেশে পাড়ি জমিয়েছে। কেমন অনুভূতি হবে? আর ভাবতে পারল না সৌধ। আচমকা সিনুর মুখটা ভেসে ওঠল চোখের সামনে। অনুভব করল, বউয়ের ভাবনা মাথায় এলেই এখন সিনুর মুখ দেখতে পায় সে। কী আশ্চর্য গতিবিধি। মানব হৃদয়ের এ কেমন লীলা? বুকের ভেতর মৃদু স্পন্দন হচ্ছে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠেছে মৃদু হাসি। পাশে আাইয়াজ। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে৷ সে হঠাৎ নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,
‘ কতশত বছর আগে আমাদের আলাদা দুটো জীবন এক হওয়ার পরোয়ানা জারি হয়েছে রে? এত অল্প সময়ে ডিরেক্ট বউ হয়ে চোখের পাতায়, মনের কোণায় ধরা দিচ্ছে?‘

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।