ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৭১

18 Min Read

কেউ নতুন প্রণয়ানুভূতিতে সিক্ত৷ কেউ বিরহে নিবৃত্ত। সব ভুল চুকিয়ে কেউ ব্যস্ত সঠিক পথে চলতে। আবার কেউ পেশাগত ও সাংসারিক জটিলতার সমাধান খুঁজতে ব্যস্ত৷ এমনই ভাবে কেটে গেল কয়েকটি মাস। আইয়াজ, ফারাহর জীবনে বহুমুখী সমস্যা এসেছে। আবার একটু সময় লাগলেও সক্ষম হয়েছে সমস্যা গুলোর সমাধান দিতে। দীর্ঘদিন তারা চেষ্টায় ছিল দু’জন মিলে একই হসপিটালে কর্মরত থাকার৷ অবশেষে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও ভিসা জটিলতার জন্য তাদের অ্যামেরিকায় যাওয়া আঁটকে ছিল। অবশেষে আইয়াজ, ফারাহ এবং সুহাস৷ তিনজনেরই ভিসা এসে গেছে। ওদের খুশি হওয়ার কথা থাকলেও কেউ ঠিকঠাক খুশি হতে পারছে না৷ কারণ, হিসেবে অনুযায়ী নামীর ডেলিভারি হয়ে যাওয়ার কথা। আর বাচ্চার বয়স এখন দেড় থেকে দু’মাস। সহ্য হয়? কোনো বাবা পারে সহ্য করতে? পারে না। সুহাসও পারছে না৷ যদি শুধু আইয়াজ, ফারাহর ভিসা জটিলতা তৈরি হতো তাহলে সমস্যা ছিল না৷ ভিসা আঁটকে ছিল সুহাসেরও। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশের বহু সংখ্যক মানুষও এই সমস্যার কবলে পড়েছিল। এবার সব ঝামেলা শেষ। বাকি যা করণীয় আছে তা সম্পন্ন হলেই নির্দিষ্ট সময়ে উড়াল দেবে তারা।
.
আইয়াজের বাসা ঢাকা মোহাম্মদ পুরে৷ গতকালই সে তার বউকে নিয়ে বাসায় এসেছে। তিনতলা বাড়ির পুরোটাই ভাড়া দেওয়া৷ শুধু দ্বিতীয় তলার তিনটা ফ্ল্যাট বাদে৷ দ্বিতীয় তলার সবচেয়ে বড়ো ফ্ল্যাটটাতেই ওর পরিবার থাকে৷ বাকি দু’টো ফ্ল্যাট ফাঁকা। কারণ ওগুলো তাদের দু’ভাইয়ের সংসার গুছানোর জন্য বাবার তরফ থেকে উপহার পেয়েছে। বড়ো ভাই প্রবাসী৷ তাই তার বউ আর সন্তান শশুর, শাশুড়ির সাথেই থাকে। ছোটো বোনকে বিয়ে দিয়েছে বনেদি পরিবারে। বাবার বাড়িতে আসার সময় হয়ে ওঠে না তার৷ আর রইল সে আর ফারাহ। তারা দু’জন পেশাগত কারণে নিজ বাসা ছেড়ে দূরে থাকে।
রাত প্রায় এগারোটা। রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের ব্যাগপ্যাক গুছানো শুরু করে দিয়েছে আইয়াজ। ফারাহ ডাইনিং রুমে শাশুড়ির সঙ্গে বসে আছে চুপচাপ। আইয়াজের মায়ের নাম রমেছা বেগম৷ অল্প শিক্ষিত হলেও বুদ্ধি ধারালো। ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে এ নিয়ে তার আপত্তি নেই। কারণ বাকি দুই ছেলে মেয়েও একই পথের পথিক৷ কিন্তু আইয়াজ একা একা বিয়ে করে নিয়েছে বাবা-মা হীন এক এতিম মেয়েকে। এই নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তুষ্টি না জানালেও ভেতরে ভেতরে পীড়িত হয়েছে। সেই পীড়ন ভাব গাঢ় হচ্ছে ছোটো ছেলের ঘরে এখনো সন্তানাদি আসছে না বলে৷ বাড়ির বউ চাকরি করুক চায় না রমেছা বেগম। তার সংসারে কীসের অভাব যে ছেলে বউদের চাকরি করতে হবে? বড়ো বউ নিয়ে চিন্তা নেই। একদম ঘরকুনো, সংসারী মেয়ে। যত চিন্তা এই ছোটো বউ নিয়ে৷ মেয়ে মানুষ এমন বাইর মুখী হলে সংসার চলে? স্বপ্ন ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু ছেলে বউ ডাক্তারনি হবে। এমন স্বপ্ন তো সে কখনো দেখেনি। যাক গে এসব পুরোনো কথা, মলিন ব্যথা। আজ রমেছা বেগমের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। ছেলে বউকে নিয়ে অ্যামেরিকায় ঘুরতে যাবে শুনে। ছোটো থেকেই এই ছেলেটা তার ভীষণ বোকা৷ যা জ্ঞান ওই পড়াশোনাতেই৷ নারী লোকের ছল বিষয়ে একেবারে মূর্খ। তা না হলে কি আর এমন মেয়ে বিয়ে করে? গায়ে সাদা চামড়া আর পড়াশোনা করে ডাক্তার হলেই তো কোনো মেয়ে তাদের পরিবারের যোগ্য হয়ে যায় না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমেছা। পাশে বসা ফারাহর দিকে তাকিয়ে থাকে ড্যাবড্যাব করে। শুরু থেকেই ফারাহর ভারিক্কি শরীর তার পছন্দ নয়। এখন এই মোটা স্বাস্থ্যই চক্ষুশূল হয়েছে। তার ধারণা অতিরিক্ত স্বাস্থ্যের কারণে পেটে তেল ধরেছে ফারাহ। এজন্যই বাচ্চা ধরে না৷ তাই প্রথমে যে কথাটা বলল তা হলো,
‘ ফারা, খাবারদাবার হিসেব কইরে খাইয়ো৷ দিনদিন চেহারার কী হাল হইতাছে দেখছ? আর কয়দিন পর তো আমার ছেলের ডাবল হইয়া যাবা। হিমারে দেখো এক পোলার মাও হইয়াও ফিনফিনা দেহ। ‘
হিমা ফারাহর জা৷ শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে তীব্র লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল মেয়েটার৷ শঙ্কিত হলো, এসব কথা আবার আইয়াজ না শুনে ফেলে৷ আইয়াজের কাছে মা ফেরেশতার মতো। বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ি মায়ের অনেক তীক্ষ্ণ কথার শিকার সে। শশুর বাড়ি সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা আছে বলে এসব মালুম করে না। এতিম মেয়ে। বোনের সংসারে কাটিয়েছে দীর্ঘকাল। তাই পূর্বের তুলনায় এটা তার কাছে খুবই নগণ্য। নিজের বোন, বান্ধবী নামী সবার শাশুড়ি সম্পর্কেই টুকিটাকি জানা আছে৷ তাই নিজের শাশুড়ির এহেন আচরণে খুব একটা কষ্ট পায় না৷ এই মানুষটা তার প্রিয় স্বামী, ভালোবাসার মানুষ আইয়াজের জন্মদাত্রী। এতেই যেন তার সাতখু ন মাফ করে দেয় সে৷ চারপাশে সচেতনতার দৃষ্টি বুলিয়ে স্মিত হাসে ফারাহ৷ মৃদু স্বরে শাশুড়িকে বলে,
‘ জি মা, ভাবছি ডায়েট করব। ‘
এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে রমেছা বেগম বলল,
‘ কয়দিন ছুটি কাটাবা দুইজন মিলা বাসাতেই কাটাইতা৷ বিদেশ যাওন লাগব ক্যান বুঝি না৷ বাচ্চা, কাচ্চা হইতাছে না ঘরে বসে আল্লাহরে ডাকবা। দুইজন তার দরবারে হাত তুইলা কান্নাকাটি করবা৷ তা না যাইতাছ আমেরিকাত৷ ‘
ফারাহ জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। বলল না কিছুই৷ রমেছা বেগম নিজে থেকেই বকবক করল। হতাশার সুরে বলল,
‘ শুনো, জামাই বউ মিলা চাকরি করার কী দরকার? লাভটা কী আমারে বুঝাও৷ হইছ তো শিশু বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তোমারি একটা শিশু নাই৷ লাভ আছে কোনো? আর হিমারে দেখো। উচ্চ মাধ্যমিক পইড়া পড়ার ক্ষ্যান্ত দিছে। স্বামী সন্তান নিয়া তার সুখের সংসার৷ ‘
এবারেও হাসি উপহার দিল ফারাহ৷ ভেতরে কতখানি যন্ত্রণা হলো, হৃদয় কতটুকু ছিন্নভিন্ন হলো বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। শাশুড়ি মায়ের মুখ চলতেই থাকল,
‘ শুনলাম দুইজন এখন এক সাথেই থাকবা। ঘুইরা আসো দোয়া করি আল্লাহর রহমতে শিগগিরই কোল ভরুক। ‘
এ পর্যায়ে একটু স্বস্তি পেল ফারাহ। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শাশুড়ির দিকে। রমেছা বেগম সেদিকে খেয়াল না দিয়ে আপন মনেই বলল,
‘ আমার কথা শুইনা রাগ হইয়ো না। ভালার জন্যই বলতাছি৷ এখন তো ভেজাল নাই৷ একটা, দুইটা হোক তখন বুঝবা চাকরি করন কী কঠিন৷ একসাথে সব সামলানো যায় না। আমিও তো অনেক ভালো স্টুডেন্ট আছিলাম। পড়তে কি পারছি? বিরাট বড়ো সংসার৷ স্বামী, শশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর আবার তিনটা পোলাপান। এই ভীড়ে মেট্রিকেই পড়া ক্ষ্যান্ত দিছি৷ তোমারো ভেজাল বাড়ুক তুমিও বুঝবা৷ যাও ঘরে যাও। বিদেশ যাবা, ঘুরবা ফিরবা গোছগাছ করো গা। ‘
কথা শেষ করে উঠে পড়ল রমেছা বেগম। ফারাহ কিয়ৎক্ষণ চুপ করে বসে থেকে গাল বেয়ে পড়া অশ্রু গুলো মুছে নিয়ে ঘরে চলে এলো৷ এসে দেখল, আইয়াজ নিজের কাপড় গুছিয়ে এখন তার জামা-কাপড় গোছাচ্ছে। সে কোনোকিছু না ভেবে আইয়াজের কাছে গিয়ে পাশে বসে বলল,
‘ কাল থেকে আমি ডায়েট করব আয়াজ। ‘
জামা ভাঁজ করছিল আইয়াজ হঠাৎ ফারাহর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ আবার ডায়েটের ভূত চাপল মাথায়? তোমাকে বলেছি না আমার এই তুমিটাকেই পারফেক্ট লাগে। তুমি সারাদিন পেট ভরে, মন ভরে খেয়ে যেমন থাকবে আমার এমনটাই চাই। এটাই আমার সুখ শান্তি। ‘
মুখ ঘুরিয়ে রইল ফারাহ। সে জানে তাকে নিয়ে তার আইয়াজের একবিন্দু সমস্যাও নেই৷ তবু শাশুড়ির কথা শুনে তীব্র খারাপ লাগা আর অভিমান থেকেই এসব বলছে। আইয়াজ ফের কাজে মন দিলে সে আবারো বলল,
‘ কেমন ডাক্তার আমি? কীসের চাইল্ড স্পেশালিস্ট, যার নিজেরই একটা চাইল্ড নেই। ‘
সহসা হাত থেমে গেল আইয়াজের। স্তব্ধ মুখে তাকাল ফারাহর দিকে। ত্বরিত জামাকাপড় গুলো এক সাইটে রেখে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল বউকে। চোখে চোখ রেখে নরম গলায় শুধাল,
‘ কার মুখের কথা এগুলো? ‘
কণ্ঠ নরম হলেও চোখ দু’টো দৃঢ়। ফারাহ ত্বরিত নিজেকে সামলে নিল। ঢোক গিলে জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ আসলে আমারি খারাপ লাগছিল। তাই পাগলামি করছি। ‘
‘ তুমি মিথ্যা বলতে পারো না ফারাহ। সত্যি বলো।’
ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আকস্মিক আইয়াজকে জড়িয়ে ধরল ফারাহ। শক্ত করে। সে চায় না যে মাকে আইয়াজ ফেরেশতা ভেবে ভক্তি করে। বউয়ের জন্য সে মা সম্পর্কে তার নেতিবাচক ধারণা হোক। তাই স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল সে৷ আর বুঝালো সে নিজের আবেগ থেকে এসব বলছে। তীব্র খারাপ লাগা থেকেই তার বুকে আশ্রয় নিয়ে কাঁদছে। ব্যস আর কিছুই না। কিন্তু আইয়াজ বিশ্বাস করল না। ভালোবাসে তো এই নরম মনের মেয়েটাকে। এই মেয়েটার শরীরে শিরা, উপশিরা থেকে শুরু সমস্ত কিছু ওর চেনা। তাই এক মুহুর্ত স্তম্ভিত মুখে বসে রইল৷ বুকের গভীরে সুক্ষ্ম এক ব্যথা অনুভব করল। অর্ধাঙ্গিনীর যন্ত্রণায় সেও কাতর হয়ে রইল দীর্ঘক্ষণ।
.
.
আগামী মাসের দশ তারিখ ফ্লাইট ওদের৷ তিন বন্ধুর যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। সৌধ ছুটি নেয়ার তোরজোর করছে। এমতাবস্থায় একদিন ভোরবেলা নিধির কল পেল সৌধ। জানতে পারল, নামী তাকে মেইল করেছে! জানিয়েছে, নেক্সট মন্থে সে তার বাচ্চাকে নিয়ে দীর্ঘ কিছু মাসের জন্য সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। নিধির ফোনকল পেয়ে নামী সম্পর্কে এসব শুনে মাথা হ্যাং হয়ে যায় সৌধর। এ কোন খেলা খেলছে নামী? এ কোন লীলায় জড়িয়ে পড়ছে সুহাস? ভাগ্য কোনদিকে মোড় নেবে? সুহাস, নামীর ভবিষ্যত কী? আর নিষ্পাপ ওই বাচ্চাটা? আর কিছু ভাবতে পারে না সৌধ। তীব্র উত্তেজিত হয়ে কল করে আইয়াজকে। বলে,
‘ সুহাসের অ্যামেরিকায় যাওয়া হচ্ছে না দোস্ত। ওকে সুইজারল্যান্ড যেতে হবে। তুই আর ফারাহই যা অ্যামেরিকায়। ‘
‘ হোয়াট! কী বলছিস? ‘
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আইয়াজ। সৌধ পুরো বিষয়টা খুলে বলে ওকে। মস্তিষ্ক স্থির হয়ে যায় আইয়াজেরও৷ এসব কী হচ্ছে! দাঁড়ানো ছেলেটা বসে পড়ে। এরপর সৌধ ফোন কেটে কল করে সিমরানকে। এদিকে আইয়াজের মুখে সবটা শুনে ঘামতে শুরু করে ফারাহ। এত স্ট্রাগল, জল্পনা কল্পনা শেষে ফলাফল দেখে মাথা ঘুরে যায় ওরও। ভেবে পায় না নামী এতটা পাষণ্ডতা কেন করছে? অতিরিক্ত দুঃশ্চিতায় শ্বাসনালি আঁটকে যায় ফারাহর। নিমেষে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে বিছানার কোণায়। ভাগ্যিস আইয়াজ খেয়াল করে তৎক্ষনাৎ আগলে ধরেছে। নয়তো এক্ষুনি বিপদ ঘটত। ফ্লোরে পড়ে আঘাত পেত খুব৷
‘ ফারাহ, এই ফারাহ, চোখ খুলো, ফারাহ! ‘
অকস্মাৎ ফারাহ জ্ঞান হারাতে ঘাবড়ে গেল আইয়াজ। গলা উঁচু করে ডাকতে লাগল, মা আর ভাবিকে।
.
.
মাস পেরুতে পেরুতে বছরটা ঘুরে গেল৷ সুহাস অ্যামেরিকায় যায়নি৷ যায়নি আইয়াজ, ফারাহও৷ অদৃষ্টের চমৎকার পালাবদল ঘটেছে৷ ফারাহ এখন সন্তান সম্ভবা। বর্তমানে তার গর্ভাবস্থার চার মাস চলছে৷ সেদিন নামীর সুইজারল্যান্ড চলে যাবার খবর আর নিজের গর্ভে আইয়াজের সন্তানের অস্তিত্ব আছে জানার পর তারা আর অ্যামেরিকায় যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি৷ কিন্তু সৌধ আর সুহাস প্রস্তুতি নিচ্ছে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার। ইতিমধ্যে তারা খবর পেয়েছে নামীর সঙ্গে তার সৎ মা আর বাবার সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে। বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী আর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের দুই জমজ ছেলের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই অবহেলা করেছে মেয়েকে৷ সেই অভিমানেই নামী বাবার ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব সরাসরি ওরা কেউ জানতে পারেনি৷ নিধিকে পাঠানো নামীর মেইল পড়ে এতটুকু আন্দাজ করেছে ওরা৷ নামীর মতো মেয়েদের জীবনে ভালোবাসা ঠিক পান করা পানির মতো। যে পানিতে এক বিন্দু ময়লা পড়ে থাকে সে পানি কি আমরা পান করি? করি না। মানুষ যেমন পরিষ্কার, স্বচ্ছ পানি পান করে জীবন বাঁচায় ঠিক তেমনি তারা ভালোবাসাতেও স্বচ্ছতা চায়৷ নামী মেয়েটা ভালোবাসার কাঙালিনী। তাই বলে ভেজাল যুক্ত ভালোবাসা সে গ্রহণ করতে পারে না৷ পানি এবং ভালোবাসা দু’টোর ক্ষেত্রেই সে মারাত্মক সেনসেটিভ। পর্যাপ্ত সম্মান বিহীন সে যেমন ভালোবাসা মেনে নিতে পারে না। ঠিক তেমনি অস্বচ্ছ ভালোবাসাও সহ্য করতে পারে না৷ কথায় বলে না অভাগা যেদিকে যায় সেদিকেই সাগর শুকায়? নামীর জীবনটা বুঝি এমনই হয়ে গেল।
.
.
বিয়ের পর অনেক গুলো মাস পেরিয়ে গেছে। বিস্তর পরিবর্তন এসেছে সিমরানের জীবনে। সৌধর সঙ্গে একটি মিষ্টি সম্পর্ক, পড়াশোনা, টুকিটাকি সংসার, শাশুড়ির অগাধ স্নেহ আর দাদুনির অকারণ অল্পস্বল্প ক্ষোভ। ওদিকে আবার ভাই, ভাবিকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা।
সব মিলিয়ে তার জীবনটা ঠিক টক, ঝাল, মিষ্টিত্বে ভরপুর। বাপের বাড়ি ছিল সে। হঠাৎ ফোন পেল সৌধর। শুনতে পেল তার শীতল কণ্ঠস্বর,
‘ সিনু, পরশু বাড়ি ফিরছি। তুই বিকেলেই চলে যা৷ ‘
নিমেষে বুক ধক করে ওঠে সিমরানের। ইদানীং যে তার পাশাপাশি সৌধও মিস করা নামক শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে টের পায় সে৷ তাকে মিস করে মানুষটা৷ এইতো ক’দিন আগে এসে ভিসার আবদেন করে গেল। আবার এত তাড়াতাড়ি কেন আসছে? অজান্তেই নেচে ওঠে মন৷ আবার আকস্মিক মনে পড়ে যায় কাঙ্ক্ষিত একটি দিনের কথা। গত বছর এই দিনেই তো সে পার্বতী হতে হতেও হয়নি। আর সৌধ ভাই হয়নি দেবদাস৷ হৃৎস্পন্দন দ্রুত চলতে শুরু করে। সে বাপের বাড়ি থেকে শশুর বাড়ি চলে আসে৷ রাত পেরিয়ে একটা দিন একটা রাত কেটে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়। সারারাত কাটে নির্ঘুমে। বিছানায় ছটফট করে। ভোরের দিকে চোখ লেগে এলেই আকস্মিক কর্ণে বেজে ওঠে দরজার ঠকঠক শব্দ। তড়াক করে ওঠে বসে সিমরান। একছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই ক্লান্ত মুখে দাঁড়ানো সৌধকে দেখতে পায়৷ তার ঘুম জড়ানো চোখ আর ভোরের স্নিগ্ধ শীতলতায় টকটকে হয়ে থাকা ঠোঁটের পানে তাকিয়ে সৌধ মিটিমিটি হাসে। গাঢ় স্বরে বলে,
‘ গুড মর্নিং ডিয়ার। ‘
নিমেষে সরে দাঁড়ায় সিমরান৷ গলা ভিজিয়ে উত্তর করে,
‘ গুড মর্নিং। ‘
সৌধ খেয়াল করল ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে সিমরান। নিজের ভেতরে চলা উত্তেজনাটুকু লুকানোর চেষ্টা করেও লুকাতে পারছে না৷ ধরা পড়ে গেল। মনে মনে প্রচণ্ড হাসল সৌধ। এগিয়ে গিয়ে হাতের ব্যাগটা রেখে ফের সিমরানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। একদম সটান হয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাত ডুবিয়ে দিল প্যান্টের পকেটে। সিমরান কিছু বলতে উদ্যত হবে তার আগেই সে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গভীর গলায় বলল,
‘ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে শার্টটা খুলে দিবি? ‘
চমকে ওঠে সিমরান৷ তীব্র মায়া হয়৷ ভাবে আহারে লম্বা জার্নি করে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার বরটার। তাই হাত বাড়িয়ে শার্টের বোতাম স্পর্শ করতেই আচমকা বুকে ধুকপুক শুরু হয়৷ ফিরিয়ে নেয় হাত দু’টো। এতে সৌধর গাঢ় চোখদ্বয় আরো বেশি গাঢ় হয়৷ লজ্জায় গাল দু’টো রক্তাভ হয়ে ওঠে সিমরানের। নিঃশ্বাস হয় ভারিক্কি। ইতস্তত করতে করতে আবারো হাত বাড়িয়ে বোতামে স্পর্শ করে৷ এক পা এগিয়ে একদম কাছাকাছি দাঁড়ায়। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সৌধ। যার পুরোটায় ছড়িয়ে পড়ে সিমরানের মুখশ্রীতে। সে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধ মুখের তরুণীটির পানে। দু’টো বোতাম খুলতেই সিমরানের হাত, পায়ে কম্পণ ধরে যায়। ঠোঁট দু’টো আপনাআপনি কাঁপতে শুরু করে। সৌধর মুখের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস, উষ্ণ, শুভ্র বলিষ্ঠ বুকের কুচকুচে লোম গুলো ওর সমস্ত শিরা, উপশিরায় হিম ধরিয়ে দেয়। ভীষণ নাজেহাল হয়ে অবশেষে সবকটা বোতাম খুলতে সক্ষম হয়। গা থেকে পুরোপুরি শার্ট ছাড়াতে সাহায্য করে সৌধ নিজেই। সিমরান সেটা নিয়ে বাথরুমে জমিয়ে রাখা কাপড় গুলোর সঙ্গে রেখে আসে। এরপর দেখতে পায় শরীরে থাকা স্যান্ডো গেঞ্জিটাও খুলে ফেলেছে সৌধ ভাই। নিমেষে চোখ সরিয়ে নেয়। বলিষ্ঠ বুকটা দেখে এত বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে যে নড়ার শক্তিটুকুও পায় না। সে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি সৌধ ভাই এসেছে? নিশ্চিত হতে নিজের বা’হাতে চিমটি কাটে। ব্যথা পেতেই ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ চৌকা হয়ে যায়৷ সৌধ খেয়াল করে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। হুঁশ ফেরে সিমরানের। চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে যায়৷ সত্যিই তো সৌধ ভাই এসেছে। ঢোক গিলে ত্বরিত। ধড়ফড় করা বুকে এসে কাঁপা স্বরে বলে,
‘ সৌধ..’
ভাই টুকু বলার আগেই ওর ঠোঁটে তর্জনী চেপে ধরে সৌধ। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে ভারী গলায় বলে,
‘ ডোন্ট কল ব্রো। ‘
স্তব্ধিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সিমরান। সৌধ কথাটা বলেই তর্জনী সরায়। দু’হাত বাড়িয়ে চনমনে কণ্ঠে বলে,
‘ জাস্ট হাগ…। ‘
সৌধ কথাটা বললেও সিমরান জড়িয়ে ধরল না তাকে৷ বরং চিন্তায় পড়ে গেল ভীষণ। বিয়ের পর তাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা হয়নি তেমন। এক বিছানায় থাকার সুবাধে যতটুকু কাছাকাছি গেছে ততটুকুকে ঘনিষ্ঠতা বলে না। ঘুমের ঘোরে বহুবার সে সৌধ ভাইকে জড়িয়ে ধরেছে৷ বিনিময়ে অবহেলা পায়নি৷ সৌধ ভাই ঠিক প্রশ্রয় দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছে। বুকে আগলে ধরে ঘুমিয়েছে। সেটাতে আলাদা কোনো চাওয়া, পাওয়া ছিল না। তবে আজ কেন অন্যরকম লাগছে? এই সুগভীর চোখ দু’টো যেন অন্য সুরে তাকাচ্ছে আজ। এই যে হাতটা বাড়িয়ে ধরেছে তারও অন্যরকম চাহিদা৷ ওই প্রশস্ত বুকটাও যেন অন্যরকম আলিঙ্গনে ডাকছে। নিমেষে থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর দেহশ্রী। ঠিক কয়েক সেকেণ্ড ব্যবধানে সহসা সৌধ নিজেই ওকে টেনে ধরে বুকের ভেতর ভরে নেয়। উষ্ণ আলিঙ্গনে ডুবিয়ে রাখে দীর্ঘক্ষণ। দরজা খোলা আছে সেদিকে ওদের কারোরি হুঁশ নেই। সিমরান চোখ বুঁজে অনুভব করতে ব্যস্ত তার প্রণয় পুরুষটার বুকের বা’পাশের ধুকপুক শব্দ। আর সৌধ বিভোর অর্ধাঙ্গিনীকে গভীর আলিঙ্গনে…।

® জান্নাতুল নাঈমা
গল্পের স্বার্থে কিছু তথ্য থাকবে যার বাস্তবিক ভিত্তি আছে কিনা জানা নেই। যেমন : ভিসা জটিলতা।
আর হ্যাঁ আমি আগেও এলার্ট করেছিলাম। আজ আবারো করছি : এই উপন্যাসের কিছু পর্ব, কিছু অংশ প্রাপ্তমনস্ক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। আশা করছি আপনারা সহজ, স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করবেন৷

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।