ডিসেম্বরের সূচনা৷ হিমশীতল পরিবেশ। ধরণিতলে সূর্যরশ্মি পড়েনি আজ৷ মনকেমন করা একটা সকাল। অলস দুপুর আর ম্রিয়মাণ বিকেল। রাতটা পিপাসিত। পিপাসিতা রমণীটি বসে আছে আয়নার সামনে। নিজের রূপ, ঐশ্বর্য দৃষ্টিপাত করে ভেঙচি কাটছে বারংবার। কারণ খুবই হৃদয়স্পর্শী। সুন্দরী তরুণিমার তরুণকুমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। চঞ্চলা মন, উষ্ণ, নরম দেহ হাপিত্যেশ করে। পরোক্ষণেই আবার শিশুভুলানোর মতো করে বলে,
‘ শরীরটুকুই দূরে। মন ঠিকি কাছে মিশে। ‘
প্রিয়তমের ভাবনায় মশগুল সিমরান। ব্যস্ত অশান্ত হৃদয়ে সান্ত্বনা দিতে। তৎক্ষনাৎ বেজে উঠে সেলফোন। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কল ভেবে ছুটে যায়। ফোন ধরতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠে ‘ সুলল কাকু ‘ নামটা। একটুক্ষণ থেমে নিঃশ্বাস ছাড়ে শব্দ করে। এরপর ফোন রিসিভ করে সালাম দেয়। সালাম ফিরিয়ে শান্ত, সুন্দর, সাবলীল কণ্ঠে সুলল কাকু শুধায়,
‘ কেমন আছো আম্মু? ‘
‘ আলহামদুলিল্লাহ, আপনারা কেমন আছেন কাকু? ‘
উৎফুল্ল কণ্ঠ সিমরানের। সুলল কাকু স্মিত হেসে বলে,
‘ এইতো ভালো। তোমার বোনটি যে অস্থির হয়ে উঠেছে। কাল আসবে, উত্তেজনায় আজি তার ঘুম আসছে না। ভাবছি ওর স্কুল থেকে ফেরার পথে পিক করে নেব তোমায়। তৈরি থেকো কেমন? ‘
বুকের ভেতর শীতল শিহরণ বয়ে যায় সিমরানের। বারকয়েক পলক ঝাপটিয়ে মৃদু হেসে সম্মতি দেয়। ফোন রেখে দেয় সুলল কাকু। সিমরানের মনে পড়ে যায় লুনার কথা। বেচারি তার বিয়ের পর বেশকিছু মাস প্রচণ্ড বিরক্ত করেছে সুলল কাকুকে। তাহানীর সেকেণ্ড মাদার হওয়ার শখ হয়েছিল খুব৷ অচেনা একটি নাম্বার থেকে ডিস্টার্ব করাতে সুলল কাকু যখন খোঁজ লাগালো নাম্বারটি কার? মেয়েটি কে? লুনা সম্পর্কে জানার পর সর্বপ্রথম সিমরানের কাছেই এসেছিল। কী ভয় পেয়েছিল সিমরান। সে ভয় কাটিয়েছে সুলল কাকু নিজেই৷ খুবই অমায়িকভাবে প্রশ্ন করে শুনে নিয়েছে সবটা। এরপর একদিন লুনার সঙ্গে দেখা করে সুলল কাকু। সে দেখায় তাদের কী কথা হয়েছে জানা নেই। তবে সেদিনের পর থেকে লুনাকে আর দেখা যায়নি। অন্য বন্ধু, বান্ধবীদের থেকে শুনেছে, লুনার দিদা ভীষণ অসুস্থ। তাকে দেখতেই দেশের বাড়ি চলে গেছে। এরপর কতগুলো মাস পেরুলো। লুনার কোনো খোঁজ পায়নি কেউ। বাস্তব এবং ভার্চুয়াল। দু’টো জগত থেকেই লাপাত্তা মেয়েটি৷ ওর কোনো আত্নীয়, স্বজনকে চেনে না বান্ধবীরা৷ ওর মায়ের একটি ফোন নাম্বার ছিল৷ সেটাও বন্ধ। পড়াশোনাটাও যেন থেমে গেল মাঝপথে। কে জানে উদ্ভ্রান্ত, পাগলী মেয়েটা কেমন আছে? প্রিয় বান্ধবী লুনার কথা ভাবতে ভাবতে ত্বরিত ব্যাগপত্র গুছাতে মন দিল সিমরান। বাবার বাড়িতে বেশ অনেকদিন হলো এসেছে। নিত্যদিন বাবার সঙ্গে জমিয়েছে গল্প-আড্ডা। নিয়ম করে বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে। সময়, অসময়ে ব্যস্ত থেকেছে বরের সঙ্গে ফোনালাপেও। পাশাপাশি চালিয়েছে পড়াশোনা, ডায়ারি লেখা আর ইউটিউব ঘেঁটে টুকিটাকি রান্না শেখা। এতকিছুর ভীড়ে সময় গুলো কীভাবে ফুরিয়ে গেল টেরই পায়নি। শশুর বাড়ি ফেরার আনন্দ হওয়ার পাশাপাশি বাবাকে ছেড়ে যাবে বলে মন খারাপও হলো। মানুষটা যে ভীষণ একা। ভাইয়া, ভাবি আর সুহৃদ এলে বাবাকে নিয়ে আর কোনো চিন্তা থাকবে না। তাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে ক্ষানিকটা মন খারাপ করেই হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল। বেশ আবেগি, আহ্লাদী হয়েই সৌধকে ম্যাসেজ করল,
‘ কবে আসবে তোমরা? কাল ও বাড়ি যাব। আব্বুকে ছেড়ে যেতে খুব মন খারাপ হচ্ছে। ভাইয়া, ভাবিপু, সুহৃদ থাকলে কি এই মন খারাপটা হতো? ‘
.
প্র্যাগ্নেসির সাড়ে পাঁচ মাস চলছে ফারাহর। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মনও বিষাদে ভুগে খুব৷ বাবা, মাকে ইদানীং ভীষণ মনে পড়ে। কাছে পেতে ইচ্ছে করে৷ মনে বলে, যদি একটিবার বাবা ভরসামাখা হাত মাথায় রাখত। মা যদি একবার তার স্নেহময় বুকে আগলে ধরত। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয় যখন আকস্মিক মনে পড়ে এ পৃথিবীতে তার বাবা, মা নেই৷ এতিম সে ৷ আছে কেবল বোনটাই। যার সঙ্গে বিয়ের পর তেমন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। আগে মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হতো। এখন সেটুকুও হয় না৷ আইয়াজকে বলেছিল, আপুকে একদিন ফোন করে তাদের বাসায় নিমন্ত্রণ করতে। আইয়াজ সরাসরি না করেছে। ফারাহর অনুভূতি বুঝতে পারে আইয়াজ। তবু রাজি হয়নি। তার রাজি না হওয়ার পেছনের কারণটা জানে ফারাহ। তবু মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে। ফোনে কথা হলেই আপুকে দেখতে ইচ্ছে করে। একবার কাঁধে মাথা রাখতে ইচ্ছে করে৷ নিজের জীবনের পরিবর্তন, প্রাপ্তি গুলো মন খুলে বলতে ইচ্ছে করে। তাই এখন ফোনও করে না। একটা বীভৎস ঘটনা, অতীত কত নির্মমভাবে দু’বোনের মাঝে দেয়াল তুলে দিল!
গর্ভাবস্থায় মেয়েরা সাধারণত মুটিয়ে যায়। ফারাহ আগে থেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। কিন্তু গর্ভবতী হওয়ার পর সে স্বাস্থ্য ক্রমশ নুয়ে পড়ছে। খেতে ভালোবাসা মেয়েটি এখন খেতে পারে না। আইয়াজ চেষ্টা করে যথাসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে বাপের বাড়ির যে সুবিধা পায় মেয়েরা। ফারাহ সেটা পাচ্ছে না৷ আইয়াজের মা দায়িত্ব পালন করে ঠিক। কিন্তু মায়েদের যে আন্তরিকতা সেটুকু ফারাহর প্রতি খুঁজে পাওয়া যায় না৷ ফলশ্রুতিতে আইয়াজই চেষ্টা করে সকলের অভাব নিজে একাই পূরণ করতে। ইদানীং টুকটাক রান্না শেখাও হচ্ছে। বউ মাঝেমাঝে ওটা, সেটা খাওয়ার বায়না করলে তৈরি করে খাওয়ায়। দিনে যেহেতু ব্যস্ত থাকে তাই মধ্যরাতটাই হয় ওর বউকে রেঁধে খাওয়ানোর যোগ্য সময়৷ এমনই ভাবে গতকাল রাতে ফারাহকে তেঁতুলের চাটনি করে খাইয়েছে। একটা ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও দিয়েছে। যেখানে সুহাস, সৌধ সহ তিন বন্ধু আর সিমরান, ফারাহও ছিল। তেঁতুল চাটনি দেখে সবাই প্রশংসা করেছে খুব৷ সিমরান প্রশংসার পাশাপাশি জানিয়েছে, সে এখন বেশ রান্নাবান্না শিখেছে। এখন জলপাইয়ের মরশুম। ইউটিউব ঘেঁটে শিঘ্রই জলপাই আচার বানাবে। আর এক বয়াম পাঠিয়ে দেবে ফারাহপুর ঠিকানায়। সিনুর ম্যাসেজ দেখে ফারাহ তো বেজায় খুশি। ভীষণ অপেক্ষায় জলপাই আচার খেতে সিনুপাকনির হাতে।
.
.
জেনেভা শহরে প্রায় একমাস হতে চলল সৌধ সুহাসের। অথচ নামীমন গলল না। হয়তো-বা গলেছে। কিন্তু টের পায়নি এখন অবধি ৷ নিয়ম করে ছেলেকে কাছে পায় সুহাস। বাবা, ছেলের মধ্যিখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না নামী। ছেলেকে নিয়ে মাঝেমাঝে লং ড্রাইভে বেরোয় বাবা। হয় নিত্যদিনের খেলার সাথীও। যেদিন নামীর হসপিটালে ডিউটি থাকে। সেদিন পুরোদিন সুহৃদের দেখভাল করে সুহাস৷ নিজের কাছে নিয়ে রাখে। বাবা আর চাচ্চু সৌধর সান্নিধ্যে দারুণ সময় কাটে সুহৃদের। উপভোগ করে ভীষণ। ভিডিয়ো কলে কথা বলে দাদুভাই আর ফুপির সাথে। খিলখিল করে হেসে, অস্পষ্ট সব কথা বলে মুগ্ধ করে রাখে সবাইকে। সময়গুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। নিভৃতে বোধহয় গলতে শুরু করেছিল নামীমনের বরফও। এমতাবস্থায় আকস্মিক একটি অঘটন ঘটে। বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে সুহৃদের দুরন্তপনাও বাড়ছিল। গতরাতে একটা ইংরেজি উপন্যাস পড়ায় ব্যস্ত ছিল নামী৷ সুহৃদ পাশেই খেলনা দিয়ে খেলছিল। হঠাৎ খেলা ছেড়ে বেডের পাশে টেবিলে রাখা পানি ভর্তি কাঁচের গ্লাস ধরতে গিয়ে ফেলে দেয়। নামী বইয়ে এতটাই মগ্ন ছিল যে শব্দটা শুনেও গুরুত্ব দেয়নি। আর সুহৃদ একটু চমকে বিছানা থেকে নেমে যায়। বয়স ন’মাস চলছে। শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে একা হাঁটতে পারে না। তাই এক কদম এগুতে গিয়ে কাঁচের টুকরো গুলোর উপরই মুখ থুবড়ে পড়ে! সঙ্গে সঙ্গে গালের একপাশে, হাতে আর পেটে কাঁচ ঢুকে যায়। নিমেষে শিশু বাচ্চাটির তরতাজা রক্তের স্রোত আর হৃদয় বিদারক কান্নায় মুখরিত হয় নীরব ঘর। এরপর সাড়া বাড়ি। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নামী। সন্তানের এহেন দৃশ্য দেখে ডাক্তারসত্তা নিভে গিয়ে মাতৃসত্তায় দিশেহারা হয়ে উঠে৷ পাগলপ্রায় হয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে, দাঁতে দাঁত পিষে, শ্বাসরুদ্ধ করে সুহৃদের শরীর থেকে কাঁচের টুকরো গুলো বের করে। এরপর নরম কাপড়ে কেটে যাওয়া অংশগুলো বেঁধে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ছুটে যায় নিচে। বাড়িতে অ্যালেন ছিল। তাই তাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। গালে আর পেটে দু’টো সেলাই পড়ে বাচ্চাটার। হাতে ব্যান্ডেজ। সুহাস আর সৌধকে খবর জানালে তারা যেভাবে, যে অবস্থায় ছিল সেভাবেই ছুটে আসে৷ এতটুকুন একটা বাচ্চা। ছোট্ট শরীর। ধকল ঠিক কতটা গেছে ভাবতেই শিউরে উঠে সুহাস৷ চোখমুখ লাল করে, বিধ্বস্ত হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেকে নিজের কাছে চাইলে জানানো হয়, সুহৃদকে দুগ্ধপানে ঘুমপাড়ানোর চেষ্টা করছে নামী।
মধ্যরাত। হসপিটাল কেবিনে ঘুমে বিভোর সুহৃদ। পাশে নামী। টলমল চোখে ছেলের ব্যান্ডেজ করা অংশে তাকিয়ে আছে। সুহাস এলো তখন৷ একটু চমকাল নামী৷ এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। দোষারোপ করতে ওস্তাদ সুহাস৷ এখন রাগ ঝাড়বে। দোষারোপ করবে। আক্রোশে ফেটে পড়ে অনেক কটুবাক্যই আওড়াবে৷ জানে নামী। মনটা তার ক্ষতবিক্ষত এখন। সুহাসের দোষারোপ, ক্রোধ সহ্য করার শক্তি নেই। আর না আছে প্রতিবাদ করার সামর্থ্য। তাই কান্না বিগলিত কণ্ঠে বলল,
‘ প্লিজ, যত রাগ ঝাড়ার, যত দোষারোপ করার পরে করো। এ মুহুর্তে মনের দিক দিয়ে আমি ভীষণ আহত। ‘
বেডের একপাশে চুপচাপ বসল সুহাস। রক্তিম দৃষ্টিজোড়া ছেলের ব্যথাতুর মুখে স্থির। নামীর দিকে তাকাল না। শুধু প্রতিত্তোরে বলল,
‘ রাগ, দোষ? আমার সন্তানের কোনো বিপদেই তো আমি পাশে থাকতে পারিনি৷ ওর একটু একটু করে বেড়ে উঠা, এ পৃথিবীতে আগমন এর কোনো অনুভূতিই আমি পাইনি। না ওর পাশে থাকতে পেরেছি আর না ওর মায়ের৷ তাহলে আজ কোন অধিকারে দোষারোপ করব? কী স্পর্ধায় রাগ ঝাড়ব? ‘
ধরে আসা গলায় কথাগুলো বলতেই ডান চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ল। টলমল দৃষ্টিতে নামী দেখল তা৷ বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়ে গাল বেয়ে নোনাপানির ধারা নামল তারও৷ অনুভব করল একই রক্তক্ষরণ সুহাসেরও হচ্ছে। সে যেমন সুহৃদের মা সুহাসও বাবা। তার থেকে আজ যেন সুহাসের যন্ত্রণাটাই বেশি। অপারগতার যন্ত্রণা যে ভয়ানক হয় ভীষণ ভয়ানক।
Leave a comment