ইট পাটকেল | পর্ব – ২১

9 Min Read

সকাল থেকেই কামিনী চৌধুরী কে খুব খুশি খুশি লাগছে।নূর তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু অবলোকন করেছে।মায়া বেগম নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছেন। বিয়ের পর থেকে কিচেন সে সামলায়।এখন আর সেফের রান্না না খেয়ে সবাই তার হাতের রান্না ই খায়।তবে কামিনী চৌধুরীর খাবার সেফ রান্না করে।
আশমিন আজ সপ্তাহ খানেক হলো কানাডা গিয়েছে।কিছু জরুরি কাজে আটকে যাওয়ায় আরো কয়েকদিন থাকতে হবে। নূরের সাথে এই কয়েকদিন কথা হয়নি তার। কামিনী চৌধুরী নূর কে চার’শ কোটি টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে কাল।সেই সাথে আর এস কোম্পানির থেকে শেয়ারের একটা পোশাক কারখানা তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।পৈতৃক সুত্রে সে এই কারখানা পেয়েছে।আর এস কোম্পানি তে তার আর কোন শেয়ার নেই।কামিনী চৌধুরী দাতে দাত চেপে মেনে নিয়েছে সব।কোথায় চার হাজার কোটি টাকার ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি আর কোথায় পঞ্চাশ কোটি টাকার সামান্য একটা কারখানা।
আজ ছুটির দিন। শুক্রবার কেউ অফিসে যায় না।আমজাদ চৌধুরী নিজের রুমে রেস্ট নিচ্ছে।মায়া বেগমের রুমেই সে থাকে।কয়েকবার কামিনী চৌধুরীর কাছে যেতে চাইলেও কামিনী চৌধুরী তাকে রুমে ঢুকতে দেয়নি। মায়া বেগমের সাথে তার সম্পর্ক আগের মতোই আছে। কেউ কারোর সাথে খুব একটা কথা বলে না। আশমিনের সাথেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে আমজাদ চৌধুরীর। চার বছর বয়স থেকে আশমিন হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে।কামিনী চৌধুরী ছোট বেলা থেকেই আশমিনের প্রতি ছিল উদাসীন। জীবনের বিশ টা বছর সে হোস্টেলেই কাটিয়েছে।তবুও আমজাদ চৌধুরীর সাথে তার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। আজ এতো কাছে থেকেও তাদের মধ্যে হাজার মাইলের দূরত্ব।

ড্রয়িং রুমে বসে অফিসের কিছু কাজ করছিল নূর।অমি কিছু হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে তাকে।আজ আশমিনের দেশে আসার কথা। সেদিন ই একইরকম দেখতে আরেকটা গাড়ি নিয়ে এসেছে আশমিন।
কলিং বেলের শব্দে কামিনী চৌধুরী একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললেন।মেড গুলো হা করে তাকিয়ে আছে কামিনী চৌধুরীর দিকে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টা কে দেখে কামিনী চৌধুরীর মুখ চকচক করে উঠলো। তাকে জরিয়ে ধরে কুমিরের কান্না কাদতে লাগলো। নূর চোখ মুখ কুচকে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। অমি নিস্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো কামিন চৌধুরীর দিকে। কামিনী চৌধুরীর কান্নার আওয়াজ শুনে আমজাদ চৌধুরী ও বেরিয়ে এসেছে তার রুম থেকে। কামিনী চৌধুরী কে শান্ত করে বুক থেকে সরাতেই কেপে উঠলো অমি।অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।এ জেন তারই প্রতিচ্ছবি। নূর একবার দেখে আবার নিজের কাজে মন দিলো। সেদিকে চোরা চোখে তাকালো অমি।নুরের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে অবাক হলেও কিছু বললো না। আমজাদ চৌধুরী একবার নূরের তাকিয়ে আবার শক্ত চোখে কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকালো। মনে মনে করুণা হলো তার সহধর্মিণীর জন্য। পদে পদে হেরে নিজেকে উন্মাদ করে চলেছে।এর পরিনতি অত্যন্ত ভয়ংকর।
ছেলেটা কে নিয়ে ভিতরে আসলো কামিনী চৌধুরী। ছেলেটা দেখতে অমির মত হলেও অমি থেকে তার গায়ের রঙ অনেকটা উজ্জ্বল।
কামিনী চৌধুরী শয়তানি হেসে নূরের বরাবর এসে বসলো। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— সবার মনে অনেক প্রশ্ন তা আমি জানি।তার আগে পরিচয় করিয়ে দেই,এ হচ্ছে আশিয়ান শিকদার।শিকদার আম্পায়ারের একমাত্র উত্তরাধিকারী।রাফসান শিকদারের ছেলে।
আশিয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অমির দিকে।দেখতে তার মতো ছেলেটা কে বুঝতে বাকি নেই তার।কাউকে কিছু না বলে সে অমি কে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। অমি অবাক হলেও কিছু বললো না। কামিনী চৌধুরী মুখ কুচকে সেদিকে তাকিয়ে আছে। নূর এবার আয়েশ করে বসলো।
অমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আশিয়ানের থেকে।চোখের পানি লুকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
প্রায় বিশজন গার্ডসহ বাড়িতে ঢুকলো আশমিন। সারি সারি লাগেজ গুলো রেখে গার্ড গুলো নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লো। আশমিন ক্লান্ত গা এলিয়ে দিলো সোফায়।নূরের কাধে মাথা রেখে ন্যাকা গলায় বলল,
— আই মিসড ইউ বউ। তোমাকে ছাড়া থাকতেই পারছলাম না জানো?তাই তারাতাড়ি চলে এলাম।
নূর ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লো। না এই লোকের অসহ্য কারবার শেষ হবে আর না নূর ভালো বউদের মতো সংসার করতে পারবে। আশমিন কে কিছু না বলে আশিয়ানের দিকে তাকালো নূর। সে আপাতত কামিনী চৌধুরীর পাশে বসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে নূর আর আশমিনের দিকে। নূর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— আপনার পরিচয়?
কামিনী চৌধুরী কর্কশ গলায় বলল,
— এই মেয়ে,একটু আগে কি বললাম শুনতে পাওনি?
— নাহ।আমি সবার কথায় কান দেই না।রাস্তার কুকুর ও ঘেউঘেউ করে।তাই বলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে তার কোন মানে নেই।আমি আপনার সাথে কথা বলছি না মিসেস চৌধুরী।পরের বার আমার কথায় বাম হাত ঢুকানোর চেষ্টা করবেন না। আই ডোন্ট লাইক ইট।
কামিনী চৌধুরী কটমট করে তাকালো নূরের দিকে। আশিয়ান ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলে নূরের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— আমি আশিয়ান শিকদার। রাফসান শিকদারের ছেলে।
আশমিন নূরের কাধ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আশিয়ানের দিকে।
নূর শান্ত চোখে তাকালো। উঠে গিয়ে রাফসান শিকদারের কাউচে বসে পায়ের উপর পা তুলে গম্ভীর গলায় বলল,
— প্রুফ?
আশিয়ান নড়েচড়ে বসলো।জোর গলায় বলল,
— ডিএনএ টেস্ট করিয়ে দেখতে পারো। কানাডায় আমার আম্মুর সাথে সম্পর্ক ছিল তোমার বাবার। সেখানেই আমার জন্ম। আমজাদ চৌধুরীর আর মামনি সাক্ষী আছেন।চাইলে জিজ্ঞেস করতে পারো নূর।
নূর ক্রুর হাসলো। আশমিন শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূর মলিন চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। আশমিন চোখ সরিয়ে নিলো। এ তো একদিন হওয়ার ই ছিল। নূর আশিয়ানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল,
— আমার বাবার এক রাতেই বেড পার্টনার ছিল আপনার মা।তার জন্য তাকে এক কোটি টাকা পেমেন্ট করা হয়েছে। আর আপনার মা আমার বাবার সুযোগ নিয়েছিল। তার বেহায়াপনার ফল হচ্ছেন আপনি। যাকে বলে অবৈধ সন্তান। কোন অবৈধ সন্তান কি করে রাফসান শিকদারের উত্তরাধিকারী হতে পারে? নিজের অবস্থান বুঝতে শিখুন মি. আশিয়ান।লোকে শুনলে হাসবে যে।
আশিয়ান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। এই মেয়ে কে দুই আঙ্গুলে পিষে দেলা তার দুই মিনিটের ব্যপার। নিজের হিংস্রতা এই মুহুর্তে বাইরে আনতে চাইছেনা সে।কামিনী চৌধুরী বাকা হাসলো। সে জানতো নূর এমন কিছুই করবে।আশিয়ান কে হালকা ভাবে নেয়া তাদের মোটেই উচিত হচ্ছে না। ডুবাইয়ের নামকরা মাফিয়া সে। শিকদারের এই অর্থ সম্পদ তার হাতের ধুলোর মতো। কিন্তু সে শিকদার দের মৃ*ত্যু চায়।তার মায়ের মৃ*ত্যুর বদলা নেয়ার জন্যই তার এখানে আসা।চাইলে এই মুহুর্তে সবাই কে মেরে ফেলতে পারে সে। কিন্তু এতো সহজ মৃত্যু এদের দিবেনা আশিয়ান।ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর যন্ত্রণা দিবে এদের।তার কাছে মৃত্যু খুব সামান্য শাস্তি।
— সত্যি টা জানানোর ছিল তাই জানালাম। অনেক তো আয়েশ করলে।এবার নাহয় বাবার জারজ সন্তানের সাথে হালকা মোকাবেলা হয়ে যাক।
আশমিন শব্দ করে হেসে উঠলো। আশিয়ান আর কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ক্রুর হেসে বললো,
— কেন নয় মি.মাফিয়া।আপনার অপেক্ষায় আমার চোখের নিচে কালি পরে গেলো। এতো অপেক্ষা তো আমি আমার বউয়ের জন্য ও করিনি। এসেছেন, কয়েকদিন ঘুরুন ফিরুন। যা হওয়ার তা নাহয় পরে হবে। দেখা গেলো আর সুযোগ ই পেলেন না বাংলাদেশ দেখার।কয়েকদিন রেস্ট নিন।এখন আপনি আসতে পারেন।আমার খুব প্রেম পেয়েছে।এই মুহুর্তে বউ দরকার। আমি আবার প্রেম চেপে রাখতে পারি না। আসো তো বউ।
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নূর কে টেনে উপরে নিয়ে গেলো আশমিন। অমি কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। আশিয়ান আয়েসি ভঙ্গিতে বসে বাকা হাসলো। ইন্টারেস্টিং কিছু হবে এবার।
আশমিন নূর কে নিজের রুমে এনেই দরজা বন্ধ করে দিল।নূর শয়তানি হেসে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই নূর অগ্রাসী ভাবে আদর করতে লাগলো আশমিন কে। আশমিন থমকে গেলো। মাথার মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেলো।ঠোঁটে হালকা ব্যথার আবির্ভাব হতেই দুই লাফে দূরে সরে গেলো।
— তুমি এভাবে একজন গণ্যমান্য মন্ত্রীর ইজ্জত লুটে নিতে পারো না! আমার এতো বড় সর্বনাশ করো না নূর। আমি জনগণের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। এখনো বউয়ের সাথে বাসর টা ও করা হয়নি।
নূর কটমট চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। আশমিন দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। নূর একটা বালিশ ছুড়ে মারলো আশমিনের দিকে। রাগী গলায় বলল,,
— এমন করলে আর বাসর করাও হবে না। এতো নাটক করেন কিভাবে?অসহ্য মানুষ একটা।

(যাদের ভালো লাগছে না ইগনোর করুন।কারন দুজনের টক্কর সারা গল্প জুরেই চলবে।হোক সেটা ভালোবাসার বা প্রতিশোধের।)

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।