চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির বিলাসবহুল কেবিনে বসে আছে আশমিন। শান্ত মুখে পরাজয়ের ছাপ স্পষ্ট। তার সামনেই আমজাদ চৌধুরী বসে ছেলের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে।
— সব কিছু জেনেও এভাবে হাতে হাত রেখে বসে আছো কেন? ও তোমাকে আঘাত করবে আশমিন।বাবা হতে চলেছো তুমি।নিজেদের মধ্যে সবকিছু মিটিয়ে নাও।
আশমিন চোখ তুলে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। শান্ত গলায় বললো,
— ও আমাকে ঘৃণা করে আব্বু।যতটা ঘৃণা করলে একটা মানুষের হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দেয়া যায় ও আমাকে ঠিক ততটা ঘৃণা করে। আমি প্রতিটি মুহুর্ত তা অনুভব করতে পারি।
— তাহলে কি তুমি এভাবেই সব কিছু চলতে দিবে? রাগের বসে ও যদি নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলে?বাচ্চার সাথে ও তো কিছু করে ফেলতে পারে।যে তোমাকে ঘৃণা করে সে তোমার বাচ্চাকে ও তো ঘৃণা করবে।বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?(অস্থির হয়ে)
আমজাদ চৌধুরীর অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো আশমিন। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত চোখে তাকালো তার বাবার দিকে।
— ভুল ভাবছো তুমি আব্বু।ও কখনো আমাদের সন্তানের কোন ক্ষতি করবে না। ও আমার একার সন্তান না।ও নূরের ও সন্তান।আমি হয়তো এখনো ওকে অনুভব করতে পারি নি।কিন্তু নূর প্রতি মুহুর্তে ওকে অনুভব করছে। একজন মা কখনো তার সন্তানের ক্ষতি চাইতে পারে না।আমার প্রতি যতই ঘৃণা থাকুক না কেন,নিজের সন্তান কে অবহেলা করবে না ও। আর আমার প্রতি ঘৃণা টা কি অযোক্তিক আব্বু?
আমজাদ চৌধুরী চুপ হয়ে গেলেন। নিজেকে তার খুব অসহায় মনে হচ্ছে। রাফসান শিকদার ভুল ছিল।সে ইচ্ছে করে কামিনীর স্বামী কে মারে নি। ওটা একটা দূর্ঘটনা ছিল। এক প্রতিশোধের জন্য কামিনী নূরের মা কেও মেরে ফেলেছে। এর পরেও সে থেমে থাকে নি।রাফসান চৌধুরী কে ও ছাড়েনি সে। নূরের মায়ের এখানে কোন দোষ ছিল না। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল।কামিনী কে রাফসান শিকদারের কথা মেনে নিতে বলেছিল যাতে পরবর্তীতে রাফসান শিকদার কে বোঝানোর কিছুটা সময় পায়।কিন্তু বরাবর উগ্র মেজাজের কামিনী তাকেই আঘাত করে বসলো।পরিস্থিতি খারাপের দিকে একমাত্র কামিনী চৌধুরীর ঔদ্ধত্যের কারনে গিয়েছে। সে কামিনী কে বিয়ে করেছে তাকে আগলে রাখার জন্য। তার প্রখর ভালবাসা কামিনী বারবার উপেক্ষা করে গিয়েছে। কামিনী চৌধুরী যে তাকে ভালবাসে না তা কিন্তু না। কিন্তু তাদের মাঝে সারাজীবন দেয়াল হয়ে রয়ে গেলো তার প্রাক্তন। কামিনী চৌধুরীর প্রত্যেক টা অন্যায় জানার পর বারবার মুষড়ে পরেছেন।বাধা দিতে গিয়ে তার রোষানলে পড়তে হয়েছে।প্রচন্ড ভালবাসার কারণে আইনের হাতে তুলে দিতে পারেনি।আজ তার প্রখর ভালবাসা ই কাল হয়ে দাড়ালো। তার আবেগে ভেসে যাওয়ার কারনেই এতো গুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেলো।
— বাসায় যাও আব্বু। সব কিছুর উর্ধ্বে আমি নূর কে ভালবাসি।ও আমাকে ঘৃণা করুক বা ভালবাসুক। আমার সাথেই ওকে থাকতে হবে। এই জীবনে ওর আমি থেকে মুক্তি নেই।
আমজাদ চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন।কামিনী চৌধুরী ফিরে এসেছে কানাডা থেকে।আমজাদ চৌধুরী আমতা আমতা করে বললো,
— তোমার আম্মু যদি,,
আশমিন ঠান্ডা চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। হিমশীতল গলায় বলল,
— নিজের বউ সামলে রেখো আব্বু।আমি মানুষ টা মোটেও সুবিধার নয়। প্রচন্ড স্বার্থপর মানুষ আমি।আমার স্বার্থে আঘাত লাগলে কেউ ছাড় পাবে না।
আমজাদ চৌধুরী ভয়ার্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। ছেলে কতটা সিরিয়াস তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন।
আশমিন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দেয়ালের দিকে। সে কোন ভুল করে নি।সেদিক থেকে বিবেচনা করতে গেলে নূর ও কোন ভুল করছে না।তাহলে ভুলটা কার?বুকের ভিতর অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো আশমিনের।নিজের অস্থিরতা কমাতে তার বউ দরকার। অস্থির পায়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল আশমিন। না জানি বউ তার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র করছে।তাই বলে সে তো আর তাকে একা ছেড়ে দিতে পারেনা।
সাত মাসের পেট নিয়ে অফিসে এসেছে নূর। এই কয়েকমাসে তার বিশ্বস্ত কয়েকজন খু*ন হয়েছে।দুটো পোশাক কারখানায় আগুন লেগেছে।রাতের আধারে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবেই যে সব করেছে তা সে জানে। মেশিন সব পুড়ে গেলেও মাল সব অক্ষত ছিল। প্রতিদিনের মালামাল সবার অগোচরে নূর কারখানা থেকে সরিয়ে ফেলতো। কয়েক কোটি টাকার মাল বেচে গেলেও মেশিন গুলো আর বাচাতে পারে নি।ক্ষতির পরিমান টা তাই একটু কম হয়েছে। তাই প্রতিটি কারখানায় কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করেছে নূর।নিজেই সব মনিটরিং করছে। আশমিন বাধা দিলেও আমলে নেয়নি। বাড়িতে থাকা এখন তার জন্য আরো বেশি অনিরাপদ। কামিনী চৌধুরী কখন কিভাবে তার ক্ষতি করে ফেলবে তার নিশ্চয়তা নেই।
— আসবো ম্যাম,,
নূর ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকালো। অমি ক্লান্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
— না। আসবে না। কতো বার ম্যাম বলতে নিষেধ করেছি?
অমি বোনের অভিমান দেখে মুচকি হাসলো। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
— আপনি সব সময় আমার ম্যাম হয়েই থাকবেন। আমি এতেই কমফোর্ট ফিল করি।
নূর মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস ছাড়লো।
— আচ্ছা সেসব বাদ দাও।কাজ হয়ে গেছে?
— হুম।আশিয়ান এসেছিল। সব স্বিকার করেছে সে।
নূর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো। শরীর টা ইদানীং খুব খারাপ যাচ্ছে। পা গুলো অসম্ভব ফুলে উঠেছে।রাতে ঘুম হয় না ভালো করে। আশমিন ও তার সাথে জেগে থাকে।তার মন ভালো করার চেষ্টা করে। নূর কিছু নিয়ে আবদার করে না আশমিনের কাছে। যা দরকার হয় নিজেই করে নেয়। এর জন্য আশমিনের অভিযোগের শেষ নেই।
— শরীর খারাপ লাগছে ম্যাম?
— নূর মাথা নেড়ে সায় জানালো। অমি অস্থির হয়ে নূরের কাছে গেলো। পাশের কেবিন থেকে লুবানাও ছুটে এসেছে।নূরের কেবিন আর লুবানার কেবিনের মাঝে গ্লাসের দেয়াল থাকায় লুবানা স্পষ্ট সব দেখতে পায়।
নূর অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছে। লুবানা পানি এগিয়ে দিলো নূরের দিকে। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলেও নূরের অস্থিরতা কমছে না। অমি চিৎকার করে নূর কে বুকের সাথে চেপে ধরলো। অস্থির গলায় লুবানা কে বললো,,
— তারাতাড়ি ডাক্তার ডাকো লুবানা।
নূর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। অমি পাগলের মতো ডেকে চলেছে তাকে।
— নূর,,কি হয়েছে বোন।চোখ খোল।কোথায় খারাপ লাগছে আমাকে বল। আল্লহ! নূর চোখ খুলছেনা কেন? (অস্থির হয়ে)
— ডাক্তার চলে আসবে স্যার।আমি কল করে দিয়েছি।
লুবানা ভয়ে ঘেমে গিয়েছে।নূরের অবস্থা দেখে তার আত্মা কাপছে। আশমিন জানতে পারলে তাকে আর আস্তো রাখবে না।
— নূর!!
আশমিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে নিস্তেজ নূরের দিকে। অমির কান্নারত চেহারা দেখে তার বুক কেপে উঠলো। দ্রুত পায়ে এসে নিজের বুকে আগলে নিলো নূরকে।
— কি হয়েছে নূরের? ও কথা বলছে না কেন?
আশমিনের রক্তিম চোখ দেখে দুজনেই কেপে উঠলো। আশমিন দেড়ি না করে নূর কে কোলে তুলে পাশের রুমে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে ও যখন নূরের জ্ঞান ফিরলো না তখন শুরু হলো তার পাগলামি। ভয়ে তার বুক কাপছে। আশমিন জায়িন চৌধুরীর বুক কাপছে!
দুই মিনিটের মধ্যে ই ডাক্তার চলে এসেছে।আশমিন নূর কে এক মুহুর্তের জন্য ও ছাড়েনি। নূরের মাথা টা নিজের বুকের সাতগেই চেপে ধরে ছিল।ডাক্তার নূর কে চেকআপ করে বললো,
— অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারনে জ্ঞান হারিয়েছে। ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া ও করে না হয়তো। শরীর খুব দুর্বল। রক্ত শূন্যতা ও থাকতে পারে। এই সময় এগুলো ভালো লক্ষণ নয়। বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন। টেনশন ফ্রী রাখার চেষ্টা করবেন সব সময়। এমন চলতে থাকলে দুজনের জন্যই খুব রিস্ক হয়ে যাবে।
ডাক্তার কিছু ঔষধ প্রেসক্রাইব করে দিলেন। অমি দ্রুত পায়ে চলে গেলো ঔষধ আনতে।আশমিন চুপ করে বসে আছে। রাগে তার মাথা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। লুবানার দিকে অগ্নি চোখে তাকাতেই লুবানা কান্না করে দিলো।
— আমি খুব চেষ্টা করেছি স্যার।ম্যাম আমার কোন কথা ই শুনে না।আপনাকেও কিছু বলতে দেয় না।আমি কি করবো বলুন?
আশমিন কিছু বললো না। তার এখন কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ডাক্তার সেলাইন দিবে নূর কে।ডাক্তার কে নূর মঞ্জিলে আসতে বলে আশমিন নূর কে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। লুবানা আর ডাক্তার ও তার পিছনে ছুটলো।
— ভাইয়া আপনি ঔষধ নিয়ে বাসায় চলে আসুন।আমরা ম্যাম কে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি।
অমি আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। টেনশন হচ্ছে তার।তারাতাড়ি বাসায় পৌছাতে হবে।
Leave a comment