ভালবাসার রাজপ্রাসাদ | পর্ব – ২০ | ৬৪ ছক 2

28 Min Read

অভি ওর মাথার চুল আঁচড়ে বলে, “পরী পিসি কে খুব মনে পরে, তাই না?”
অভির কোল ঘেঁসে বসে দুষ্টু, “হ্যাঁ, পরী পিসিকে খুব মনে পরে আমার। আমার সাথে খেলত, আমাকে খাইয়ে দিত, আমার চুল আঁচরে দিত, স্নান করিয়ে দিত আমাকে। ঘুম না পেলে গান গেয়ে ঘুম পারিয়ে দিত পরী পিসি। পিসি চলে যাবার পরে আমার খুব একা একা লাগে।”
বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সেই ছোট্ট ছেলেকে, “তোর পরী পিসি কোথাও যায় নি।”
ছোটো বুকের বাম দিকে আদর করে হাত রেখে অভি ওকে জানায়, “তোর পরী পিসি সর্বদা এখানে থাকবে।”
দুষ্টু ওর কথা শুনে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “পরী পিসির সাথে দেখা করার জন্য আমি তোমার বাড়ি যেতে পারি?”
অভির গলা ধরে আসে, “হ্যাঁ বাবা, তুই যখন খুশি আমার বাড়িতে আসতে পারিস। সারা জীবন আমার বাড়ির দরজা তোর জন্য খোলা।”
আনন্দের আবেগে দুষ্টু ওর গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, “তুমি না আমার সব থেকে ভালো কাকু, অভি কাকু।” নিশকলঙ্ক নিষ্পাপ সেই মিষ্টি হাসি দেখে অভির মন আনন্দে ভরে ওঠে।

সূর্য বেশ খানিখন আগেই ডুবে গেছে। মাথার ওপরে পাখীর কিচির মিচির, বাসায় ফিরে যাওয়ার তাড়া সবার। জামা কাপড় শুকিয়ে গেছে ওদের। জামা কাপর পরে বাড়ি ফিরে আসে ওরা, সারাটা পথ, অভির হাত আঁকড়ে ধরে থাকে দুষ্টু। বাড়িতে ঢুকেই পরী কে দেখে লাফিয়ে কোলে চড়ে যায় আর কানে কানে কিছু বলে। পরী অভির দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে দুষ্টুর কথা শুনে হেসে ফেলে।
পরী ওকে বলে, “হ্যাঁ রে, তুই যখন তখন আমার বাড়িতে আসতে পারিস।”
বাড়িতে অভির উপস্থিতি যেন আবহাওয়াকে ভারী করে তুলেছে। বিশেষ করে সুব্রত আর অভির মধ্যে যে একটা মনমালিন্য চলছে সেটা দিদা আর সুমন্ত মামার চোখ এড়ায় না। এক বিকেলে সুমন্ত মামা আর অভি বারান্দায় বসে মুড়ি আর চা খাচ্ছিল, সুমন্ত মামা ওকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি সুব্রতর বিয়ের সময়ে ওর সাথে সারা রাত ছিলে, তাই না?”
চায়ের কাপে ছুমুক দিয়ে অভি জানায়, “হ্যাঁ ছিলাম।”
সুমন্ত মামা, “তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে, তোমরা দুজনে এঁকে ওপরের সাথে ঠিক করে কথা বলছ না কেন? বউমাকেও তোমার সামনে বের হতে দেখলাম না, কি ব্যাপার?”
অভি ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে। চা মুড়ি খাওয়া ভুলে যায় অভি, কিছুক্ষণ মামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বুঝতে চেষ্টা করে যে মামা কত টুকু খবর জানেন।
তারপরে অভি চালাকি করে উত্তর দেয়, “হয়ত আমার কোন কথায় একটু বোঝার ভুল হয়ে থাকবে, আমি আমার দিকে থেকে ঠিক আছি। অপেক্ষা করছি ও কখন আমার সাথে কথা বলে। যদি কিছু ভুল বোঝা বুঝি হয়ে থাকে তাহলে নিজেদের মধ্যে পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।”
সুমন্ত মামা মাথা দোলায়, “ঠিক কথা, এখুনি ওকে ডেকে কথা বলা যাক।”
তারপরে সুমন্ত মামা চেঁচিয়ে সুব্রত কে ডাক দেয়, “সুব্রত বারান্দায় আয় একবার, তোর সাথে কিছু কথা আছে।”
সুমন্ত মামার আওয়াজ শুনে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে সুব্রত, এসেই দেখে দাদার পাসে অভি বসে। ওকে দেখে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুব্রত। দু’চোখে ভয় আর বিতৃষ্ণা। গলা শুকিয়ে এসেছে সুব্রতর, ধির পায়ে সুমন্ত মামার কাছে এসে দাঁড়ায়।
ভয়ার্ত গলায় মাথা নিচু করে সুমন্ত মামাকে জিজ্ঞেস করে সুব্রত, “কি হয়েছে দাদা?”
সুমন্ত মামা একবার অভির দিকে তাকায় তারপরে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই অভির সাথে কথা বলছিস না কেন? তোদের মধ্যে কোন মনোমালিন্য হয়েছে নাকি?”
অভি অনুধাবন করে যে এখুনি সুব্রতকে বিব্রত করা বিচক্ষণের কাজ নয়। অভি সুব্রতর দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত দিয়ে হেসে বলে, “কিছু হয়নি, তাই না মামা। সব ঠিক আছে।”
সুমন্ত মামার দিকে তাকিয়ে বলে, “সুব্রত হয়ত সময় পায়নি কথা বলার, নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই, বউকে নিয়ে ব্যাস্ত আছে।”
অভির কথা শুনে সুব্রতর বুকের থেকে এক বিশাল পাথর সরে যায়, স্বস্তির শ্বাস নেয় সুব্রত। কৃতজ্ঞতা ভরা চোখ নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।
কিছু পরে সুমন্ত মামা অভিকে জিজ্ঞেস করেন, “পরী তোমাদের বাড়িতে ঠিক আছে ত?”
অভি সুমন্ত মামার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার বাড়ি আর কোথায়, এখন ত ওটা পরীর বাড়ি। মাকে ছোটো মা বলে ডাকে বাবা কে বাবু।”
সুমন্ত মামা, “আমি কাউকে ঠিক ভাবে দেখতে পারিনি সেই সময়ে। কি করব, বাবা মারা যাওয়ার পরে, আমাকেই কাজে নামতে হয় পেটের ভাত যোগাড় করার জন্য। আমি যখন সময় পেলাম মাথা তুলে তাকানোর, ততদিনে আমার সেই মিষ্টি ছোট্ট বোন অনেক বড় হয়ে গেছে। মাথা তুললাম বটে, কিন্তু আমার কথা আর কেউ শোনেনা। এই পৃথিবী কাঁচের ঝকমকি তে উজ্জ্বল, অভি। আসল হীরের মর্যাদা বোঝে না, আসল হীরে ত চমকায় না, না কাটা পর্যন্ত শুধু একটা সাদা পাথর মাত্র। কিন্তু কাঁচ, কাটা হোক, বা আস্ত হোক, সর্বদা চমকায়।”
অভি, “এসব কথা কেন বলছ মামা?”
সুমন্ত মামা, “তোমার মা, উলুপি দি আর আমাদের পরিবার। আমাদের মাঝে রক্তের বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই হ্যাঁ, অনেক দূর সম্পর্কের দিদি হন উলুপিদি। এই বাড়িতে থাকতেন কেননা তুমি তখন অনার পেটে আর অনার স্কুল এখানে তাই। সেই সম্পর্ক না থাকার পরেও তিনি যা করেছেন সেই সময়ে আমাদের নিজের কোন আত্মীয় আমাদের জন্য করেনি।”
অভি, “মামা, ছাড়ো অসব কথা, পরী এখন ভালো আছে, আনন্দে আছে।”
সুমন্ত মামা, “হ্যাঁ ওর মুখের হাসি দেখে মনে শান্তি লাগে। তবে ভয় হয়, কতদিন ওই হাসি ওর মুখে থাকবে।”
অভি, “কেন? হাসি কেন চলে যাবে, এই রকম কেন ভাবছ তুমি?”
সুমন্ত মামা, “মেয়ে হয়ে জন্মেছে, একদিন না একদিন বিয়ে করে পরের বাড়ি চলে যাবে। কে জানে, ভাগ্য বিধাতা কি লিখে গেছে ওর কপালে।”
অভি, “ওর মুখে হাসি ফুটুক, এটা তুমি চাও, এইত।”
সুমন্ত মামা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।”
অভি বলে, “ও যেখানে আছে এখন বড় ভালো আছে, শান্তিতে আছে। তুমি চিন্তা করোনা, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
সুমন্ত মামা, “অভি, এই পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর।”
অভি, “মামা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি যতদিন ওর পাশে আছি ততদিন ওর কিছু হতে দেব না।”
মামা কি বুঝল জানেনা, ম্লান হেসে অভিকে বললেন, “কতদিন, কতদিন থাকবে ওর পাশে, তুমি? এক না এক দিন ত বিয়ে করে ওকে চলে যেতে হবে।”
মনে মনে বলে অভি, “না মামা, পরী কোনদিন আমার চোখের সামনে থেকে যাবেনা, তুমি একবার বল, আমি কোনদিন ওকে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দেব না।”
সুমন্ত মামাকে মজা করে বলে, “মামা, চিন্তা করোনা, পরী কোথাও যাবে না, সর্বদা তোমার ছোটো বোন, তোমার বুকের কাছেই থাকবে। যেখানেই থাকুক না কেন, বড় সুখে থাকবে ও।”
একদিন রাতে, অভি ছাদে উঠে সিগারেট টানছিল। মাথার ওপরে অন্ধকার, গাড় নীল আকাশের বুকে অজস্র নক্ষত্র জ্বল জ্বল করছে। গীষ্মের রাতের দখিনা বাতাস ওর মন বিচলিত করে তোলে। বাড়ির সবাই হয়ত এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে, সময় প্রায় মধ্যরাত্রি। অভি দিগন্তের দিকে তাকায়, দিগন্তে কালো কালো নারকেল গাছ যেন ভুতের মতন মাথা দুলিয়ে ওকে কাছে ডাকে। পাশে কোথাও কোন বাঁশ ঝাড়ের ভেতর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। বাড়ির পাশের ঝোপ থেকে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দুরে রাস্তার মোড়ে একটা কুকুর ডেকে ওঠে মনে হয় বিড়াল দেখে তাড়া করেছে কুকুরটা।
সিগারেট শেষে, অভি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই সামনে পরীকে দেখে অবাক হয়ে যায়। আকাশের বাঁকা চাঁদের মৃদু আলোয় পরীর সুন্দর মুখ যেন গাঁদা ফুলের মতন দেখায়। পরী ওর দিকে হেসে বলে, “কি রে দুষ্টু ছেলে, ঘুম আসছে না?”
অভি পরীর মাথার চুল মুঠি করে ধরে নিয়ে নিজের দিকে টেনে আনে, “শয়তান হাড়গিলে, তোরও ত ঘুম আসছে না।”
ছাদে উঠে, ছাদের এক কোনে পরীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। নরম পেটের ওপরে আদর করে অভি আর পেছনে মাথা হেলিয়ে ওর হাত দুটি ধরে দাঁড়িয়ে আদর খায় পরী। অনেকক্ষণ ধরে এঁকে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের অপরূপ দৃশ্যে হারিয়ে যায়।
মৃদুকনে বলে পরী, “এত রাতে ছাদে কি করছিলে?”
গালে গাল ঘষে উত্তর দেয়, “তোমার ও ত ঘুম আসছিল না, কেন জেগে?”
পরী, “সিঁড়ি তে তোমার পায়ের শব্দ শুনে দেখতে এলাম তুমি কি করছ।”
অভি, “মিথ্যে বোলনা সোনা, পায়ের শব্দে তোমার ঘুম ভাঙ্গেনি। তুমি আগে থেকেই জেগে ছিলে, তাই না?”
পরী ওর বাঁধা হাতের মাঝে ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বুকের ওপরে হাত রেখে চোখের দিকে তাকায়। পরীর চোখের দিকে তাকিয়ে অভির মনে সংশয় জাগে, পরীর দু’চোখে সংশয়ের ছায়া। অভি ভুরু কুঁচকায় পরীর দিকে তাকিয়ে, “কি হল?”
পরী উত্তর দেয়, “মৈথিলী তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিল। আমাকে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু কিছু কারনে বলতে পারছিল না।”
অভি, “পুরো ব্যাপারটা বলবে কি আমাকে?”
পরীকে নিবিড় করে টেনে নেয় বুকের কাছে, “তোমার মনে ভেতরে এত চাপা উত্তেজনা কেন?”
পরী কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, “তোমার আর সুব্রতদার ব্যাবহারের জন্য আমি চাপা উত্তেজনায় ভুগছি। তুমি কি নিজে বুঝতে পারছ না, তুমি আসার পর থেকে এক বারের জন্যেও ওরা দুজনে তোমার সামনে আসেনি।”
দীর্ঘ এক শ্বাস ছেড়ে বলে, “ওরা আমার সামনে আসেনি ত আমি কি করতে পারি তাঁর জন্য।”
পরী অভির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি নিজে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলতে পার ত।”
অল্প বিরক্ত হয়ে ওঠে অভি, বাহুর বাঁধন আলগা করে নেয় পরীর কোমরের থেকে, “আমি কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবো? আমি যদি আগ বাড়িয়ে ওদের সাথে কথা বলতে যাই তাহলে মনে হবে যেন আমি দোষী। আমি ত কিছু করিনি।”
পরী ওর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে একটু দুরে দাঁড়িয়ে ওকে বলে, “মেঘনা বৌদি আর মা, তোমাদের দুজনের মধ্যের এই ব্যাবধান নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। আমি কি উত্তর দেব ওদের?”
আরও একটা সিগারেট জ্বালায় অভি, বুক ভরে ধোঁয়া নিয়ে, “মৈথিলী তোমাকে কি বলেছে বাঁ কি বলতে চেয়েছে?”
পরী, “কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছিল আমাকে, তবে কিছু না বলে শুধু আমাকে বলল যে, অভিকে বলে দিও আমি খুব অনুতপ্ত। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি যে কি ঘটনা ঘটেছে। তাঁর উত্তর আমাকে শুধু বলল যে ও তোমার সামনে আসতে পারবে না। ওর মুখের পরিতাপের ছায়া ছিল।”
পরীর কথা শুনে মাথা গরম হয়ে যায় অভির, “কি দরকার ছিল ওর ঘরে যাওয়ার?”
পরী বিরক্ত হয়ে ওঠে অভির বকুনি শুনে, “আমি কি করতে পারি। আমাকে ত দেখাতে হবে যে আমি কিছু জানিনা। তুমি কেন কিছু না বুঝেই চেঁচাতে শুরু করে দাও আমার ওপরে?”
অভি দেখল যে প্রেয়সী রেগে উঠেছে, হাত ধরে কাছে টেনে নেয় পরীকে, “ঠিক আছে যেকোন একদিন রাতে আমার সাথে দেখা করতে বল। আর হ্যাঁ, ওয়াকম্যানটা আনতে ভুলবে না, আর তুমি আমার সাথে সেখানে উপস্থিত থাকবে।”
পরী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি কেন? তুমি ওদের সাথে কথা বলবে, হয়ত আমি থাকলে ওরা ঠিক ভাবে খুলে কথা বলতে পারবে না।”
অভি দাঁতে দাঁত পিষে বলে, “ওই বেশ্যা মেয়েছেলেটা আমার সামনে কাপড় খুলে দাঁড়াতে পারে আর তোমার সামনে কথা বলতে পারবে না? আমি ওই শুয়োর টাকে আর ওর নিচ বউকে উচিত শিক্ষা দেব, চিরকাল মনে রাখবে।”
পরী অভির গালে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “আরে এত রেগে যায় না, মাথা ঠাণ্ডা করও আর শুতে চলো।” অভির ঠোঁটে চুমু খেয়ে দুজনে শুতে চলে আসে।
দিদার বাড়িতে অভিদের বেড়ানোর দিন ফুরিয়ে আসে। বাবা মা রবিবার সকালের প্লেনে বম্বে থেকে ফিরে আসছে। শনিবার বিকেলের মধ্যে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। কোলকাতা ফিরে যাবার ঠিক আগেরদিন, দিদা ঠাকুর ঘরে বসে সন্ধ্যে প্রদিপ দিচ্ছিলেন ঠাকুর কে। অভি চুপিচুপি এসে দিদার পেছনে বসে পরে। দিদা খুব মন দিয়ে একটা ধার্মিক বই পড়ছিলেন। সন্ধ্যে প্রদিপের আলোয় দিদার চোখের কোল চিকচিক করতে দেখে। বুকের মাঝে মোচর দিয়ে ওঠে অভির, দিদার ব্যাথা ভরা চোখ দেখে, ছোটো মেয়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাথা। পুজো শেষে দিদা বুঝতে পারেন যে অভি ওর পেছনে বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে অভির দিকে স্নেহ সুলভ দৃষ্টি তে তাকিয়ে দেখলেন।
সেই কুড়ি বছর আগেকার অভিকে যেন দেখতে পায় দিদা। অভি হাত বাড়িয়ে ধরে, “প্রসাদ দেবে না আমাকে?”
দিদা ওর দিকে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করেন, “কখন এলি তুই?”
অভি, “অনেক আগে। তুমি বই পড়তে এত ব্যাস্ত ছিলে তাই তোমাকে ব্যাঘাত করিনি।”
অভির হাতে সন্দেশর প্রসাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “হ্যাঁরে, পরী তোদের বাড়িতে ঠিক করে থাকে ত?”
অভি, “তোমরা সবাই ওই রকম প্রশ্ন করও কেন বলত? ওটা ওর আরও একটা বাড়ি, এখানে যা করে ওখানেঅ তাই করে। তুমি ওর জন্য এত চিন্তা কেন করছ?”
দিদা ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করেন, “কাল তোরা চলে যাবি। আবার কবে আসবি?”
অভি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, “তোমার মেয়ের বাড়িতে যাবার জন্য তোমাকে জানিয়ে যেতে হবে নাকি? তুমি যখন খুশি যেতে পার। আমার মাও ত তোমার মেয়ের মতন।”
দিদা মাথা নাড়ায়, “না রে, উলুপি আমার মেয়ে নয় আমার বোনের মতন।”
অভি দিদাকে শান্তনা দেয়, “আহ দিদা ছাড়ো না ওই সব কথা, অন্য কিছু বলো।”
হেসে ফেলেন দিদা, “এই বুড়িটার কাছ থেকে আর কি চাস তুই?”
হাঁটু গেড়ে দিদার সামনে বসে পরে অভি, দিদার কুঁচকানো চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি একদিন এসে তোমার পুতুল চাইব।”
দিদা বুঝতে পারেনা অভির কথা। ঠাকুরের সিংহাসনে রাখা পিতলের লক্ষ্মী ঠাকুরের দিকে দেখিয়ে বলে, “কোনটা, এটা?”
হেসে ফেলে অভি, “দিদা, এটাও হতে পারে, অন্য কোন পুতুলও হতে পারে।”
দিদা মাথা নাড়িয়ে অভির মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলেন, “তুই কি যে হেঁয়ালি করছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। কিন্তু তুই যা চাইছিস সেটা যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে তাহলে আমি তোকে দিয়ে দেব। আমার অমুল্য রতন তুই।”
“দিদা, আমি তোমার মেয়ে, শুচিস্মিতাকে ভালবাসি, আমি তোমার কাছে সেই মোমের পুতুলের আব্দার করছি দিদা, দেবে আমাকে তোমার সাধের পুতুলের হাত।” না সে কথা অভির ঠোঁটে আসেনি, বুকের মাঝে থেকে গেছিল সেদিন, কোনদিন সেই কথা দিদাকে বলতে পারেনি অভিমন্যু।
খাওয়ার পরে পরী ব্যাগ ঘুছাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। অভি পেছন থেকে দেখে পরী কে আর মাঝে মাঝে খুনসুটি করে আদর করে দেয় পরীকে। ব্যাগ গুছান কম আর ছোটো বেড়াল ছানার মতন মারামারি করে বেশি। ব্যাগ গুছানোর পরে দিদার সাথে পরী শুতে চলে যায়।
অভির চোখে ঘুম আসেনা তাই বিছনায় বসে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত পড়তে বসে। ঠিক সেই সময়ে পরী দরজায় টোকা দিয়ে বিচলিত চোখে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। ঢুকেই বালিশের তলায় কিছু একটা গুঁজে দেয়। অভি জিজ্ঞেস করাতে, ইশারায় জানায় যে বালিশের তলায় ও ওয়াকম্যান টা লুকিয়েছে। অভি জিজ্ঞেস করে এত বিচলিত কেন দেখাচ্ছে ওকে।
পরী উত্তর দেয়, “সুব্রত আর মৈথিলী তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
অভি ইশারায় বলে যে ওদের ভেতরে ডাকতে। রাত অনেক, বাড়ির সবাই শুয়ে পড়েছিল। সুব্রত মাথা নিচু করে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। অভি ওর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যে কি বলতে চাইছে সুব্রত, মাথার মধ্যে রক্ত চড়ে গেছে ওর মুখ দেখে, কান গরম হয়ে গেছে অভির, রাগে।
সুব্রত মুখ নিচু করে মিনমিন সুরে বলে, “আমরা তোমার সাথে একা কিছু কথা বলতে চাই।”
দাঁতে দাঁত পিষে চশ্মার ওপর দিয়ে সুব্রতর দিকে তাকায় অভি। পরী একবার সুব্রতর দিকে তাকায় তারপর অভির দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হতে যায়। অভি ওকে থাকতে ইশারা করে, বিছানায় বসতে বলে। সুব্রতর দিকে তাকিয়ে রাগত সুরে বলে, “যা কিছু বলার আছে পরীর সামনে বল।”
সুব্রত চুপ করে থাকে। বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে চুপি চুপি ওয়াকম্যান চালিয়ে দেয় অভি। গভমির সুরে দাতেদাত পিষে সুব্রতকে বলে, “চুপ কেন? কি বলার আছে বল?”
সুব্রত অভির দিকে তাকায় আর চাপা স্বরে বলে, “তোমার সাথে একা কথা আছে আমাদের। পরীর সামনে সে সব কথা বলা যাবে না।”
বিছানা ছেড়ে সুব্রতর সামনে উঠে দাঁড়ায় অভি, পরী কে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে সুব্রতকে বলে, “পরী কোথাও যাবেনা। তোমার যা কিছু বলার আছে তোমাকে পরীর সামনেই বলতে হবে। কোন কিছু বোকাম করার চেষ্টা কোরো না।”
পরী অভির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বুকের মাঝে দুরুদুরু করতে শুরু করে। পেছন থেকে অভির কাঁধ খামচে ধরে থাকে। পরীর তপ্ত শ্বাস ওর কাঁধ পুড়িয়ে দেয়।
কিছু পরে সুব্রত ওকে বলে, “যা কিছু ঘটে গেছে সব কিছু একটা বড় ভুল বুঝাবুঝির কারনে ঘটে গেছে।”
অভি রাগে কাঁপতে কাঁপতে সুব্রতর দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলে, “ভুল বোঝা বুঝির জন্য হয়েছ, মশকরা করার জায়গা পাওনি তুমি? কোন কিছু ভুল বোঝা বুঝি হয়নি, তুমি আর তোমার বেশ্যা বউ মিলে খুব মেপে জকে চাল খেলেছিলে। তুমি আগে থেকেই জানতে তোমার বউ কি করতে চলেছে আর তুমি ওকে বারন করনি, কেন করনি? তোমার বউ কোথায়, ডাকো ওকে?”
অভির মুখে বেশ্যা শুনে সুব্রত রেগে যায়, দাঁতে দাঁত পিষে অভির দিকে তাকায়। অভি ওর দিকে হাত মুঠি করে চাপা গর্জন করে ওঠে, “বেশি কিছু বললে এক ঘুসিতে নাক ফাটিয়ে দেব। শালা, তোমার মাথা দেয়ালে ঠুকে যাবে।”
সুব্রত চাপা স্বরে বলে, “তুমি আগে আমার বউয়ের দিকে পা বাড়িয়েছ। তুমি গান গেয়েছিলে আমার বউকে দেখে, সেটা ভুলে গেছ এখন?”
ঘাড় ঘুরিয়ে পরীর দিকে তাকায় অভি, তারপরে সুব্রতকে বলে, “আমি তোমার বউয়ের জন্য গান গাইনি। আর যদি গেয়ে থাকি, তাহলে মজা করে গেয়েছিলাম, তুমি মজাও বোঝনা? সত্যি কথাটা বল তো বাপু, তোমার বউ আমার পেছনে কেন পড়েছিল? এমনি এমনি ত এই সব হয়নি, এর মধ্যে কোন গুড় চাল লুকিয়ে আছে।”
সুব্রতর উত্তর অভি আর পরীকে কাঁপিয়ে দিল, শুনে ওদের বুক ঘৃণায় রিরি করে ওঠে। সুব্রত বলে ওদের কে, “বিয়ের কিছু দিন পরে মৈথিলী আমাকে আর অরুনিমাকে একসাথে দেখে ফেলে। অরুনিমা মৈথিলী কে বোঝায় যে এমন কোন মানুষের সাথে ও প্রেম করবে যাতে মৈথিলী নিজেও নিজের শরীরের ক্ষুধা মিটাতে পারে। যাতে আমাদের চারজনের মধ্যেই এই সব ঘটনা সিমিত থাকে।”
ওর কথা শুনে পরী ঘৃণায় থাকতে না পেরে অভির কাঁধের মাংসে নখ বসিয়ে দেয়। রাগে দুঃখে ওর চোখে জল এসে যায়, অভির পিঠের ওপরে কপাল ঠুকতে থাকে। সুব্রত আরও জানায় যে, “যখন তুমি গান গাইলে বা মৈথিলীর দিকে একটু ওই রকম ভাবে তাকালে তখন আমরা ভাবলাম যে তোমাকে আমাদের দলে টেনে নেই। কিন্তু আমরা মানুষ চিনতে বড় ভুল করে ফেলি। তুমি যাকেই ভালোবাসো, তাকে যে তুমি ভুলে যাও নি, সেটা অনেক বড়।”
সব কথা শুনে অভির মনে হল যেন, সুব্রতর মাথা ধরে দেয়ালে ঠুকে দেয়। চাপা গর্জন করে জিজ্ঞেস করে, “তোমার বউ কোথায়?”
সুব্রত, “দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে।”
অভি, “ভেতরে ডাকো।”
সুব্রত মৈথিলীকে হাত ধরে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসে। মৈথিলীর দু চোখ বেয়ে অবিরাম জলের ধারা বয়ে চলে, মাটির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মৈথিলী, মনে মনে মা ধরিত্রির কাছে প্রার্থনা জানায় যে “মা তুমি দ্বিধা হও, আমাকে তোমার কোলে টেনে নাও।”
সেই পরিতাপের অশ্রু অভির মন গলাতে পারেনা। বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে ওয়াকম্যানটা বের করে এনে, সুব্রতর নাকের নিচে নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “জানো এটা কি?”
অভি, ওয়াকম্যান চালিয়ে ওদের সব কথা শুনিয়ে দেয়। স্বামী, স্ত্রীর দুজনের বুক শুকিয়ে যায় ভয়ে, সারা শরীর রক্তশূন্য হয়ে যায়, মনে হয় যেন চোখের সামনে নিজেদের মৃত্যু কে দেখছে।
সুব্রত কেঁদে ফেলে প্রায়, অভির হাত ধরে কাকুতি মিনতি করে, “দয়া করে আমার সাথে ওই রকম করোনা। আমার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে, আমরা মারা পড়ব।”
অভি হাথ ছাড়িয়ে নিয়ে সুব্রতকে জিজ্ঞেস করে, “একটা কারন বল, কেন আমি করব না।”
ঘরের মধ্যে মধ্য রাতের নিঝুমতা নেমে আসে, কারুর মুখে কোন কথা নেই। অভি অধির অপেক্ষা করে থাকে সুব্রতর উত্তরের জন্য। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে অভি ওদের বলে, “তোমাকে আমার একটা কাজ করতে হবে।”
ভয়ে স্বামী স্ত্রী অভির দিকে তাকায়, আবার কি করতে বলে ওদের, সেই চিন্তায় মরমে যেন মরে যায়।
পরীর দিকে তাকায় অভি, তারপরে সুব্রতদের দিকে তাকায়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় অভি, ওকে কিছু একটা পদক্ষেপ নিতে হবে, “সেই রাতে আমি যে গান গেয়েছিলাম, সেটা পরীকে দেখে গেয়েছিলাম। তোমার বিয়ের রাতে আমি থেকে গেছিলাম শুধু মাত্র পরীর জন্য। আমি পরীকে খুব ভালবাসি। তুমি ভালো ভাবে জানো, যে আমাদের পরিবারের মধ্যে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু যেহেতু আমার মা ওকে মেয়ের মতন দেখে আর পরী আমার চেয়ে দু বছরের বড়, সুতরাং আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কোন বাড়ি মত দেবে না। সবাই আমাদের ভালোবাসা কে উপেক্ষা করবে।
তোমার হাতে দু বছর আছে। পরী মাস্টার্স শেষ করবে আর ইতিমধ্যে আমাকে একটা ভালো চাকরি খুঁজতে হবে। এই দুই বছরের মধ্যে তোমাদের কে দুই বাড়িকে বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। কি করে করবে, আমি জানি না, তবে আমি ফল চাই। আমি যদি ওকে না পাই, তাহলে তোমাদের জীবন আমি নরক বানিয়ে দেব। দিদাকে আর সুমন্ত মামাকে সব বলে দেব, আমি রানাঘাটের মৈথিলীর বাড়ি চিনি, আর ঢাকুরিয়ায় অরুনিমার বাড়িও চিনি। সুতরাং আমার সাথে কোন রকমের চালাকি করার চেষ্টা করবে না।”
পরী অভির কথা শুনে কেঁপে ওঠে, “কি বলছে ও, কেন বলছে?”
হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার মাথার ঠিক আছে ত? কি বলছ তুমি?”
পরীর দিকে দেখে হেসে বলে, “আমি যা বলেছি ওদের সেটা করতে হবে, না করে ওদের আর কোন রাস্তা নেই, সোনা।” সুব্রত আর মৈথিলী যেন নিজেদের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে অভিমন্যু, শুচিস্মিতাকে ভালবাসে, হাঁ করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা দুই স্বামী স্ত্রী।
অভি ওদেরকে বলে, “এতে অবাক হবার কিছু নেই, আমি ওকে ভালোবাসি। এখন যাও আমার ঘর থেকে, আমি বিশ্রাম নেব। আর হ্যাঁ, তোমার ওই শয়তান বউকে বেঁধে রেখ যেন, না হলে আমি কিন্তু তোমাদের জীবন নরক বানিয়ে দেবো।”
মাথা নিচু করে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায় সুব্রত আর মৈথিলী, যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করে যায় যে অভির কথা ওরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।
সুব্রত বেড়িয়ে যাবার পরেই পরী অভির গালে সপাটে এক চড় মেরে চাপা চিৎকার করে ওঠে, “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
অভির চোখের চশমা উড়ে বিছানার ওপরে গিয়ে পরে। অভি ওর হাত ধরে শান্তনা দেয়, রাগে কাঁপতে শুরু করে পরী। অভি পরীকে বুকের কাছে টেনে এনে বলে, “এত রাগ করছ কেন? আমার সাথে যেমন চাল চেলেছে আমি ও একই রকম চাল চেলেছি।”
পরী অভির বুকের ওপরে কিল মেরে ককিয়ে ওঠে, “একি করলে তুমি? এখন আমাদের কথা সবাই জেনে যাবে আর সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
অভি, “কিছুই হবে না সোনা, বিশ্বাস করো। আমাদের কথা কাক পক্ষীতেও টের পাবে না, ওরা আমাদের কথা কাউকে জানাবে না, কেননা আমাদের হাতে ওদের প্রান ভ্রমর আটকে আছে।”
বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে অভিকে। অভি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। বুকের ওপরে ঠোঁট চেপে আলতো চুমু খায় পরী, মৃদুকনে অভিকে জানায়, “আমি তোমাকে ভালোবাসি, সোনা, তোমাকে না পেলে আমি সত্যি মরে যাবো।”
বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পরীকে, মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে চুমু খেয়ে বলে, “সোনা ভয় পেও না, আমি আছি। আমি আমার ভালবাসার জন্য যা কিছু ক্করতে রাজি আছি। এভরি থিং ইস ফেয়ার ইন লাভ এন্ড অয়ার।”
দুজনে আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপরে পরী ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে শুতে চলে যায়।
পরদিন, শনিবার, অভি আর পরী কোলকাতার বাড়িতে ফিরে আসে। বিদায়ের ক্ষণ বড় বেদনাময় হয়ে ওঠে। সবাই জল ভরা চোখে পরীকে বিদায় জানায়। সময় কারুর জন্য অপেক্ষা করে থাকেনা, ওদের এক সময়ে বিদায় নিতেই হত। সারাটা সময়, পরী বাড়ির কথা আর ঘুরে বেড়ানোর কথা বলে নিজের মনের বিদায়ের ব্যাথা টাকে দুরে করে রাখে। বিকেলে বাড়ি পৌঁছে অভি ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। সন্ধ্যে নাগাদ অভির মা, ফোন করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ওদের কথা।
রাতের খাওয়া শেষ, পরীর ডিভানে শুয়ে, আর ওর পেটের ওপরে মাথা রেখে অভি শুয়ে শুয়ে সত্যজিৎ রায়ের “কাঞ্চনজঙ্ঘা” সিনেমা দেখছিল। অভির বাঁ হাত বুকের কাছে রেখে আঙুল নিয়ে খেলা করছিল পরী আর মাঝে মাঝে ওপরে চেপে ধরে চুমু খেয়ে দিচ্ছিল।
পরী অভিকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি বাড়ির সবার ওপরে কি জাদু করেছ?”
অভি জিজ্ঞেস করে, “আমি জাদু? কেন জিজ্ঞেস করছ?”
পরী মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “জীবনের প্রথম বার দেখলাম বড় বউদিকে রান্না ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এসে কোন আত্মীয় কে বিদায় জানাতে। এই প্রথম বার বড়দা মাঠে না গিয়ে আমাদের যাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দুষ্টু দৌড়ে এসে কোলে চেপে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমি ওকে কবে নিয়ে আসব কোলকাতায়। এর আগেও দিদিরা যখন বাড়ি থেকে বিদায় নিত, তখন কেউ কাঁদত না, কিন্ত আজ সবার চোখে জল ছিল। কি জাদু করেছ তুমি সবার ওপরে?”
অভি পরীর হাত টেনে ঠোঁটের ওপরে চেপে ধরে বলে, “সোনা, পরী, আমি কারুর ওপরে কোন জাদু করিনি। জীবনটাই একটা বড় দাবার ছক। বত্রিশটা সাদা ছক আর বত্রিশটা কালো। দাবায় কেউ সৈনিক, কেউ ঘোড়া, কেউ গজ, তোমাকে সবসময়ে মেপে চাল চালতে হয় সোনা, না হলে হেরে যাবে। তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমি যা কিছু করতে রাজি, পরী।”
পরী অভির চোখে তাকিয়ে বলে, “আমি দাবা খেলা জানিনা, অভি, আমি শুধু জানি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি, ব্যাস। তোমাকে ছাড়া আমি যে বাঁচতে পারবোনা, অভি।”

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।