সালাম বিনিময় হতে আরহাম খানিক চুপ থেকে বললেন, ‘আই নীড সাম টাইম টু ওবজার্ভ ইউ।’
আদওয়ার দৃষ্টি স্থির হলো উনার জড়তামাখা মুখের আদলে।
তিনি আবারও বলতে লাগলেন, ‘আপনি আপনার মতো থাকুন।যেভাবে খুশি।আমার পরিবার মানে আপনার পরিবারই।এখানে কেউ নন-মাহরাম নেই আপনার জন্য।হুট করে নিকাহ হয়ে গিয়েছে।আমার আপনাকে বুঝতে একটু সময় লাগবে।আন্ডারস্ট্যান্ডিং ঠিকঠাক হোক, আপনিও বুঝুন আমাকে।আর বাকি দূইজন আপনার বোনের মতো।তাদের সাথে কোনো নেগেটিভ বিহ্যাভ করবেন না আশা করি।’
‘হুমম।’
আরহাম একটু এগিয়ে দূ পকেটে হাত গুজে আদওয়াকে আপাদমস্তক পরখ করতে মিষ্টি হেসে বললেন, ‘ইউ লাইক লুক এ্যা প্রিন্সেস!’
এটাই যথেষ্ট ছিল আদওয়ার খুশি উপচে পড়ার জন্য।লাজুকতা ভেঙ্গে ও বলতে লাগল,’জানেন মেকাপ টা চোজ করেছি আমি।ইন্ডিয়ান ব্রাইডাল মেকাপ।লিপ কালারটাও গাউনের সাথে ম্যাচ করা।আইলেস লাগাইনি,ভ্রু ও প্লাক করিনি।আইসেডো টাও লাইট কালার।ব্লাসেস টাও লাইট পিংক।লাল কালার একেবারেই ইনগোর করেছি।ফেইক নেইলও ইউজ করিনি।কাউকে আমার ফেইসও দেখাইনি,ফ্রেন্ডদেরও দেখাইনি।কারও সাথে ছবিও উঠিনি।আপনি অসন্তুষ্ট হবেন এজন্য’
‘তাই?’
‘জ্বি।’
‘আপনি ভারী কাপড় চেইন্জ করে নিন।অস্বস্তি লাগছে নিশ্চয়ই।উমায়ের কে পাঠাচ্ছি।’
‘তিনি কে?’
‘আমার দ্বিতীয় চাঁদ।’
আদওয়ার একটুখানি হলেও কষ্ট পাওয়ার কথা।কিন্তু সে হাসলো!কত সুন্দর উনার সম্বোধন!
*****
ঘন্টা তিনেক পের হলো।আম্মু এসে কথা বললেন।আইরাও কথা বললো অনেকক্ষণ।আপুরাও আসল।কিন্তু তিনি একবারও আসলেন না।কিচেনে ডিনার রেডি করছিল হাফসা।আম্মু এসে বললেন, ‘আমি রেডি করছি।আরহামকে নিয়ে আসো তুমি।’
প্রতিদিন এমন হলে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসতো।আজকে মনে হলো এটা খুব কঠিন ওর জন্য।হাফসার রুম বাদেই অল্প একটু ব্যাবধান।তারপর আরহামের রুম।প্রথমে নিজের রুমে গিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করে হাসিখুশি ফেইস করে বের হলো সে।
রুমে না পেয়ে বারান্দায় যেতে দেখলো তিনি রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছেন একমনে।হাফসা একটা গলা খাঁকারি দিতেই আরহাম পিছু ফিরলেন।
মলিন চেহারা উনার।দূ পকেটে হাত গুজে স্থির তাকিয়ে আছেন হাফসার চোখের দিকে।মায়া হলো হাফসার,বিষয়টা অন্যরকম হলে যেকোনো ভাবে মন ভালো করে দিত উনার।
উনার ধারালো দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ বৈকি অল্প সময়ও চোখ মেলানোর সাহস হলো না হাফসার।কথা বলতে গেলে বুঝলো গলা ভারী হয়ে আসছে।নিজের ওপরই রাগ লাগলো।নিজেকে স্ট্রং করে এসেও কেন উনার সামনে গুড়িয়ে যায়।গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ব্যস্তভঙ্গিতে বলল, ‘খেতে আসুন নিচে।’
তিনি প্রত্যুত্তর করলেন না।একইভাবে তাকিয়ে রইলেন।
অতপর ধীরে এসে হাফসার কাঁধে মাথা রাখলেন তিনি।হাফসা বুঝলো,ওর প্রিয়তম মানসিকভাবে ভীষণ দূর্বল।
পার হলো বেশ কিছুক্ষণ।হাফসা উনার বাহুতে হাত রাখলো।বলল, ‘আমি,আমরা তো খুশি।আপত্তি তো নেই।এত নার্ভাস কেন হচ্ছেন?’
উনি ধীরসুরে উত্তর দিলেন আরো কিছুক্ষণ পর, ‘আমি তো বুঝি আপনার ভিতর কী চলে।’
উনি যতবার জড়িয়ে ধরেন ততবার ছোট্ট প্রানের আবরণে চুমু খান।এবারও পেটের মধ্যে স্পর্শ দিয়ে বললেন,’তাকে কিস করলে আলাদা আনন্দ লাগে কেন?যা আর কোথাও পাই না।’
‘হ্যাপিনেস তাই!’
******
ডিনারে হাফসা আর মাইমুনা কে আরহাম মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়ার সময় আদওয়া তাকিয়ে রইলো।ও তো নতুন।তাদের মতো আমাকে তো আর উনি ভালোবাসেন না!আমাকে নিশ্চয়ই খাইয়ে দিবেন না!
মনে মনে এমন চিন্তা করে খেতে নিতেই আরহাম খাবার সামনে ধরলেন।নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেয়ে খেয়ে নিলো সে।দূই আপু ইচ্ছে করেই পাশাপাশি বসিয়েছেন নবদম্পতি কে।অল্প খেয়েই চোখমুখ লাল হয়ে এলো আদওয়ার।আরহাম খাবার রেখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।অবস্থা বেগতিক দেখে বললেন, ‘ঝাল খেতে পারেন না?খাওয়া লাগবে না আর।অন্য কিছু টেস্ট করুন।’
বলে এঁটো প্লেটের খাবারগুলো নিজের পাতে তুলে নিলেন তিনি।আদওয়া হা হুতাশ রেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।হাফসা এসে অনুতাপের সুরে বলল,’আই এম সরী।ঝাল তো খুবই অল্প।আমি জানতাম না।পরেরবার থেকে ঠিক করে রান্না করব’ বলে নতুন প্লেটে খাবার তুলে দিলো সে।
আদওয়া একবার উনার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার হাফসার দিকে।এত কেয়ারিং ও ডিজার্ভ করে?
******
রাতের খাবার শেষে আরহাম রুমে আসলেন।ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বললেন, ‘আপনি ঘুমাবেন তো?’
‘জ্বি।’
‘কখন?’
‘এখন’
‘আচ্ছা।’
আদওয়া চাইছিলো আরহামের সাথে একটু-আধটু গল্প করতে।ভালো মন্দ মন খুলে কিছুক্ষণ কথা বলতে।কিন্তু উনার ইচ্ছা নেই দেখে আর ঘাটলো না।
কমল গায়ে জড়িয়ে অন্যপাশ হয়ে সেও শুয়ে পড়লো।
******
সকাল-
জায়নামাজে হাত তোলার সময় নি:শব্দে চোখ ভিজে উঠলো হাফসার।রাতের খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ এর এক তৃতীয়াংশ মিক্সড করেছিলো,যাতে রাতের ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা অনুভব না করা লাগে।দিনে হয়তো ব্যস্ত থাকা যাবে!
কিন্তু মোনাজাতে আর চোখের বাঁধ মানলো না।দীর্ঘক্ষন মোনাজাত শেষে চোখমুখ মুছে নিজেকে শান্ত করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে রইলো।কিছুক্ষণ পর দরজায় নক হয়, প্রথমে চমকালেও পরে বুঝলো এটা আরহাম।ইচ্ছে করেই খুললো না।
উনি বেশ কয়েকবার নক করলেন।হাফসা চুপচাপ রইলো।এখন উনাকে দেখলে যদি কান্না আসে,উনি কষ্ট পাবেন।
দরজার ওপাশ থেকে কাতর কন্টস্বর ভেসে এলো, ‘উমায়ের প্লিজ।দরজাটা খুলুন প্লিজ’
হাফসা উনার দূর্বল কন্ঠে চমকালো।তাও দরজা খুলার সাহস হলো না।
আরও কিছুক্ষণ পর আবার ভেসে এলো, ‘আমি জানি আপনি জেগে আছেন।প্লিজ উমায়ের। দরজাটা খুলুন।’
হাফসা আর পারলো না।উনার কন্ঠ শুনেই কান্নার ধকল আসছে!উঠে আয়নায় নিজেকে দেখে স্বাভাবিক হয়ে গিয়ে দরজা খুললো।
চোখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না।ব্যস্ত দৃষ্টি রেখে বলল, ‘আপনি?কিছু লাগবে?’
আরহামের চোখ জোড়া লাল।কোনোকিছু না বলেই উমায়েরের হাত ধরে বিছানায় নিয়ে গেলেন।তারপরেই আচমকাই ওর কোলে মাথা গুজে দিলেন।
হাফসা চমকাচ্ছে বারবার।এমন আচরণ করছেন কেন হঠাৎ!
‘কি হয়েছে আপনার?কিছু হয়েছে?’
আরহাম ওর দিকে চোখ তুলে বললেন, ‘আবেগের বশে মত দিয়ে ফেলেছি উমায়ের।কিন্তু কাল রাতে নিদারুণ যন্ত্রণায় কাতরেছি।আমি ভুল করেছি তাই না?’
66★
‘আমি ভুল করেছি তাই না?’
আরহামের প্রশ্নে হাফসা বক্ষে ভারী কষ্ট চাপা দিয়ে বললো, ‘উহু।’
‘আপনাদের কষ্ট দিয়েছি।এটা ভাবলেই আমার হৃদয়টা ছিঁড়ে ফেঁড়ে যাচ্ছে।’
হাফসাকে চুপ দেখে ওর কোলে মুখ গুজে রইলেন আবার।খানিক পর বললেন,’কালকে কেন দরজা খুলেননি?আপনি কেঁদেছেন তাই না?এত ডেকেছি তারপরেও কেন খুলেননি?’
হাফসা অবাক হয়ে বলল,’কখন?’
‘আপনি শুনেন নি?’
‘কখন?’
‘ডিনারের আধঘন্টা পর থেকে সারারাত।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ।সারারাত দরজার সামনে ছিলাম।’
‘ক্ ক কেন?’
‘অশান্তি লাগছিলো উমায়ের।আপনি কেন খুলেননি দরজা?’
‘আমি ঘুমে ছিলাম।’
‘এত ঘুমে?আপনি ইগনোর করেছেন আমাকে তাই না?’
হাফসা বুঝানোর ভঙ্গিতে বললো, ‘জ্বী না,মানে আ আমি আসলেই… ‘
তিনি আর কথা বললেন না।হাফসাই বরং জিজ্ঞেস করলো, ‘ত্ তাহলে আদওয়ার সাথে রাতে থাকেননি?’
‘না।’
‘এটা ঠিক না।’
আরহাম এবার মুখ তুলে ভেজাকন্ঠে বললেন, ‘আমি কেন এমন করলাম?কীভাবে করলাম?ভাবতে পারছি না কিছু।আমি উনার সাথে কীভাবে থাকব?’
হাফসা আরহামকে শান্ত করতে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘শান্ত হোন।সময় তো আছে।’
‘উঁহু।’
‘আচ্ছা সব ঠিক হয়ে যাবে।ঘুমাননি সারারাত। এখন ঘুমান।’
*****
প্রথম সকালটা একটু মন খারাপ নিয়ে কাটল আদওয়ার।আম্মু এসে ঘুম ভাঙ্গিয়ে নাস্তা করতে বললেন।
ডাইন ইন এ বাবা,মাইমুনা আম্মু।আরহামকে রুমে না দেখে আম্মু বললেন,হয়তো নিজের রুমে গিয়েছে উপরে।আর হাফসাকে ডাকতে নিজেই দোতলা উঠলো আদওয়া।
দরজা লাগানো দেখে ঠেলতে গিয়ে খুলেই গেল।আগ্রহ নিয়ে ডুকতে গেলে পা থেমে গেলো ওর।হাফসার কোলের ওপর বালিশ রেখে উনাকে ঘুমাতে দেখে দরজা ভিজিয়ে ফিরে এলো সে।ভেতরটায় দপ করে কষ্টের উল্কা জ্বলে উঠলো।
নিজেকে সামলে টেবিলে এসে বলল,’ঘুমাচ্ছেন দূজনই।’
আম্মু ডাকতে গেলে আব্বু বাধা দিয়ে বললেন, ‘নিজেই উঠে খেয়ে নিবে।আমরা বসি।বসো আদওয়া।’
১০৫
ঘুম ভাঙ্গলো বেশ দেরিতেই।আরহাম উঠে শাওয়ার নিয়ে নিচে নামলেন।ড্রয়িংরুমে আম্মু-আব্বু দূজনের সাথেই গল্পে মশগুল আদওয়া।হাফসা এসে খাবার বেড়ে দিলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই খেয়েছে?’
‘হ্যাঁ’ বোধক উত্তর পেতেই খেতে শুরু করলেও একটা অপরাধবোধ কাজ করলো ভেতর-ভেতর।পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলেও সব মেয়েরই বিয়ে নিয়ে অনেক আশা,স্বপ্ন থাকে।বিয়েটা যেহেতু হয়েই গিয়েছে, তাকে অবহেলার প্রতিটা মূহুর্তের জবাবদিহি করতে হবে।আদওয়ার দিকে ঘন ঘন তাকানোতে বারবার চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছিলো।সে বোধহয় লজ্জা পেয়েছে,তাই ঘরে চলে গিয়েছে।
আরহাম খাবার শেষে ঘরে যেতে দেখলেন আদওয়া বসে আছে চুপচাপ।
আরহাম কিছুটা সংকোচ নিয়ে পাশে বসলেন।কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও আটকে যাচ্ছেন বারবার।জগ ঢেলে এক গ্লাসে পানি খেয়ে বললেন, ‘কফি খান তো?’
আদওয়া তৎপর উত্তর দিলো,’জ্বী।’
উত্তর পেয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।আদওয়া চুপচাপ বেলকনি চলে গেলো।আপন নীড়ের কথা মনে পড়ছে খুব!
তিনি ফিরলেন মিনিট দশেক পর।অনুমতি চেয়ে বেলকনি এসে ওর হাতে এককাপ কফি ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন?’
আদওয়া মাথা এপাশ-ওপাশ করে বলল, ‘ভালো।’
আরহাম অনুতপ্ত সুরে বললেন, ‘আই এম সরি।আমি রুমে ফিরে গিয়েছিলাম আপনাকে না বলেই।’
‘আচ্ছা।’
‘আপনার মা বাবার সাথে কথা বলেছেন?’
মাথা নেড়ে না বুঝাতেই আরহাম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলেননি?’
সে মন খারাপ আড়াল করতে চেয়েও পারলো না।চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসলো মুহুর্তেই।
আরহাম উনার ফোন এগিয়ে দিলে আদওয়া দ্রুত নাম্বার ডায়াল করে কল লাগায়!আরহাম ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় ভুগলেন।রাতে অন্তত একটা কল দিয়ে কথা বলানো উচিত ছিলো।গোটা একটা দিন পেরিয়ে গেলো।
ওপাশ থেকে আহ্লাদিত কন্ঠ আসতেই ওর চোখ ছাপিয়ে জল নামে।কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলে।আরহাম জড়তা কাটিয়ে আলতো হাতে গাল মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করলেন,ভরসা দিলেন।এই ভরসাটুকু শক্তি যোগালো ওকে।
কুশলাদি বিনিময় শেষে আরহামও কথা বললেন।আদওয়া খুশি হলো খুব।মন খারাপ উবে গেল মুহুর্তেই।
আগামীকাল তাদের রিসিপশন।সেই উপলক্ষে সন্ধ্যার পর আদওয়ার পরিবার থেকে আরহামের জন্য ফুল স্যুট সেট গিফট আসতেই উনি রেগে গেলেন।সুট পরবেন না বলে একবাক্যে না করে দিলেন।সাথে বললেন, এই নিয়মগুলো আমার মোটেও পছন্দ নয়।আমি কন্ডিশন দিয়েছিলাম আক্বদের দিন।বিধর্মীদের কোনো নিয়মই যেনো অনুসরণ না করা হয়।’
আরহামের তিরিক্ষ মেজাজে আদওয়া ভয়ে চুপসে গেলো।পরিস্থিতি হাতের বাইরে দেখে হাফসা উনাকে শান্ত করতে সোফায় বসালো।পানি খাইয়ে বলল, ‘হাইপার হবেন না।তারা তো আপনার কথা রেখেছে। আর সুট আপনাকে গিফট করেছে ছেলে হিসেবে।রাগারাগি করলে তারা কষ্ট পাবে,আদওয়া কষ্ট পাবে।ভয়ে চুপসে আছে এমনিই।’
আরহাম শান্ত হলেন।আম্মু-আব্বু দূর থেকে হাফসার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতেই লজ্জা পেয়ে যায় সে।আম্মু ইশারায় কাছে ঢেকে বললেন, ‘এখন আমাদের আর টেনশন নেই।আমার ছেলের হাইভোল্টেজের রাগ সামলাতে শিখে গেছো।একমাএ তুমিই পারলে শান্ত করতে।’
******
মাইমুনার ঘরে যেতে দেখলেন সে নেই।মনে মনে ভয় হলো,নিশ্চয়ই রেগে আছেন খুব।সকাল থেকে একবারও দেখা করা হয়নি।খোঁজ করতে করতে আব্বুর রুমে গিয়ে পেলেন তাকে।আব্বু তাকে কুইজ ধরছেন ইসলামের ইতিহাস থেকে।আরহাম পারমিশন চাইলেন, দুজনে কানেই নিলেন না উনার কথা।যেনো তাঁরা দেখতেই পায়নি উনাকে।ভয়টা গাঢ় হলো আবার।আব্বু মাইমুনার পক্ষেই।আর কিছু জিজ্ঞেস না করে চুপচাপ গিয়ে মাইমুনার পাশ ঘেষে বসলে মাইমুনা বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরে বসে।আরহাম আবারও পাশে গিয়ে বসলে আব্বু আরহামের দিকে দৃষ্টি তুলে বললেন, ‘এসেছো ডিস্টার্ব করো না।চুপচাপ বসো,নয়তো চলে যাও।’
মাইমুনা ও চোখতুলে তাকালো,যেনো বাবার কথাটাই চোখ দিয়ে আবার রিপিট করছে সে।আরহাম কিছুই বললেন না।আদেশ মেনে চুপচাপ বসে থাকলেন মাইমুনার পাশ ঘেষে।
কিছুক্ষণ বাবা-মেয়ের প্রশ্নোত্তর চললে আরহাম বলে উঠলেন, ‘আমিও জয়েন হই কুইজে?’
‘তুমি তো পারবে।’
বাবার কথায় উনি অনিশ্চয়তা নিয়ে বললেন, ‘জ্বি না আব্বু।আপনি যা জিজ্ঞেস করছেন, অনেক উত্তরই অজানা আমার।’
‘আচ্ছা।হানড্রেড মার্কসের প্রশ্ন ধরবো।যে বেশী মার্কস পাবে,তার জন্য একটা গিফট থাকবে।’
মাইমুনা ভয়ার্ত চোখে তাকালো,আরহামের সাথে কম্পিটিশনে অবশ্যই হেরে যাবে সে।গিফট টা পাওয়া হবে না।
আরহাম মুচকি হেসে মাইমুনার চোখের দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘শুরু করুন আব্বু।’
দূই পক্ষের প্রথম দূই প্রশ্নে দূজনই সঠিক উত্তর দিলো।কিন্তু তৃতীয়বারে আটকে গেলো মাইমুনা।দরজার সামনে থেকে প্রতিযোগিতা ইনজয় করছিলো হাফসা।বাবার চোখ সেদিকে পড়তেই তাকে ডেকে বললেন, ‘হাফসা মাইমুনা কে সাহায্য করতে পারো।কিন্তু আরহাম একাই উত্তর দিবে।’
আরহাম মন খারাপ করে বললেন, ‘কি কঠিন কঠিন প্রশ্নগুলো করছেন আমাকে।আর উনাকে সহজ প্রশ্নগুলো করে সাথে হেল্পারও দিচ্ছেন?’
‘তারা আমার মেয়ে।আর তুমি ছেলে।তাদের অধিকার বেশী।’
কুইজ চললো আরও বিশ মিনিট।হাফসা মাইমুনা দূজনে মিলে বেশীরভাগ প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিয়েছেন।কিন্তু আরহাম আটকে গেছেন বেশ কয়েকবার।আব্বু মার্কস জানালে মাইমুনা জিতে যায়।মাইমুনার থেকে বহু কম মার্কস পেয়েই হেরে গেলেন আরহাম।দূজনের খুশিমাখা হাসিতে আরহামও সন্তুষ্ট হলেন।জানা প্রশ্নগুলোরও ভুল উত্তর দিয়ে নিজেকে হারিয়ে তাদেরকে জিতিয়ে দিয়েছেন।
উনার দিকে চেয়ে ভেংচি কাটছে দূইজন।আরহাম চোখ সরিয়ে আব্বুর দিকে তাকাতে দেখলেন,আব্বু উনার দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসছিলেন।আরহাম যে ইচ্ছে করে তাদেরকে জিতিয়ে দিয়েছেন সেটা বুঝতে বাকি নেই আব্বুর।
তবুও মন খারাপ করে বললেন, ‘এটা তো অন্যায়।তারা দূজনে মিলে উত্তর দিয়েছে।আর আমি একা।হেরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
মাইমুনাকে একসেট কালারফুল কুরআন গিফট করলেন। যেটা সত্যিই সুন্দর।চোখ জুড়ানোর মতো।সাথে আরহামকে শাস্তির ঘোষনা দিয়ে বললেন, ‘এত পড়াশোনা করে এত বড় আলেম হয়েও উত্তর দিতে পারো নি।এর শাস্তিস্বরুপ আজকের দিনে তারা দূইজন যা যা আবদার করবে,সব পূরন করতে হবে।’
দূজনের চোখেমুখে আবারও খুশি উপচে পড়তে দেখা গেলো যেনো বাবার দেয়া শাস্তির শর্ত খুব পছন্দ হয়েছে তাদের।আরহাম বিনাবাক্যে মাথা পেতে নিলেন শাস্তিটুকু!
*******
আদওয়ার সব ইচ্ছের মাঝে আরেকটা ইচ্ছা ছিলো,বরের বাসা খুব সুন্দর করে লাইটিং করা থাকবে।লাল নীল বাতিতে চারিদিক ঝলমল করবে,আতশ বাজি ফুটবে।পূর্ণিমার রাত থাকবে।একসাথে চাঁদ দেখা হবে।
বাট আনফরচুনেটলি এসব কোনো আবদারই পূরণ করেননি আরহাম।আদওয়া জিজ্ঞেস ও করে নি।ওয়েডিং নাইটে যেখানে মন খুলে একটু কথা বলা হলো না,একটু গল্প করা হলো না,অনুভূতির বিনিময় হলো না সেখানে এসব ভাবা বিলাসিতা।
ইশার নামাজের পর বাইরে গিয়েছিলেন আরহাম।ফিরেছেন বেশ দেরীতেই।আদওয়ার হাতে আলাদা একটা প্যাকেট ধরিয়ে উপরে নিজের রুমে ফিরে গিয়েছেন।
ডিনারে যখন আম্মুর মানা করা সত্ত্বেও একাজ ওকাজে সাহায্য করতে ব্যস্ত তখন আরহাম মাইমুনার ঘর থেকে বেরোলেন।হাফসাকে কিচেনে দেখে রাগ উঠে গেলো উনার।ধমকে এনে টেবিলে বসাতেই আদওয়া কেঁপে উঠে।লোকটার রাগ সম্পর্কে মোটেই অবগত নয় সে।
হাফসাকে ধমকে কথা বলছেন তিনি।হাফসার কাঁপুনি দেখে আদওয়া আম্মুর পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে রইলো।আরহাম আড়চোখে সেটি লক্ষ্য করলেন।তবু রাগ কমলো না।কড়াভাষায় বললেন,’আর কিচেনে দেখলে আপনার সামনেও আসবো না কথা বলা তো দূর।’
আম্মু আরহামকে শাসনের সুরে বললেন, ‘এখন চাচ্ছো ও ভয় পেয়ে কাঁপা-কাঁপি করে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলুক?’
‘না।’
‘তাহলে এত রোড বিহ্যাভ কেন করছো?বুঝিয়ে বললেই তো হয়।’
‘বলিনা আমি আম্মু?জিজ্ঞেস করেন,দিনে রাতে কতবার একই ওয়ার্নিং দেই?’
‘আচ্ছা।আর আসবে না।’
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আরহাম স্বাভাবিক হলেন।মুঠো করা হাতজোড়া ছেড়ে দীর্ঘশ্বাস নিলেন।উমায়েরের হাত ধরে উপরে নিয়ে গেলেন কিছু না বলেই।
রুমে এসে দরজা লক করে দেখলেন, ছলছল চোখে বিছানার কোণ ঘেষে বসে আছে চুপচাপ।
আরহাম আমতা আমতা করে বললেন, ‘আই এম সরী।রাগ উঠে গিয়েছিলো আপনাকে কিচেনে দেখে।’
হাফসা কান্নামাখা সুরে বলল, ‘ধমক দেওয়ার হলে আলাদা দিতেন।কড়া কথা বলতে হলে আলাদা বলতেন।সবার সামনে কেন বললেন!আদওয়াও ছিল..
ততক্ষণে হেঁচকি উঠে গেছে ওর।হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,’আমার খারাপ লাগেনি সবার সামনে?’