বৃহস্পতিবার। তাই সূর্য অস্তমান হতেই জমিদার বাড়ি’র বাইজি গৃহে বাইজিদের নৃত্য পরিশীলন আরম্ভ হলো। শুক্রবার অর্থাৎ আগামীকাল ঢাকা শহর থেকে অলিওর চৌধুরী’র সাহেব বন্ধুগণ আসবে পাঁচফোড়ন গৃহে। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য সর্বপ্রকার আয়োজনই সম্পন্ন হয়েছে। এবার শুধু বাইজি গৃহের বাইজিদের প্রস্তুতি চলছে। বলাবাহুল্য অলিওর চৌধুরী’র শহুরে বন্ধুদের আপ্যায়নের ক্ষেত্রে বাইজি গৃহের বাইজিদের আপ্যায়নই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে৷ জমিদার অলিওর চৌধুরী’র বিরাট রাজত্বেরই একটি অংশ বাইজি গৃহ। প্রয়াত বিখ্যাত জমিদার আজহার চৌধুরী’র বাইজি গৃহ ছিলো এটি।বংশপরম্পরায় যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আর এই দায়িত্বটি সুশীলভাবে পালন করছে জমিদার অলিওর চৌধুরী এবং তার জ্যোষ্ঠ পুত্র পল্লব চৌধুরী। ২৩১ শতাংশ অর্থাৎ ৭ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই জমিদার বাড়িটির ৩ বিঘা জুড়েই “পাঁচফোড়ন গৃহ ” এ গৃহের সম্মুখে রয়েছে রঙ বেরঙের পুষ্পেভরা বিশালাকার বাগান৷ বাগানের মধ্যবরাবর থেকে থেকে সরু ও লম্বা সারি সারিভাবে পথ। যে পথ জমিদার বাড়ির মূল প্রবেশদ্বারে গিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। এ বাড়ির পশ্চাতে রয়েছে এক বিঘা জমির ওপর বিশালাকৃতির পুকুর যেটি পাঁচফোড়ন গৃহেরও পশ্চাতে অবস্থিত। পুকুরের ডান পার্শ্বে জমিদার বাড়িরই একাংশ যা “বাইজি গৃহ” হিসেবেই পরিচিত। বাম পার্শ্বে ঘন বিস্তীর্ণ অরণ্য। যে অরণ্য থেকে রোজ প্রাতঃসন্ধ্যায় ভেসে আসে বাঁশির সুর। সেই সুরে মোহিত হয় বাইজি গৃহের এক ছোট্ট কিশোরীর মন! কিন্তু অরণ্যে অবস্থানরত বাঁশিওয়ালাটির সে খবর অজানা। সুরের ছলনায় মোহদান করা কারিগরটি যখন জানবে তার সুরের ঘোরে কারো ছোট্ট হৃদয়ের ছোট্ট প্রাণ পাখিটি উথাল-পাতাল ঢেউয়ের তরে আছড়ে মরছে নিজ অন্তঃকোণে। সে কি অবাক হবে? জানার তীব্র বাসনা নিয়ে ছুটে আসবে বাইজি গৃহে? নাকি বাকি দশটা পুরুষের মতোই সেও আসবে নারী শরীরে মাখামাখি হতে,অসংখ্য নারী গন্ধে মুখরিত হতে!
ছোট্ট কিশোরী’টি বাইজি শারমিন শায়লার কন্যা শাহিনুর শায়লা। বয়স মাত্র পনেরো বছর। বাইজি গৃহের নিয়মানুসারে বয়স ষোল হওয়ার পূর্বে কোনো নারীই বাইজি হতে পারবেনা। তাই শাহিনুর বাইজি গৃহের বাইজি নয় বাইজি কন্যা হিসেবেই পরিচিত।
ঘুঙুরের আওয়াজে মুখরিত চারপাশ। সে আওয়াজে কর্ণপাত করছে না শাহিনুর। করে লাভও নেই। কারণ মনে তীব্র বাসনা থাকা সত্ত্বেও মায়ের কড়াশাসনের জেরে ঐ ঘুঙুরকে নিজ চরণে কখনো ঠাঁই দিতে পারেনি সে। যে সুরের টানে ঘুঙুরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ ভুলে যায় শাহিনূর সে সুরের ঘোরেই মোহিত হয়ে চারদেয়ালে আবিষ্ট ঘরটিতে থেকে সে সর্বাঙ্গে,অন্তঃকোণে স্বর্গসুখ অনুভব করছে।
শারমিন বুঝতে পারে ঘুঙুরের প্রতি শাহিনুরের তীব্র আকর্ষণ রয়েছে। ঘুঙুরের আওয়াজে জেগে ওঠে শাহিনুরের সমস্ত ইন্দ্রিয়। তাই এই ঘুঙুর থেকে মেয়ে’কে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করে। যদিও অসম্ভব প্রায় বিষয়টিকে সম্ভব করার চেষ্টামাত্র। তবুও শারমিন তার সিদ্ধান্তে অটল। সে বাইজি কিন্তু তার কন্যা’কে কোনক্রমেই বাইজি তকমা পেতে দেবেনা। হয়ে যাক দশটা খুন হোক সে দশটা খুনের আসামী। প্রয়োজনের তাগিদে বরণ করে নেবে মৃত্যু’কে। হয়ে যাবে নিজ কন্যার খুনি তবুও বাইজি’তে রূপান্তরিত হতে দেবেনা শাহিনুরকে। বাইজি গৃহের সর্বোচ্চ গোপন ঘরটিই শাহিনুরের জন্য বরাদ্দ করেছে শারমিন। সে ঘরেই রোজ নির্দিষ্ট সময়ে বন্দী পড়ে থাকে সে। যে ঘরটির গ্রিল বিহীন খোলা জানালা থেকে জমিদার বাড়ির অরণ্য অতি নিকটেই। সে অরণ্য থেকেই রোজ বাঁশির সুর শুনতে পায় শাহিনুর। যে সুর তার কিশোরী মনের ছটফটানিগুলো গাঢ় করে। কিশোরী বয়সের কৌতুহলগুলোকে করে তীব্র। অবুঝ মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তুলে,
-‘ কে বাজায় বাঁশি? এতো মধুর সুরে কে ডাকে আমায়? এই সুরে বুক কাঁপে কেন ? আম্মা ঘুঙুরের আওয়াজে আমি নাচতে চাই। কিন্তু বাঁশির সুরে আমার বুক নৃত্য করে এই নৃত্য তুমি ক্যামনে বন্ধ করবা? ‘
[৫]
রাতের খাবার সেরে চা পানে ব্যস্ত প্রণয়, অঙ্গন। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছে প্রণয়,অঙ্গন,রোমানা। তিনজনের মধ্য স্থলে ছোট্ট গোলাকার বেতের টেবিল। প্রণয়, রোমানা পাশাপাশি বসেছে। আর অঙ্গন তাদের সামনে। শহুরে রাত। রাস্তায় মানুষজনে তখনো কিলবিল করছে। চলছে অবিরত বাস,ট্রাকসহ নানান যানবাহন। থেকে থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দগুলো বারি খাচ্ছে কানে। মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময় হলেও তীব্র শীত ছুঁতে পারেনি ওদের। একদিকে মানুষের কোলাহল যানবাহনের বিকট শব্দ অপরদিকে বইছে শোঁশোঁ বাতাস। প্রণয়ের একটি হাত নিজ দু’হাতে মুঠোবন্দি করে নিয়ে মাথা নিচু করে আছে রোমানা। কখনো কাউকে ধ্যান করতে দেখলে বোঝা যাবে রোমানার অবস্থা এখন ঠিক কী? দৃষ্টিজোড়া নিবদ্ধ রেখে ওষ্ঠজোড়া চেপে দু’হাতে শক্ত করে প্রণয়ের হাতটি আবদ্ধ করে বসে আছে সে। যেনো সে প্রণয়নের হাত নয় বহু আকাঙ্ক্ষিত কোন জিনিস পেয়ে সার্থকতার এক ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়েছে। হাতে হাত মিলিত হওয়াতে এক উষ্ণ অনুভূতিতে লেপ্টে যাচ্ছে রোমানা। তীব্র উত্তেজনায় কাঁপছে বুক। থেকে থেকে শিউরে ওঠছে দেহের প্রতিটি অঙ্গ। কিন্তু এসব অনুভূতি কি বিপরীত পক্ষের মানুষটাকে আদেও ছুঁয়েছে? নাকি সবটাই একপাক্ষিক!
প্রণয়ের এক হাত যেহেতু রোমানার নিকট বন্দী তাই সে অপরহাতে চা পান করছে। মুখমন্ডলে তার অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ভাব। তাদের দেখে অঙ্গনের মুখে দুষ্টু হাসির আভাস পাওয়া গেলেও সে হাসি স্পষ্টতর করলো না৷ কারণ সম্মুখের মানবটি ভীষণ গম্ভীর এবং রসকষহীন আর মানবীটি ভীষণ লাজুক এবং অভিমানী। দুষ্টুমির ছলে যদি এখন সে হেসে ফেলে স্বভাবসুলভ মেয়েটি অভিমানে আরক্ত হয়ে ছলছল নয়নে চেয়ে ঠিক বলবে,
-‘ ইট’স নট ফেয়ার অঙ্গন তুমি আমাকে ক্ষেপাচ্ছো। তুমি জানোনা তোমার ভাইটাকে কতোদিন পর কাছে পেয়েছি? ‘
খালাতো বোনের সঙ্গে মেয়েটি তার বেষ্ট ফ্রেন্ডও। তাই এই মেয়েটির অভিমানে ঘেরা ছলছল নয়নদ্বয় তার পক্ষে সহ্য করা খুব কঠিন।
অঙ্গন বললো,
-‘ ভাই ন’টা বাজে এবার তো ওঠতে হবে। ‘
আতঙ্কিত হয়ে তাকালো রোমানা। প্রণয়ের হাতটি আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। কম্পিত কন্ঠে বললো,
-‘ আমি যাব না। ‘
প্রণয়, অঙ্গন দু’জনই তাকালো রোমানার দিকে। রোমানার করুণ দৃষ্টিজোড়া দেখামাত্রই অঙ্গন বললো,
-‘ ভাই আজ বাড়ি চলো কালতো তোমার ছুটিই। ‘
এ’কথায় কোন জবাব দিলো না প্রণয়। রোমানার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ তুই গিয়ে গাড়িতে বোস আমি ওকে পাঠাচ্ছি। ‘
নিচে চলে গেলো অঙ্গন বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়ালো প্রণয়। দু-হাত পকেটে গুঁজে গম্ভীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার শানিত দৃষ্টিজোড়া প্রগাঢ় ভাবে বুলাতে থাকলো রোমানার সর্বাঙ্গে। তীব্র লজ্জায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো রোমানা। প্রণয়ের দৃষ্টিতে নিজ দৃষ্টিজোড়া স্থির রেখে বললো,
-‘ একটুও কি মায়া হয় না তোমার? একটুও কি ইচ্ছে করেনা এই অসহায়িনীকে বুকে জায়গা দিতে? ‘
স্মিথ হাসলো প্রণয় তার দৃঢ় চরণদ্বয় গৃহ তলে ফেলে দুকদম এগুলো। রোমানার একটি হাত ধরে নিজ ওষ্ঠে ছুঁইয়ে বললো,
-‘ এই ওষ্ঠজোড়া তোমারই। ‘
তারপর ওষ্ঠ থেকে রোমানার হাতটি ধীরে ধীরে নিজের বক্ষে চেপে ধরলো বললো,
-‘ এই বুকটাও তোমার সময় হলে ঠিক জায়গা পাবে।’
তারপর রোমানার হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিয়ে ললাটে ললাট ছুঁইয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললো,
-‘ এই কপাল, এই ওষ্ঠ,এই বুক, এই হাত সবই তো তোমার রোমানা। ‘
আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে মিহি কন্ঠে প্রশ্ন করলো রোমানা,
-‘ এসব নয় প্রণয় তোমার মনটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য। তোমার মনটুকু শুধু আমার জন্য বরাদ্দ থাকলেই চলবে। ‘
আচমকাই রোমানার মুখশ্রীতে কড়া দৃষ্টি ফেললো প্রণয়। আচমকা হাতটিও ছেড়ে দিলো। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
-‘ এসব প্রসাধনী কেন মেখেছো রোমানা? প্রকৃতগতভাবে তুমি যা আছো তাই যথেষ্ট এসবের কি প্রয়োজন! ‘
-‘ খালামুনিই তো সাজিয়ে দিয়েছে আমাকে তুমি কেন রাগ করছো আমায় কি ভালো লাগছে না? ‘
-‘ একদমই না নকল জিনিসের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই রোমানা। তোমার গায়ের চাপা রঙ নিয়ে যদি আমি কমফোর্ট ফিল করি তুমি কেন করবেনা? ‘
চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে ওঠলো প্রণয়ের তীব্র ক্ষোভ নিয়ে সরে গেলো রোমানার সামনে থেকে। আতঙ্কিত হয়ে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রোমানার। প্রণয় রেগে গেছে, তার প্রতি রেগে গেছে। কেন সে খালামুনির কথায় এতো সাজলো? কেন মাখতে গেলো প্রসাধনীগুলো? এখন কি করে এই কঠিন মানুষটাকে নিয়ন্ত্রণে আনবে সে?
রোমানার ধারণা প্রণয় তার সাজগোজের জন্য রেগে গেছে। প্রণয় তাকে বোঝালোও তাই৷ কিন্তু প্রণয় যদি এটার জন্যই এভাবে রেগে গিয়ে থাকে তাহলে পূর্বেই কেন রাগলো না? নাকি পূর্বে খেয়াল করেনি। এতো সময় পর খেয়াল হয়েছে বলে এভাবে রেগে গিয়ে ছুঁড়ে ফেললো তাকে? নাকি সাংঘাতিক কিছু লুকাতেই এই প্রয়াস!
লেখকের কথা: প্রিয় পাঠক – এই উপন্যাসটি থ্রিলার এবং রোমান্টিক জনরার। এক পর্ব,দুই পর্ব পড়ে বা অমনোযোগী হয়ে পড়ে এই উপন্যাসের কিছুই বোঝা যাবে না। প্রতিটি লাইন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। ইতিমধ্যে অনেকে চিন্তিত হয়ে পড়েছে হিরো কে? এই উত্তর মেলাতে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে উপন্যাসটি পড়তে হবে।