প্রণয়ের কথার প্রেক্ষিতে কিছুই বলল না শাহিনুর৷ কিছু সময় মৌন থেকে প্রণয়ের চোখে চোখ রেখে
বলল,
-‘এভাবে কেন নিয়ে এলেন আমায়?’
জড়তা হীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্নটি করায় কিঞ্চিৎ অবাক হলো প্রণয়। বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বড়ো বড়ো লাগছে শাহিনুর’কে৷ কথার মাঝে ভয় নেই, দৃষ্টিতে লজ্জা নেই। সাধারণত নতুন নতুন বিবাহের পর মেয়েরা স্বামীর চোখে চোখ রাখতে ভীষণ লজ্জাবোধ করে৷ শাহিনুরের মাঝে তার কানাকড়িও নেই৷ অবশ্য লজ্জা পাওয়ার মতো কোন কিছুই হয়নি তাদের৷ কিছু সময়ের জন্য সে অনুভব করল, আর সবার চেয়ে শাহিনুর আলাদা। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শাহিনুর৷ প্রণয় হালকা কেশে ওঠে বলল,
-‘তুমি বেশ সাহসী হয়ে গেছ।’
-‘জমিদারের পুত্রবধূ’দের সাহসীই মানায়।’
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো প্রণয়৷ দৃষ্টিজোড়া দৃঢ় করে শাহিনুর বলল,
-‘ভয় পেলেই অন্যায়, অবহেলা মেনে নিতে হবে।’
-‘তার মানে তুমি আমার থেকে অন্যায় বা অবহেলা চাইছো না?’
প্রণয়ের ওষ্ঠে বাঁকা হাসি। সে হাসি দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিল শাহিনুর। শান্ত কন্ঠে বলল,
-‘ আপনার ভাবিদের কথা ভেবে বলেছি। আমার কথা বলিনি৷’
-‘তার মানে তোমার প্রতি অন্যায় করা যাবে,অবহেলা করা যাবে?’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল শাহিনুর। মনে মনে ভাবল, অন্যায় ছাড়া আর কিছু হয়েছে নাকি আমার সাথে…মুখে বলল,
-‘যা’কে মনে স্থান দেইনি সে অন্যায়, অবহেলা করলেই কী না করলেই কী?’
প্রচণ্ড দাম্ভিকতার সাথে প্রণয় বলল,
-‘চক চক করলেই সোনা হয় না। যাকে চোখে ধরে তাকে মনে ধরতে পারে না।’
পরোক্ষভাবে রঙ্গন’কে ইঙ্গিত করে কথাটা বলেছে প্রণয়৷ তা প্রথমে বুঝতে না পারলেও এবার ঠিক বুঝল শাহিনুর৷ তাই পুনরায় প্রণয়ের দৃষ্টিতে নিজের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বলল,
-‘আপনি চোখে লাগেন না এটা কেন মনে হলো?’
বিস্মিত হলো প্রণয়। সহসা দুর্বৃত্ত হাসি ফুটে ওঠল ঠোঁটে। মাথা নিচু করে শাহিনুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-‘যে পুরুষ’কে চোখে ধরে সে পুরুষ’কে কখনো মনে ধরে না। ব্যাপারটা এমন চোখে লাগে কিন্তু মনে লাগে না। আর যে পুরুষ’কে চোখ, মন উভয়েই ধরে সে পুরুষ নয় মহাপুরুষ। সেই মহাপুরুষের খোঁজ যেদিন পাবে সেদিন নারী তুমি ধন্য।’
শান্ত,নিশ্চুপ শাহিনুর ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। প্রণয় চলে গেল সেখান থেকে। শাহিনুর মনে মনে বলল,
-‘হয়তো আপনিই ঠিক!’
[৫৭]
পুরো দিন কেটে রাত নেমে এলো। ময়না’কে জিজ্ঞাসা করেও কোন লাভ হলো না। তার এক কথা,
-‘ নতুন ভাবি বিশ্বাস করেন, আমি সব বিছানায় রাইখা আইছি। আপনার ভিতরকার কাপড় আমি ক্যান নিতে যামু।’
শাহিনুর মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছে। সে শুধু প্রশ্ন করেছিল কাপড়টা তুলেছে কিনা৷ বিনিময়ে মেয়েটা অসংখ্য কথা বলেছে৷ এদিকে হাফিজা খালা বলেছে,নতুন বউয়ের কাপড় হারানো তো ভালো লক্ষণ না । এর পর থেকে সাবধান থাকতে। বেশ চিন্তিত হয়েই রাতে কক্ষে এলো শাহিনুর৷ ফাঁকা কক্ষে একাই বসে ছিল৷ এমন সময় খবর পেল বাইজি গৃহের। মান্নাত বাইজি পালিয়েছে! এ খবর দিল, ময়না। শাহিনুর বিমর্ষ মুখে প্রশ্ন করল,
-‘ বুবু পালিয়ে গেছে! কে বলল তোমায়? ‘
-‘ বাইজি গৃহের সবুর উদ্দিন জানাইছে। বড়ো ভাইজান, ছোটো ভাইজান গেল ঐখানে।’
শাহিনুর বুঝল পল্লব আর রঙ্গন গেছে। পলাশ কোথায়? মনে প্রশ্ন জাগলেও চুপ রইল সে।
বাইজি গৃহ থেকে একজন বাইজি উধাও হয়ে গেল! এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করল পল্লব চৌধুরী। কতবড়ো স্পর্ধা মান্নাত বাইজির। জমিদার অলিওর চৌধুরীর বাইজি গৃহ থেকে সে পালিয়ে যায়। বাইজি গৃহের ভিতরকার সব খবর জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা হলো পল্লবের। পলাশ আর রঙ্গন তাকে আস্থা দিল কিচ্ছু হবে না। প্রণয়ের প্রতিও ক্ষুব্ধ হলো সে। শুধুমাত্র তার জন্যই বাইজি গৃহের প্রতি অবহেলা হয়েছে। এ নিয়ে অবশ্য প্রণয়’কে তেমন চিন্তিত দেখালো না। বাইজি গৃহ, বা বাইজিদের নিয়ে কোনকালেই মাথা ব্যথা ছিলো না তার। প্রণয়ের থেকে বিন্দু পরিমাণ পাত্তা না পেয়ে রেগে গেল পল্লব। সিদ্ধান্ত নিল পুনরায় বাইজি গৃহের হাল ধরবে সে। এবার আরো কঠিন নিয়মে চলবে কার্যক্রম। পল্লব’কে সমর্থন জানালো পলাশ। রঙ্গন মৌন রইল৷ এক্ষেত্রে মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হিসেবেই বিবেচিত হলো। প্রতিবাদ করল প্রণয়৷ যার ফলে বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো। শেষে প্রণয় সংযত হয়ে গেল। বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে আর একটি বাক্য বিনিময়ও করল না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, যতদ্রুত সম্ভব শাহিনুর কে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। এ বাড়ির সঙ্গে তেমন কোন সম্পর্ক রাখবে না। তার আগে শাহিনুরের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়া দরকার।
একা শুয়ে ছিল শাহিনুর৷ অসংখ্য ভাবনায় মশগুল থেকে কখন জানি চোখটা লেগে গেছে। প্রণয় কক্ষে এসে দ্বার বন্ধ করে ঘুরতেই শাহিনুর’কে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখল। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে কাপড় পাল্টে শুধুমাত্র একটি শর্ট প্যান্ট পরে শাহিনুরের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শাহিনুর হালকা নড়ে চড়ে ঘুমের ঘোরেই তার দিক ফিরল। বুক থেকে অল্পখানি আঁচল সরে গেছে তার। সেদিকে দৃষ্টি পড়তেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো প্রণয়ের। পুরুষত্বে টান পড়ল। সব কিছুর ঊর্ধ্বে সেও তো পুরুষ। সব অনুভূতি মাটি চাপা দিয়ে সন্তর্পণে চোখ বুজল,ত্বরান্বিত হয়ে পিঠ ঘুরিয়ে শুয়ে রইল৷ বদ্ধ চোখে রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল কেবল। নিঃশ্বাসের সে শব্দেই ঘুম ভঙ্গ হয়ে গেল শাহিনুরের। পাশে প্রণয়’কে দেখে চমকে ওঠল সে। খেয়াল করল, ডাক্তারসাহেব ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। নিঃশব্দে কিঞ্চিৎ সরে গেল সে। প্রণয়ের প্রতিটি নিঃশ্বাসের শব্দ তার শরীরে এসে বিঁধল যেন৷ কেমন দম বন্ধকর অনুভূতি হলো। অনুভব করল, তার বুকের ভিতর অদ্ভুত এক শব্দ হচ্ছে। কান পাতলে স্পষ্ট বোঝা যাবে ধকধক ধকধক ধ্বনিতে মুখরিত তার বক্ষগহ্বরের চারপাশ।
বিছানার দু’পাশে দু’জন সারারাত নিদ্রাহীন কাটিয়ে দিল। ভুল করেও কেউ কারো কারো দিকে ফিরল না। শাহিনুর ভয় পেল, প্রণয় তার স্বামী। প্রণয়ের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে তার প্রতি। সে চাইলে তার প্রতি সম্পূর্ণ অধিকার খাটাতে পারবে৷ সে বাঁধা দিতে পারবে না উচিতও নয়। আর প্রণয় ভয় পেল, যদি কিছু হয়ে যায়? সে চায় তাদের সম্পর্কের একটি সুন্দর পরিণয় দিতে। যে পরিণয়ে তার এবং শাহিনুরের সমান অনুভূতি মিশে থাকবে। আর পাঁচটা ছেলের মতো শুধু অধিকারের জন্য নয় বরং ভালোবাসার জন্য কাছে যাবে। সম্পূর্ণরূপে নিজের করে নেবে শাহিনুর’কে। তার প্রতিটি স্পর্শে অধিকার নয় ভালোবাসা খুঁজে পাবে শাহিনুর।
শেষরাতে ওঠে বসল শাহিনুর৷ প্রণয় টের পেয়ে চোখ খুলল। বলল,
-‘ঘুম হয়নি?’
-‘নাহ আপনার?’
ওঠে বসল প্রণয়। শাহিনুর তাকিয়ে রইল। প্রণয় মৃদু হেসে বলল,
-‘এ বাড়িটা আমার শান্তির জন্য উপযুক্ত নয় নুর। এবার সময় হয়েছে ফিরে যাওয়ার।’
-‘কোথায় যাবেন আপনি?’
-‘যেখানে থাকি সেখানেই। আপাতত আমার কোয়ার্টার তারপর আমরা একটা ছোট্ট সংসার গোছাবো।’
আঁতকে ওঠল শাহিনুর। বলল,
-‘আমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না।’
-‘আমার পক্ষে এ বাড়িতে থাকা সম্ভব না।’
-‘ তাহলে আপনি চলে যান। আমি কোথাও যাব না।’
বিস্ময়ান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইল প্রণয়৷ পরোক্ষণেই চোয়াল শক্ত করে বলল,
-‘রঙ্গন ছাড়া এ বাড়িতে থাকতে চাওয়ার কোন কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না।’
চুপ করে রইল শাহিনুর৷ কোন উত্তর না পেয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ল প্রণয়। দু’হাতে একটানে শাহিনুর’কে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আচম্বিতে এমন কাণ্ড ঘটানোতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল শাহিনুর। প্রণয়ের একটি হাত তার কোমড়ে আরেকটি হাত ঘাড়ের নিচে। প্রচণ্ড শক্ত করে তার কোমল শরীরে চেপে আছে হাত দু’টো। আতঙ্কিত দৃষ্টিজোড়া ছুঁড়ে দিয়ে শুঁকনো এক ঢোক গিললো সে। প্রণয়ের ক্রোধান্বিত দৃষ্টিও তার দিকে স্থির। সে দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রণয় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘আমার স্বপ্ন পূরণে তুমি বাঁধা দেবে না নুর। তোমাকে ভালোবাসার বিনিময়ে আমার সব স্বপ্ন পূরণ হওয়া চাই।’
চারিদিকে ফজরের আজান ধ্বনি ভেসে ওঠল। প্রণয় শান্ত হলো। ধীরে ধীরে শাহিনুর’কে ছেড়ে দিল সে। ছাড়া পেয়ে পরনের কাপড় ঠিক করতে লাগল শাহিনুর। কাঁধে আঁচল তোলার সময় প্রণয় খেয়াল করল, ঘাড়ের দিকে লালচে দাগ পড়ে গেছে। তার কঠিন হাতের ছোঁয়ায় নরম দেহে এই দাগ অস্বাভাবিক কিছু না৷ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে আড়চোখে কোমড়ের দিকে তাকালো। সেখানেও একই অবস্থা দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল। শাহিনুর বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। মনে মনে সে রাগ করল কিনা বোঝা গেল না৷ প্রণয় বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। মেয়েটা সবসময়ই শান্ত থাকে। দু’চার কথা বললেও তা শান্ত,স্বাভাবিক সুরে বলে। প্রণয় আরো একটু সময় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। সিদ্ধান্ত নিলো আর ক’টা দিন যাক।
[৫৮]
লম্বা একটি সময় ছুটি কাটানোর পর অবশেষে ছুটির দিন শেষ হলো৷ পূর্বের নিয়ম মেনেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে তৈরি হল প্রণয়৷ শাহিনুর এসে দেখল প্রণয় সাহেবি পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ শাহিনুর’কে দেখে মুচকি হাসলো সে। বলল,
-‘ তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।’
ধীরপায়ে এগিয়ে এলো শাহিনুর। বলল,
-‘ কোথায় যাচ্ছেন আপনি? ‘
-‘ আমার ছুটি শেষ নুর৷ এখন থেকে রোজ হসপিটাল যেতে হবে। রোগাক্রান্ত মানুষ’দের সেবা দিতে হবে। ‘
-‘ওহ’
ছোটো করে জবাব দিল শাহিনুর। প্রণয় বলল,
-‘মন খারাপ হলো? ‘
ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে, কিছু বলল না৷ প্রণয় আবার বলল,
-‘জানি মন খারাপ হয়নি। বরং শান্তি পাচ্ছো।’
কথাটা পছন্দ হলো না শাহিনুরের। তাই মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রণয় তার সন্নিকটে এসে বলল,
-‘আমার প্রতি তুমি বড্ড উদাসীন নুর। তোমার এই উদাসীনতা একদম পছন্দ নয় আমার।’
এবারেও কোন জবাব পেল না। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-‘ আসছি সাবধানে থেকো। অপ্রয়োজনে রুম থেকে বের হবে না৷’
শাহিনুর ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। প্রণয় চলে যেতে উদ্যত হয়েও আবার থেমে গেল৷ সহসা শাহিনুরের একটি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ডিভানের সামনে। ছোট্ট টেবিলের ওপর রাখা টেলিফোনের কাছে। তারপর সেটির ব্যবহার শিখিয়ে দিল। ডায়েরি’তে তার মোবাইল নাম্বার, কোয়ার্টার এবং হসপিটালের টেলিফোন নাম্বার লিখে দিল৷ কীভাবে ফোন করবে সেটাও শিখিয়ে দিল। শাহিনুর খুব মনোযোগ দিয়ে শিখল। প্রণয় সামনে বসেই ও’কে দিয়ে তার নাম্বারে ফোন করাল। সে পারল। তাই প্রণয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-‘যেকোন প্রয়োজনে ফোন করবে৷ অপ্রয়োজনে ফোন করলেও আমি কিছু মনে করব না।’
এক পলক তাকালো শাহিনুর। প্রণয়ের অধরে দুষ্টু হাসি। সে হাসি দেখে অস্বস্তি হলো তার। সে অস্বস্তি টুকু কেটে গেল ত্বরান্বিত হয়ে প্রণয়ের চলে যাওয়াতে।
প্রণয় বেরিয়ে যাওয়ার পর তার কক্ষের সামনে ঘুরঘুর করছে রঙ্গন। উদ্দেশ্য শাহিনুরের সঙ্গে কথা বলা। গত একমাসে তেমন দেখা বা কথা কোনটিই হয়নি। শুধু একদিন হুট করে সামনে পড়ে গিয়েছিল৷ আর সে বলেছিল,
-‘আমি বলে ছিলাম,আমাদের আবার দেখা হবে৷ তাই বলে ভাবিরূপে এটা আশা করিনি!’
শাহিনুর কোনো জবাব দেয়নি। শুধু তাকিয়ে ছিল৷
দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল রঙ্গন। কক্ষের সামনে রঙ্গন’কে দেখে অবাকান্বিত হয়ে গেল শাহিনুর৷ আলতো হেসে রঙ্গন বলল,
-‘অবশেষে তোমার দেখা পেলাম। ‘
শাহিনুর মৃদু হেসে বলল,
-‘গত একমাস যাবৎ অনেক সুযোগ খুঁজেছি। একটি বার তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ছটফট করেছি৷ তবুও কথা বলতে পারিনি৷ কারণ তুমি চাওনি। আর আজ তুমি চেয়েছ বলে কত সহজেই সুযোগটি পেয়ে গেলাম।’
শান্ত কন্ঠে উচ্চারিত বাক্যগুলো শুনে বিস্মিত হলো রঙ্গন। শাহিনুর’কে আগাগোড়া পরখ করে নিয়ে বলল,
-‘তুমি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছ নুর।’
শাহিনুর বলল,
-‘ বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবে? ভেতরে এসো। ‘
রঙ্গন বলল,
-‘ তুমি বোধহয় কোন কাজে বের হচ্ছিলে। ‘
-‘ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুমি এসো। ‘
শাহিনুর ধীরপায়ে ভিতরে চলে গেল। শাহিনুরের আচরণে পরিবর্তন লক্ষ করে ঘাবড়ে গেল রঙ্গন৷ তার পরিচিত নুরের সঙ্গে এই নুরের একদম মিল নেই। অদৃশ্য এক দাম্ভিকতা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে এই নুর’কে৷ জমিদার বাড়ির বউ হয়ে তার মধ্যে অহং জন্মালো? সহজসরল বাচ্চা শাহিনুর তো এ নয়। বিচলিত হয়েই কক্ষে প্রবেশ করল সে। শাহিনুর তাকে ডিভানে বসতে বলল। আর সে বসল বিছানায়। রঙ্গন যা ভেবে এসেছিল সব তালগোল পাকিয়ে গেল। শাহিনুর শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করল,
-‘ তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?’
শাহিনুরের তাকানো দেখে হকচকিয়ে গেল রঙ্গন৷ এই চাহনি শাহিনুরের হতে পারে? অবিশ্বাস্য কন্ঠে সে বলল,
-‘ তুমি আমায় ভুল বুঝছ না তো নুর? ‘
ভ্রু কুঁচকিয়ে শাহিনুর বলল,
-‘ ভুল? কোনটা ভুল। আমার দুঃসময়ে বন্ধু হিসেবে তোমায় পাশে পাইনি। এখানে কোন ভুল নেই। ‘
-‘ যা ঘটেছে তোমায় আমি বলতে পারব না। শুধু বলব, ক্ষমা করে দিও। আমি যদি বাড়ি থাকতাম তাহলে তোমার জীবন টা নষ্ট হতে দিতাম না৷ নিজের জীবন দিয়ে হলেও ভাইয়ার থেকে রক্ষা করতাম তোমায়। ‘
শাহিনুর ভেবেছিল রঙ্গন পলাশের কথা বলছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রঙ্গন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
-‘ প্রণয় ভাই আমাকে আঁটকে রেখেছিল নুর। বলেছিল, যতদিন না সে তোমায় বিয়ে করবে ততদিন ছাড়বে না আমায়। ‘
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো শাহিনুরের। তীব্র উত্তেজনায় বুক কাঁপছে তার। বসা থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ রঙ্গন এবার দু’চোখের পানি ঝরিয়ে বলতে শুরু করল,
-‘ আমার কথা তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আমি তোমাদের বিয়ের পরের দিনই কেন এলাম এটা একবার ভেবে দেখ। আমি জানি তুমি খুব ছোটো৷ এমন ষড়যন্ত্র তুমি বুঝবে না৷ নিজের ভাইয়ের সম্পর্কে এসব কথা বলার বিন্দু ইচ্ছে ছিল না। তাই এতদিন চুপ করে ছিলাম। কিন্তু চোখের সামনে তোমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিলাম না৷ মনে হলো সত্যি টা না জানালে তোমার প্রতি অন্যায় হবে।যে অন্যায়ের ভার নিয়ে মরেও শান্তি পাব না আমি।’
শাহিনুরের শুষ্ক দৃষ্টিজোড়া অনেকদিন পর ভিজে ওঠল। এতে রঙ্গন আরো কায়দা পেল বলল,
-‘ তোমার সঙ্গে খুব খারাপ হয়েছে নুর৷ তোমার এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। ‘
ভাঙা গলায় শাহিনুর বলল,
-‘আমার কোন কষ্ট নেই। ‘
-‘ তোমার প্রতি অনেক জোর জুলুম হচ্ছে তাই না? ‘
রঙ্গনের চোখের দিকে তাকালো শাহিনুর৷ অবাক হলো রঙ্গন তার চোখে খুব বেশি সময় চোখ রাখতে পারল না৷ সরিয়ে নিল। শাহিনুর মৃদু হেসে বলল,
-‘কোন জোর জুলুম হয়নি। আমাদের বাসর ঘরের গল্প শুনবে? ‘
সবটা শোনার পর রঙ্গন সহ্য করতে পারল না এমন ভণিতায় ওঠে দাঁড়াল। হাঁসফাঁস করতে করতে বলল,
-‘ আমি তোমাকে এভাবে আর দেখতে পারছি না। ‘
-‘ কিন্তু আমি মেনে নিয়েছি, ভাগ্য’কে। ‘
রঙ্গন আরো কিছু বলতে চাইল৷ কিন্তু তার পূর্বেই শাহিনুর বলল,
-‘ আমাকে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমার যা হবার হয়ে গেছে। ‘
-‘ কিছু হয়নি নুর সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক করে দেব আমি। ‘
-‘ কীভাবে? ‘
-‘ আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাব। অনেক দূরে চলে যাব আমরা৷’
-‘ আমার বিয়ে হয়ে গেছে। ‘
-‘ তাতে আমার জায় আসে না। তোমার বিয়ে হয়েছে, বাসর হয়েছে এসবে আমার কোন সমস্যা নেই। আমার শুধু তোমাকে চাই। ‘
শাহিনুর স্তব্ধ হয়ে গেল। রঙ্গন অধৈর্য হয়ে তার একটি হাত চেপে ধরল। বলল,
-‘ নুর আমার তোমাকে চাই। এক ভাইয়ের জন্য মুন’কে ত্যাগ করেছি আমি। আরেক ভাইয়ের জন্য তোমাকে ত্যাগ করতে পারব না। ‘
হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে শাহিনুর বলল,
-‘হাত ছাড়ো, শান্ত হও। ‘
-‘আগে বলো তুমি আমার সঙ্গে যাবে। ‘
-‘ আগে তুমি আমার হাত ছাড়ো। ‘
হাত ছেড়ে দিতেই লম্বা এক নিঃশ্বাস ত্যাগ করল শাহিনুর৷ শেষ অবধি কেন জানি রঙ্গন’কে অবিশ্বাস করতে পারল না। তাই বলল,
-‘ আমি এ বাড়িতে থাকতে চাই না রঙ্গন। তোমার ভাই আমাকে নিয়ে চলে যেতে চায় কিন্তু আমি যাচ্ছি না। কারণ আমি আমার আম্মার খু’নি, মান্নাত বুবুর খু’নি’কে চিহ্নিত করতে চাই। ‘
ভয়ে শিউরে ওঠল রঙ্গন। হতভম্ব হয়ে বলল,
-‘ খু’নি, খু’ন, মান্নাত বাইজি খু’ন হয়েছে! সে তো পালিয়ে গেছে। ‘
তাচ্ছিল্য হেসে সেদিন রাতের পুরো ঘটনা খুলে বলল শাহিনুর। রঙ্গনের গলা শুকিয়ে হাত,পা কাঁপতে শুরু করল। রুদ্ধ হয়ে আসা কন্ঠে বলল,
-‘যে মুহূর্তে তুমি ঐ দৃশ্য দেখেছিলে প্রণয় ভাই কি তখন কক্ষে ছিল? ‘
অন্যমনস্ক হয়ে শাহিনুর বলল,
-‘ নাহ। ‘
রঙ্গন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল,
-‘ এমন নৃশংসতা প্রণয় ভাই’কে ছাড়া আর কেউ করতে পারেনা৷ ‘
শাহিনুর আতঙ্কিত হয়ে তাকালো রঙ্গনের দিকে। রঙ্গন বলল,
-‘ যে খু’নের বর্ণনা তুমি দিলে সে খু’ন কারো দ্বারা সম্ভব নয়। ডাক্তার’রা হৃদয়হীন হয়। তারা মানুষ’কে কেটে কুটে অভ্যস্ত। তাই এটা প্রণয় চৌধুরী’কে দিয়েই সম্ভব। ‘
মাথা ঘুরে গেল শাহিনুরের। অস্ফুটে স্বরে বলল,
-‘ উনি কেন বুবু’কে হত্যা করবে? ‘
-‘ মান্নাত বাইজি বেঁচে থাকলে সত্যিটা তুমি জেনে যেতে তাই। ‘
-‘ কোন সত্যি? ‘
-‘ বিয়ের দিন বাসর ঘরে বউ রেখে প্রণয় চৌধুরী মান্নাত বাইজির সঙ্গে রাত কাটিয়েছে এই সত্যি! ‘
শাহিনুর তাকে বাসর ঘরের গল্প শুনিয়েছে। সে সুযোগ কাজে লাগিয়েই প্রণয়’কে খু’নি প্রমাণ করে দিল। প্রমাণ সরূপ বলল,
-‘ তুমি ভাবছ এসব কখন হলো? তুমি সত্যিই অনেক ছোটো নুর৷ যখন তুমি ঘুমিয়ে গেছিলে সেই সুযোগটাই কাজে লাগানো হয়েছে। তোমার কাছে মহান হয়েছে ঠিকি৷ কিন্তু নিজের পুরুষত্ব’কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি!’