ফরিনা পদ্মজার ঘরে প্রবেশ করে ঘাবড়ে গেলেন। বিছানায় রক্তাক্ত দীর্ঘদেহী একজন পুরুষ সংজ্ঞাহারা হয়ে পড়ে আছে। নাকি মরে গেছে? ফরিনা শিউরে উঠেন। পদ্মজা ফরিনাকে এক নজর দেখে জগ থেকে গ্লাসে জল নিয়ে ঢকঢক করে পান করল। ফরিনার মনে হচ্ছে বিছানায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত পুরুষ মানুষটি রিদওয়ান! যখন শতভাগ নিশ্চিত হলেন এটা রিদওয়ান, মনে তীব্র একটা ভয় জেঁকে বসে। তিনি নিঃশ্বাস আটকে পদ্মজার কাছে ছুটে আসেন। চাপা স্বরে প্রশ্ন করলেন,’রিদু কি মইরা গেছে?’
পদ্মজা তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারলো না। সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে বলল,’মরেনি বোধহয়। তবে বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে মরে যাবে।’
পদ্মজার তরঙ্গহীন গলার স্বর ফরিনার ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। তিনি পদ্মজাকে আচমকা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। পদ্মজা থতমত খেয়ে গেল। ফরিনার হৃৎপিণ্ডের কাঁপুনি টের পায় সে। ফরিনা অস্থির হয়ে বললেন,’ও মা-
পদ্মজা ফরিনার বুক থেকে মাথা তুলে বলল,’কী হয়েছে আম্মা?’
ফরিনার চোখের দৃষ্টি অস্থির। তিনি ঢোক গিলে বললেন,’তুমি পলাইয়া যাও। আর আইবা না। রুম্পার মতো চইলা যাও।’
‘আম্মা,ওরা আমাকে মারবে না। রিদওয়ান ভাইয়াই বলেছে।’
‘মিছা কথা…মিছা কথা কইছে।’
‘আম্মা,আপনি এমন করছেন কেন?’
ফরিনা দ্রুত সংজ্ঞাহীন রিদওয়ানকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর বললেন,’তুমি পলায়া যাও। তোমার আব্বা,ওই শকুনের বাইচ্ছা আমার নিষ্পাপ কলিজার টুকরা বাবুরে মাইরা ফেলছে কিন্তু…’
জুতার ছপছপ আওয়াজ শুনে ফরিনা থমকে যান। এরকম আওয়াজ মজিদের জুতোয় হয়। মনে হয় জুতায় পানি নিয়ে হাঁটছে। তিনি আতঙ্কে চোখ দুটি বড় বড় করে তাকালেন। মজিদ তো ঘরে ছিল না! কখন চলে এলো? আর যতক্ষণ মজিদ ঘরে থাকে ততক্ষণ ফরিনাকেও ঘরে থাকতে হয়। তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত মজিদ এখন পদ্মজার ঘরে আসবে। আর রিদওয়ানকে দেখে ফেলবে! তিনি পদ্মজার আলমারি খুলে তালা-চাবি বের করলেন। একটা ঝড় থামতেই যেন আরেকটা ঝড় শুরু হয়েছে। পদ্মজা ফরিনাকে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল,’আম্মা,কিন্তু কী? বাবু মানে উনাকে মেরে ফেলেছে মানে? আপনি কীভাবে জানেন? আম্মা…”
ফরিনা নিজের এক হাতে পদ্মজার এক হাত শক্ত করে চেপে ধরেন। তারপর দৌড়ে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। বারান্দায় পা রাখতেই মজিদের সাথে দেখা হয়। ফরিনা মজিদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে পদ্মজাকে টেনে নিয়ে যান তিন তলায়। মজিদ হতভম্ব হয়ে দেখলেন ঘটনাটা। পদ্মজা বার বার জিজ্ঞাসা করছে ফরিনাকে,’আম্মা,আপনি এটা কী বললেন! আমার বুক কাঁপছে। আম্মা কোথায় যাচ্ছেন?’
মজিদ পদ্মজার ঘরে উঁকি দিলেন। তার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি। বিছানার উপর রিদওয়ানকে দেখতে না পেলেও,রিদওয়ানের পা জোড়া চোখে পড়ে যায়। তিনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। চাদর সরিয়ে রিদওয়ানকে দেখে আঁৎকে উঠলেন। এদিকে,ফরিনা পদ্মজাকে ঠেলে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেন। ঘরের দরজাটি লোহার। পদ্মজা ধাক্কা খেয়ে ঘরের মধ্যিখানে পড়ে। সে মেঝে থেকে উঠতে উঠতে ফরিনা বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। পদ্মজা আচমকার ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। তার মাথায় বার বার বাজছে,তোমার আব্বা,ওই শকুনের বাইচ্ছা আমার নিষ্পাপ কইলজার টুকরা বাবুরে মাইরা ফেলছে!’
পদ্মজা দুই হাতে মুখ চেপে ধরে। মনে হচ্ছে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখুনি মারা যাবে। বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ফরিনা বলেছিলেন,সম্পত্তির জন্য হলেও আমিরকে ওরা জানে মারবে না! এজন্যই পদ্মজা ধৈর্য ধরে পাঁচটি দিন কাটাতে পেরেছে। ভেবেছিল, শরীরে একটু শক্তি জমিয়ে তারপর সে তার স্বামীকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু একটু আগে ফরিনা যা বললেন তাতে পদ্মজার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। রিদওয়ান শর্ত দিয়েছিল, পদ্মজা ঢাকা চলে গেলে আমিরকে ছেড়ে দিবে। পদ্মজা তাই মানতো। শুধু না করে আরেকটু কথা বের করতে চেয়েছিল সে। তার আগেই রিদওয়ান আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। আর পদ্মজাও আঘাত করে বসে। পাঁচ দিনের সব ধৈর্য, পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গেল ফরিনার এক কথায়। পদ্মজা দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডাকল,’আম্মা…আম্মা কেন আটকালেন আমাকে? দরজা খুলুন। আম্মা আপনার ছেলের কী হয়েছে? কী বললেন? আম্মা…’
ফরিনা হাতের চাবিটা দূরে ছুঁড়ে ফেললেন। সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছে দপদপ! তিনি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখেন,অস্বাভাবিকভাবে হাত কাঁপছে। কাঁপছে পা। মজিদ,খলিল একসাথে উঠে আসে। ফরিনার সামনে এসে দাঁড়ায়। ফরিনা ভয়ে জমে গেছেন। মজিদের চেহারা ক্ষুদ্ধ। তিনি রাগে গজগজ করতে করতে প্রশ্ন করলেন,’রিদওয়ানকে পদ্মজা আঘাত করেছে?’
ফরিনা কিছু বললেন না। মজিদের গলার স্বর শুনে পদ্মজা চুপ হয়ে যায়। ফরিনা এলোমেলো দৃষ্টি নিয়ে কাঁপছেন। খলিল বললেন,’ভাবিরে জিগাও কেন? ওই ছেড়ি ছাড়া আর কার এতো সাহস আছে? এই ছেড়ি এই ঘরের ভিতরে?’
ফরিনা দরজার সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছেন। খলিলের প্রশ্ন শুনে আরো শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। মজিদ ফরিনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন। দরজায় তালা! তখনই পদ্মজা দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডাকল,’আম্মা…আম্মা দরজা খুলুন। কী হচ্ছে ওখানে?’
মজিদের ক্ষুদ্ধ চেহারা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে। তিনি ফরিনার কাছে চাবি চাইলেন,’চাবি দাও। কি বলছি,কানে যায় না? চাবি দাও।’
ফরিনা আমতাআমতা করে বললেন,’ন…না-ই।’
মজিদ ফরিনার মুখ চেপে ধরেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন,’চাবি দাও।’
ফরিনা তাও বললেন,চাবি নেই। মজিদ আরো একবার বললেন,’চাবি দাও বলছি। শাড়ির কোন ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছো?’
‘চাবি নাই। চাবি নাই আমার কাছে।’ গলা উঁচিয়ে বললেন ফরিনা।
খলিল দরজায় জোরে কয়টা লাথি দিলেন। তালা ভাঙার চেষ্টা করলেন। দুপদাপ শব্দ! সেই সাথে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে নোংরা গালি। খলিলের মুখের ভাষা শুনে পদ্মজার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে যায়। ফরিনার উঁচুবাক্য শুনে মজিদ হাওলাদার রাগে কাঁপতে থাকলেন। ফরিনার এতো সাহস কবে হলো! তিনি ফরিনার শরীর হাতড়ে চাবি খুঁজতে খুঁজতে বললেন,’চাবি কোথায় রাখছো? জলদি বলো। নয়তো এরপর যা হবে,ভালো হবে না।’
ফরিনার শরীর কাঁপছে ভয়ে। তিনি জানেন,এই মুহূর্তে তিনি খুন হয়ে যেতেও পারেন। তবুও চাবি দিবেন না। নয়তো ওরা পদ্মজাকে খুন করে ফেলবে। ওরা পারে না এমন কিছু নেই! মজিদের নিকৃষ্ট অনেক কাজের সাক্ষী তিনি। এই মানুষটা তার জীবনের জাহান্নাম। মজিদ রাগে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ফরিনা কিছুতেই কথা মানছে না বলে, ছোট ভাইয়ের সামনে ফরিনার শাড়ি টেনে খুলে ফেললেন তিনি। আর বললেন,’চাবি কোন চিপায় রাখছো? বলো,নয়তো মেরে পুঁতে ফেলবো।’
ফরিনা টু শব্দও করলেন না। খলিলের সামনে যুবতীকালে তাকে বিবস্ত্র করেও মজিদ মেরেছে! সম্মান-ইজ্জত কবেই হারিয়ে গেছে। নতুন করে হারানোর কিছু নেই। বয়সও অনেক হয়েছে! তবে এদের শিকার পদ্মজাকে হতে দিবেন না কিছুতেই। মজিদ কোনোভাবেই ফরিনার কাছ থেকে চাবি উদ্ধার করতে পারেননি। এদিকে রিদওয়ানের অবস্থা খারাপের দিকে। খলিল দ্রুত নিচে চলে গেলেন। মজিদ ফরিনাকে মেঝেতে ফেলে ইচ্ছেমত লাথি,থাপ্পড় দেন,সাথে বিশ্রি গালিগালাজ। চারপাশ ফরিনার কান্নায় ভারী হয়ে উঠে। ফরিনার কান্নার স্বর পদ্মজার কানে আসতেই সে চিৎকার করে বলল,’আব্বা,আম্মাকে মারবেন না। আব্বা…দোহাই লাগে। আম্মা লাশের মতো হয়ে গেছে। আব্বা,আম্মাকে মারবেন না। আমাকে মারেন। আব্বা। আম্মা আপনি দরজা খুলুন। আম্মাকে এভাবে কেন মারছেন আব্বা ? আপনি তো অলন্দপুরের ফেরেশতা ছিলেন আব্বা। আপনার এমন রূপ কেন? আম্মা দরজা খুলুন। আব্বা,আম্মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। অনুরোধ করছি,আর মারবেন না।’
বাইরে ফরিনার কান্না,ঘরের ভেতর পদ্মজার কান্না। আর দরজায় এলোপাথাড়ি থাপ্পড়ের আওয়াজ। সব মিলিয়ে চারপাশ যেন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। খলিলের ডাক শুনে মজিদ চলে গেলেন। কিন্তু যাওয়ার পূর্বে ফরিনার পেটে বড় একটা লাথি বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফরিনার মুখ দিয়ে বমি বেরিয়ে আসে। মজিদ চলে যাওয়ার মিনিট দুয়েক পর লতিফা দৌড়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় সে দুইবার হোঁচট খেল। তারপর ফরিনার মাথা নিজের কোলে নিয়ে কেঁদে বলল,’খালাম্মা আপনি কেন খালুর বিরুদ্ধে গেলেন। ও খালাম্মা কথা কন। খালাম্মা?’
লতিফার ব্যকুল কণ্ঠস্বর শুনে পদ্মজা আরো জোরে থাপ্পড় দিল দরজায়। বলল,’লুতু বুবু আম্মার কী হয়েছে? লুতু বুবু দরজা খুলো। ও লুতু বুবু।’
ফরিনা অস্পষ্ট স্বরে লতিফাকে বললেন,’তোর খালু চইলা গেছে?’
‘হ,গেছে।’
‘বাড়ি থেইকা বাইর হইছে?’ ফরিনার কণ্ঠ নিভে আসছে।
লতিফা ফরিনার মাথাটা সাবধানে মেঝেতে রেখে বারান্দা থেকে বাইরে উঁকি দিল। মজিদ,খলিল,মদন আর বাড়ির দারোয়ান মিলে গরু গাড়ি দিয়ে রিদওয়ানকে নিয়ে যাচ্ছে। গেইটের কাছাকাছি চলে গেছে। সে ফরিনাকে এসে বলল,’বাইর হইয়া গেছে খাল্লাম্মা।’
পদ্মজা দরজায় এলোপাথাড়ি থাপ্পড় দিচ্ছে। বিকট শব্দ হচ্ছে! ফরিনা আঙ্গুলের ইশারায় ডান দিকটা দেখিয়ে বললেন,’ওইহানে খুঁইজা দেখ,চাবি পাবি একটা। দরজাডা খুইলা দে।’
লতিফা ফরিনার কথামতো চাবি খুঁজল। পেয়েও গেল। তারপর দরজা খুলতেই পদ্মজা হুড়মুড়িয়ে বের হয়। ফরিনাকে দেখে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। গায়ে শাড়ি নেই। পেটিকোট হাঁটু অবধি তোলা। মিষ্টি রঙের ব্লাউজে রক্তের দাগ। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। দুই চোখ ফুলে গেছে। হাতে,পায়ে জখম। বয়স্ক মানুষটাকেও ছাড়েনি! পদ্মজা হাঁটুগেড়ে বসে ফরিনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল,’ আম্মা,আপনি কেন চাবিটা দিলেন না? এরা মানুষ? নিজের বউকে কেউ এভাবে মারে? লুতু বুবু আম্মাকে ধরো।’
লতিফা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’পদ্মজা তুমি কিচ্চু জানো না। খালু এমনেই মারে।’
‘এখন ধরো আম্মাকে।’
লতিফা,পদ্মজা দুজন মিলে ফরিনাকে ধরে ধরে তিন তলার আরেকটি ঘরে নিয়ে যায়। যে ঘরটিতে প্রথম রুম্পা ছিল,তারপর রানি। নিচ তলা অবধি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফরিনা মেঝেতে পা সোজা করে ফেলতে পারছেন না। চোখ দুটি বার বার বুজে যাচ্ছে। পদ্মজা একটা অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করছে। যেমনটা তার মায়ের মৃত্যুর আগে অনুভব হয়েছিল। পদ্মজার গা কেঁপে উঠে। চোখ ছাপিয়ে জল নামে। মনে মনে কেঁদে বলল,’আল্লাহ! কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে! কীসের পরীক্ষা নিচ্ছো তুমি? আমার চারপাশ এতো নির্মম কেন? কোথায় আছো আম্মা। কোথায় আছেন পারিজার আব্বু। আমি ভীষণ একা। ভীষণ।’
পদ্মজার হেঁচকি উঠে গেল। সে ঢোক গিলে নিজেকে সামলায়। ফরিনার যত্ন নিতে হবে তার। ফরিনাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই তিনি থেমে থেমে বললেন,’আমার কৈ মাছের জান। আমি মরতাম না। তুমি,তুমি পলায়া যাও।’
‘আম্মা,আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। লুতু বুবু হালকা গরম পানি,আর আমার ঘরের আলমারির ডান পাশের ড্রয়ার থেকে স্যাভলন আর তুলা নিয়ে আসো।’
পদ্মজার আদেশ পাওয়া মাত্র লতিফা বেরিয়ে গেল। ফরিনা করুণ চোখে পদ্মজার দিকে চেয়ে বললেন,’কান্দো কেরে? কাইন্দো না।’
পদ্মজার সুন্দর দুটি চোখে জলের পুকুর। বিরতিহীনভাবে পানি গড়িয়ে পড়ছে গলায়,বুকে। সে ফরিনার এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে হতাশ হয়ে ব্যর্থ কণ্ঠে বলল,’আম্মা,আমি কী করব? যখনই ভাবি এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তখনই ভয়ংকর সব ঘটনার সম্মূখীন হতে হয়। আমি আর পারছি না। এতো খারাপ পরিবেশ আমি আর নিতে পারছি না আম্মা। নিজেকে কিছুক্ষণ আগেও শক্তিমান মনে হয়েছে। মনে হয়েছে,আমি চাইলে সব পারব। কিন্তু এখন খুব দূর্বল মনে হচ্ছে। আমি ওদের বিরুদ্ধে পেরে উঠছি না। আপনি ভালো হয়ে উঠুন আম্মা। আপনার ছেলে কি সত্যি-”
পদ্মজা তাকিয়ে দেখল, ফরিনার চোখ বোজা অবস্থায় আছে। পদ্মজার বুক ছ্যাঁত করে উঠল। সে ফরিনার নাকের কাছে হাত নিয়ে পরীক্ষা করল,নিঃশ্বাস নিচ্ছে নাকি। নিঃশ্বাস নিচ্ছে! সেই সময় লতিফা স্যাভলন,তুলা,আর হালকা গরম পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো।
ফরিনা ঘুমাচ্ছেন। কথা বলার অবস্থায় নেই। পদ্মজার পায়ে ঘা হয়েছে। পাঁচদিনে কি ছেঁড়াকাঁটা ভালো হয়? শীতের কারণে উলটো আরো কষ্ট বাড়ে। পায়ের অবস্থা যা তা! তাতে অবশ্য যায় আসে না পদ্মজার। সে অস্থির হয়ে আছে। বুকে এক ফোঁটাও শান্তি নেই। রিদওয়ান দুপুরে জঙ্গল থেকে ফিরেছিল। পদ্মজার ধারণা,আমির জঙ্গলের কোথাও বন্দি আছে। অথবা লাশটা হলেও আছে! ভাবনাটা পদ্মজার মাথায় আসতেই সে দ্রুত মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে,’ না! আমি কী ভাবছি! কিছু হয়নি। কারো কিছু হয়নি। সবাই ভালো আছে।’
সে লতিফার দায়িত্বে ফরিনাকে রেখে নিচ তলায় নেমে আসে। সাথে ছুরি,রাম দা নিয়েছে। আজ খোঁপা করেনি। বেণী করেছে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই। সব হাসপাতালে। ওরা ফিরলে সে আর আস্তো থাকবে না। তার আগেই আমিরকে বের করতে হবে। সেই সাথে লুকোনো গুপ্ত রহস্য। সদর ঘরে আমিনা ছিলেন। তিনি আলোকে খিচুরি খাওয়াচ্ছেন। নির্বিকার ভঙ্গি! কোনো তাড়া নেই,চিন্তা নেই! রিদওয়ানের অবস্থা কী দেখেনি? এই মানুষটা শুধু রানির জন্যই কাঁদেন। আর কারোর জন্য না! কিন্তু কেন? পরিবারের সবার সাথে দূরত্ব বজায় রাখেন। যদিও কথা বলেন,তা অহংকারী, কটু কথা। পদ্মজা বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার নামায পড়েই বেরিয়েছে। আজ জঙ্গলে মরবে নয়তো আগামীকাল এই বাড়ির পুরুষগুলোর হাতে! সে মনে মনে মৃত্যু মেনে নিয়েছে। ধীর পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকে। বোনদের কথা খুব মনে পড়ছে। সে মারা গেলে, ওদের কী হবে? খুব কী কাঁদবে? কাঁদতে কাঁদতে জ্বর উঠে যাবে বোধহয়! পূর্ণার তো খুব কান্নার পর জ্বর হয়। প্রেমা নিজেকে সামলাতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় পদ্মজা মানুষের উপস্থিতি টের পেলো। ফিসফিসিয়ে কাছে কোথাও কেউ কথা বলছে। পদ্মজা এখনও ভালো করে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করেনি। সে হিজল গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে দুটি মানুষ চোখের পর্দায় ভেসে উঠে। তারা জঙ্গলের পশ্চিম দিক থেকে এসেছে। অস্পষ্ট তাদের মুখ। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে অন্দরমহলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল তারা। একটা মুখ চিনতে পারে পদ্মজা। মৃদুল! মৃদুলের হাতে টর্চ। সেই টর্চের আলোতে পাশের জনের হাত ভেসে উঠে। এক হাতে লাল তাজা রক্ত, অন্য হাতে রামদা। পদ্মজা শিউরে উঠে। ঘামতে থাকল। উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ড ফেটে যাওয়ার উপক্রম। গলা শুকিয়ে কাঠ। মৃদুল কিছু একটা বলে। উত্তরে আগন্তুক কিছু একটা বলে। ঝাপসা আলোয় মৃদুলের সাথের লোকটার দেহ আর চুল স্পষ্ট হয়। লম্বা শরীর,মাথায় ঝাকড়া চুল। চারপাশ থমকে যায়। পদ্মজার শরীর বেয়ে যেন মুহূর্তে শীতল কিছু একটা ছুটে যায়। সে বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছে না।
(আমাদের সমাজে অহরহ অনেক নোংরা ঘটনা ঘটছে! সেরকম অনেক দৃশ্য এই উপন্যাসে চলে আসবে। চরিত্রের প্রয়োজনে! আশা করি,এসব নিয়ে কেউ অভিযোগ তুলবেন না। আমি পদ্মজা থ্রিলারধর্মী উপন্যাস।)