অঙ্গারের নেশা | পর্ব – ১৩

7 Min Read

প্রানেশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সুফিয়ান। এই পনেরো মিনিট যাবৎ অনবরত হিচকি তুলে কান্না করেছে প্রানেশা। এখন মনে মনে নিজেকেই বকছে সুফিয়ান। প্রানেশার ওয়াটার ফোবিয়া আছে৷ এই কথাটা সুফিয়ানের মনে ছিলো না। নিজের প্রতি এত রাগ কখনো লাগেনি যতটা আজ লাগছে। প্রানেশার ভয় আপাতত কাটাতে হবে ভেবেই প্রানেশাকে উঠিয়ে বসালো। প্রানেশার মুখ লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে হালকা ছোঁয়ালেই টুপটুপ করে রক্ত বের হবে। সুফিয়ান নিজের হাত দিয়ে যত্ন করে মুখ চোখ মুছিয়ে দিলো৷ প্রানেশাকে পানি খাইয়ে দিয়ে জড়িয়ে রাখলো বাহুডোরে৷ প্রানেশা ঠোঁট উল্টে বললো-‘আপনি আমায় ভয় দেখাচ্ছিলেন? ‘
সুফিয়ান প্রানেশার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বললো-
‘না প্রানেশ্বরি, রুকি সত্যিই দ্রুত চলে৷ এখন আমি বলায় ধীরে চালাচ্ছে। ‘
প্রানেশা চুপ করে বুকের সাথে লেপ্টে আছে৷ সুফিয়ান বললো-
‘প্রানেশ্বরি, এভাবে চললে তো দ্রুত পৌঁছাতে পারবো না। ‘
প্রানেশা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো৷ সুফিয়ান মৃদু হেসে বললো –
‘ভয় পাচ্ছো কেন? এক কাজ করো তুমি শক্ত করে আমায় ধরে রাখো তো। আর যা ইচ্ছে প্রশ্ন করো ‘
প্রানেশা প্রশ্ন করতে পছন্দ করে। তাই সুফিয়ান ভয় ভুলাতে এই কথা বললো। সুফিয়ান হাত দিয়ে ইশারা করতেই রুকি আবারও দ্রুত চলতে শুরু করলো। নরমাল যে কেউই রুকিতে ভীষণ উপভোগ করবে। নীল সমুদ্রের জলের স্নিগ্ধ ফোঁটাগুলোকে মুক্তর দানা মনে হবে। কিন্তু এসবের কিছুই দেখতে পারলো না প্রানেশা। তার যে সাধারণ কোনো ফোবিয়া নয়। প্রানেশা মনে মনে ভাবলো ‘যদি সেই ঘটনাটা আমার সঙ্গে না ঘটতো, তাহলে আমি হয়তো আজ সবকিছু উপভোগ করতে পারতাম’ এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরও শক্ত করে ধরে রাখলো সুফিয়ানকে৷
সুফিয়ানকে হঠাৎই একটা উদ্ভট প্রশ্ন করতে মন চাইলো প্রানেশার। চট করে বললো –
-‘ আপনি আগে কারো প্রেমে পড়েছিলেন?’
সুফিয়ান ভ্রু কুচকে বললো-
-‘হঠাৎ এই প্রশ্ন? ‘
-‘আপনি কিন্তু বলেছেন সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন! ‘
-‘হুম, তবে শোনো আমি এক এলোকেশীর প্রেমে পড়েছিলাম কয়েক বছর আগে ‘
প্রানেশার মুখ কালো হয়ে গেলো। ভালো না বাসলেও সুফিয়ান তার স্বামী। মেয়েরা সব ভাগ করতে পারলেও স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে চায়না। এ যেনো একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষ। প্রানেশার মনে কিছু একটা চিনচিন করে উঠলো৷ ভাবতেই কষ্ট হলো, তার আগে এই বুকে অন্য কারো স্থান ছিলো। ভালোবাসাটা অন্য কারো নামে ছিলো। ধুপ করে মনে এলো, রেয়ানকে যখন প্রানেশা জড়িয়ে ধরেছিলো তখনও কী সুফিয়ানের এমন কষ্ট হয়েছিলো৷ নাহ, হয়তো আরও বেশী হয়েছে। ভাবতেই বুক ভারি হয়ে এলো। নাহ আজ থেকেই সবকিছু নতুন করে শুরু করবে। বালিতে আসার মূল কারণ তো এটাই ছিলো।এক ঘন্টার মাঝেই পৌঁছে গেলো দুজন। পৌঁছাতেই প্রানেশাকে ধরে নামালো সুফিয়ান। প্রানেশাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটা শুরু করলো।
দ্বীপটা খুবই নিরিবিলি, শান্ত। মানুষ জন কম হওয়ায় হেঁটে শান্তি পাওয়া যায়। এমন পরিবেশে সারাজীবনের জন্য ছেড়ে দিলেও প্রানেশার কোনো আপত্তি থাকবে না। এখানে অনেকগুলো সুন্দর রিসোর্ট ও ভিলা আছে। ‘হারতা লেম্বগান ‘ নামক ভিলায় উঠলো সুফিয়ান ও প্রানেশা। সুফিয়ান প্রানেশাকে রুমে পাঠিয়ে বললো এক ঘন্টা পরই আসবে। সুফিয়ান মূলত সিকিউরিটি গার্ডদের আরও কড়া ভাবে নজর রাখতে বলার জন্য গেলো৷ প্রানেশা রুমে ঢুকতেই দেখলো রুমটা থেকে কাছেই সমুদ্র দেখা যায়। কিছুক্ষণ ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করে গুনগুন করে ওয়াশরুমে গেলো শাওয়ার নিতে।
ক্লান্ত হয়ে টাইয়ের নাট ঢিলে করতে করতে রুমের দরজা খুলতেই হা করে তাকালো৷ একি!রুমে একফোঁটা আলোও নেই৷ প্রানেশা এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে কী করছে! হাত দিয়ে খুঁজে খুঁজে দেয়ালের সুইচবোর্ডে সুইচ চেপে লাইট জ্বালালো৷ সাথে সাথেই অবাক হয়ে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো৷ এসব কী! বিছানায় লাভ শেইপ করে গোলাপের পাপড়ি৷ আশেপাশে কয়েকটা ক্যান্ডেল লাইট।সুফিয়ান ঘরের লাইট বন্ধ করতেই ঘরে হালকা মোমের আলো নিজের শোভা ছড়ালো৷ এসব তবে, তার প্রাণ করেছে! ভাবতেই মনে খুশির জোয়ার বইলো । এতদিনের অতি প্রত্যাশিত মেয়েটিই তাকে আজ এতো বড় সারপ্রাইজ দিলো, ভেবে মুখে হাসি ফুটলো৷
কিছুদূর এগিয়ে দেখলো প্রানেশাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে৷ এখানে আরও বড় শক খেলো যখন দেখলো, প্রানেশা নাইটি পড়েছে। তাও হাটুর একটু নিচ পর্যন্ত, পিঠের অর্ধেকের বেশি দেখা যাচ্ছে। হায় আল্লাহ! এ তো তাকে পাকাপোক্ত ভাবে মারার প্ল্যান। ঘাম ছুটে গেলো সুফিয়ানের। শুকনো ঢোক গিলে প্রানেশার কাঁধে পেছনে থেকে হাত রাখতেই প্রানেশা সামনে ফিরলো৷ মাতালের মতন হাসতেই সুফিয়ান ভ্রু কুচকে বললো- ‘আর ইউ ড্রাংক প্রাণ?’
প্রানেশা বাচ্চাদের মতোন মাথা নাড়িয়ে বললো-
-‘হুম,বেশী না একটুউউ’
সুফিয়ান বড় বড় চোখ করে বললো-
-‘ ড্রিংকস কোথায় পেলে তুমি? ‘
প্রানেশা খাটের নিচে থেকে একটা ওয়াইনের বোতল বের করে গর্বের হাসি দিলো, এ যেন খুবই গর্বের একটি কাজ। হাসতে হাসতে বললো-
-‘ কিছুক্ষণ আগেই একজন ওয়েট্রেস এটা দিয়ে গেলো৷ ‘ তারপর বাচ্চাদের মতো করে ঠোঁট উল্টো করে বললো-‘বিশ্বাস করুন, আমি চাইনি এটা খেতে। কিন্তু এইযে বোতলটা বারবার খালি বলছিলো ‘একটু খেয়ে দেখো, ভীষণ টেস্ট ‘ আমি কী করবো! একটু খেয়ে নিলাম ‘
সুফিয়ানের মাথায় হাত! এ কী সর্বনাশ! এমনিতেই কথার চোটে কান ঝালাপালা করে দেয়। এসব খেয়ে সারা রাত আর ঘুমাতে দেবে না। চিন্তিত ভঙ্গিতে এসব ভাবতেই হঠাৎ দেখলো, প্রানেশা তার পায়ে পা রেখে গলা জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশা হয়তো খুব বেশি একটা মাতাল হয়নি। জ্ঞান আছে এখনো ভালোই। হালকা নেশা নেশা কন্ঠে বললো-
‘আপনি এতো সুন্দর কেনো?’
সুফিয়ান হা করে তাকিয়ে আছে। তাকে আরও অবাক করে প্রানেশা সুফিয়ানের এডামস এপেলের নিচের সেই তিলটায় গাঢ় ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো৷ সুফিয়ানের পুরো শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো৷ ভেতরে ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে টের পেতেই সুফিয়ান বললো-
‘এমন করেনা লক্ষ্মীটি!তুমি এখন হুঁশে নেই। পরে পস্তাবে, চলো ঘুমাবো’
প্রানেশা কথায় তেমন গুরুত্ব দিলো বলে মনে হয় না। সে সুফিয়ানের আর মাঝের হালকা দুরত্বটুকুও ঘুচিয়ে আরও কাছে এলো।ছোট বাচ্চার ন্যায় আবদার করলো-
‘ আমি আপনার ঠোঁটটা খাই?’
সুফিয়ান কড়া কন্ঠে বললো –
‘চুপ! চলো ঘুমাবে। ঠোঁট কোনো খাওয়ার জিনিস নয় ‘
প্রানেশা জেদ করার ভঙ্গিতে বললো –
‘নাহ, আমি খাবো৷বেশী না একবার, সত্যি বলছি
সুফিয়ান নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। শেষ বারের মতো বললো-
‘এমন বলতে নেই প্রাণ, ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে ‘
প্রানেশা গলা জড়িয়ে গা এলিয়ে দিতেই সুফিয়ান পাঁজা কোলে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে উন্মাদের মতো গলায় চুমু খেতে লাগলো। প্রানেশা হালকা হলেও হুঁশে
আছে। ছোঁয়ায় লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান পেছনে ফিতা খুলতে নিলেই প্রানেশা লজ্জায় মাথা নেড়ে না বললো৷ সুফিয়ান অধর কোণে হেঁসে বললো –
‘আমি তো বলেছিলাম প্রাণেশ্বরী, এখন না করলেও আমি যে শুনবোনা ‘
সারা রাতের ভালোবাসায় প্রানেশার সত্যিই মনে হলো তার ভুল হলো, বিশাল ভুল, সর্বনাশা ভুল।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।