‘কোকিলপুর ‘ গ্রামের থেকে সুফিয়ান ফিরেছে আজ এক মাস। এই এক মাসে সুফিয়ান প্রতিটি নিঃশ্বাস নেয়ার সময় প্রানেশাকে মনে করেছে। গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছে ওই অচেনা মেয়েটাকে ছাড়া শান্তিমতোন নিঃশ্বাস নেয়া সম্ভব না। মেয়েটার ওই ভেজা ঠান্ডা পবিত্র মুখটা প্রতি রাতেই সুফিয়ান স্বপ্ন দেখে। তখন শরীরে শীতল একটা স্রোত বয়ে যায়। স্বপ্ন সাজায় নতুন জীবনের। সেখানে ছোট্ট একটা ঘর থাকবে, বৃষ্টির দিনে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি আওয়াজ শোনা যাবে, পাশে একটা পুকুর থাকবে। সব মিলিয়ে ছিমছাম সংসার কিন্তু সুখ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হবে। কী সুন্দরই না হবে সেই মুহূর্তগুলো!
সুফিয়ান বসে আছে নিজের বারান্দার দোলনায়। হাতে কফির কাপ। সময় এখন বিকাল পাঁচটা। এই সময়টা একা একাই কাটায়, বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়ায়। নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা হাতে নিলো, তনিম কল করেছে। এলাকার ছোট ভাই, একে কয়েকদিন আগে প্রানেশার খোঁজ নিতে পাঠিয়ে ছিলো ৷ হয়তো কোনো খোঁজ পেয়েছে ভাবতেই এক চিলতে হাসি নিয়ে ফোন রিসিভ করলো-
‘বল তনিম কী খবর পেলি?’
‘ভাইই!’
এমন কাঁদো কাঁদো স্বরে সুফিয়ান অবাক হলো। পরমুহূর্তেই বললো –
‘ কী হয়েছে? ‘
‘ভাই, এ আপনি আমাকে কার কাছে পাঠালেন! এ তো মেয়ে না ভাই! ‘
‘হোয়াট ননসেন্স! ‘
‘না না মানে! এ হলো বোম্বাই মরিচ । ‘
‘কী করেছে তোমায়?’
তনিম কাতর গলায় বললো –
‘ ভাই! ভাবী, কলেজ থেকে ফিরছিলো। আমি কলেজের ফলো করে বাসার এড্রেস বের করতে পিছু নিলাম। ভাবী মনে হয় সন্দেহ করলো, দুই একবার পিছনে ফিরছিলো। আমি অনেক লুকিয়ে চুপিসারে যাচ্ছিলাম কিন্তু..! ‘
‘ কিন্তু কী?’
‘মাঝপথে ভাবী রাস্তায় দৌড়ে এসে আমাকে ধরে মেয়েধরা! মেয়েধরা! বলে জনগণের কাছে উদুম কেলানি খাইয়েছেন ‘
সুফিয়ান মনোভাব সহকারে সব কথা শুনছিলো। শেষের কথা শুনে সুফিয়ান হেসে ফেললো৷ তনিম তখনও হা হুতাশ করছে। হাসিটা চেপে বললো-
‘তোমাকে কে বলেছিলো একা যেতে,ডাফার! ‘
হাসতে হাসতে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো সুফিয়ানের। কয়েক দিন আগেই সেভ করেছে সুফিয়ান। কল দিতেই জ্বলজ্বল করে উঠলো ‘নেশা ‘। চতুর্থবারের সময় কলটা রিসিভ হলো।
অপর পাশ থেকে প্রানেশা বললো-
‘কে বলছেন?’
সুফিয়ান লম্বা শ্বাস ফেলে বললো-
‘ সুমি বলছেন?’
প্রানেশা শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিলো। গায়ে একটা লেডিস শার্ট আর প্লাজু। ভ্রু কুচকে বললো-
‘ জি না, আপনি বোধ হয় রং নাম্বারে কল দিয়েছেন! আমি সুমি নই ‘
‘কিন্তু আমাকে তো বলা হয়েছে এটাই সুমির নাম্বার!’
‘ওহহো! বললাম তো আমি সুমি নই৷ আমি প্রাণেশা ‘
‘ওহ আচ্ছা , তাহলে ওই গুন্ডি মেয়েটার নাম প্রাণেশা! ‘
প্রানেশার পিলে চমকালো। গুন্ডি মেয়ে মানে! লোকটা কী বোঝাতে চাইছে! ওহ, আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় একটা লোককে ইচ্ছেমতো মার নিজেও দিয়েছে, সঙ্গে জণগণ দিয়েও খাইয়েছে। যদিও প্রানেশা এখনো সিউর না যে লোকটা আসলে কে ছিলো! সন্দেহবশত কাজটা করে কী তবে ফেঁসে যেতে হবে! কলেজ থেকে
ফেরার সময় মাথা এমনিতেই গরম ছিলো। তারপর নিজের সব রাগ মিটিয়েছে লোকটার উপর৷ তারপর বাসায় এসে নিজেই আফসোস করলো৷ কিন্তু এখন আফসোস করে কী হবে!
‘শুনছেন মিস?’
প্রাণেশা তোতলানো গলায় বললো –
‘জি জি, শুনছি। ‘
‘তো আপনি কী জানেন আপনি কার গায়ে হাত তুলেছেন? ‘
প্রানেশার কেঁদে ফেলার মতোন অবস্থা হলো৷
‘ক.. কার উপর? ‘
‘এলাকার নেতার ছেলের উপর ‘
প্রানেশা মনে মনে ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। নাটক সিনেমায় দেখেছে সে নেতারা মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যায়! অনেক সময় মেরে টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ফেলে রাখে৷ প্রানেশার চোখ লাল হয়ে গেছে, টুপটুপ করে জল পড়ছে৷
‘এখন কী তাহলে সে আমায় মেরে ফেলবে?’
সুফিয়ান মনে মনে ভীষণ হাসছে৷ এভাবে কে বিশ্বাস করে! তারপরও গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললো –
‘ হতে পারে! ‘
প্রানেশা আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান প্রথম কথোপকথনেই বুঝতে পারলো প্রানেশা মেয়েটা সহজ সরল বোকাসোকা, ভীতু ৷ কিন্তু এভাবে কাঁদছে দেখে সুফিয়ানের নিজেরই কষ্ট লাগলো। হড়বড় করে বললো –
‘আরে মেয়ে কাঁদছো কেনো! তোমাকে বাঁচাতেই তো আমি কল করলাম’
‘আপনি সত্যিই বাঁচাবেন আমায়?’
‘হ্যা বোকা মেয়ে ‘
‘কীভাবে? ‘
‘শোনো,তুমি যাকে মার দিয়েছো সে আমার পরমবন্ধু আমি হলাম তার বেস্ট ফ্রেন্ড। যদি তুমি আমার কথামতো চলো তাহলে আমি তোমার সাহায্য করতে পারি’
প্রানেশার আশার প্রদীপ খুঁজে পেলো। খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে বললো-
‘সত্যিই!’
‘হ্যা একদম সত্যি ‘
‘আমাকে কী করতে হবে? ‘
‘আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে। যা বলবো সেটা মানতে হবে, বন্ধু হতে হবে’
‘তাহলেই আমাকে আপনার বন্ধু আর কিছু বলবে না! ‘
‘একদম না, আমি না বললে কখনোই করবেনা ‘
প্রাণেশা খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো৷ সতেরো বছরের আদরের দুলালি এতটুকু বুঝতে পারলো না যে তাকে বোকা বানানো হচ্ছে। খুশি খুশি সবটা মেনে ফোন রেখে দিলো সে৷ সুফিয়ান ফোনের দিক তাকিয়ে বললো –
‘ আমার বোকা প্রাণেশ্বরী!‘
Leave a comment