অঙ্গারের নেশা | পর্ব – ২৫

12 Min Read

অন্যান্য দিনের চেয়ে সেই সকালটা ছিলো অন্যরকম।
আকাশ তখন হলদে রঙে সেজেগুজে হাজির হয়েছে। নারীর দেহে অলংকারের ন্যায় আকাশেরও হলদে রঙ বেশ শোভা ছড়াচ্ছে। না আছে রোদ আর না আছে কোনো মেঘলা ভাব। চমৎকার একটা পরিবেশ। এরকম একটা সময়ে ভালোবাসার মানুষের হাতটা যদি নিজের মুঠোয় থাকে তাহলে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে বেশি কিছু লাগে না।
হসপিটালের ৩০৯ নাম্বার কেবিনে আড়াআড়ি ভাবে লম্বা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুফিয়ান। জানালার বাহিরের সৌন্দর্যে মোড়ানো এক টুকরো অপার্থিব দৃশ্য উপভোগ করছিলো। একাকিত্বের এই মূহুর্তগুলোতে প্রানেশার স্মৃতিগুলো খুব কঠোর ভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে অতৃপ্ত শ্বাস।
পাশের ঝুলানো ক্যালেন্ডারে লাল কালির দাগ জ্বলজ্বল করছে৷ সুফিয়ানের মনে পড়লো, আজ নিজের মাতৃভূমি থেকে দূরে চলে এসেছে ৫ বছর ৩ মাস। এর আগে চারটা ক্যালেন্ডারেও সে এভাবেই লাল কালির একটা দাগ কেটে দিতো৷ কোনো লাভ নেই, কিন্তু কোথায় কিছু একটা ভালো লাগে তার৷ গায়ে সাদা রঙের একটা শার্ট ইন করা। পাশের ডেস্কে সার্জিক্যাল স্যুট, গ্লাভস, মাস্ক পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আজ তার পাঁচ নাম্বার অপারেশন ছিলো।
নতুন ডাক্তার হওয়ায় খুব বেশি অপারেশন করে না সে৷ সার্জারির জন্য বেশি প্রেশার পড়লে তবেই করে।
এখন, মেডিসিনের উপর ২ বছরের একটা কোর্স করবে ঠিক করলো। নাহলে, শুধু সার্জারী করে আত্মতুষ্টি পাওয়া যায় না বলে মনে করে সুফিয়ান। ঠিক করলো, মেডিসিন কোর্স শেষ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সে বাংলাদেশেই ফিরবে না। এতগুলো দিনে একবারো বাংলাদেশের কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। ইচ্ছে যে হয়নি তা না, বরং মাকে, রেয়ুকে খুব মনে পড়েছে কিন্তু বললেই যে বাংলাদেশে চলে যেতে মন চাইবে।
জাস্টিন বেইবারের ‘বেবি ‘ গানের রিংটোন বেজে উঠতেই হাল্কা চমকপ্রদ হলো সুফিয়ান। ডেস্কের কাছে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো। ‘ইভ’ নামটা উঠে আছে৷ সুফিয়ানের চোখে তার জীবনের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। যে তার বিপদে আপদে মনে রাখে, ঠিক এমনটাই তো মনে করে সুফিয়ান!
কল রিসিভ করে কানে তুলতেই শোনা গেলো সুর টেনে ইভানান বলছে-
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ‘
সুফিয়ান অবাক হয়ে গেলেও পরে মনে করলো আজ তার জন্মদিন। এত ব্যস্ততায় সে ভুলে বসেছিলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-
‘তুইও না! বুড়ো হয়ে বাচ্চাদের মতো বার্থডে উইশ করিস ‘
ইভানান হাসতে হাসতে বললো-
‘আমি কী আর তো মতো বুড়ো নাকি! আই এম ফিট এন্ড ফাইন। ত্রিশ পেরোলেই না তার আগেই তুই বুড়োর মতো গম্ভীর হয়ে থাকিস বুড়োদের মতো আচরণ করিস’
‘মনের রঙ ঘুচে গেলে তখন আর নিজেকে জুয়ান মনে হয় না, শরীর তরতাজা থাকলেও মনটা মরা মাছের মতোন ‘
‘হয়েছে, এবার তোর জ্ঞান শুরু করে দিস না। ‘
সুফিয়ান হেসে বললো –
‘আচ্ছা তা না হয়, না দিলাম। তোর খবর কী বল, দুই বছর ধরে আলাদা থাকছিস’
‘এখানে থেকে আমি একটু শান্তি অনুভব করি। প্রকৃতির রূপে ডুবে থাকি, আমি তো চাকরি- বাকরি
করবো না। তাই, আঁকাআকি করে এক্সিবিশন গুলোতে যা পাই তা দিয়েই চলি ‘
‘হাহাঃ আমি দুইটা সার্জারী করেও যা পাইনা তার ডাবল তুই একটা এক্সিবিশনেই পেয়ে যাস। ‘
প্রতুত্তরে হাসলো ইভানান। সত্যি বলতে প্রচুর টাকার মালিক ইভানান। প্রকাশ না করলেও তা সুফিয়ান ভালোই জানে। বেশ ভালো একটা হোটেলে থাকছে এখন সে, প্রতি ছয় মাস পরপর নানান হোটেল বুক করে ঘুরাফেরা করে। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –
‘ওহ শোন, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে ‘
‘সারপ্রাইজ! ‘
‘হ্যা, তোর জীবনের সেরা উপহার হবে এটা সুফি’
সুফিয়ান হেঁসে বললো –
‘ঠিক আছে, টাইম ইজ স্টার্ট নাও ‘
কল কেটে দিতেই সুফিয়ান নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ৷ দুই মিনিট পর ডোরে কেউ নক করায় ভ্রু কুচকে সুফিয়ান বললো-
‘ কাম ইন ‘
বিদেশি কালোমতো একটা ছেলে ভেতরে এসে গুড মর্নিং বললো৷ এখন বাজে সাড়ে এগারোটা, তাই গুড মর্নিং শুনে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুফিয়ান তাকালো। ছেলেটার হাঁটু কাপছে। সুফিয়ান গম্ভীর স্বরে বললো-
‘সে ইট কুইকলি ‘
ছেলেটা কেঁপে কেঁপেই বললো-
‘এ ম্যান হ্যাজ কাম টু সি ইউ, স্যার’
(আপনার সঙ্গে একজন লোক দেখা করতে এসেছে স্যার)
সুফিয়ান হাতের বইটা সাইডে রেখে বললো –
‘নেম? ‘
‘তনিম ‘
সুফিয়ান চকিতে তাকালো। তনিম! এখানে তার সাথে দেখা করতে কেনো এসেছে! তনিমকে তো সে প্রানেশার খোঁজ নিতে পাঁচ বছর আগে পাঠিয়েছিলো।
মাথা তুলে বললো-
‘সেন্ড হিম ‘
ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড পরই ভেতরে স্যুট প্যান্ট পড়া ভদ্রলোক আসলো৷ সুফিয়ান বেশ খানিকটা অবাক হলো৷ তনিম যে এতটা বদলাবে ভাবেনি। উঠে দাঁড়াতেই তনিম তার স্বভাবমতোন সুফিয়ানের কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ান পিঠ চাপড়ে বললো-
‘কী ব্যাপার তনিম? কেমন আছো?’
তনিমকে অনেক উত্তেজিত দেখালো৷ যেনো কিছু বলার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছে সে৷ সুফিয়ানের প্রশ্নে বললো –
‘জি আলহামদুলিল্লাহ ভাই, ভালো আছি ‘
কিছুটা থেমে আবার বললো-
‘ভাই, আপনাকে কিছু কথা বলা অনেক জরুরি। ‘
‘ঠিক আছে, বসো আগে ‘
তনিম সামনের চেয়ারে বসে পড়লো। হাতের তালু কচলে আমতাআমতা করতে করতে বললো –
‘ভাই, একটা ভুল হয়ে গেছে ‘
সুফিয়ান ভ্রু বাকিয়ে বললো-
‘কী ভুল তনিম?
তনিম আচমকা ঠোঁট চেপে কেঁদে ফেললো৷ সুফিয়ান থতমত খেয়ে বললো-
‘আরে! কাঁদছো কেনো? কী হয়েছে বলবে তো?’
‘অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে ভাই। পাপ করেছি আমি, আজ শাস্তি ভোগ করছি, পাঁচ বছর আগের করা ভুলের মাশুল গুনছি আমি ‘
এতটুকু বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো তনিম। সুফিয়ান তনিমের কাঁধে হাত রেখে বললো –
‘কী করেছো খুলে বলো ‘
তনিম দুই হাতে চোখ মুছে নিলো৷ লম্বা শ্বাসে বললো-
‘আপনি তো জানেনই ভাই, আমি গরীব ঘরের ছেলে। এলাকায় বড় ভাই টাইয়ের সাথে ঘুরতাম তাই মানুষ চিনতো৷ বাবা যখন মারা গেলো, তার কয়েক দিন পরই আবার মায়ের একটা কিডনি নষ্ট হলো৷ আমি আকূলপাথারে পড়লাম৷ তখন আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি সাহায্যের জন্য সবার আগে আপনার কাছে গেলাম, কিন্তু আপনি তো হসপিটালের বেডে তখন৷ তবুও, আপনাকে দেখার জন্য একবার হসপিটালের ভিতর ঢুকলাম। দেখে চলে আসছিলাম, ঠিক তখন পেছন থেকে আমাকে কেউ ডাকলো। ফিরে দেখি ইভানান ভাই। আমি তাকে দেখে সালাম দিলাম, সে আগে থেকেই বোধ হয় আমার মায়ের ব্যাপারটা জানতো৷ সে নিজে থেকেই আমাকে দশ লাখ টাকা দিলো৷ আমি মানা করলে জোর করে টাকা দিলো৷ আমি ভেবেই নিলাম, আপনার বন্ধুও আপনার মতোন বড় মনের মানুষ। আমার মায়ের অপারেশনের পর, আমি যখন বাড়ি ফিরলাম। সে বললো আমাকে তার হয়ে একটা কাজ করতে হবে। তা নাহলে, পাঁচ দিনের মাঝেই টাকা ফেরত দিতে হবে। আমার ঘাম ছুটে গেলো৷ পাঁচ দিনের মাঝে টাকা দেয়া কোনো ভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব না তা ইভানান ভাইও জানে।
আমি বুঝলাম, বড় কোনো কাজ করাতেই সে আমাকে ব্যবহার করতে চায়। কোনো উপায় না পেয়ে আমি সায় দিলাম। সে বললো ফোনে কাজ বুঝিয়ে দিবে। তার কয়েক দিন পরই আমাকে সকালে ফোন দিয়ে বললো আমি যেনো বলি প্রানেশা ভাবির আরেক জায়গায় সম্পর্ক আছে, আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। আমি তার হাত পায়ে ধরে অনুরোধ করে বলেছি এসব করতে পারবো না। কিন্তু, টাকার হুমকি দেয়ায় কাজটা করতে বাধ্য হলাম৷ যখন আপনাকে বললাম ভাবীর অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে তখন সে বললো, মায়ামতী ঝিলের কথাটা বলতে ৷ বলার পরে যে আপনি এভাবে অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসবেন আমি ভাবিনি ‘
কিছুটা থেমে তনিম আবারও রেয়ানের চেহারা সহ সবকিছু খুলে বললো৷
সুফিয়ান স্থির হয়ে সবকিছু শুনছে৷ এখনও বিশ্বাস করে ওঠতে পারছে না। যাকে এতোটা বিশ্বাস করলো সে কিভাবে এমন করবে! সুফিয়ান থমকে যাওয়া চোখে বললো-
‘ইভানান! ‘
তনিম সুফিয়ানের মুখপানে চেয়ে বুঝতে পারলো ধোঁকায় সুফিয়ান কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।
তনিমের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো-
‘তুমি এখন যাও তনিম ‘
তনিম নিঃশব্দে হেঁটে বাহিরে চলে গেলো৷ সুফিয়ান চোখ বন্ধ করে দুই মিনিট ধাতস্থ হলো, চোখ খুলতেই বাম চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে টুপ করে নিচে পড়লো। এই তাহলে মূল্য দিলো ইভানান তার বন্ধুত্বের। বাহ! চমৎকার। তনিম সবকিছু বললেও ইভানান কেনো এসব করেছে তা বলেনি৷ সুফিয়ানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে । উঠে দাড়িয়ে রওনা হলো ইভানানের হোটেলের উদ্দেশ্যে।
ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে আধা ঘণ্টায় রাস্তা পাড় করে ফেললো৷ রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইভানান যদি সত্যিই এসব করে তাহলে জান নিয়ে ছাড়বে ওর।
উপরে উঠতেই বিশাল রুমের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো৷ হাসতে হাসতে কেউ একজন বললো-
‘সারপ্রাইজ কেমন লাগলো বন্ধু? ‘
সুফিয়ান রেগে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ইভানান হাত
ভাজ করে খাটের উপর বসে আছে। সুফিয়ান ঠাস করে গালের উপর চড় বসিয়ে দিলো। ইভানানের ঠোঁটের হাসি মুছেনি৷ সে তার হাসি আরও বিস্তৃত করলো। সুফিয়ান মারতে মারতে হাঁপিয়ে উঠলো৷ দূরে সরে এসে বললো-
‘তোর এখনো লজ্জা করছে না? ‘
ইভানান হেসে বললো –
‘নাহ, কারণ এসব তো আমিই সাজিয়েছি। আমি না চাইলে তনিম এই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতো না৷ আজ মা মরেছে বলে জানপ্রাণ নিয়ে ছুটে এলো ‘
‘এসব কেনো করলি তুই?’
‘এখনও বুঝিসনি? ‘
সুফিয়ান চিৎকার করার স্বরে বললো –
‘না বুঝিনি, এসব কেনো করলি?’
ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –
‘কারণ আমি চাই, তুইও বুঝিস যে আপন মানুষ থেকে দূরে থাকা ঠিক কতটা কঠিন সঙ্গে যখন নিজের বন্ধুর কারণেই হয় ‘
সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘ কেনো? ‘
‘কেনোনা তুই পাঁচ বছর আগে আমার সঙ্গেও এটাই করেছিলি, আমার ইনু শুধু মাত্র তোর কারণে মারা গেছে। তুই যদি আমার বোনকে কষ্ট না দিতি আত্মহত্যা কখনো করতো না ‘
‘ইনায়াকে আমি আত্মহত্যা করতে বলিনি ইভ!’
‘বলিসনি কিন্তু বাধ্য করেছিস, আমার সহজসরল বোনটাকে শেষ করেছিস। আর তাই তোর কাছে থেকে বদলাস্বরূপ আমি তোর ভালোবাসাকে সরিয়ে দিলাম তোর কাছে থেকে দূরে ‘
সুফিয়ান বুঝতে পারলো একে বলে কিছু লাভ নেই।
ইভানান যে বোনের শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই ইভানানকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো-
‘যাই করিস, এবার প্রানেশাকে আমি আমার কাছে আনবোই ‘
সুফিয়ান বের হওয়ার পর ইভানান উচ্চস্বরে বললো –
‘কী করে হয় আমি দেখবো সুফি ‘
সুফিয়ান সেদিকে কান না দিয়ে চলে গেলো। দুইদিন পরই বাংলাদেশে চলে গেলো৷ মা আর বাবাকে ইভানান, রেয়ানের কাজের কথা বললো। মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেব অবাক হয়ে গেলেন৷ কারণ, রেয়ান চেহারা পাল্টে যে এই ভয়ংকর খেলায় মেতেছে। সুফিয়ান মিসেস অদিতিকে বললো প্রানেশার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে ৷ আর বিয়েতে যেনো সমস্যা না হয় তাই রেয়ানকে সিঙ্গাপুর পাঠালেন রাহাত সাহেব। তার আট দিন পরে হুলুস্থুল করে প্রানেশাকে বিয়ে করে নিলো।
বর্তমান –
সুফিয়ান ফুঁপানোর শব্দে পাশে ঘুরলো৷ প্রানেশা ঠোঁট চেপে কাঁদছে। সুফিয়ান অস্থির ভাব উঠলো। প্রানেশাকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলো। প্রানেশা সুফিয়ানের গলা জড়িয়ে কাঁধের একটু নিচে মাথা রেখে আদুরীর মতো বললো-
‘ভালোবাসি অঙ্গার’

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।