অঙ্গারের নেশা | পর্ব – ২৯

6 Min Read

সুফিয়ানের কথায় প্রতুত্তর করতে পারলো না প্রানেশা।
এতক্ষণের সকল ক্ষোভ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সুফিয়ান যেনো তার দোষ গুলো তার চোখের সামনে তুলে ধরলো ৷ ঠিকই তো বলেছে সুফিয়ান!
না জেনেই হোক রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলো সে। প্রানেশা যেমন সত্যি জানতো না তেমন
সুফিয়ানও ধোঁয়াশায় ছিলো। সে হিসেবে দুজনেই বরাবর অপরাধী৷
সুফিয়ান যখন বুঝতে পারলো প্রানেশার মন শান্ত হয়ে এসেছে, তখন নিজের দিকে ফেরালো। প্রানেশার চোখ বেয়ে অশ্রুর সাড়ি। সুফিয়ান মৃদু কন্ঠে বললো-
‘সরি প্রাণ, আমি পুরনো কথা বলতে চাইনি। আই এম সো সরি ‘
প্রানেশা আচমকা সুফিয়ানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান তাল সামলাতে না পেরে খাটে বসে পড়লো। প্রানেশা কেঁদেকেটে নিজের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সুফিয়ান অস্থির ভাবে বললো –
‘আহা! আর কাঁদে না প্রানেশ্বরী। অসুস্থ তো তুমি ‘
প্রানেশা হেঁচকি তুলে ফেলেছে । হেঁচকিতে আটকে আটকে বললো –
‘সব আমার দোষ। আমার ওমন করা উচিত হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনাকে হঠাৎ ওই অবস্থায় দেখে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছিলো৷ পৃথিবীটা অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিলো। খুব ভালোবাসি আপনাকে।’
সরল স্বীকারোক্তিতে সুফিয়ানের মন ভালো লাগায় ভরে গেলো। সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি তো হবেই। কিন্তু তা নিজেদেরই মিটিয়ে নিতে হবে। একজনের অভিমান হলে আরেকজনের মাথা নত করতে হবে। ইগো বজায় রাখতে গিয়ে অনেক সময় সম্পর্কে ফাটল ধরে। অথচ,সম্পর্কের একটুখানি যত্ন নিলে তা নতুনত্ব বরণ করে নেয়। এখন প্রানেশা যদি অবুঝের মতো নিজের রাগ বজায় রেখে চলে যেতো তাহলে এত দিনের সুন্দর ভালোবাসাময় সম্পর্কটা ভেঙ্গে খানখান হয়ে পড়তো।
সুফিয়ান প্রানেশার কান্নামাখা মুখ আর সহ্য করতে পারলো না। তাই বললো-
‘ প্রাণ, মেয়েগুলোর কারো সঙ্গেই আমার শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি ‘
প্রানেশা কান্নার মাঝেই চমকে তাকালো। সুফিয়ান স্মিত হেসে প্রানেশার চোখ মুছে নিয়ে কপালে গাঢ় চুমু
খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো-
‘ইভানান আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতো যে মেয়ের নেশা মেয়ে দিয়ে কাটবে। প্রথমে আমি রেগে গেছিলাম। কিন্তু বন্ধুর উপর বিশ্বাস করে পরবর্তীতে রাজি হই। মেডিকেলে পড়াশোনা করে, ক্লাবে ড্রিংকস করার পরও যখন তোমাকে না পাওয়ার বিরহে কাতর হয়ে উঠতাম তখন ইভানান সুযোগের সৎ ব্যবহার করে আমার রুমে ক্লাবের একটা ড্যান্সারকে পাঠায়। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের অধিকারী। আমার মনে হয়েছিলো আমি হয়তো তোমার জ্বালানো আগুন নিভাতে সক্ষম হবো ৷ অথচ কাছে আসার পর আগুন যেনো আরও বেশি পুড়াতে শুরু করলো আমাকে। মেয়েটার পর আরও অনেক সুন্দর মেয়েকে আমার রুমে পাঠাতো ইভানান। কিন্তু কোনোভাবেই আমি ওদের খুব কাছে যেতে পারিনি। তোমার ভালোবাসা আমায় যেতে দেয়নি প্রাণ। ‘
প্রানেশার চোখ মুছে সুফিয়ান বললো-
‘বসো, সকালে বমি করে সব ফেলে দিয়েছো। খাবার খেয়ে আবার কেঁদো ‘
বলেই রসাত্মক হেঁসে খাবার আনতে চলে গেলো। প্রানেশা বিস্ময় নজরে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটা কতটা ত্যাগ করেছে তার জন্য। আর সে কিনা টেরও পায়নি। এত আঘাতের পরও তাকে ভালোবেসে যাচ্ছে! সুফিয়ান যে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তা ঢের ভালো করে জানে প্রানেশা। অথচ , সে যে ক্ষুদার্ত তা বলার আগেই জেনে গেছে সুফিয়ান। এত ভালোবাসা সবার কপালে জোটে না।
__________________
পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রানেশা। আজ তার থার্ড সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষা ছিলো।
সুফিয়ানের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিলো। ডক্টর বলেছে আর ১৫ দিন পরই ডেলিভারি ডেট। সবগুলো পরীক্ষার দিনই সুফিয়ান ঘন্টার পর ঘন্টা সব কামধাম ফেলে গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতো। অনেক সময় দেখা গেছে পারমিশন নিয়ে হুটহাট হলের ভিতর ঢুকে পরীক্ষার মাঝে প্রানেশাকে খাইয়ে দিয়ে আসতো। প্রানেশা এত মানুষের ভিতর লজ্জা পেয়ে সুফিয়ানকে আসতে মানা করতো। কিন্তু সুফিয়ান তো সুফিয়ানই! সে প্রানেশাকে কোনোরকম তোয়াক্কা না করে খাবার দাবার নিয়ে হাজির হতো৷
আজও সুফিয়ান সকালে দিয়ে গেছে। শেষ পরীক্ষায়ও সুফিয়ান চেয়েছিলো বাহিরে অপেক্ষা করতে। কিন্তু ইমার্জেন্সি থাকায় প্রানেশা নিজেই জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো৷ গত এক মাস যাবৎ সুফিয়ান প্রানেশাকে দেখাশোনার জন্য হসপিটালের কাজ থেকে বিরতিতে ছিলো।
সুফিয়ান কল করে বলেছে দশ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে। গার্ড পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু প্রানেশা বলেছে
তার প্রয়োজন নেই। গ্রীষ্মের ভস্ম করা গরম। উঁচু পেট ঢাকতে প্রানেশার গায়ে বড় শাল জড়ানো। গরমের সময়ে শালটা পড়ে আত্মা বের হওয়ার উপক্রম।
নাহ! আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মাথা ঘুরে আসছে। প্রানেশা পাশের চায়ের দোকানের ছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ালো৷ ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলো পানি খেয়ে মোবাইলটা বের করে সুফিয়ানকে আরেকবার কল করলো৷ হয়তো ব্যস্ত, তাই রিসিভ করছে না৷
আরেকটু অপেক্ষা করতে পাশের বেঞ্চে বসে পড়লো।
বিকেলে বৃষ্টি হবে হয়তো। এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখ ঢেকে বসে রইলো। গাড়ি থামার আওয়াজে মুখ তুললো। প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো সুফিয়ান৷ কিন্তু নাহ, গাড়ি তো এটা নয়। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ব্লু কোর্ট পরিহিত সুদর্শন যুবক। নীল চোখের স্বচ্ছ পানির ন্যায় চোখের পুরুষ। সামনের আরেকটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ছয়জন মুখোশ পড়া লোক ৷
সুদর্শন যুবকটি প্রানেশার বরাবর এসে দাঁড়ালো। প্রানেশা প্রথমে চিনতে না পারলেও পরবর্তীতে সুফিয়ানের বলা বর্ণনায় মিলে যাওয়ায় বুঝতে পারলো এটা ইভানান। শজারুর কাঁটার ন্যায় চুলগুলো পেছনের দিকে এলিয়ে রাখা৷ চলাচলের ভঙ্গি সুফিয়ানের সঙ্গে কিছুটা মিলে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়লো সে৷ প্রানেশা উঠে দাঁড়িয়ে ভীত মনে বললো-
‘কী চাই আপনার? এখানে কেনো এসেছেন? ‘
ইভানান ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফুটিয়ে প্রানেশার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো-
‘স্রোতস্বিনীর স্থান শুধু তার নীল পুরুষের বুকে ৷ নীল পুরুষ বেঁচে থাকতে স্রোতস্বিনী অন্য কারো বুকে বাসা কী করে বাঁধে!‘

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।