রাত দু’টো ছুঁই ছুঁই সদর হাসপাতালের সামনে দু’জন নারী লোক দাঁড়িয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নারীদ্বয় অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারিনী। হাসপাতাল কোয়ার্টারের ছাদ থেকে দৃশ্যটি দেখা মাত্রই ডক্টর প্রণয় চৌধুরী’র ওষ্ঠকোণে অসরল হাসির রেখা মিললো। দৃষ্টিজোড়া অজ্ঞাত নারীদ্বয়ের দিকে নিবদ্ধ রেখে ভ্রুজোড়া কুঁচকে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে বিরবির করে বললো,
– ‘আজকাল রাত গভীর হলে হাসপাতালের সামনেও আকাঙ্ক্ষাময়ী রমণীদের দেখা মেলে! ইন্টারেস্টিং।’
মিনিট কয়েক সময় অতিবাহিত হতেই প্রণয়ের কুঁচকানো ভ্রুজোড়া দিগুণ কুঁচকে গেলো। কারণ নারীদ্বয়ের সম্মুখে একটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে উপস্থিত হলো সবুর উদ্দিন। যিনি তার পিতার বাইজি গৃহের দাঁড়োয়ানের দায়িত্ব প্রাপ্ত রয়েছে। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রণয়। ভাবলো,
-‘ বাইজি গৃহে আজকাল রমণীদের অভাব পড়েছে নাকি যে সবুর উদ্দিন নারী দেহ খুঁজতে রাস্তায় নেমেছে? ‘
পরোক্ষণেই আরেক দফা বিস্মিত হলো তার দৃষ্টিজোড়া। বক্ষে বেড়ে গেলো তীব্র উত্তেজনা। যেই উত্তেজনাটুকু দমিয়ে রাখতে না পেরে ছুটে চললো নিচে। সে নিচে যেতে যেতেই অজ্ঞাত নারী দু’জন হাসপাতালের ভিতর থেকে একজন রোগাক্রান্ত নারী’কে নিয়ে পুনরায় গেটের সামনে এলো। ততোক্ষণে প্রণয়ও গেটের সামনে চলে গেলো। প্রণয় সবুর উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ‘গভীর রাতে রাস্তাঘাটে তোমার দেখা মিলছে,
বহু নারী’র গন্ধও তোমার আশপাশে কিলবিল করছে, ব্যাপারখানা কি সবুর উদ্দিন ধর্ম কর্ম সব গিলে খেলে নাকি? ‘
আঁতকে ওঠলো সবুর উদ্দিন। পা থেকে মাথা অবদি ভয়ংকর কম্পন সৃষ্টি হলো তার। বারকয়েক ঢোক গিলে একবার নারী লোকদের দিকে তো আরেকবার প্রণয়ের দিকে দৃষ্টি বুলাতে শুরু করলো। ভয়ে কুঁকড়ে গেলো নারী লোকগুলোও। কিন্তু পীড়িত নারীটি নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছিলোনা বিধায় দু’জন মিলে তাকে ভ্যানগাড়িতে শুইয়িয়ে দিলো। তারপর জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দু’জনই। তাদের একজন অপরজন’কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এ দৃশ্য দেখে বিরক্তি’তে চোখ মুখ কুঁচকে সবুর উদ্দিনের দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রণয়। প্রশ্ন করলো,
-‘ এরা কারা সবুর উদ্দিন আমার প্রশ্নের জবাব দাও।’
দু’হাত জোড় করে প্রণয় চৌধুরী’র পায়ে লুটিয়ে পড়লো সবুর উদ্দিন। বললো,
-‘ ক্ষমা করবেন জনাব এরা আপনার গৃহেরই সদস্য।’
-‘ আমার গৃহের? ‘
অবাকান্বিত স্বরে প্রশ্নটি করতেই সবুর উদ্দিন দাঁড়িয়ে থাকা নারীদ্বয়ের মধ্যে মধ্যবয়স্কা নারী এবং ভ্যানগাড়িতে শয্যায়িত নারীকে দেখিয়ে বললো,
-‘ উনি বাইজি গৃহের প্রধান বাইজি শারমিন শায়লা। আর উনি সহকারী বাইজি মান্নাত। ‘
সবুর উদ্দিনের কথা শেষ হওয়া মাত্রই প্রণয়ের মুখ বিকৃত রূপ ধারণ করলো। একরাশ ঘৃণা ছুঁড়ে তাকালো শারমিন বাইজি এবং মান্নাত বাইজির দিকে। শারমিন বাইজি প্রণয়ের অমন দৃষ্টি দেখে বুকে জড়িয়ে রাখা মেয়েটি’কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কারণ ইতিমধ্যেই ভয়ে মেয়েটি কাঁদতে শুরু করেছে। প্রণয় চৌধুরী এসব দৃশ্যে বিন্দু ভ্রুক্ষেপ করলো না কিন্তু ভ্যানগাড়িতে শুয়ে থাকা নারী’টির দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করলো,
-‘ সর্বক্ষণের জন্য পাঁচফোড়ন গৃহে চিকিৎসক রয়েছে। রয়েছে অগণিত সেবিকারা। যতোদূর জানি বাইজি গৃহের জন্যও আলাদা আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে
তবুও কেন এই নারী’কে এখানে নিয়ে আসা হলো? ‘
প্রণয় চৌধুরী’র এহেন হুংকারে শারমিন বাইজির বক্ষে চেপে রাখা কন্যাটির সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো কয়েক পল সময় নিয়ে নিজ বোধশক্তিও হারিয়ে ফেললো। পুরোপুরি দেহের ভার ছেড়ে দেওয়ায় শারমিন বাইজি আঁতকে ওঠলো মৃদু আর্তনাদ করে বললো,
-‘ নুর! ‘
সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাকালো সবুর উদ্দিন। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে তাকালো প্রণয়ও। দেখতে পেলো শারমিন বাইজি মাটিতে বসে পড়েছে। কোলে দেহের ভার ছেড়ে পড়ে আছে এতোক্ষণ সময় বক্ষে চেপে রাখা কন্যাটি। এবারে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লো প্রণয়। চোয়ালজোড়া শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-‘ এই কন্যাটির পরিচয় তুমি আমায় দাওনি সবুর উদ্দিন।’
কম্পিত কণ্ঠে সবুর উদ্দিন বললো,
-‘ ও শারমিন বাইজির কন্যা শাহিনুর শায়লা। ‘
-‘ সে কি বাইজি নয়? যদি বাইজি হয়ে থাকে তার নামের আগে পিছে বাইজি তকমা দেওয়া উচিৎ ছিলো।’
-‘ ওর বয়স ষোল হয়নি জনাব। ‘
নতজানু হয়ে উত্তর সবুর উদ্দিনের। এদিকে শারমিন বাইজি কেঁদে অস্থির। তার ক্রন্দনধ্বনি’তে প্রণয়ের সর্বাঙ্গে অগ্নিজ্বলে যাচ্ছে। অসহ্যের চরম সীমানায় পৌঁছে গিয়ে সবুর উদ্দিন’কে আদেশ করলো,
-‘ সবুর উদ্দিন পীড়িত নারীটিকে এই মূহুর্তে বাইজি গৃহে পৌঁছে দিয়ে আসবে। ‘
স্বস্তির সহিত ওঠে দাঁড়ালো সবুর উদ্দিন। শারমিন বাইজিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘ বুবুজান নুরের জ্ঞান কি ফিরছে? ‘
প্রণয় বললো,
-‘ উহুম সবুর উদ্দিন বুঝতে ভুল করেছো। আমি তোমাকে এবং এই নারী’কে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি। এই দুজন’কে নয়। তোমাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি এইজন্য যে বিশ মিনিটের মাথায় আমি আবার তোমাকে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই। ‘
-‘ কিন্তু জনাব ওদের কোন দোষ নাই। ‘
‘দোষ তোমারও নেই সবুর উদ্দিন কিন্তু ভুল তোমাদের প্রত্যেকের রয়েছে। আর সেই ভুল সম্পর্কে অবগত হওয়ার অধিকার আমার রয়েছে। আশা করি বুঝতে পেরেছো। ‘
মান্নাত বাইজি’কে নিয়ে পাঁচফোড়ন গৃহের উদ্দেশ্যে রওনা হলো সবুর উদ্দিন। সবুর উদ্দিন বিদায় হতেই প্রণয় চৌধুরী শারমিন বাইজিকে বললো,
-‘ শারমিন বাইজি নিজ কন্যাটিকে জাগানোর চেষ্টা করো। ‘
শারমিন বাইজি চারপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলালো। প্রণয় চৌধুরী তখনও গম্ভীর ভঙ্গিতে বিপরীত দিকে তাকিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শারমিন বাইজি বললো,
-‘ জনাব আপনি অনুমতি দিলে পানির ব্যবস্থা করতাম।’
প্রণয় চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তবুও একটিবার পিছু ফিরে চাইলো না। ভূমিতেই দেহ ভাসিয়ে শাহিনুর’কে শুইয়িয়ে দিলো শারমিন বাইজি। হাসপাতালের কোন সাইটে পাবলিক টিউবওয়েল রয়েছে জানেনা শারমিন। তবুও প্রণয় চৌধুরী’কে একটিবার প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখালো না সে। কারণ প্রণয় যে জমিদার পুত্র। জমিদারের পুত্ররা প্রশ্ন করার অধিকার রাখে কিন্তু কারো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনা। শাহিনুরের জ্ঞান ফিরেছে। উপস্থিত হয়েছে সবুর উদ্দিনও। প্রণয় চৌধুরীও আদেশ দিয়েছে তাকে অনুসরণ করার জন্য। তিনটে শঙ্কিত প্রাণ অত্যন্ত সচেতন হয়ে প্রণয়ের পিছু পিছু চলতে লাগলো। শাহিনুর নিচু গলায় ক্রমাগত মা’কে প্রশ্ন করতে থাকলো,
-‘ আম্মা কোথায় যাই আমরা? মান্নাত বুবু কই? আম্মা এই মন্দ লোক’টা কে? ‘
[২]
দোতালায় আলোকবিশিষ্ট একটি ঘরে প্রবেশ করলো প্রণয়। ঘরের মাঝবরাবর চতুর্ভূজাকৃতির একটি টেবিল এবং একটি চেয়ার ব্যতিত আর কিছু নেই। প্রণয় চৌধুরী তার সুগঠিত ভারবাহক দেহটি দৃঢ় চরণদ্বয় দ্বারা এগিয়ে নিয়ে সিংহাসনের ন্যায় চেয়ারটিতে বসলো। বাম পায়ের ওপর ডান পা তুলে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। সবুর উদ্দিন,শারমিন বাইজি,শাহিনূর তিনটে মাথাই নিচু হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তার সম্মুখে। প্রণয় চৌধুরী কয়েক পল চুপ থেকে আচমকাই টেলিফোন থেকে কাউকে কল করলো। বললো,
-‘ এক কাপ চা পাঠিয়ে দাও তো নিবির। ‘
তারপর টেলিফোন রেখে দৃঢ় চাহনিতে তাকালো সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানব-মানবীদের দিকে। পুরোপুরি আলোতে স্পষ্ট তিনটা মুখ দেখে দৃষ্টিজোড়া আর দৃঢ় রইলো না প্রণয়ের। গোলাপি রঙের জর্জেট শাড়ি পরিহিত শারমিন বাইজি। গলায়,কানে লাল,নীল পাথরের সংমিশ্রণের গয়না। দু’হাত ভর্তি কাঁচের চুরি। ভ্রুজোড়ার মধ্যবর্তী অংশে গোলাপি রঙের টিপ, ওষ্ঠজোড়া চকচকে গোলাপি আয়নার মতো ফুটে ওঠেছে গাঢ় গোলাপি রঙের লিপস্টিক দেওয়ার জন্য। চেহেরার চাকচিক্য দেখে বোঝাই যাচ্ছে যৌবন এখনো ফুরিয়ে যায়নি তার। যতকাল যৌবন আছে ততোকালই আকাঙ্ক্ষাময়ী নারীদের রাজত্ব চলবে। ভাবা মাত্রই পাশে থাকা পুষ্প মুকুলের দিকে নজর পড়লো তার। মূহর্তেই দৃষ্টিজোড়া সরিয়ে নিলো। বিরবির করে তাচ্ছিল্য সহকারে বললো,
-‘পুষ্পকুঁড়ি এই ছিন্নমূলে পরিণত হলো বলে! ‘
প্রণয় চৌধুরী’র দৃষ্টি’কে পরিচিত ঘৃণাত্মক দৃষ্টিতে মিলিয়ে নিয়ে শারমিন বাইজির অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠলো। শাহিনূরের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে উপরওয়ালার নিকট কেবল একটাই প্রার্থনা জানালো,
-‘ হে প্রভু রক্ষা করো, রক্ষা করো। ‘
প্রণয় চৌধুরী বললো,
-‘ সবুর উদ্দিন এবং শারমিন বাইজি সুস্পষ্টভাবে পুরো ঘটনার বিবৃতি করো। ‘
সবুর উদ্দিন, শারমিন বাইজি দু’জনেই ঢোক গিললো। শাহিনূর অবুঝের ন্যায় মা এবং সবুর উদ্দিনের দিকে তাকালো। কিন্তু সম্মুখে তাকানোর সাহস হয়ে ওঠলো না। দুনিয়া জুড়ে মন্দ পুরুষের বাস। কিছু সময় পূর্বে সম্মুখের মন্দ পুরুষটির হুংকারে হৃৎপিণ্ড ছিন্ন হতে নিয়েও হয়নি কিন্তু হুঁশ হারিয়েছে। না জানি এখন সম্মুখে তাকালে কোন প্রলয় ঘটে যায়! তার আম্মা বলেছে মন্দ মানুষ টা ঐ মন্দ বাড়িরই ছেলে। তাই মন্দ নজরে নজর না মেলানোই শ্রেয়।
শাহিনূর মনের সাথে মনের আলোচনাতে ব্যস্ত। এদিকে সবুর উদ্দিন শঙ্কিত কন্ঠে বললো,
-‘ মান্নাত বাইজি গর্ভবতী ছিলো জনাব তাই গোপনভাবে গর্ভপাত করাতে এই হাসপাতালে নিয়া আসছি। জমিদার বাড়ির কোন চিকিৎসক এই খবর জানলে কেলেংকারী ঘটে যাবে। ‘
চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে ওঠলো প্রণয়ের। ক্ষোভে ফেটে পড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-‘ বাচ্চা’টা কার? ‘
ভয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো সবুর উদ্দিন। বললো,
-‘ মাফ করুন জনাব এ কথা আমি বলতে পারবো না। ‘
-‘ কাল সকাল দেখার আশা আছে সবুর উদ্দিন? ‘
প্রণয়ের মুখে এহেন বাক্য শুনে কেঁপে ওঠলো শারমিন বাইজি। অনবরত কাঁপতে থাকলো শাহিনূরও। কিন্তু শারমিন নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিয়ে অত্যন্ত সাহসীকতার সঙ্গে জবাব দিলো,
-‘ নিজ ঘরের কুকীর্তি শুনে হজম করতে পারবেন তো জনাব? ‘
শারমিনের মুখে এমন অকপট জবাবের সঙ্গে প্রশ্ন শুনে চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো প্রণয়ের। দু’হাত সর্বচ্চ শক্তি দিয়ে মুঠোবন্দি করে নিয়ে বললো,
-‘ সোজাসাপ্টা জবাব দাও বাইজি কে এই সন্তানের বাবা? ‘
-‘ নামটা না হয় আড়ালেই থাকুক তবে নিশ্চিত থাকুন জনাব অলিওর চৌধুরী’র বংশধরেরই বিনাশ ঘটেছে। ‘
ললাট বেয়ে ঘাম ঝড়তে শুরু করলো প্রণয়ের। আফসোসের সুরে বললো,
-‘ এক বাইজির গর্ভে জমিদারের অংশের শেষ পরিণতি এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে! শারমিন বাইজি নিঃশ্বেষ হয়ে যাওয়া ঐ অংশটুকুর পিতৃ পরিচয় জানিয়ে বিদায় হও। ‘
[৩]
শহরের অভ্যন্তরেই বসবাস জমিদার অলিওর চৌধুরীর। তিনি পাঁচ পুত্রের জনক। তার দ্বিতীয় স্ত্রী প্রেরণার গর্ভের সন্তান পল্লব চৌধুরী, পলাশ চৌধুরী, প্রণয় চৌধুরী, অঙ্গন এবং রঙ্গন চৌধুরী। তার প্রথম স্ত্রী’র নাম অরুণা চৌধুরী। প্রথম স্ত্রী অরুণা সন্তান ধারণে অক্ষম ছিলেন তাই খালাতো বোন প্রেরণার সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক পরবর্তী’তে বৈবাহিক সম্পর্কে রূপ নেয়। বিয়ের দশবছরের ব্যবধানেই পাঁচ পুত্রের জনক জননী হয় অলিওর এবং প্রেরণা চৌধুরী। পাঁচ পুত্র’কে নিয়ে গর্ভধারিণী প্রেরণার থেকেও বেশী উল্লসিত ছিলো অরুণা৷ তাই অলিওরের কাছে পঞ্চ পুত্র নিয়ে তার প্রথম আবদার ছিলো তাদের প্রধান এই গৃহটি পঞ্চ ভাই’কে উপহার সরূপ লিখে দিতে এবং জমিদার বাড়িটির নামকরণ করতে হবে – “পাঁচফোড়ন গৃহ” । জমিদারের এই পাঁচ পুত্র ঠিক পাঁচ প্রকার মশলার মতোই। জিরা,কালোজিরা, মেথি,মৌরি ও রাঁধুনির সংমিশ্রণে যেমন তৈরি হয়েছে পাঁচফোড়ন মশলা। ঠিক তেমনি অলিওর চৌধুরী’র পঞ্চ পুত্রের মিশ্রণে তৈরি “পাঁচফোড়ন গৃহ” যারা একই গর্ভ থেকে জন্মানো সত্ত্বেও প্রত্যেকে ভিন্ন স্বভাবের অধিকারী। জমিদার অলিওর চৌধুরী যেমন সম্পদশালী ঠিক তেমনি বদমেজাজি। তার দুই সহধর্মিণী ভীষণ শান্তশিষ্ট এবং ধৈর্য্যশীল। কিন্তু তার পুত্র’রা একেকটা ঠিক একেক ধাচের। মিল কেবল একদিকেই রয়েছে পঞ্চ ভাই’ই ভীষণ রহস্যময় এবং দুর্বৃত্ত চরিত্রের অধিকারী। এই পঞ্চ ভাইদের মধ্যে পাঁচফোড়ন গৃহের বাইরে রয়েছে একজনই সে হলো প্রণয় চৌধুরী। যিনি বাবার বিরাট রাজত্বের তোয়াক্কা না করে পড়াশোনায় সফলতা বয়ে এনে একই শহরের একটি সরকারি হাসপাতালে এমবিবিএস ডাক্তার হিসেবে কর্মরত রয়েছে। কোথায় বাবার রাজত্বের টান কোথায় বাবার বাইজি গৃহে নারী দেহের টান? কোন কিছুরই টান অনুভব করেনা সে কেবল মস্তিষ্কের উপরিভাগে মাতৃ হস্তের স্নেহ,ললাটে মাতৃ ওষ্ঠের চুম্বন ছাড়া।
হাসপাতাল থেকে কোয়াটারে ফিরতেই বিছানায় অঙ্গন’কে দেখতে পেলো প্রণয়। বললো,
-‘ কখন এলি? ‘
শোয়া থেকে ওঠে বসলো অঙ্গন। ওষ্ঠকোণে দুর্বৃত্ত হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,
-‘ আমি দুপুরে সে এসেছে বিকালে।’
অঙ্গনের চোখের ইশারায় বা দিকে ঘাড় ঘোরালো প্রণয়। রোমানাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-‘ রোমানা! কবে এলে? ‘
বারান্দা থেকেই গুটিগুটি পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো রোমানা। অভিমানী সুরে বললো,
-‘ দু’দিন আগে এসেছি গতকাল তোমার বাড়ি ফেরার কথা ছিলো প্রণয় কেন তুমি ফেরোনি? ‘
গায়ে জড়ানো কোর্ট খুলতে খুলতে গম্ভীর কন্ঠে প্রণয় বললো,
-‘ এই প্রাপ্তিটুকুর জন্যই। ‘
প্রণয়ের ওষ্ঠকোণে গুরুগম্ভীর বাঁকা হাসি দেখতে পেয়ে বক্ষস্থলে শীতল স্রোত বেয়ে গেলো রোমানার। গায়ে পরিহিত শুভ্র শাড়িটির আঁচলখানা খামচে ধরে দন্ত দ্বারা নিজের অধরে কামড়াতে শুরু করলো ক্রমাগত। প্রণয় অঙ্গনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ডায়েরি লিখতে ব্যস্ত তাই ধীরপায়ে রোমানার দিকে এগিয়ে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বললো,
-‘ তোমার দাঁতগুলো আমি তুলে নেবো রোমানা। আমার কাজ এরা কেন করছে বলতে পারো? তোমার কোমল ওষ্ঠজোড়া আমার দাঁত দ্বারাই দংশন হবে এ’কি জানোনা?’
Leave a comment