বাইজি কন্যা | পর্ব – ১১

10 Min Read
বাইজি কন্যা

অতি আদরে শাহিনুর’কে নিজ বক্ষে চেপে ধরলো প্রণয়৷ দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে হাঁটা ধরলো নির্দিষ্ট একটি স্থানের উদ্দেশ্যে। কোয়াটার থেকে বেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় বিরতিহীন চলছে সে। নিস্তব্ধ রাত, চারদিকের স্বল্প আলোয় বিশাল দেহের অধিকারী মানুষ’টা কোলে এক ছোট্ট কিশোরী’কে নিয়ে আপনমনে হেঁটে চলেছে। অধরে তার কুটিল হাসি,সুক্ষ্ম দৃষ্টি’জোড়ায় আকাশসম রহস্য। পরিবেশে গা থমথমে এক ভাব। দু’টো মানুষের ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ, একজোড়া সুক্ষ্ম পদধ্বনি ব্যতিত আর কোন শব্দের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না৷ নিস্তব্ধ রাস্তায় গুরুগম্ভীর পদধ্বনি,ক্রমশ দু’টো মানব-মানবীর নিঃশ্বাসের উত্থান-পতন পরিবেশটা’কে দ্বিগুণ থমথমে করে তুললো। নিবিড় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন শাহিনুর এসবের কিছুই টের পেলো না৷ পেলে হয়তো ঐ অবস্থাতেই মূর্ছা ধরতো। তার সে মূর্ছনায় বিরক্ত হয়ে হয়তো চোখ,মুখ কুঁচকে ফেলতো প্রণয়। কিন্তু সেটুকু টের পেতোনা শাহিনুর। সে যে কিছুই টের পায় না৷ বিশাল পৃথিবী’তে বিশাল অনুভূতি’তে আচ্ছন্ন এই কিশোরী কবে টের পাবে সবটা?

প্রণয়ের বিশ্বস্ত ড্রাইভার কোয়াটার থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রণয় সেখানে উপস্থিত হতেই ড্রাইভার মেরাজুল হক মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে গেলো। প্রণয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে শাহিনুর’কে পাশের সিটে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো। আর নিজে বসে পড়লো ড্রাইভিং সিটে। শীতার্ত রজনী, পাশে অতি সুদর্শনীয়,মনোহারিণী এক কিশোরী,বক্ষঃস্থলে নিদারুণ এক যন্ত্রণা, সবমিলিয়ে এমন অনুভূতি তৈরি হয়েছে যা বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। এমন’ই অনুভূতি’তে সিক্ত প্রণয়। বেশ ধীরগতিতেই ড্রাইভ করতে শুরু করলো সে। অকস্মাৎ মাঝপথে থেমে থেমে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেও শাহিনুরকে। গভীর রজনী, অন্ধকারাচ্ছন্ন ফাঁকা একটি রাস্তা, পাশে অল্পবয়সী অতি সুদর্শনীয় এক কিশোরী। ভাবতেই আনমনে হেসে ওঠলো প্রণয় চৌধুরী। আজ যদি রঙ্গন শাহিনুর’কে এভাবে তার কাছে না নিয়ে আসতো, আর সে যদি কুটিলতা না করতো এই মূহুর্ত’টা কি উপভোগ করতে পারতো? যতোই সে ব্যতিক্রম স্বভাবের হোক জমিদারের রক্ত বইছে তার শরীরে। আর সকলে যেমন কুটিল বুদ্ধি দিয়ে বহু নারী’র সংস্পর্শ লাভ করে তেমনি কুটিল বুদ্ধি দিয়ে সে এই এক নারী’র সংস্পর্শই লাভ করবে।
কিন্তু ভাই’টা কি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে? নারী লোভ যে বড়ো ভয়ংকর লোভ। আর এই নারী’তে শুধু তার এক ভাই নয় অঙ্গন বাদে সব ভাই’ই আকৃষ্ট!

বাইজি গৃহের সামনে গাড়ি থামালো প্রণয়৷ চোখজোড়া বন্ধ করে বার কয়েক নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। তারপর আচমকাই চোখ খুললো। তাকালো শাহিনুরের মুখপানে। শাহিনুরের ঢেউ খেলানো চুলগুলো অর্ধেক শরীর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কপালজুড়ে লেপ্টে রয়েছে ছোট ছোট ঢেউ খেলানো চুল। প্রণয় হাত বাড়িয়ে আলতো ছুঁয়ে দিলো কপালের লেপ্টে থাকা চুলগুলোতে। খানিকটা ঝুঁকে শাহিনুরের পুরো মুখশ্রী’তে অদ্ভুত চাহনি নিক্ষেপ করলো৷ দু’চোখের ঘনপাপড়ি,তড়তড়া নাক,কোমল মসৃন ওষ্ঠজোড়ায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসলো। সব শেষে থুতনির মঝের গর্তটায় বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে বেশ শব্দ করেই হাসলো। বিরবির করে বললো,
-‘ চারদিকে অগণিত অপবিত্র স্পর্শ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য নুর, সেই অপবিত্র স্পর্শগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলে আমার স্পর্শ তোমায় হাসিমুখে বরণ করতে হবে। কিন্তু সেটা পবিত্রভাবে নাকি অপবিত্রভাবে এটা পুরোপুরিই তোমার ওপর নির্ভর করবে। ‘
গাড়ির দরজা খুলে নামতে যেয়েও থেমে গেলো প্রণয়। আবার পিছু ঘুরে শাহিনুরে’র দিকে ঝুঁকে বিরবির করেই বললো,
-‘ এটা’কে কি বলে আখ্যা দেবে নুর ? তুমি খুব বোকা, আমি ভালোবাসার মতো ভালোবাসা দেবো। বোকাপ্রাণী’রা ভালোবাসা বুঝেনা। তুমিও বুঝবে না,বাট আই ডোন্ট কেয়ার। তোমার এই অতিশয় সৌন্দর্যের ভাগ আমি কাউকে দেবো না। রূপবতী নারী’দের জীবনসঙ্গী, শয্যাসঙ্গী আমার মতোন ইতর হবে এটাই স্বাভাবিক। তোমার জন্য আমি এক ইতর প্রাণী আমার জন্য তুমি এক বোকাপ্রাণী।
কথাগুলো বলে বাঁকা হাসলো প্রণয়। শাহিনুরের গালে আলতো ছুঁয়ে আবার বললো,
-‘ বোকা মেয়ে। রঙ্গন নয় প্রণয় তোমার ভবিতব্য! তাই রঙ্গন’কে নয় প্রণয়’কে ভরসা করতে শেখো। আজ বেরিয়েছো ওর হাত ধরে আর ফিরেছো আমার বক্ষেচেপে। এখানেই প্রমাণিত হাতে নয় বুকে থাকতে হবে তোমায় মিস শাহিনুর শায়লা…’

রাতের শেষ ভাগ ঘরের এক কোণে হারিকেনের আলো জ্বলছে। দরজার কাছে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে মান্নাত। শাহিনুর’কে না পেয়ে দিশেহারা সে। দরজার বাইরে উন্মুখ হয়ে বসে আছে শারমিন। অনেকটা সময় ধরে সে শারমিন’কে বোঝাচ্ছে শাহিনুর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে। সে যেনো ফিরে যায়৷ কিন্তু শারমিন ফিরে যায়নি। বার বার দরজা খুলতে বলছে। শারমিন যতোবার দরজা খুলতে বলছে ততোবার মান্নাত ভীতি স্বরে বলছে,
-‘ সখী নুর ঘুমাই গেছে তুমিও ঘুমাও গিয়ে। ‘
শারমিন, মান্নাতের এমন কার্যক্রমের মধ্যেই অতি সতর্কতা অবলম্বন করে মই বেয়ে জানালা টপকে ঘরে প্রবেশ করলো প্রণয়। নিঃশব্দে শাহিনুর’কে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে চলে আসার জন্য উদ্যত হলো। কিন্তু অন্তঃকোণে গভীর পীড়া শুরু হয়ে গেলো। হতবুদ্ধি হয়ে অকস্মাৎ আক্রমণ করলো শাহিনুর’কে। আক্রমণটি এমনই যে একটা নয় দু’টো নয় নিজের সুঠাম,শক্তিশালী হস্তদ্বারা শাহিনুরের কেশগুচ্ছ থেকে তিনটা চুল ছিঁড়ে ফেললো। যদিও বুঝে, শুনে গণনা করে এই কার্য সে সম্পাদন করেনি। তবুও পৈশাচিক আনন্দ পেলো সে। ব্যথা পেয়ে ঘুমের ঘোরেই ‘ওহ’ সূচক শব্দ করলো শাহিনুর। চমকে গেলো মান্নাত! ভূত ভূত বলে চেঁচিয়েও ওঠলো। প্রণয় আর অপেক্ষা করলো না ত্বরিতগতিতে জানালা থেকে এক লাফে নিচে নেমে পড়লো। মূহুর্তেই কি ঘটে গেলো কিছুই বুঝতে পারলো না মান্নাত৷ তবে কোন কিছুই যে স্বাভাবিক নেই খুব টের পেলো। তবে যাই ঘটুক না কেন আগে নিজে বুঝবে এবং পরে শারমিন’কে অবগত করবে এটুকুন ভেবে
শঙ্কিত হয়ে দরজা খুলে দিলো। শারমিন ধাতস্থ হয়ে ঘরে ঢুকে দেখলো পুরো শরীরে শাড়ি পেঁচিয়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে শাহিনুর৷ শারমিন ভীতিগ্রস্ত মান্নাত’কে বললো,
-‘ মাথা কি গেছে তোর ভূত ভূত করছিস কেন? আর ওকে ওষুধ লাগিয়ে শাড়িটা ঠিকভাবেও পরাসনি। তুই এতোক্ষণ কি করলি তাহলে। কোন জগতে ছিলি বলবি? ‘
প্রচন্ড রেগে গিয়ে শাহিনুর’কে শাড়ি পরিয়ে দিতে দিতে বললো শারমিন। মান্নাত এক ঢোক গিলে ওষুধের বাটিটা আড়াল করলো। জোর পূর্বক হেসে শাহিনুরের দিকে গভীরভাবে চোখ বুলিয়ে বললো,
-‘ আসলে আমার খুব ঘুম পাইছে। তুমিতো জানো অতিরিক্ত ঘুম পেলে আমি এমন আবল তাবল বকি।’
শারমিন চিন্তিত স্বরে বললো,
-‘ ওহ তুই তাহলে যা আমি ওর কাছে আছি,ঘুমা গিয়ে। ‘
পরেরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো শাহিনুরের৷ মায়ের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। কারণ সে ঘুম থেকে ওঠার পূর্বেই চলে গেছে শারমিন। কিন্তু শাহিনুর ভাবছে সে কি করে বাইজি গৃহে এলো? সে বাঁশিওয়ালার সাথে খরখরে স্বভাবের মানুষ’টার কাছে গিয়েছিলো। তারপর তারপর কি হলো? একমনে গতরাতের কথা স্মরণ করতে শুরু করলো শাহিনুর৷ কিন্তু কিছুই বোধগম্য হলো না তার। তাহলে কি এটা তার স্বপ্ন ছিলো! জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘন বনের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। এমন সময় ঘরে এলো মান্নাত। বললো,
-‘ নুর কাল রাতে কোথায় গিয়েছিলি তুই? ‘
কেঁপে ওঠলো শাহিনুর। সমানতালে ঢোক গিলতে গিলতে বললো,
-‘ কই কোথাও না তো, বুবু তুমি আম্মা’কে কিছু বলোনা পায়ে পড়ি তোমার। ‘
কেঁদে ফেললো শাহিনুর। মান্নাত আশ্চর্য হয়ে শাহিনুরের দু’কাঁধ চেপে ধরলো। বললো,
-‘ নুর কি হয়েছে? ঐ লোকটা কে ছিলো? তোকে ঘুমন্ত অবস্থায় কে দিয়ে গেলো কাল? কোথায় ছিলি তুই? ‘
মান্নাতের কথা শুনে শাহিনুর ভাবলো কাল সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো আর বাঁশিওয়ালা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এখানে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। তাই কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-‘ জমিদার পুত্র বাঁশিওয়ালা। ‘
সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো মান্নাতের৷ শাহিনুরের দিকে বড়ো বড়ো করে চেয়ে বললো,
-‘ কি বলছিস এসব! ‘
শাহিনুর’কে চাপ দিয়ে সমস্ত কথাই শুনলো মান্নাত। সবটা শুনে থমকে গেলো সে। তার মতোই ভুলপথে পা বাড়াচ্ছে শাহিনুর। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অভিশপ্ত গৃহ থেকে বের করতে হবে নুর’কে। শারমিন’কে এসব জানালে নিজ হাতে খুন করবে মেয়ে’কে। তাই সবটা চেপে গিয়ে নুর’কে এখান থেকে দূরে সরানোর জন্য শারমিন’কে আশকারা দিতে হবে। ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ছাড়লো মান্নাত৷ আচমকাই শাহিনুর’কে জড়িয়ে ধরে কম্পিত কন্ঠে বললো,
-‘ নুর, বাঘ কখনো বাঘ মারে না, কুকুর কখনো কুকুর মারে না কিন্তু মানুষ, মানুষ মারে। ‘
কিছুই বুঝলো না শাহিনুর। বললো,
-‘ এই কথার মানে কি বুবু? ‘
এমন সময় ঘরে ঢুকলো শারমিন। তার বলা কথাগুলোই মান্নাত নুর’কে বলছে। কিন্তু নুর’তো এতো কঠিন কথা বুঝবে না। তাকে সহজ ভাবে বোঝাতে হবে। তাই মুচকি হেসে সে বললো,
-‘ নুর মনে আছে সেদিন বললাম, ঢাকা শহরের এক পরিবারে ছেলের হাতে বাবা খুন হয়েছে। এমনই অনেক মানুষই মানুষ খুন করে। কিন্তু ভেবে দেখো একটি কুকুর আরেকটা কুকুর’কে খুন করতে পারেনা। একটি বাঘও আরেকটি বাঘ’কে খুন করে না৷ পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও শুনতে পাওয়া যায়নি একই জাতির পশুদের মধ্যে রক্তারক্তি ঘটনা ঘটেছে বা এক প্রাণী দ্বারা একই শ্রেণীর অপর প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে। বাঘ কখনো বাঘ’কে মারে না। কুকুর কখনো কুকুর’কে মারে না। কিন্তু মানুষ, মানুষ’কে মারে। মানুষে মানুষে মারামারি, কাটাকাটি,খুনাখুনি হয়। পৃথিবী’টা বড়োই অদ্ভুত’রে মা। এখানে বোধ প্রাণী’রাই নির্বোধ। নির্বোধ প্রাণীরাই দারুণ বোধ শক্তির অধিকারী।’

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।