শিশুকালে সন্তান যখন প্রাকৃতিকভাবে জামাকাপড় নোংরা করে মা বিনা দ্বিধায় তা পরিষ্কার করে। নিজ সন্তান’কে সকল নোংরা থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। তেমনি সন্তান যতোই বড়ো হোক মা সব সময় নিজ সন্তান’কে পৃথিবীর সকল নোংরা থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। শারমিন বাইজিও এর বাইরে নয়। সেও তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে শাহিনুর’কে সকল নোংরা মানুষ’জন থেকে মুক্ত রাখতে। একদিকে মা চাচ্ছে মেয়ে’কে নোংরা জল যেনো স্পর্শ করতে না পারে। অপরদিকে সেই নোংরা জল পান করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে মেয়ে। একজন সন্তানের পক্ষে মায়ের মন’কে ফাঁকি দেওয়া খুবই কঠিন। শারমিন ইদানীং বেশ লক্ষ করছে শাহিনুর’কে। তাছাড়া মান্নাতও কিছু একটার আভাস দিয়েছে। যতোদ্রুত সম্ভব শাহিনুর’কে এখান থেকে দূরে পাঠাতে বলেছে। শারমিনের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক পুরোটা ধরতে না পারলেও খানিকটা আঁচ পেয়েছে। কিন্তু বিপরীতে কে আছে তা বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু শারমিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাহিনুরের গোপন কক্ষটি পরিবর্তন করবে৷ শুক্রবার থাকাতে আজো অলিওর চৌধুরী, পল্লব চৌধুরী, পলাশ চৌধুরী বাইজি গৃহে এসেছে। বাইজি গৃহের সর্বোচ্চ বৃহৎ কক্ষের রঙ্গমঞ্চে নৃত্য প্রদর্শন করছে বাইজি’রা৷ দু’ভাই ডিভানে আধশোয়া হয়ে প্রমত্তকর রস পান করছে। তাদের কামনীয় দৃষ্টিজোড়া নিবদ্ধ বাইজি’দের উন্মুক্ত কোমড়ের ভাঁজে ভাঁজে। পলাশ চৌধুরী’র আদেশে আজ নর্তকী’র বেশে তার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে মান্নাত বাইজিও। কিন্তু মান্নাত বাইজি সকলের সামনে উপস্থিত হওয়ার মিনিট, দুয়েক পরেই পলাশ চৌধুরী ওঠে দাঁড়ালো। গণ্ডস্থলের কিঞ্চিৎ নিচে পাঞ্জাবির পরপর তিনটে বোতাম খোলা পলাশের। শ্যামবর্ণ গলায় স্বর্ণের চিকন হার চকচক করছে। পুরুষ’দের স্বর্ণ পরতে নেই। তাদের জন্য এটা হারাম। হারাম জিনিসগুলোই নিজেদের মধ্যে ধারণ করা যেনো নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে জমিদার পুত্রদের। এক পা, দু’পা করে এগুতে এগুতে একদম মান্নাতের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো পলাশ। আচমকাই চরণদ্বয় থেমে গেলো মান্নাতের , থেমে গেলো ঘুঙুরের আওয়াজও। বক্ষঃস্থলে শুরু হলো তাণ্ডব। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে আবারো নৃত্য শুরু করতে উদ্যত হলো মান্নাত কিন্তু পলাশের স্পর্শে থেমে গেলো সে। পলাশের কন্ঠস্বরে রুদ্ধ হয়ে আসলো তার শ্বাসনালী।
-‘ তোমাকে এভাবে আমার ঠিক পুষায় না মান্নাত। ‘
বিকৃত সুরে হেসে ওঠলো পল্লব চৌধুরী। হেসে ওঠলো উপস্থিত বাকি সকলেই, নিঃশব্দে কেঁদে ওঠলো মান্নাত৷ কারণ সে জানে আজ আবার পলাশ চৌধুরী’র কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হবে । হে সৃষ্টিকর্তা কাউ’কে ভালোবাসার শাস্তি এতো প্রখর হয় কেন?
প্রধান বাইজি কক্ষের ডিভানে বসে আছে অলিওর চৌধুরী। প্রধান বাইজি শারমিন তার সম্মুখেই মেঝেতে হাঁটু মুড়িয়ে বসে আছে। অলিওর চৌধুরী একধ্যানে তাকিয়ে দেখছে শারমিন’কে। শারমিনও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া নিক্ষেপ করে ঠাঁই বসে আছে। অনুমান করা যায় অলিওর চৌধুরী’র বয়স ষাট ছুঁয়েছে তবুও মনে রঙ কমেনি। এই যে বিশাল সাম্রাজ্য,দুই পত্মী,পাঁচ পুত্রদের একদিকে ঠেলে নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে বাইজি গৃহে আসে,শারমিন’কে আত্মাভরে দেখে, একটু ভালোবাসা ভিক্ষা চায়, এই বয়সে এসে জমিদারের কি এসব মানায়? বেহায়া,নির্লজ্জ জমিদার তবুও থামে না, ক্লান্ত হয় না, মানে লাগেনা একটুও। শারমিন বরাবরের মতোই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া দিয়ে শাসিয়ে যাচ্ছে অলিওর’কে। অলিওর তা সাদরে গ্রহণ করেও নিচ্ছে। যা তার মুচকি হাসিতেই টের পাচ্ছে শারমিন৷ কিন্তু অলিওরের এই হাসিটুকু বেশীক্ষণ টিকতে দিলো না৷ বললো,
-‘ ছোট ভাই’য়ের বউ’কে এভাবে আর কতো দেখবেন জমিদার সাহেব। ‘
আকস্মাৎ কেঁপে ওঠলো অলিওর চৌধুরী। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে ক্রুদ্ধ সুরে বললো,
-‘ নিজেকে ঐ বিশ্বাসঘাতকের বউ বলতে কষ্ট হয় না,ঘৃণা লাগে না ? আমার তো শুনতেই কষ্ট হয়, খুব ঘৃণা লাগে। ‘
বুকের ভিতর পাথরচাপা দিয়ে কথাগুলো হজম করলো শারমিন। অলিওরের দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-‘ বিশ্বাস করো জমিদার, খুব কষ্ট হয় কিন্তু ঘৃণা হয় হয় না। কারণ মানুষ’টা আমার সন্তানের জন্মদাতা।
এটাও বিশ্বাস করো যদি কোন দিন জানতে পারি আমার সন্তানের বাবা নিরপরাধ ছিলো,আমার সন্তানের বাবা কোন ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছিল সেদিন তুমি বুঝবে এই শারমিন বাইজি কতোটা নৃশংস। ‘
-‘ শারমিন!’
অলিওর চৌধুরী’র মৃদু ধমকে তাচ্ছিল্য হেসে শারমিন বললো,
-‘ তখন খুব ছোট ছিলাম জমিদার, এতো জটিলতা বুঝতাম না। বড়ো আফসোস হয় তখন যদি আজকের আমিটা থাকতাম। ‘
-‘ শেষকালে এসে এটুকুই আমার প্রাপ্য? ‘
-‘ জমিদার সাহেব, নুরের বাবার দেওয়া বিবাহবিচ্ছেদ পত্র তুমি এখনো আমায় দেখাওনি। তখনকার শারমিন আর এখানকার শারমিনের মাঝে বিস্তর ফারাক। তাই ঐ কাগজখানা তুমি আমাকে দেখার সুযোগ করে দাও। কথা দিচ্ছি ভালোবাসতে না পারি আজীবন আমার অন্তরে তোমার জন্য সম্মানীয় স্থান বরাদ্দ থাকবে। ‘
শারমিনের জালে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে ওঠে দাঁড়ালো অলিওর৷ দু’হাত শক্ত মুঠ করে কঠিন কন্ঠে জবাব দিলো,
-‘ তোমার মনে সন্দেহ ঢুকেছে শারমিন এই সন্দেহটুকু দূর করো অপরাধী’কে অপরাধী হিসেবেই বিশ্বাস করো তবেই মঙ্গল। ‘
অলিওরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো শারমিন। অলিওরের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ যদি সে অপরাধী হয় তার অপরাধ গুলো আমি আবার ঘেটে দেখতে চাই। তোমার সমস্যা কি জমিদার? ‘
-‘ কারণ আমি চাইনা আমি ব্যতিত তুমি অন্য কোন পুরুষ’কে নিয়ে ব্যস্ত থাকো। ‘
-‘ হাসালে জমিদার। ‘
এটুকু বলে আচমকাই অলিওরের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলো শারমিন। রণমুর্তি ধারন করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-‘ পাপ বাপ’কেও ছাড়ে না জমিদার! তুমি যদি পাপ করে থাকো শাস্তি তুমিও পাবে। ‘
মুচকি হাসলো অলিওর শারমিনের একটি হাতে নিজের হাত স্পর্শ করে বললো,
-‘ এতোগুলো বছরে না তোমার রূপ কমেছে আর না কমেছে ত্যাজ। ‘
রাগে ফুঁসতে শুরু করলো শারমিন৷ অলিওরের কলার ছেড়ে পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো৷ অলিওর পাশে দাঁড়িয়ে একহাত শারমিনের মাথায় রেখে মৃদু কন্ঠে বললো,
-‘ শান্ত হও শারমিন। ভুলার চেষ্টা করো অতীত’টাকে। মনে রেখো তোমার কোন অতীত নেই কিন্তু বর্তমান আছে, ভবিষ্যৎ আছে। তোমার বর্তমানও আমি ভবিষ্যৎও আমি। তোমার ভালোবাসা এখন আর চাইনা কিন্তু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মূহুর্তে তোমাকে পাশে চাই। ‘
নিজের বক্তব্য শেষ করে কক্ষ ত্যাগ করলো অলিওর৷ মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো শারমিন৷ কি করে অতীত ভুলবে সে? কি করে? অতীত ভুলতে গেলে যে নুরের অস্তিত্বটুকুও বিলীন করতে হবে! বক্ষঃস্থলে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে শারমিনের। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মানুষ টা যদি আজ দুনিয়া’তে থাকতো ঠিক সত্যির নাগাল পেতো সে। কিন্তু মানুষ টা যে নেই। কি ঘটেছিলো সেদিন। পুরো দুনিয়া সেদিন শাহিনের বিপক্ষে ছিলো, শাহিন কি নিজের পাশে শারমিন’কে আশা করেছিলো? সেদিনের ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা হাজারোবার স্মরণ করলো শারমিন৷ সেসবে খুঁজে পেলো অসংখ্য সন্দেহজনক ঘটনা৷ কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় শাহিন কেন শারমিন’কে মুখ ফুটে একটি বার বলেনি সে নিরপরাধ। তার কোন দোষ নেই। কেন বললো না? নাকি সে শারমিনের চোখে অবিশ্বাসের ছাপ দেখেছিলো? এটুকু ভাবতেই দু’হাতে মুখ চেপে কাঁদতে শুরু করলো শারমিন। যদি তার দ্বারা সত্যি ভুল হয়ে যায় কোন দিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না৷ এক মন বলছে হোক প্রমাণ শাহিন নির্দোষ। আরেক মন বলছে শাহিন নির্দোষ প্রমাণিত হলে নিজেকে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না তার। কারণ শাহিনুর কোনদিন ক্ষমা করবে না তাকে৷ আবার ভাবলো,
নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শাহিনুরের বাবাকে নিরপরাধ হিসেবে জানা। বহুবছর আগের সেই ঘটনা,পর্দার আড়ালে থাকা সেই সত্যি এক অলিওর ছাড়া কেউ জানেনা। এটা শারমিনের দৃঢ় বিশ্বাস৷ এতোগুলো বছরে অলিওর সম্পর্কে, জমিদার বাড়ি সম্পর্কে বেশ সুক্ষ্ম ধারণা তৈরি হয়েছে, সেই ধারণা থেকেই অনুসন্ধান করবে শারমিন৷ আফসোস একটাই যাকে ঘিরে এই অনুসন্ধান সে মানুষ’টাই আর পৃথিবীতে নেই। আচ্ছা মানুষ’টা কি অভিমানেই ফুরিয়ে গেলো!
Leave a comment