বাইজি কন্যা | পর্ব – ২১

10 Min Read
বাইজি কন্যা

একমাস পর – পাঁচফোড়ন গৃহে এখন চরম বিপর্যস্ত অবস্থা। রোজ নিয়ম করে কোলাহল শুনতে পাওয়া যায়, কখনো কখনো জমিদারের ছোট গিন্নির ক্রন্দনধ্বনিও শুনতে পাওয়া যায় সুস্পষ্টভাবে। তার আহাজারিতে ব্যথিত হয় সকল মা’য়ের মন। কখনো অঙ্গনের ভাঙচুর, চিৎকার, চেঁচামেচি,কখনো বা হাহাকার ভেসে বেড়ায় গৃহের আনাচে-কানাচে। আবার কখনো পলাশ চৌধুরী’র অশ্রাব্য গালিগালাজও শোনা যায়। ছোট ভাইয়ের করুণ দশায় তার মাঝে বিন্দু পরিমাণ আফসোস তো খুঁজে পাওয়াই যায় না৷ আবার ভাই’টা যখন মস্তিষ্কের তীব্র যন্ত্রণায়,মনের তীব্র ক্লেশে আবিষ্ট হয়ে ছটফট করে, আর্তনাদ করে, সকলের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে গায়ে হাতও তুলে, তখন ক্রোধান্বিত হয়ে পলাশ মারধর করে অঙ্গন’কে। বড়ো ভাই পল্লব আর অলিওর যেদিন বাড়ি থাকে সেদিন রক্ষা পায় অঙ্গন৷ কিন্তু যেদিন তারা বাড়ি থাকে না সেদিন একদম রক্তাক্ত করে আধমরা করে কক্ষে আঁটকে রাখে। এসব সহ্য করতে না পেরে, পলাশ’কে কোনক্রমেই বাঁধা দিতে না পেরে যখন প্রেরণা ছেলে শোকে জ্ঞান হারায় তখনি খবর যায় প্রণয়ের কাছে। একমাত্র প্রণয়ই প্রতিবাদ করে পলাশের সঙ্গে। গতো দিনগুলোতে প্রণয় কম চেষ্টা করেনি। শহরের বড়ো বড়ো মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়েছে। চিকিৎসা চলছে অঙ্গনের তবুও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। দিনের পর দিন অঙ্গনের পাগলামো যেনো বেড়েই চলেছে। অঙ্গনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে করতে প্রেরণাও কেমন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় অরুণা প্রেরণা’কে বললো,
-‘ ছোট বউ প্রণয়ের থেকে তো সবটাই শুনছিস। অঙ্গন সেই কিশোর বয়স থেকে রোমানা’কে ভালোবাসতো। কিন্তু রোমানা প্রণয়’কে ভালোবাসতো বলে সে নিজের মনের কথা গোপন রাখছে। রোমানার সুখ চাইছে, কিন্তু মেয়েটার মৃত্যু’তে সব উলোটপালোট হয়ে গেলো৷ এই ছেলের চিন্তায় আমার ঘুম আসেনারে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম অঙ্গন’কে বিয়ে করানো উচিৎ। ‘
মনমরা হয়ে পালঙ্কে বসে ছিলো প্রেরণা৷ হঠাৎ অরুণা এসে পাশে বসে এমন কথা বলায় কিঞ্চিৎ বিচলিত হলো প্রেরণা। অরুণার দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ডুঁকরে ওঠে বললো,
-‘ আমার ছেলেটা’কে কেউ মেয়ে দিবনা আপা। আমার অমন সুন্দর, সভ্য ছেলেটার জীবনে কার কুনজর পড়লো। আমার হিরার টুকরা ছেলে,আমার অঙ্গনটার কি হয়ে গেলো। ‘
বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো প্রেরণা৷ অরুণা তাকে স্বান্তনা দিয়ে বললো,
-‘ কাঁদিস না কাঁদিস না। আমাদের এতো দুর্দিন আসেনাই যে এ বাড়ির ছেলের জন্য পাত্রীর অভাব পড়বে। ‘
-‘ কিন্তু আমার অঙ্গন কি স্বাভাবিক হবে? আমার কলিজাটা কি আগের মতো সুন্দর হাসি দিয়ে আবারো আমার বুকে শান্তি দিবে? আম্মা,আম্মা ডাকতে ডাকতে ঘরে এসে আমার কোলে মাথা রাখবে? ‘
-‘ সব হবে আগে তুই মত দে। ‘
-‘ বিয়ে করালে সত্যি আমার অঙ্গন ঠিক হবে আপা?’
-‘ সব ঠিক হবে তার জন্য লাগবে একজন রূপবতী মেয়ের সান্নিধ্য। মনে রাখিস নারী’র সান্নিধ্য পেলে পুরুষ মহাপুরুষ হয়ে যায়৷ আমাদের অঙ্গনের জন্য একটা রূপের সমুদ্র নিয়ে আসবো আমি দেখিস। যার সান্নিধ্য পেলে রোমানা’কে ভুলে যাবে অঙ্গন। ‘
প্রেরণার চোখ, মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো৷ চকচকে দৃষ্টিজোড়ায় ভেসে ওঠলো অরুণার প্রতি অগাধ ভরসা৷ সেই ভরসাতেই প্রেরণা অনুমতি দিলো,
-‘ তবে তাই হোক আপা তাই হোক। ‘
[২৮]
বাইজি গৃহঃ
হাতাহীন কৃষ্ণবর্ণীয় ব্লাউজের সঙ্গে পাতলা একটি শাড়ি পরে পলাশের সামনে এসে দাঁড়ালো মান্নাত বাইজি৷ বাইজি গৃহের সেই ঘরে রয়েছে তারা যে ঘরে গত কয়েক বছর ধরে নিয়মে,অনিয়মে বাসরশয্যা হয় তাদের। পুরোনো বহু স্মৃতি এসে হানা দেয় মান্নাতের মনে। বক্ষঃস্থল হয়ে ওঠে ভারী। এই সেই ঘর যে ঘরটার প্রতিটি ইষ্টকও তার আর্তনাদের শাক্ষি। চেয়েছিলো আস্ত এক ভালোবাসাময় মানব,একটি ছোট্ট ঘর, ছোট্ট সংসার অথচ পেলো, আস্ত অভিশাপ। ভালোবাসা মানে অভিশাপ। হয়তো সবার বেলায় নয়, তবে জমিদারের পুত্রদের ভালোবাসা মানেই আস্ত এক অভিশাপ। যে অভিশাপের ভার বহন করতে করতে লাশ হয়ে ক্ষ্যান্ত হতে হয়। তবে জীবিত লাশের সংখ্যাই বেশী, আর জীবিত লাশগুলোর যন্ত্রণাও বেশ প্রখর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কক্ষের দরজা লাগালো মান্নাত৷ পলাশ চৌধুরী তখন বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে উদাম শরীরে শুয়ে আছে বিছানায়। নাভীর কিঞ্চিৎ নিচ থেকে প্যান্ট পরায় নগ্ন বুক থেকে উদর অবদি পুরোটাই সুস্পষ্ট চোখে ধরা দিলো। তার শ্যামবর্ণীয় সুঠাম দেহে, লোমশ ভর্তি বুকে এক নজর তাকাতেই দৃষ্টি নত করে ফেললো মান্নাত। এক ঢোক গিলে ধীরপায়ে এগিয়ে যেতেই বিশ্রী হেসে হেচকা টান দিয়ে মান্নাত’কে নিজের বুকে আঁছড়ে ফেললো পলাশ। মূহুর্তেই মান্নাতের শরীর থেকে শাড়িটি খুলে বুকে মুখ ডুবিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিতে শুরু করলো। আচমকা মান্নাত’কে শূন্যিতে তিলে ঘুরিয়ে বিছানায় ফেলে নিজের বিশাল দেহটি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো৷ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত স্বরে বলে ওঠলো,
-‘ তোকে আমি বলেছিলাম, বলেছিলাম ছল করে চতুরতা করে নুর’কে আমার কাছে নিয়ে আসতে। তুই আমার কথা রাখিসনি,রাখিসনি তুই আমার কথা। ‘
শুধু কন্ঠে ক্ষিপ্ততা নয় বরং নিজের শক্তিশালী দেহটি দ্বারাও অসহীনয় ক্ষিপ্ততা প্রকাশ করলো পলাশ। কখনো অসহ্য হয়ে ছটফট করলো মান্নাত,কখনো চোখে অশ্রুপাত ঘটালো, কখনো যন্ত্রণাময় স্পর্শগুলোয় তাল মেলালো। তবুও মুখফুটে একটি শব্দও উচ্চারণ করলো না। কারণ নৃশংস মানুষ’টা তার থেকে ভালো,মন্দ যাই শুনবে তাতেই তার ক্ষিপ্ততা বেড়ে যাবে। মনে মনে এখন সে খুব চায় পলাশ চৌধুরী তাকে খুন করে ফেলুক। তার জান কবজ করে তাকে মুক্তি দিক। জান দিয়ে দেবে তবুও তার হাতে কোন পরিস্থিতি’তে নুর’কে তুলে দেবেনা। বেইমানি, জমিদার’দের রক্তে থাকতে পারে কিন্তু সামান্য বাইজিদের রক্তে বেইমানি নেই।

রাত তখন দশটা ছুঁয়েছে। শাহিনুর’কে বক্ষে চেপে শুয়ে আছে শারমিন। এই একমাসে অনেক কিছু ঘটেছে। শারমিন জানতে পেরেছে নুরের জীবনে রঙ্গনের প্রবেশের কথা। সব শুনে পায়ের নিচ থেকে যেনো মাটি সরে গেছে শারমিনের। এতো পরিশ্রম করে, এতোটা যুদ্ধ করে কী লাভ হলো তার সেই শকুনিদের নজরেই পড়লো শাহিনুর! যেদিন তীব্র ভয়ে জর্জরিত হয়ে শাহিনুর সবটা বলে ক্ষমা চাইলো, বাকরুদ্ধ হয়ে কতোটা সময় বসে ছিলো শারমিন জানা নেই। কিন্তু যখন সে সংবিৎ ফিরে পেলো তখন শাহিনুর’কে প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। বহুবছর পর অনেকটা সময় কেঁদেছিলো শারমিন। শাহিনুরের ছোট্ট মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়েছিলো তার জীবনের বিশাল বিশ্বাসঘাতকতার কথা। মা’য়ের থেকে সবটা শুনে শাহিনুরও বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলো। প্রশ্ন করেছিলো,
-‘ আম্মা জমিদার তোমাকে ভালোবাসলে এমন খারাপ জায়গায় কেন রাখলো? মা’কে ভালোবাসে বলে মা’য়ের অন্যায়কেও ভালোবাসতে হবে কেন? অন্যায় তো অন্যায়ই সে যেই করুক না কেন। ‘
শাহিনুরের কথা শুনে গর্বে বুক ভরে ওঠে শারমিনের। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে,
-‘ এইতো আমার মেয়েটা কতো বুঝে। তোমায় আরো বুঝতে হবে, আরো জানতে হবে। দুনিয়া টা বড়ো কঠিন। দুনিয়ার মানুষগুলো বড়ো স্বার্থপর। কঠিন এই দুনিয়াতে নিজেকে কঠিনভাবে গড়ে তুলতে হবে। স্বার্থপর মানুষগুলোর সাথে স্বার্থপর হয়েই লড়াই করতে হবে। ‘
সেদিনের পর থেকেই শুরু হয় শারমিনের সংগ্রাম। নিজের মেয়ে’কে কঠিনভাবে গড়ে তোলার সংগ্রাম। যে সংগ্রামের শুরু হয়েছে বাইজি গৃহের ভেতরে আর শেষ হবে বাইরের জগতে, বিশাল পৃথিবী’তে।
এখন আর নুর’কে একা রাখে না শারমিন। সবসময় নিজের কাছে,নিজের বুকে আগলে রাখে। কতোদিন হয়ে গেলো অলিওরের সঙ্গেও দেখা করেনা। অলিওর ঠিকই আসে কিন্তু মেয়ে’কে ছেড়ে সে এক মূহুর্তের জন্যও সরতে নারাজ। মায়ের মন বুকের ভিতর কেমন কেমন করে, সামনের দিনগুলো নিয়ে ভয় করে খুব। শহর থেকে বান্ধবীর চিঠি পেয়েছে দু’দিন আগে। সে বেশ কঠিনভাবে এবার জানিয়েছে,সামনে মাসেই নুর’কে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। নয়তো পরে আফসোস করতে হবে। বান্ধবীর চিঠির উত্তর দিয়ে শারমিনও বলেছে,
-‘ প্রিয় সেতেরা,
তুই রাগ করিস না। তুই তো জানিস জমিদারের চতুর্থ পুত্র বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে৷ এই নিয়ে জমিদারের অবস্থাও তোকে জানিয়েছি। তাই কিছুদিন নুরের বিষয়ে তার সাথে কথা বলিনি। কিন্তু আজ,কালের মধ্যে তাকে জানাবো আমার মেয়ে’কে এবার আমার বান্ধবীর হাতে তুলে দিতে চাই। মেয়ের মা আমি, আমাকে তো মেয়ে’কে পরের ঘরে দান করতেই হবে বল। তুই রাগ করিস না। যদি রাগ করিস বেয়ান হিসেবে না হয় মনে মনে গালটা টিপে দেবো। সাক্ষাৎে তা তো আর সম্ভব হবে না! শোন বেয়ান, তোর ছেলেটা’কে বলে দিস তার শাশুড়ি মা তার জন্য আস্ত এক ডায়েরি পাঠাবে। সেখানে একটি অক্ষর না পেলেও নিজের মতোন করে অক্ষর দিয়ে শব্দ বুনে নেবে, ভালোবাসা মাখিয়ে বাক্য তৈরি করতে পারবে। যা কখনো নিঃশ্বেষ হবে না। মানুষ নশ্বর কিন্তু তাদের সৃষ্টি অবিনশ্বর। আমি আস্ত এক ডায়েরি দিলাম তাকে আস্ত ভালোবাসা বুনে নিতে বলিস। আর হ্যাঁ মেয়েটাকে এখনো এ ব্যাপারে জানাইনি তুই আমাকে দুটো দিন সময় দে আমি সবটা সাজিয়ে,গুছিয়ে নিয়ে আমার অমূল্য রতন,কলিজার টুকরাটাকে শিঘ্রই পাঠিয়ে দেবো। ভালো থাকিস চিঠির অপেক্ষায় থাকবো।

-শারমিন শায়লা
[২৯]
জরুরী তলবে প্রণয়ের কোয়ার্টারে এসে হাজির হলো রঙ্গন৷ প্রণয় অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বসে আছে সোফায়৷ রঙ্গন গিয়ে তার পাশে বসলো৷ প্রণয় হাতে কিছু পেপার্স নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে৷ রঙ্গন অনুমান করলো, তার কোন পেশেন্টের কাগজপত্র ওগুলো৷ হয়তো অঙ্গনেরই হবে। তাই সেদিকে মাথা ঘামালো না। অপেক্ষা করলো প্রণয়ের কথা শোনার জন্য গুটিকয়েক মিনিট পর কাগজপত্র গুছিয়ে পাশে রাখলো প্রণয়৷ পিঠ এলিয়ে এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতেও বসলো। দৃষ্টি উপরের দিকে স্থির রেখে তর্জনী আঙুল দ্বারা ভ্রু চুলকাতে চুলকাতে প্রশ্ন করলো,
-‘ বাইজি’র মেয়েটার কি খবর? রাত দুপুরে এখনো দেখা হয়? ‘
রঙ্গন কিঞ্চিৎ অবাক হলো পরোক্ষণেই মৃদু হেসে বললো,
-‘ না ভাইয়া ওর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিলো তোমার জন্মদিনের দিন তারপর আর হয়নি। ‘
-‘ কেন? ‘
-‘ ও চায়নি। ‘
ওষ্ঠকোণে দুর্বৃত্ত হাসির দেখা মিললো প্রণয়ের। সহসা রঙ্গনের দিকে ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করলো,
-‘ ওর সাথে ব্যাপারটা কতোদূর এগিয়েছিলো রঙ্গন? হাত অবদিই নাকি আরো গভীরে গিয়েছিলি?’

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।