কৌশলে প্রণয় তার এবং নুরের মধ্যেকার সম্পর্ক জানতে চাচ্ছে, এর পেছনে সঠিক কারণ বোধগম্য হলো না রঙ্গনের৷ তবুও বড়ো ভাই এমন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে উত্তর না দিয়েও উপায় নেই। ওষ্ঠকোণে কিঞ্চিৎ লজ্জা মিশ্রিত হাসির আভাস নিয়ে রঙ্গন বললো,
-‘ আরে নাহ, কি যে বলো অমন ইনোসেন্ট মুখ দেখলেই তো প্রাণ জুড়িয়ে যায়, আর কিছু লাগে নাকি? ‘
প্রণয় ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আবারো গা এলিয়ে বসলো। বাঁকা চোখে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ পুরো পৃথিবী’কে রঙ্গ দেখিয়ে ঘোল খাওয়াতে পারিস, কিন্তু আমাকে পারবিনা জমিদারের ছোট পুত্তুর! ‘
প্রণয়ের মুখে পুত্তুর শুনে রঙ্গনের ছোটবেলাকার কথা মনে পড়ে গেলো। তার দাদিও ঠিক এভাবেই পুত্তুর সম্বোধন করতো৷ দাদির কথা মনে পড়ায় অতি উচ্চ স্বরে হেসে ওঠলো রঙ্গন৷ বললো,
-‘ আমরা সব ভাই’রা তো পাঁচ মিশাল তাইনা ভাইয়া? তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুবুদ্ধি সম্পন্ন, সুজ্ঞান সম্পন্ন তো একমাত্র তুমিই। আমরা কেউ তা অস্বীকার করতে পারিনা বা আমরা কোন ভাই এই সত্যিটা অবিশ্বাসও করিনা। কিন্তু ভাই, আমি যতো রঙ্গই দেখাই,যতো রঙ্গই করি আমার ভিতরেও একটা সফট মন আছে। ‘
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রণয় বললো,
-‘ তা আমি জানি আর তোর সফট কর্ণার কোথায়,কে সেটাও জানি৷ তাই তো বলছি বাইজির মেয়েটা’কে যখন ভালোইবাসিস না এতো রঙ্গ করছিস কেন? ‘
-‘ আরেহ ভাই এতো সুন্দরী একটা মেয়ে আমার প্রেমে দিওয়ানা, হতে পারে সে বাইজি’র মেয়ে। কিন্তু ভাবোতো মেয়েটা’কে বউ হিসেবে পাওয়া কতোটা সৌভাগ্যের? এমন ইনোসেন্ট, এমন বিউটিফুল গার্ল’কে কে না বউরূপে পেতে চায়। ‘
তাচ্ছিল্য সহকারে হেসে প্রণয় বললো,
-‘ যদি ভালো নাই বাসিস বিয়ে করে মেয়েটা’কে ঠকাতে দেবো না রঙ্গন। তাছাড়া পলাশ চৌধুরী বেঁচে থাকতে তুই নুরের সঙ্গে বিয়ে,সংসার কোনটাই করতে পারবিনা৷ আর আমি বেঁচে থাকতে ওকে ঠকতে দেবো না। ‘
শেষ কথাটায় কেমন যেনো চমকে ওঠলো রঙ্গন। বিস্মিত হয়ে স্পষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রণয়ের দিকে। দেখতে পেলো প্রচণ্ড গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে প্রণয়। তার দৃষ্টির দৃঢ়তা,মুখের গম্ভীর্যতায় বক্ষঃস্থল কেমন আনচান করে ওঠলো। অস্থির চিত্তে প্রণয়’কে প্রশ্ন করলো,
-‘ কি বলছো ভাইয়া! ‘
এ পর্যায়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না প্রণয়৷ চট করে ওঠে দাঁড়ালো। পিছ মুখী হয়ে ক্রমশ শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ বাড়িয়ে তুলে চোয়াল শক্ত করে বললো,
-‘ ইয়েসস আই ওয়ান্ট টু সেভ হার। এর জন্য তাকে আমার হতে হবে। ‘
রঙ্গন কিছুটা বিচলিত ভঙ্গিতে ওঠে দাঁড়ালো। তার পুরো শরীর তরতর করে ঘামতে শুরু করলো। বিস্ময়ান্বিত কন্ঠে বললো,
-‘ ভাই আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। ‘
-‘ ওর আমাকে খুব প্রয়োজন রঙ্গন, ওর আমাকে ভীষণ প্রয়োজন। ‘
-‘ না এটা মিথ্যা, তুমি আমার সাথে ছলনা করছো ভাইয়া! তুমিও বাকি সবার মতো নুরের রূপে উন্মাদ হয়ে গেছো। কিন্তু ভাইয়া নুর আমাকে ভালোবাসে ঐ মেয়েটা’কে আমি ঠকাতে পারবো না। ‘
ক্রোধান্বিত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে রঙ্গনের গালে ঠাশশ করে থাপ্পড় মারলো প্রণয়। ধমকের সুরে বললো,
-‘ এতোগুলো দিন হবু ভাবি’র সঙ্গে তামাশা করেছিস কিছু বাঁধায় তা দাঁত চেপে মেনে নিয়েছি। নেক্সট কোন তামাশা চাই না। ‘
রঙ্গনের চোখ,মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। গালে হাত দিয়ে ব্যথাহত কন্ঠে বললো,
-‘ সামান্য একটা মেয়ের জন্য তুমি আমার গায়ে হাত তুললে ভাইয়া৷’
প্রণয় স্মিত হেসে বললো,
-‘ এক থাপ্পড়ে যে মেয়েটা তোর কাছে সামান্য হয়ে গেলো সেই মেয়েটা কতোটা অসামান্য তুই জানিস না রঙ্গন। আমার পূর্বে মেয়েটা তোকে ভালোবাসি বলেছে তবুও আমি ওকে সামান্য ভাবতে পারিনি। ঐ মেয়েটা’কে তুই যেদিন থেকে চিনিস তার বহু আগে থেকে ওকে আমি চিনি৷ যাকে চিনিস না,জানিস না,যাকে ভালোবাসিস না,যে মেয়েটা তোর চোখে সামান্য তার সঙ্গে ঘর বাঁধা কাপুরুষতা রঙ্গন৷ আমার ছোট ভাই’টা কাপুরষ হোক তা আমি চাইনা৷ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়,শান্ত কন্ঠে বলছি নুর’কে জীবনে আনার কথা ভুলে যা। ‘
-‘ কিন্তু নুর আমাকে ভালোবাসে ভাইয়া। ‘
-‘ যে মেয়েটা নিজেকে ভালোবাসতে শিখেনি সেই মেয়েটা তোকে ভালোবাসে এটা খুবই হাস্যকর রঙ্গন৷’
-‘ মানে? ‘
-‘ খুবই সহজ। জীবন কী, মানুষের পূর্নরূপ কী তা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞাত নুর। তোর সঙ্গে রাত,বিরাতে ঘুরাঘুরি’তে মেয়েটা ভয় পায়নি কারণ পুরুষ মানুষ সম্পর্কে ওর ধারণাই নেই। পুরুষ দ্বারা ওর কীভাবে ক্ষতি হতে পারে সে বিষয়ে এখনো অজ্ঞান নুর, এমনি কীসে নিজের ভালো হবে,কীসে মন্দ হবে সেটাও সঠিকভাবে এখন অবদি বুঝতে পারেনি। সাধারণ নলেজ যার এতো কম সে তোকে ভালোবাসলো কী করে? ভালোবাসা’র মানেটা ঐ মেয়ে বুঝে? আমি তোকে বলছি যেদিন ঐ মেয়েটা সত্যিকারের অর্থে ভালোবাসার মানে বুঝবে সেদিন আর তোকে ভালোবাসি বলবে না। মিলিয়ে নিস। ‘
কিছুটা আহত সুরে রঙ্গন বললো,
-‘ নুরের রূপের কাছে তোমার ব্যক্তিত্বও নড়বড়ে হয়ে গেলো ভাইয়া! ‘
রঙ্গনের মুখে এমন কথা শুনে রাগ না করে হাসলো প্রণয়। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে রঙ্গনের কাঁধে হাত রাখলো। শান্ত গলায় বললো,
-‘ আগেতো দর্শনধারী পরে গুণবিচারি মেরা ভাই। ‘
রঙ্গন চাপা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। প্রণয় অতি সন্তর্পণে নিজের পকেট থেকে টিস্যু বের করে রঙ্গনের কপালে ফুটে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিতে দিতে বললো,
-‘ দেখ ভাই আমি মেজো ভাই’য়ের মতো অতোটা পাষাণ নই যে তোর ভালোবাসা কেড়ে নেবো। কিন্তু আমি তার থেকেও ভয়ংকর পাষাণ তাই নিজের ভালোবাসা’কে কেড়ে নিচ্ছি। নুর’তো তোর ভালোবাসা নয়। ‘
রঙ্গন ঠাশ করে প্রণয়ের হাত নামিয়ে দিলো৷ কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বললো,
-‘ নুর তোমাকে পছন্দ করে না। তুমি এটা করোনা ভাইয়া, তুমি তো এমন নও। ‘
-‘ তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো না? তুমি নুরের ভালো চাও না বলো? ‘
প্রচণ্ড রেগে গিয়ে রঙ্গন’কে তুমি করে বলে প্রণয়৷ রঙ্গন বুঝলো প্রণয় বেশ চটে গেছে তাই শান্ত হয়ে বললো,
-‘ আমার মাথা কাজ করছে না। ‘
প্রণয় বললো,
-‘ তোর কি কষ্ট হচ্ছে? ‘
-‘ নাহ। ‘
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রণয় এবার রঙ্গনের মাথায় হাত বুলালো। বললো,
-‘ তাহলে তুই শিওর থাক নুরের প্রতি তোর ভালোবাসা নেই। যা আছে তা দায়। ‘
-‘ আমি পলাশ চৌধুরী থেকে প্রতিশোধ নিতে চাই। ‘
-‘ তোদের প্রতিশোধের জন্য একটা নিষ্পাপ জীবন নষ্ট হোক তা আমি চাইনা৷ কিন্তু আমার ভালোবাসার জন্য কারো জীবন সুন্দরতম ভাবে গড়ে ওঠুক খুব চাই৷ সবচেয়ে বড়ো কথা আমি আমার মনোহারিণী’কে চাই। ‘
বিস্মিত কন্ঠে রঙ্গন বললো,
-‘ তুমি সত্যি নুর’কে…’
বাকিটুকু বলতে দিলো না প্রণয়। রঙ্গনের ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের তর্জনী আঙুল চেপে ধরে বললো,
-‘ ভাবি বল ভাবি। ‘
বুক কেঁপে ওঠলো রঙ্গনের একবার ভাবলো সে কি আবারো হেরে যাচ্ছে? পরোক্ষণেই ভাবলো সে তো সত্যি নুর’কে ভালোবাসে না। প্রণয় তো ভুল কিছু বলেনি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নুরের জীবন যে নষ্ট হবে না তারই বা নিশ্চয়তা কী? অগণিত দ্বিধায় দিশেহারা হয়ে গেলো রঙ্গন। তখনি কানের কাছে ফিসফিস কন্ঠস্বর শুনতে পেলো প্রণয়ের,
-‘ এতো দ্বিধা না করে নুর’কে ভাবি হিসেবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর রঙ্গন। এতে সবারই মঙ্গল। ‘
রঙ্গনের সঙ্গে অনেকটা সময় কথা বলার এক পর্যায়ে প্রণয় সিদ্ধান্ত নিলো খুব শিঘ্রই বাইজি শারমিন শায়লার সঙ্গে দেখা করবে সে। এবং খুব শিঘ্রই শারমিন শায়লার নিকট বিবাহের পয়গাম পাঠাবে স্বয়ং নিজে গিয়েই।
[৩০]
মাঝরাতে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো শারমিন বাইজির। শোয়া থেকে সটান হয়ে বসে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে শুরু করলো সে। পুরো শরীরে কেমন হিম ছুঁয়ে যাচ্ছে। গণ্ডস্থল থেকে বক্ষঃস্থল অবদি শুকিয়ে কাঠকাঠ অবস্থা। না পেরে বিছানা ছেড়ে পাশের টেবিলে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে ঢকঢক করে গিলতে লাগলো। দু’গ্লাস পানি এক নিমিষেই শেষ করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো শারমিন৷ তার কান্নায় অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেলো শাহিনুরের। নড়েচড়ে, ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসলো সে। ভয়ে জর্জরিত হয়ে শারমিনের দিকে চেয়ে বললো,
-‘ আম্মা তুমি কাঁদছো কেন? ‘
শাহিনুরের কথা শুনে চমকে ওঠে ত্বরিতগতিতে অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া মুছে নিলো। চোখেমুখে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে শাহিনুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘ কি বলছিস মা কাঁদবো কেন? পানি খেলাম’রে হেঁচকি ওঠে গেছিলো। ‘
কপট রাগ দেখিয়ে শাহিনুর বললো,
-‘ না আম্মা আমি স্পষ্ট তোমার কান্না শুনতে পেয়েছি কান্না শুনেই ঘুম ভেঙে গেছে আমার। ‘
শারমিন জানে শাহিনুর কিছুতেই হার মানবে না৷ সে চায়ও না তার মেয়ে জীবনে চলার পথে কোথাও হার মানুক, তার নিজের কাছেও নয়৷ তাই ওষ্ঠকোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে শাহিনুর’কে বুকে টেনে নিলো। মাথায় স্নেহময় চুম্বন এঁকে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ মা’রে কখনো নিজের দূর্বলতাগুলোকে কারো কাছে প্রকাশ করতে নেই। আর কারো সামনে নিজের দুঃখ যন্ত্রণাগুলো যতোটুকু পাড়া যায় গোপন করতে হয়৷ আমি কাঁদছিলাম কিনা সেটা আর জিজ্ঞেস করিস না মা। ‘
শাহিনুর নিশ্চুপ রইলো। শারমিনের বুকের ধুকপুকানি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে৷ শারমিনও বুঝলো শাহিনুর এখন কিছুটা বিচলিত হয়ে আছে। তাই বললো,
-‘ নুর, এ পৃথিবীতে কিছু মানুষ রয়েছে যারা ঠিক নারিকেলের মতো। বাইরে থেকে কঠিন আর ভিতরে একেবারে নরম। কিন্তু তুমি বাইরে ভিতরে একই রকম। আমি তোমাকে বাইরে এবং ভিতরে দু’জায়গায়ই শক্ত দেখতে চাই৷ মানুষের মন সত্যকার অর্থে কঠিন হতে পারেনা, হয় তাদের মন নরম নয়তো তাদের মন নৃশংস। তুমি ভিতরে শক্ত হতে পারো বা না পারো কেউ যেনো কখনো তোমার ভিতরের সত্তা টের না পায়৷ নিজেকে কঠিন করে গড়ে তুলতে হবে৷ তোমাকে অনেক শক্ত হতে হবে। এখন যেমনটা আছো এমনটা থাকলে চলবে না৷ যদি এমনটা থাকো পুরো দুনিয়া তোমাকে নৃশংসভাবে ঠকিয়ে দেবে৷ আর একটি কথা মনে রাখবে যার মুখে যতো রস তার সত্তায় ততো বেশী ভেলকি থাকবে৷ প্রকৃত অর্থে মানুষ’কে চিনতে হলে জানতে হলে তাদের দৃষ্টি বুঝতে হবে,বোঝার চেষ্টা করতে হবে৷ সবশেষে বলবো মানুষ’কে চেনার থেকেও মানুষ’কে পড়ার চেষ্টা বেশী করবে৷ তোমাকে একটি গল্পের নাম বললাম তুমি নাম জানলে, সে বইটা তোমার হাতে দিলাম তুমি বই’টা চিনলে। কিন্তু ভিতরের বর্ণনা গুলো না পড়লে তুমি সে বই বিষয়ে অজ্ঞই থেকে যাবে৷ বই পড়ার মতো করেই মানুষ’কে পড়তে হবে৷ মনে রেখো পৃথিবী সম্পর্কে জানার যেমন শেষ নেই তেমনি পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া বিচিত্র মানুষগুলো’কে পড়েও শেষ করা যাবে না৷ তবে সামনে, পিছে, ডানে,বা’মে, মস্তিষ্কে, মনে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিকেই নিখুঁত ভাবে পড়ার চেষ্টা করবে। পুরো দুনিয়া নয় এ’কজনকেই সুক্ষ্ম ভাবে পড়ার চেষ্টা করো সব সময়৷’
Leave a comment