বাইজি কন্যা | পর্ব – ২৫

14 Min Read
বাইজি কন্যা

বহুবছর আগে জমিদার অলিওর চৌধুরী নিখুঁতভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, বাইজি শারমিন শায়লার সাথে। তার করা বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই আজ শারমিনের পরিচয় এক বাইজি প্রধান। সেদিন যদি অলিওর পরিকল্পনা করে শাহিন’কে না ফাঁসাতো শারমিন শাহিন’কে ছেড়ে আসতো না। আর অলিওরের মা’ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে শারমিন’কে বাইজি গৃহে স্থান দিতো না। নিরপরাধ শাহিন’কে কতোটা জঘন্য ভাবে ঠকিয়েছে অলিওর। শাহিন তার ভালোবাসার মানুষ, তার স্বামী শাহিন। সবচেয়ে বড়ো কথা তার সন্তান নুরের বাবা ছিলেন তিনি। অলিওর যদি তাদের সঙ্গে এই জঘন্য খেলাটা না খেলতো, আজ শারমিন,শাহিন, এবং নুরের জীবনটা অন্যরকম হতো। না সে বাইজি হতো আর না নুরের পরিচয় শুধুমাত্র এক বাইজি কন্যা হতো। শাহিনের মতো একজন সম্মানিত ব্যক্তির স্ত্রী, সন্তানের এমন পরিচয়ের জন্য শুধুমাত্র অলিওর চৌধুরীই দায়ী। এতো কিছু করেও অলিওর চুপ করেনি৷ নিজের স্বার্থের জন্য নিজের ছেলের কামনা পূরণ করার জন্য আবারো বিশ্বাসঘাতকতা করলো! শাহিনুর’কে সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য দূরে পাঠাতে চেয়েছিলো। সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলো৷ সবটাই গোপনভাবে অথচ পলাশ চৌধুরী সবটা জেনে গেলো। তার বাবা যেমন শারমিন’কে পাওয়ার লোভে শাহিন’কে হ’ত্যা করেছিলো তেমনি নুর’কে পাওয়ার জন্য সেও আনভির’কে হত্যা করলো। এক মা’য়ের কোল খালি করলো! সবটা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে ওঠলো শারমিনের। কতোটা নৃশংস এই জমিদার আর তার এই পুত্র! এতোটা বছর যে সন্দেহ, যে ভয় মনে পুষে রেখেছিলো আজ সেটাই সত্যি হলো। হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে তার। মনে পড়ে যাচ্ছে শাহিনের সাথে কাটানো একেকটা ভালোবাসাময় দিনগুলোর কথা। অস্থিরতায় সারা শরীরে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়ার ফলে ঘনঘন শ্বাস গ্রহণ এবং ত্যাগ করছে। মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চারদিক থেকে ক্রমশ শূন্যতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে তাকে। অসহায় লাগছে খুব। আফসোসের আর্তনাদে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ঠিক এজন্যই, ঠিক এজন্যই আজ অব্দি অলিওর শাহিনের পাঠানো বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজটি দেখাতে পারেনি। দেখাবে কি করে তার স্বামী,তার নুরের বাবা তো তাকে এমন কাগজ পাঠায়নি। মানুষটা তো তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। কতো স্বপ্ন ছিলো মানুষটার, কতো আশা ছিলো নুর’কে নিয়ে। সেসবের কোনটাই যে পূরণ হলো না। কালবৈশাখী ঝড়ের আঘাতে যেমন প্রকৃতি’তে ধ্বংসলীলা সৃষ্টি হয় তেমন তাদের জীবনেও অলিওর নামক ঝড়টি এসে সবটা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। দু’হাত মুখে চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো শারমিন। একসময় একদম নিশ্চুপও হয়ে গেলো। ভিতর থেকে অস্পষ্ট কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে অলিওর এবং পলাশের। সহসা দু’হাতে কপোল বেয়ে চলা সমস্ত অশ্রুই মুছে নিলো শারমিন৷ নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে ধীর গতিতে চরণদ্বয় আগাতে লাগলো। তার পরিহিত গাঢ় হলুদ রঙের জর্জেট শাড়িটির লম্বা আঁচল তখন মেঝেতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাথার লম্বা লম্বা চুলগুলোর বড়ো খোঁপাটিও আধখোলা অবস্থায় রয়েছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে হয়তো তা পুরোপুরিই খুলে যাবে,হয়তো ঘিরে থাকবে তার পিঠ এবং কোমড়’কে। তার নিষ্পলক, দৃঢ় দৃষ্টিজোড়ায় এক ফোঁটা অশ্রুকণাও নেই। সবটা যেনো নিমিষেই কেউ শুষে নিয়েছে। এ সময় প্রখর সে দৃষ্টিজোড়ায় তাকালে যে কারোরি হৃৎপিণ্ড ভয়ংকর মাত্রায় কেঁপে ওঠবে। নিজ কক্ষে গিয়ে শারমিন সর্বপ্রথম শাহিনুরের পাশে গিয়ে বসলো৷ কিছুক্ষণ শাহিনুরের মাথায় এবং মুখে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেলো। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বিরবির করে বললো,
-‘ সোনা মা আমার ছোট্ট ভুলে আজ তোর পরিচয় বাইজি কন্যা। আমার কলিজা, ঐ বিশ্বাসঘাতক জমিদারের জন্য তুই আজ পিতৃহীন। ‘
একটু থামলো শারমিন দুফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়লো তার চোয়াল বেয়ে। তর্জনী আঙুল দ্বারা সে অশ্রুকণা মুছে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শারমিন। পুনরায় শাহিনুরের ললাট চুম্বন করে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
-‘ জানিস সোনা, ঐ অলিওর শুধু তোর বাবার সম্মান নষ্ট করে চুপ হয়নি। ঐ নরপশুটা তোর বাবার থেকে স্ত্রী, সন্তান’কে দূরে সরিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। শেষ পর্যন্ত জা’নো’য়ারটা তোর বাবাকে খু’নও করেছে! ‘
কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো শারমিনের তাই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে আবারো বললো,
-‘ এমন সম্মানিত একজন ব্যক্তি’কে এভাবে অসম্মান করে, পুরো দুনিয়ার কাছে অসম্মানিত,ঘৃণিত,চরিত্রহীন চিহ্নিত করে মৃত্যু দিয়ে দিলো! নিরপরাধ মানুষ’টাকে এভাবে ঠকালো, আমার সঙ্গে এতো বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করলো, আর আমি এতো দেরিতে তা টের পেলাম? আর পলাশ চৌধুরী সেও তো কম করলো না। শেষমেশ আনভীর’কে খুঁজে বের করে শেষ করে দিলো। এইবারেও বিশ্বাসঘাতকতা করলো অলিওর আমার সঙ্গে। ওর র’ক্তে মিশে গেছে বিশ্বাসঘাতকতা। আজ ওর র’ক্ত দিয়ে গোসল করবো আমি! নুর মা আমি আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছি। আজ এই বাইজি গৃহে সবচেয়ে নি’কৃষ্ট দু’টো প্রাণের বিনাশ ঘটবে! ‘
জ্বরের ঘোরে তন্দ্রায় মগ্ন শাহিনুর৷ শারমিন ঘুমন্ত শাহিনুরের সঙ্গেই আপনমনে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো। কথা শেষে শান্ত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো। মনে মনে স্থির করলো জমিদার এবং জমিদারের ছেলের বিনাশ ঘটিয়ে এই অভিশপ্ত গৃহ আজ ত্যাগ করবে সে। শাহিনুর’কে নিরাপদ স্থানে রেখে,নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে তারপর না-হয় পুলিশের কাছে ধরা দেবে। আর সময় নিলো না শারমিন মৃদ্যু পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের কাছে সংরক্ষিত সেই অস্ত্র’টি বের করলো। যে অস্ত্র
দেখিয়ে শাহিনুর’কে সে শিক্ষা দিয়েছিলো,
– ‘ এই অস্ত্র কোন মানুষ কে হত্যা করার জন্য নয়৷ এই অস্ত্র শুধুমাত্র অমানুষদের হত্যা করার জন্য। ‘

[৩৪]
চারপাশ ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। রাত তখন ক’টা বাজে অনুমান করা গেলো না। আজ আকাশে চাঁদ নেই,নেই অগণিত তাঁরাদের মেলা। বিশাল আকাশটায় থেকে থেকে মেঘেরা গর্জন করে ওঠছে। এই বুঝি আকাশ কাঁপিয়ে, ভূমি কাঁদিয়ে বর্ষণ শুরু হবে। প্রকৃতির এমন থমথমে আবহাওয়ায় বাইজি গৃহ’টি ঘুঙুরের শব্দে মুখরিত হয়ে আছে। শারমিন বাইজি এক হাতে তলোয়ার নিয়ে একধ্যানে এগিয়ে চলেছে। বাইজি গৃহে বরাবরের মতোই আজো চমকপ্রদ আলোকসজ্জায় সজ্জিত৷ প্রতিটি কক্ষের সামনের বারান্দা দিয়ে একের পর এক কক্ষ পার করছে শারমিন৷ বাইজি গৃহে প্রবেশের মেইন গেট থেকে গৃহের বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। রঙ্গন এ গৃহে আসার জন্য সবেই গেটের সামনে এসেছে৷ তখনি দূর থেকে শারমিন’কে অমন ভয়ানক দৃশ্যে দেখে দ্রুত পা বাড়ালো রঙ্গন। শারমিন যখন অলিওরের বিশেষ কক্ষে প্রবেশ করলো তখন অলিওর পলাশের সঙ্গে গোপন আলোচনায় মগ্ন ছিলো। শারমিন কোন কিছু না ভেবে সরাসরি অলিওরের পিঠ বরাবর তলোয়ারের মাথা ঢুকিয়ে দিলো। অলিওর আর্তনাদ করে ওঠতেই এক ধাক্কায় তাকে মেঝেতে ফেলে পেট বরাবর একবার,দু’বার, তিনবার তলোয়ার ঢুকালো এবং বের করলো। হিংস্র বাঘিনীর মতো করে গর্জন দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
-‘ বিশ্বাসঘাতক, তোর সব খেলা আজ শেষ। ‘
দাঁতে দাঁত চেপে এ’কথা বলতেই পলাশ আতঙ্কিত হয়ে শারমিনের বুক বরাবর লাথি দিলো। ছিঁটকে দূরে গিয়ে পড়লো শারমিন। অলিওরের দিকে চেয়ে আব্বা বলেই অলিওর’কে ধরলো পলাশ। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,
-‘ এই কে আছিস আমার আব্বারে মাইরা ফেলছে তাড়াতাড়ি আয় আব্বা’কে হাসপাতাল নিতে হবো। ‘
অলিওর’কে হাসপাতাল নিয়ে যাবে পলাশ। এক শ’য়তান প্রাণ বাঁচাবে আরেক শ’য়তানের। কখনোই না। জীবন দিয়ে হলেও এই দুই পিশাচ’কে ধ্বংস করবে আজ শারমিন। এই বাসনা নিয়েই চারগুণ হিংস্র হয়ে ওঠলো শারমিন। হাতের শক্তমুঠে তখনো তলোয়ার রয়েছে তার। সেটা নিয়েই পলাশ চৌধুরী’র ঘাড় বরাবর যেই আঘাত করতে গেলো৷ উদ্দেশ্য দেহ থেকে মাথা খণ্ডন করা। কিন্তু তার পূর্বেই থেমে দাঁড়ালো শারমিন, ভয়ংকর সুরে আর্তনাদও করে ওঠলো। বিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বড়ো বড়ো চোখ করে নিজের পেটের দিকে তাকাতেই সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো তার। র’ক্তাক্ত ধারালো তলোয়ারের মাথা দেখেই অসাড় হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই ক্রোধান্বিত মুখশ্রী’তে রঙ্গন’কে দেখতে পেলো। রঙ্গনের হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো তার পিঠ সই করে তলোয়ার ঢুকিয়েছে রঙ্গন। যা তার পিঠ, পেট ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত করে রঙ্গন তলোয়ার’টি একটানে বের করে ফেলতেই আহত শারমিন বাইজি নিজ শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলোনা। শরীর ছেড়ে দিয়ে একহাত পেটে চেপে ধরে অলিওরের পাশেই ধপাস করে পড়ে গেলো। পলাশ শারমিনের দিকে চেয়ে বিকৃত ভঙ্গিতে হেসে ওঠলো,পরোক্ষণেই আবার কেঁদে ওঠলো, অলিওরের দিকে চেয়ে বললো,
-‘ আব্বা,আমার আব্বা। ‘
রঙ্গন, পলাশ দু’জনই গিয়ে অলিওর’কে ধরলো। দু’জনই একডাকে বললো,
-‘ আব্বা আপনার কিছু হবে না আমরা আছি। ‘
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম অলিওর চৌধুরী ক্ষীণ স্বরে বললো,
-‘ তোরা চুপ কর, তোরা আমাকে নিয়ে টানাটানি করিস না। ‘
এটুকু বলে চোখ বন্ধ করে ফেললো অলিওর।পরোক্ষণেই অসহনীয় ব্যথায় গোঙানি দিলো কয়েকবার। শুনতে পেলো শারমিনের গেঙানিও৷ ঘাড় কাত করে শারমিনের দিকে তাকালো। করুণ কন্ঠে বললো,
-‘ তুমি আর আমি আরো কিছুকাল বাঁচতে পারতাম শারমিন। ‘
গোঙাতে গোঙাতেই শারমিন অলিওরের মুখে থুতু ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে পলাশ শারমিনের গালে ঠাশিয়ে এক থাপ্পড় মারলো। বৃদ্ধ অলিওর তার ক্ষতবিক্ষত বলহীন দেহটি কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে বলহীন হস্ত দ্বারাই পলাশের গালে দু’টো চড় মারলো। বললো,
-‘ এতো বড়ো সাহস তুই আমার শারমিনের গায়ে হাত তুলিস। দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে। আমি আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস তোর মতো বেয়াদবের সামনে ত্যাগ করতে চাই না। ‘
পলাশ ক্রোধে চুপ থাকলেও রঙ্গন ওঠে দাঁড়ালো এবং সকল ভৃত্যদের ডাকার জন্য উদ্যত হলো। কিন্তু অলিওর মৃদ্যু হুংকার দিলো তাদের দুজন’কেই বেরিয়ে যেতে। পলাশ রঙ্গন কেউ রাজি হলো না। ইতিমধ্যে বাইরে ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে। যার ফলে কক্ষের ভিতরের আওয়াজ বাইরে যাচ্ছে না। বাইজিরা তাদের কাজে মগ্ন, ভৃত্যরাও হয়তো সারাদিনের ব্যস্ততার পর বিছানায় আরাম করছে। সবটা বিবেচনা করেই অলিওর চৌধুরী বললো,
-‘ রঙ্গন তুই চলে যা বাপ তুই শহরে চলে যা। একমাসের আগে এখানে আসবি না। পলাশ বাপ আমার রাগারাগি না করে এই ঘটনা চেপে যাস। নয়তো রঙ্গনের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। ‘
এটুকু বলে শারমিনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো অলিওর৷ শারমিন কেমন নিথর হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু তার শ্বাস তখনো চলছে। শরীরে একটুখানি শক্তি ভিক্ষা চাইছে উপরওয়ালার কাছে। অলিওর সেদিক তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠেই বললো,
-‘ কি আনন্দ! কি নিরানন্দ! শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় শুধু তোমাকে পাশে চেয়েছিলাম। কি সৌভাগ্য! আমার পুত্র’রা আমার চাওয়ার থেকেও দ্বিগুণ পাওয়া দিলো। তোমাকে সঙ্গে নিয়েই পরপারে চলে যাচ্ছি। আহ, আর কোন চিন্তা নেই মরে শান্তিই পাবো। কিন্তু হায়, ভয় একটাই এপারের মতো ওপারেও আবার লড়াই না চলে? যদি উপায় হয়, যদি সুযোগ পাই ওপারে গিয়ে আমার প্রধান লক্ষ হবে শাহিনের থেকে তোমাকে দূরে দূরে রাখা। শারমিন, তোমার হাতে মৃত্যু পেয়েও বড়ো প্রশান্তি অনুভব করছি। কতো ভালোবাসি আমি তোমায় বুঝলে না শারমিন তুমি বড়ো অবুঝ। আমার প্রাণ প্রিয়া অবুঝ শারমিন অনেক ভালোবাসি তোমায়। ‘
কথাগুলো বলতে বলতে শারমিনের একদম কাছে এসে মেঝেতে শুয়ে পড়লো অলিওর। শারমিনের একটি হাত টেনে নিজের বুকে চেপে ধরে বললো,
-‘ আমার শেষ স্পন্দনটুকুও তোমার নামে শারমিন অথচ তোমার? ‘
এটুকু বলে শারমিনের বুকে হাত রাখলো অন্যহাতে তলোয়ার টেনে গায়ের সর্বশেষ শক্তিটুকু দিয়ে শারমিনের বক্ষঃস্থলে বেশ কয়েকবার আঘাত করলো। বারকয়েক গোঙানি দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো শারমিন। তার শুভ্র মুখশ্রী’তে তাকিয়ে মুচকি হেসে অলিওর বললো,
-‘ মৃত্যু সঙ্গী হলে তবুও হৃদয়ে স্থান দিলে না। ‘
আফসোসের সাথে শেষ এটুকু বাক্য উচ্চারণ করে চিৎ হয়ে শুয়ে নিজের পেট বরাবর দু’হাতে তলোয়ার চেপে ধরলো অলিওর। চোখ উল্টে দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো সে নিজেও। পলাশ,রঙ্গন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একধ্যানে তাকিয়ে রইলো শারমিন বাইজি এবং জমিদার অলিওর চৌধুরী’র মৃত দেহের দিকে। তাদের পাঁচ ভাই’য়ের সম্মানিত পিতার লাশের দিকে! ভীতিগ্রস্থ হয়ে এক ঢোক গিলে রঙ্গন পলাশের পানে তাকাতেই পলাশ চোয়াল শক্ত করে বললো,
-‘ দু’টো পথের কাঁটা একসাথে শেষ। ‘
রঙ্গন বিস্মিত হয়ে কেঁদে ফেললো। বললো,
-‘ ভাই আমাদের আব্বা! ‘
-‘ আব্বার কথা না ভেবে বাঁচতে চাইলে এ গৃহ ত্যাগ কর। পারলে শহরে চলে যা। সবটা সামলে যখন খবর দেবো তখনি আসবি। ‘
[৩৫]
সারারাত ভারী বর্ষণ হওয়ার ফলে প্রকৃতির নিয়মানুসারে আজকের সকালটি বৃষ্টিস্নাত। সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই শাহিনুর অনুভব করলো তার মা পাশে নেই। মৃদু ভাবে চোখ খোলার চেষ্টা করতেই কর্ণকুহরে ভেসে এলো একাধিক মেয়েলি কন্ঠে ক্রন্দন ধ্বনি। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকিয়ে সন্তর্পণে ওঠে বসলো সে। বার, দুয়েক আম্মা, আম্মা করে ডেকেও যখন সারা পেলো না, তখন হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। শুনতে পেলো একাধিক ক্রন্দনধ্বনি। বুকের ভিতরটা অকস্মাৎ কেমন করে যেনো কেঁপে ওঠলো। ‘ আম্মা, আম্মা’ করে ডাকতে গিয়েও কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠলো। পরনের শাড়িটা ভালোভাবে গা’য়ে জড়িয়ে আঁচলটুকু কোমড়ে গুঁজে প্রথমে ধীরে পা বাড়ালো, কয়েক পা বাড়াতেই আপনাআপনিই তার পায়ের গতি বেড়ে গেলো। অস্থিরচিত্তে কোথায় থেকে কান্নার শব্দ আসে ভাবতে ভাবতেই ছুটে গেলো সেই বিশেষ কক্ষে। সেখানে গিয়ে সর্বপ্রথম যে দু’টো মানুষ’কে তার চোখে ভেসে ওঠলো তারা হলো – প্রেরণা এবং প্রণয় চৌধুরী!

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।