-‘ আজ এই জোৎস্নামাখা রাতটি স্মরণীয় হবে তোমার আমার মাখামাখি তে! ‘
শাহিনুরের কর্ণকুহরে পলাশ চৌধুরী’র বলা কুরুচিপূর্ণ বাক্য’টি বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত করলো। সম্ভাব্য বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষার্থে অজান্তেই ভীষণ সাহসিকতার একটি কাজ করে ফেললো সে৷ সকল ভয়, ক্ষণকাল পূর্বে পাওয়া অশুভ স্পর্শের তীব্র যন্ত্রণা নিমিষেই দূর হয়ে গেলো৷ পিছন দিক না ফিরেই পলাশ চৌধুরী’র থেকে বাঁচার তাগিদে দু’হাতে মাটি খামচে ধরলো। ঝরঝরে দু’মুষ্টি মৃত্তিকা অনায়াসেই মুঠোবন্দি করে নিলো৷ তারপর ঝড়ের গতিতে পিছু ঘুরে উৎপেতে থাকা কু’দৃষ্টিজোড়ায় ছুঁড়ে মারলো শুকনো মাটির গুঁড়ো গুলো৷ ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে সহসা শাহিনুর এমন আঘাত হানবে দিবাস্বপ্নেও কল্পনা করেনি পলাশ। মৃদ্যু সুরে আর্তনাদ করে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে গেলো পলাশ৷ দু’হাতে নিজের দু’চোখ চেপে ধরে বিশ্রিভাষায় গালি দিলো শাহিনুর’কে। বদ্ধ চোখেই আন্দাজে শাহিনুর’কে খাবলে ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার পূর্বেই শাহিনুর ওঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাতে উদ্যত হয়৷ কয়েক কদম এগুতেই আঁচলে টান পড়ে৷ ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে পিছু তাকাতেই দেখতে পায় চোখজোড়া বন্ধ রেখেই একহাতে শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছে পলাশ। কয়েকবার সে আঁচল ছাড়ানোর চেষ্টা করার পর যখন দেখলো ওঠে দাঁড়াচ্ছে পলাশ তৎক্ষনাৎ কেঁদে ওঠে সম্পূর্ণ শাড়ি খুলেই পালানোর চেষ্টা করলো শাহিনুর। নিজের অর্ধনগ্ন দেহটি ঢাকার জন্য বেঁধে রাখা কেশগুচ্ছ ত্বরিতগতিতে খুলে ফেললো। ঢেউ খেলানো লম্বা লম্বা চুলগুলো ছুটতে থাকা অবস্থায়ই দু’কাঁধের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলো৷ তার মস্তিষ্কে কেবল একটা কথাই বিচরণ করলো,
-‘ আমার আম্মা নেই, কিন্তু আম্মার কথাগুলো, উপদেশ গুলো ঠিক রয়েছে। আম্মার উপদেশগুলোই আমার শক্তি। ‘
কে বলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বড়ো হতে হয়? পনেরো বছর বয়সী কিশোরী’টি একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে,নিজের জন্মদাত্রী’কে হারিয়ে ঠিক তো বড়ো হয়ে গেলো। কই তার তো বয়সের প্রয়োজন পড়লো না। এই তো ঠেকে গিয়ে ঠিক শিখে গেলো, ঠিক নিজেকে রক্ষা করার সাহস পেয়ে গেলো! প্রতিপক্ষ তোমায় দশবার আঘাত করার পর তুমি যদি একবার হলেও তাকে আঘাত করতে পারো এই ভীষণ গর্বের।
[ ৩৮ ]
অলিওর চৌধুরী এবং শারমিন বাইজির মৃত্যু দিন থেকে পলাশ’কে চোখে চোখে রাখছিলো প্রণয়। হসপিটাল থেকে লম্বা একটা সময়ের জন্য ছুটি নিলেও ইমারজেন্সি কিছু প্রয়োজনে কয়েক ঘন্টার জন্য হসপিটাল গিয়েছিল সে। সেই ফাঁকেই সুযোগ টা কাজে লাগিয়েছে পলাশ৷ বাড়ি ফিরতেই যখন পলাশ’কে পেলো না। আশপাশের কোথাও তাকে নজরে পড়লো না পাগল পাগল হয়ে গেলো সে। বাড়ির প্রতিটি সদস্য থেকে শুরু করে কয়েকজন ভৃত্য’কে জিজ্ঞাসা করলো। কিন্তু আশানুরূপ ফল পেলো না। শেষে তীব্র শঙ্কা নিয়ে বাইজে গৃহের মেইন গেটে এসে সবুর উদ্দিন’কে কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করলো। সবুর উদ্দিন ভয়জড়িত কন্ঠে সত্যি বলে দেয় যে পলাশ গৃহের ভিতরেই অবস্থান করছে। এটুকু শুনতেই কান গরম হয়ে দু’চোখ রক্তিম আভায় ছেঁয়ে গেলো তার৷ চোয়াল শক্ত হয়ে শরীরের প্রতিটি রগ যেনো ফুলে ফেঁপে ওঠলো৷ এক মূহুর্তও অপেক্ষা না করে গৃহের ভিতর প্রবেশ করে দেখলো প্রতিটি বাইজির মুখে আতঙ্কের ছাপ। ভিতরের কক্ষ থেকে দ্বারে কড়াঘাতের স্বল্প শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে শব্দ’কে অনুসরণ করে প্রণয় সঠিক কক্ষের সামনে এসে দ্রুত বদ্ধ দ্বার খুলে দিলো৷ নিমিষেই বেরিয়ে এলো মান্নাত৷ ভয়াবহ আর্তনাদ করে বললো,
-‘ নুর, নুর কোথায়? ‘
বক্ষঃস্থল কেঁপে ওঠলো প্রণয়ের। মান্নাত প্রণয়’কে দেখে ঈষৎ ভরসা পেলো৷ চিৎকার করে বললো,
-‘ আপনি তো নুরের মা’কে বলেছিলেন আপনি ওকে বিয়ে করবেন। আপনার উদ্দেশ্য যদি হালাল হয় দয়া করে নুর’কে রক্ষা করুন৷ ‘
প্রণয় থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে শঙ্কিত কন্ঠে বললো,
-‘ নুর কোথায়? ‘
মান্নাত ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো,
-‘ আপনি আমার সাথে আসুন৷ ‘
মান্নাত ত্বরিতগতিতে পা বাড়ালো বাইজি গৃহের পশ্চাতে তাকে অনুসরণ করলো প্রণয়ও৷ বাইজি
গৃহের বাম পার্শ্বে পুকুর, পুকুরের থেকে গৃহের দেয়াল অবদি যে কাঁচা রাস্তা রয়েছে সে রাস্তা দিয়েই মান্নাত আর প্রণয় যাচ্ছিলো৷ মান্নাত ছুটতে গিয়ে কিছুটা হাঁপিয়ে ওঠায় ধীরগতিতে হাঁটছে। ততোক্ষণে প্রণয় সবটা বুঝে পায়ের চলন বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠিক সেই ক্ষণেই প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহের মতো করে প্রণয়ের বুকে এসে ধাক্কা খেলো শাহিনুর। সুঠাম দেহের শক্ত মজবুত, বুকেরপাটায় আকস্মাৎ ধাক্কা খেতেই তার কোমল নাসিকার ডগা থেতলে গেলো যেনো৷ বিশাল দেহের সাথে সংঘর্ষে নিজের ক্ষুদ্র দেহখানি আর ধরে রাখতে পারলো না শাহিনুর। বদ্ধ দৃষ্টিতে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় একদম চিৎ হয়ে ভূমিতলে শরীর ছেড়ে দিলো সে! পিছন থেকে ভয়ে ‘ নুর ‘ ডেকে আর্তচিৎকার করে ওঠলো মান্নাত।
চলবে….
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২৭ ( শেষাংশ )
অর্ধন’গ্ন অবস্থায় শাহিনুর’কে দেখে থমকে গেলো প্রণয়। সহসা দৃষ্টিজোড়া সংযত করে নিলো৷ পেছনে মান্নাতের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। ইশারায় শাহিনুরের কাছে যেতে বললো তাকে। মান্নাত হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে শাহিনুর’কে ধরলো। শরীরের সমস্ত শক্তি যেনো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে লাগলো শাহিনুরের। মান্নাত’কে কাছে পেয়ে আবার পূর্বের রূপে ফিরে গেলো সে। যেই রূপে সে অতি নগন্য নির্বোধ এক কিশোরী ছাড়া আর কিছুই নয়। মাটিতে বসে মান্নাত’কে জড়িয়ে ধরে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। শরীরে অত্যাধিক কম্পনের ফলে তার ক্রন্দনধ্বনি শুনতেও ভয়াবহ লাগছে। সেই ভয়াবহ ধ্বনি কর্ণকুহরে বারংবার আঘাত করতেই বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রণয়ের। চোয়াল শক্ত করে রক্তিম চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে নিঝুম রাতটি’কে দেখতে দেখতেই তার সুঠাম দেহে জড়িয়ে থাকা শুভ্র বর্ণের শার্টটির সাতটি বোতাম অতি সন্তর্পণে খুলে ফেললো। একইভাবে দাঁড়িয়েই শার্ট এগিয়ে দিলো মান্নাতের দিকে। গম্ভীর কন্ঠে আদেশ করলো,
-‘ মান্নাত বাইজি…এটা নাও ওকে পরিয়ে দাও ফার্স্ট।’
মান্নাত কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত হয়ে প্রণয়ের থেকে শার্ট নিয়ে শাহিনুর’কে পরিয়ে দিলো। প্রশ্নও করলো,
-‘ নুর তোর কোন ক্ষতি করেনিতো ও? ‘
কান্না করতে করতে হেঁচকি ওঠে গেছে শাহিনুরের। সে অবস্থাতেই সে ভেঙে ভেঙে বললো,
-‘ না বুবু তার আগেই আমি চোখে বালু দিয়ে দৌড় দিছি। ‘
বিস্মিত হয়ে গেলো মান্নাত। বিস্মিত হলো প্রণয়ের ক্রোধান্বিত রক্তিম চক্ষু যুগলও। শুঁকনো গলায় এক ঢোকও গিললো সে। কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেয়ে বিরবির করে বললো,
-‘ তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো সৃষ্টিকর্তা। আর তোমার কাছে চিরঋণী হয়ে গেলাম নুর। ‘
দৃষ্টিজোড়া আবদ্ধ করে গভীর শ্বাস ছাড়লো প্রণয়। আজ যেনো শাহিনুর নিজেকে নয় তাকেই রক্ষা করেছে। অশুভ স্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে এনেছে তার প্রাণভোমরা’কে। শাহিনুর’কে ধীরে সুস্থে দাঁড় করালো মান্নাত। প্রণয় তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। শাহিনুরের শঙ্কিত মুখশ্রী’তে নম্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মান্নাতের উদ্দেশ্যে অকপটে বললো,
-‘ আজ এ পৃথিবীতে শারমিন বাইজি নেই। যতোদিন তিনি ছিলেন ততোদিন আমি তার সিদ্ধান্তের, তার অনুমতির প্রয়োজন বোধ করেছি। আজ যেহেতু তিনি নেই তার কন্যাটিও নিজের জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়নি। তাই তার কন্যা মানে শাহিনুর শায়লার দায়িত্ব আমি জমিদার অলিওর চৌধুরী’র পুত্র প্রণয় চৌধুরী নিলাম। ‘
সর্বাঙ্গে শিউরে ওঠলো শাহিনুরের। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো তার। কেঁপে ওঠলো মান্নাত বাইজি নিজেও। ভয়জড়িত কন্ঠে বললো,
-‘ আপনি কিন্তু শাহিনুর’কে বিয়ে করে স্ত্রী’র মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। সখী তো আমাকে এটাই বলেছিলো। কিন্তু… ‘
হাত উঁচিয়ে মান্নাত’কে থামিয়ে দিলো প্রণয়। দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ আমার আব্বা এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে আজ চারদিন। এমতাবস্থায় বিয়ে করা সম্ভব হলেও বাড়ির কারো মতামত থাকবে না। তাছাড়া আমার শ্রদ্ধের দুই মা এখনো জীবিত রয়েছেন, তাদের থেকে অনুমতি নিয়ে বেশ ধুমধাম করেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবো আমি। ‘
মান্নাত বললো,
-‘ আপনার কি মনে হয় নুরকে বিয়ে করতে চান এ সিদ্ধান্ত আপনার পরিবার সহজেই মেনে নেবে? ‘
-‘ একদমই না সহজে মানবে না বলেই কঠিন করে মানাবো৷ ‘
ঈষৎ বাঁকা হেসে প্রণয় কথাটি বলতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো মান্নাত। শাহিনুর’কে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো সে। নিঝুম রাত৷ চারদিকে নিস্তব্ধতা। দূর পানে কিছু শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। বাইজি গৃহের বাইরে এবং পাঁচফোড়ন গৃহের পশ্চাতে পুকুরের চারপাশে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। যার ফলে অন্ধকারে মৃদ্যু আলোয় প্রণয়’কে সুস্পষ্ট নজরে পড়ছে মান্নাতের। প্রণয়ের সঙ্গে চেহেরার দিক দিয়ে দারুণ মিলে যায় পলাশের৷ উচ্চতা,গায়ের বর্ণ, দেহের গড়ন, পুরু ওষ্ঠাধরে ফুটে ওঠা বাঁকা হাসি সবটাতেই অদ্ভুত মিল। যদিও পলাশের ঠোঁটজোড়া প্রণয়ের মতো এতোটা স্বচ্ছ নয়। সব মিলিয়ে মান্নাতের বক্ষঃস্থলে ঈষৎ সংশয় জাগলো। প্রণয়ের সম্পর্কে যাই শুনুক, যাই দেখুক সেও তো জমিদার পুত্র! নুর’কে প্রণয়ের হাতে তুলে দেওয়া শেয়ালের কাছে মুরগী বাগি দেওয়া হবে না তো! মান্নাতের চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রণয় বললো,
-‘ মান্নাত বাইজি… নিজ গৃহে ফিরে যাও। ‘
মান্নাত’কে কথাটা বলেই শাহিনুরের দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রণয়। শান্ত গলায় বললো,
-‘ আর তুমি, এ মূহুর্তে আমার সঙ্গে আমার গৃহে প্রবেশ করবে। কথা দিচ্ছি এ পৃথিবীর কোন অশুভ ছায়া তোমার গায়ে পড়ার সাহস করবে না। ‘
প্রণয়ের কথা শুনে শাহিনুর আঁতকে ওঠলো। মান্নাত’কে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো,
-‘ মান্নাত বুবু আমি কোথাও যাবো না, যাবো না কোথাও আমি। ওরা খুব খারাপ লোক, খুব খারাপ লোক ওরা বুবু। ‘
কোনক্রমেই প্রণয়ের সঙ্গে যেতে রাজি হলো না নুর৷ প্রণয়ও নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলো। দ্বিধান্বিত হয়ে মান্নাত খুব বোঝালো নুর’কে। কিন্তু নুরও জেদ ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রণয় একবার ভাবলো নুর’কে সময় দেবে। কিন্তু আবার ভাবলো বাইজি গৃহের সব দায়িত্ব পল্লব চৌধুরী আর পলাশ চৌধুরীর হাতে। এ গৃহ কোনমতেই নুরের জন্য নিরাপদ নয়। তাই বাঁধ্য হয়ে কিছুটা জোর খাঁটিয়ে নুরের হাত ধরলো প্রণয়। ভয়ে শিউরে ওঠলো শাহিনুর৷ একহাতে মান্নাতের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। প্রণয় তাকে তার গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাত টেনে ধরলো আর সে মান্নাতের হাত চেপে ধরে চিৎকার করে বললো,
-‘ মান্নাত বুবু আমি যাবো না। আমাকে ফেরাও বুবু, আমাকে যেতে দিও না। ‘
নিরুপায় মান্নাত জোর খাটাতে পারলো না৷ এক চিলতে সুখের আশায় প্রণয়ের কাছে ছেড়ে দিলো তাকে। আর যাইহোক মান্নাত নিশ্চিত পাঁচফোড়ন গৃহে থাকলে নুরের কোন ক্ষতি হবে না। স্বয়ং পলাশ চৌধুরীও ঐ গৃহে থাকা অবস্থায় নুর’কে স্পর্শ করার কথা ভাবতেও পারবেনা। জমিদার’রা নিজেদের গৃহে কোন অপকর্ম করেনা, এটা তাদের গুণ বললে গুণ, ধর্ম বললে পরম ধর্ম।
[৩৯]
পাঁচফোড়ন গৃহ-
বৈঠকখানায় বসে তসবিহ পড়ছে অরুনা। তার পাশে বসে আছে প্রেরণা। মুনতাহা তাকে পান বানিয়ে দিলো। সে পান গালে ভরে মুনতাহার মাথায় হাত বুলালো প্রেরণা। বললো,
-‘ যা মা বড়ো বউ অঙ্গন’কে খাওয়াতে গেছে। একটু দেখে আয় তো সব ঠিকঠাক আছে কিনা। ‘
বাধ্য মেয়ের মতো দেবরের ঘরের দিকে খোঁজ নিতে চলে গেলো মুনতাহা। জেবা হেলেদুলে একহাতে বিনুনি ঝুলাতে ঝুলাতে সবেই বৈঠকখানায় পা দিয়েছিলো। তখনি মুনতাহাকে যেতে দেখে অবাকান্বিত হয়ে সে প্রেরণা’কে প্রশ্ন করলো,
-‘ আম্মাজান, আপনি কি আপা’কে বিশ্বাস করেন না? হতে পারে সে আমার সতীন তাই বলে তার নামে মন্দ কথা বলবো না। সে কিন্তু খুবই ভালো মানুষ। আমাকে খুব আদর করে সবসময় স্বীকার করে তার চেয়ে আমি অনেক বেশী সুন্দরী। অমন একটা ভালো মনের মানুষ’কে, আমার একটা মাত্র সতীন’কে আপনি এভাবে সন্দেহ করলেন! ‘
জেবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রোধী কন্ঠে প্রেরণা বললো,
-‘ এই একদম আধপাগলের মতো কথা বলবে না। আমি কীভাবে বড়ো বউ মা’কে সন্দেহ করলাম? ‘
অরুণা বেশ বিরক্তবোধ করলো। মন মানসিকতা একদম ভালো নেই তার। আর না এদের সাপেনেউলে সম্পর্কের মাঝে ফোড়ন কাটার ইচ্ছে আছে৷ তাই তসবিহ হাতেই সে ওঠে দাঁড়ালো। ক্ষণকাল প্রেরণার দিকে নিশ্চুপ ভণিতায় চেয়ে রইলো। কিন্তু কিছু বললো না। বৈঠকখানা ত্যাগ করে নিজ কক্ষে প্রস্থান করলো। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না জেবা। সে আয়েশ করে সোফায় শাশুড়ির মুখোমুখি হয়ে বসলো। হিহিহি করে হাসতে হাসতে বললো,
-‘ আম্মা আপনার মাথায় যে একটু বুদ্ধিসু্দ্ধি কম তা আমি আগেই বুঝছি। যাকগে, আপনি যে আপনার ভাইয়ের মেয়ে মুনতাহা’কে শবনম আপার চেয়ে বেশী বিশ্বাস করেন এটার প্রমাণ এর আগেও পেয়েছি। এই যে অঙ্গন’কে রোজ তিনবেলা আপা খাওয়ায় আর আপনি তিনবেলাই মুনতাহা’কে দেখতে পাঠান এটা কি সন্দেহ করে পাঠান না? আপনি মুনতাহা’কে ভরসা করেন কিন্তু আপাকে করেন না৷ তাই তো সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখার জন্য ওরে পাঠান। যেখানে আপা আছে সেখানে সব ঠিকঠাক থাকবে না কেন বলুন? ‘
হকচকিয়ে গেলো প্রেরণা। আমতা আমতা করে বললো,
-‘ তুমি সবসময় বাজে বকো জেবা। ‘
খিলখিল করে হেসে ওঠলো জেবা। ঠোঁটে লেপ্টে থাকা গাঢ় লাল লিপস্টিক দু’ঠোঁট একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে ঘষে নিলো একবার। চোখে দুষ্টু হাসির ঝলক তুলে বললো,
-‘ ধরা পড়ে গিয়ে আমতা আমতা করছেন আম্মা দেখছেন। ‘
ফুঁসে ওঠে কড়া চোখে তাকালো প্রেরণা। জেবা তর্জনী আঙুল দিয়ে নিজের ওষ্ঠাধর চেপে ধরলো। বিরবির করে বললো,
-‘ আর সত্যি কথা বলবো না আম্মা। ‘
প্রেরণা এবার কপাল চাপড়াতে শুরু করলো। আফসোসের সুরে বললো,
-‘ হায় আল্লাহ রে আমার বড়ো ছেলে কি পাগল ধরে আনছেরে! ‘
শাহিনুর’কে নিয়ে পাঁচফোড়ন গৃহে প্রবেশ করলো প্রণয়। হাত ধরা থেকে শুরু করে পাঁচফোড়ন গৃহে প্রবেশ করা অব্দিও শাহিনুর প্রণয়ের থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু যেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করলো তখনি চুপ হয়ে গেলো সে৷ তাকে নিয়ে প্রণয় উপস্থিত হলো বৈঠকখানায়৷ সেখানে প্রেরণা আর জেবা বসা ছিলো। প্রণয় আর নুর সর্বপ্রথম জেবার নজরেই পড়লো। জেবা ওদের দেখে টু শব্দটিও করলোনা। কেবল অবাকান্বিত হয়ে ওঠে এসে তাদের সামনে দাঁড়ালো। শাহিনুর’কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। প্রণয়ের গায়ে শুধু সেন্ডো গেঞ্জি শাহিনুরের পরনে শার্ট বেশ অবাক হলো সে। প্রণয়’কে বললো,
-‘ এটা কোন নায়িকা ভাই? ‘
ক্ষণকাল চুপ থেকে ভাবুক সুরে আবার বললো,
– ‘ এই মেয়েটা কি আমার চেয়ে সুন্দরী হবে? ‘
এটুকু বলে শাহিনুরের বাহুতে ধরলো। আঁতকে ওঠলো শাহিনুর। প্রণয় শাহিনুরের হাতটা আরেকটু ভরসার সঙ্গে চেপে ধরলো। জেবা আবার বললো,
-‘ নাহ বাবা আমার চেয়ে সুন্দরী না। ‘
পিছন থেকে প্রেরণা মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে ওঠলো,
-‘ প্রণয়! এসব কী? ও তোর সঙ্গে, এভাবে কেন? ‘
আতঙ্কিত হয়ে জেবা শাহিনুরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে শাশুড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বুকের ভিতর ধড়পড় করতে শুরু করলো শাহিনুরেরও। কিন্তু প্রণয় মুখে গম্ভীর্যতা ফুটিয়ে তুলে শান্ত রইলো। বললো,
-‘ আজ থেকে ওর দায়িত্ব আমার আম্মা। আজ থেকে ও আমার সঙ্গে এ বাড়িতেই থাকবে। ছত্রিশ দিন পর বিয়ে করবো ওকে আমি! ‘
প্রণয়ের মুখে এহেন বক্তব্য শুনে মাথা ঘুরে গেলো প্রেরণার। আকস্মাৎ শবনম এসে ধরলো শাশুড়ি’কে। প্রেরণা করুণ সুরে শবনম’কে বললো,
-‘ বড়ো বউ আমার প্রণয়, আমার প্রণয় এসব কি বলছে? ‘
একে একে বাড়ির প্রতিটি সদস্য এসে হাজির হলো বৈঠকখানায়। এলো পল্লব চৌধুরী নিজেও। সকলের সম্মুখে প্রণয় জানালো সে এক বাইজি কন্যা’কে বিয়ে করবে। জমিদার পুত্র বিয়ে করবে এক বাইজি কন্যা’কে! এ কোন অভিশাপ! কার অভিশাপ! সকলেই স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মুনতাহার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। নুর’কে দেখে ভীষণ ঈর্ষা হলো তার মনে মনে বললো,
-‘ এই রূপের জন্যই উনি এতো মরিয়া হয়ে ওঠেছে।’
প্রেরণা, অরুণা প্রণয়ের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হলো। প্রেরণা আহাজারি করতে করতে বললো,
-‘ আমার এতো সভ্য, মার্জিত ছেলেটা’কেও ঐ কালনাগিনীর মেয়ে ফাঁসালো। আমার ছেলেটা’রে তাবিজ করে শেষমেশ আমার সংসারে ঢুইকা পড়লো। ‘
প্রণয় মায়ের কথায় ভ্রুক্ষেপ করলো না। সকলের সামনেই শাহিনুরের হাত ধরে গটগট পায়ে চলে গেলো নিজের কক্ষে। প্রণয়ের এইরূপ আচরণ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো প্রেরণা। পল্লব চৌধুরী ভীষণ চিন্তামগ্ন হয়ে বেরিয়ে পড়লো গৃহ থেকে। বাড়ির সকলে বাকহারা অবস্থায় শাশুড়ির কাছাকাছিই অবস্থান করলো। নিজের কক্ষে গিয়ে দরজার বন্ধ করে দিলো প্রণয়। ফাঁকা কক্ষে একা দু’জন এমতাবস্থায় দরজা বন্ধ করতেই প্রণয়ের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো শাহিনুর। আশপাশে তাকিয়ে ভাঙা কন্ঠে বললো,
-‘ দরজা বন্ধ করলেন কেন আপনি? আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাইনা, আমি থাকবো না আপনার সাথে। ‘
ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত ভঙ্গিতে পালঙ্কে গিয়ে বসলো প্রণয়। দৃষ্টি মেঝেতে নত রেখে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ আমায় তুমি ভরসা করতে পারো। তোমার কোন ক্ষতি হবে না। ‘
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। সে দৃষ্টির দিকে কিঞ্চিৎ তাকিয়ে আবারো মাথা নত রাখলো প্রণয়। বদ্ধ ঘরে কয়েক পল নীরবতায় কাটিয়ে সহসা
বলে ওঠলো,
-‘ একটা সুন্দর জীবন চাও তো নুর? একটা সুন্দর, স্বাভাবিক, সম্মানীয় জীবন কাটাতে চাও তো তুমি? ‘
ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। এক ঢোক গিলে বললো,
-‘ চাই কিন্তু আমি আপনার বউ হতে চাইনা। ‘
চমকে তাকালো প্রণয়। শাহিনুরও তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঝাপসা সে দৃষ্টিজোড়ায় দৃঢ় চোখে চেয়ে বললো,
-‘ বউ তো আমারি হতে হবে। ‘
-‘ আমি আপনার ভাই’কে ভালোবাসি। ‘
অকপটে জবাব শাহিনুরের৷ বিস্মিত হয়ে গেলো প্রণয়৷ বক্ষঃস্থলে পীড়া বোধ করলো খুব। ক্ষোভের সাথে বলে ফেললো,
-‘ ভুলে যাও সেই ভালোবাসা যে ভালোবাসা তোমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ‘
কেঁদে ফেললো শাহিনুর। বললো,
-‘ আমার আম্মা নেই বলে আপনারা সবাই সুযোগ পেয়েছেন তাইনা? আপনি নিজেকে খুব চালাক মনে করছেন। কিন্তু মনে রাখবেন আমাকে আপনি আঁটকে রাখতে পারবেন না৷ আমি ঠিক নিজেকে উদ্ধার করবো আপনার হাত থেকে! ‘
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে প্রণয় বললো,
-‘ এই যে আমিটা এ মূহুর্তে তোমার সামনে আছি আর কিছু সময় আগে আমার পুরো পরিবারের সামনে যে আমিটা দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ’দুটো আমিতে ফারাক কতোটা একদিন ঠিক বুঝতে পারবে নুর। ‘
শাহিনুর নির্বোধ চোখে তাকিয়ে রইলো। প্রণয় ঈষৎ হেসে বললো,
-‘ তুমি বড়ো ভাগ্যবতী নুর, এই তুমিটার জন্য প্রণয় চৌধুরী তার সকল কাঠিন্যতা’কেও আজ বর্জন করে ফেলেছে। তুমি বড়ো ভাগ্যবতী তাই তো পুরো দুনিয়ার কাছে কঠিন স্বভাবের মানুষ টা তোমার কাছে একেবারেই নির্মল। ‘
কঠিন অর্থপূর্ণ বাক্যগুলোয় তেমন বুঝ এলো না শাহিনুরের। কিন্তু কথার ছলে প্রণয় খেয়াল করলো শাহিনুরের উদরের পাশে সাদা শার্টটিতে কিঞ্চিৎ লাল তরলে ভেজা। যা দেখা মাত্রই বুক কেঁপে ওঠলো তার। অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ওঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে শার্ট উঁচু করতে উদ্যত হতেই পিছিয়ে গেলো শাহিনুর। আশপাশে চেয়ে প্রণয়কে আঘাত করার জন্য অস্ত্র খুঁজতে লাগলো। প্রণয়ও তার দিকে এগিয়ে গিয়ে এক হাতে তার পিঠ চেপে ধরলো। অপরহাতে ত্বরিতগতিতে উদরের থেকে শার্ট উঁচিয়ে ফর্সা ত্বকে নখের আঁচড়, রক্ত দেখলো। মনটা বিষিয়ে ওঠলো তার। পলাশ’কে স্মরণ হতেই মাথায় রক্ত ওঠে গেলো। শাহিনুর আবারো পিছিয়ে গেলো। তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়, তার দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পেরে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ শোনো মেয়ে, আমার সর্বপ্রথম পরিচয় আমি একজন দায়িত্বশীল ডক্টর। আমি পুরুষ এর থেকেও বড়ো পরিচয় আমি একজন সেবক। এ মূহুর্তে তোমার কোমল ত্বকে আমার সেবার ভীষণ প্রয়োজন। ‘
এটুকু বলেই আলতোভাবে আঙুল ছোঁয়ালো আঁচড়ের ওপর৷ শিউরে ওঠে কিঞ্চিৎ ব্যথাতুর শব্দ করলো শাহিনুর৷ প্রণয় দেরি না করে শাহিনুর’কে জোর পূর্বক পালঙ্কে বসালো। চিকিৎসা বাক্স এনে মেডিসিন লাগিয়ে দিলো। শাহিনুর অনুভব করলো,প্রণয় তার ভালোর জন্যই তাকে ছুঁয়েছে। পলাশের মতো তাকে আঘাত করেনি। বরং পলাশের করা আঘাত যত্ন নিয়ে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। একটুখানি ভালো অনুভূতির মাঝেও প্রণয়ের করা শেষ কার্যে আবার সংশয় জেগে ওঠলো মনে। তাকে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়ে হঠাৎ প্রণয় তাকে কক্ষের ভিতরে বাম পার্শ্বে যে থাই গ্লাসের দেয়াল রয়েছে সেটির সামনে নিয়ে গেলো। থাইগ্লাসের দরজাটি ধাক্কা দিয়ে খুলে শাহিনুর’কে ভিতরে নিয়ে গেলো। শাহিনুর চারপাশে চোখ বুলালো। এক কক্ষের ভিতর আরেকটি ভিন্ন কক্ষ দেখে বেশ অবাক হলো সে। এমনটি জীবনে দেখেনি সে। তার অনুভূতি বুঝতে পেরে প্রণয় মুচকি হেসে বললো,
-‘ এই বিশেষ কক্ষটি শুধু তোমার জন্য নুর। মহিলারা যেমন তাদের অতি মূল্যবান গহনা তাদের গোপন সিন্দুকে রাখে। ঠিক তেমনি আমার অতি মূল্যবান সম্পত্তি’কে ছত্রিশ দিনের জন্য এই বিশেষ কক্ষ ওরফে সিন্দুকে রেখে দিলাম। এবার দেখি কেমন করে আমার থেকে নিজেকে উদ্ধার করো প্রিয়দর্শিনী!’