মধ্যাহ্নভোজের সময় বাসায় এলো প্রণয়৷ শোবার ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল মেঝেতে স্থবির হয়ে বসে আছে শাহিনুর৷ কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে পরনের কোট খুলে বিছানার একপাশে রাখল। শার্টের কয়েকটা বোতাম আলগা করে ফ্যানের সুইচ অন করল৷ শাহিনুর তবুও এক চুল পরিমাণ নড়ল না৷ প্রণয় ভ্রু কুঁচকে হাঁটু গেড়ে বসল ওর পাশে। হাত বাড়িয়ে কাঁধ ছুঁয়ে বলল,
-‘ নুর খাবার কী হয়েছে? ‘
জবাব দিল না শাহিনুর বরং তীব্র ক্রোধের সঙ্গে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিল৷ বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেল প্রণয়। পুনরায় কাঁধে হাত রেখে শান্ত কণ্ঠে শুধাল,
-‘ এমন করছো কেন? কী হচ্ছে তোমার দু’দিন পর পর। ‘
এবারও একই ঘটনা ঘটালো শাহিনুর৷ কিন্তু এবার আর প্রণয় শান্ত রইল না। তপ্ত মেজাজে বলিষ্ঠ হাত দ্বারা শাহিনুরের দু’গাল প্রচণ্ড শক্ত করে চেপে ধরল। ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল,
-‘ একদম বেয়াদবি করবি না। কী সমস্যা হয়েছে পরিষ্কার করে বলবি। ‘
ব্যথায় অসহনীয় হয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করল শাহিনুর৷ সহসা ছেড়ে দিল প্রণয়৷ ওঠে দাঁড়িয়ে পরনের শার্টটা একটানে খুলে আছড়ে ফেলল মেঝেতে। পরোক্ষণেই এক লাথি দিয়ে দূরেও ছিটকে ফেলল। আর এক মুহূর্ত দেরি করল না সে। ধপাধপ্ পা ফেলে বেরিয়ে গেল। ডিউটি শেষ না হলেও আজ আর হাসপাতালে গেল না সে৷ দুপুরে খাবারও খেল না। চুপচাপ পাশের ঘরে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করল শুধু৷ শাহিনুরও সারাদিন অনড় হয়ে পড়ে রইল। এক সময় দুচোখে বেয়ে ঝড়তে লাগল অজস্র নোনাপানি। দিন পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এলো। প্রণয়ের রাগও কমে এলো। নিজেকে বরফের মতো ঠাণ্ডায় পরিণত করার জন্য দীর্ঘ সময় গোসল করল। ঘরে ফিরে যখন শাহিনুর’কে একই অবস্থায় দেখল কড়া কণ্ঠে আদেশ দিল স্বাভাবিক হতে,এবং কী হয়েছে তাকে বলতে। শাহিনুর কিছুই না বলে চুপচাপ ওঠে ঘরের বাইরে চলে গেল৷ রাতের খাবার তৈরি করে বসে রইল ভোজনালয়ে। প্রণয়ও কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেতে বসল। কিন্তু শাহিনুর নিজের জন্য খাবার বাড়েনি বলে সে খাওয়া শুরু করল না। শুধু কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে শাহিনুর বলল,
-‘ আমার খিদে নেই। আপনি খেয়ে নিন। ‘
সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রণয়। চোয়াল শক্ত করে জবাব দিল,
-‘ তোমার হাতের রান্না খাওয়ারও ইচ্ছে নেই আমার৷ ‘
যেভাবে খাবার ছিল সেভাবেই পড়ে রইল৷ প্রণয় শুধু অপেক্ষা করতে লাগল সঠিক সময়ের৷ সময়টা বেশ গড়িয়ে গেলেও যখন শাহিনুর এলো না। ক্রোধে চোখমুখ শক্ত করে ঘর থেকে বেরিয়ে আশপাশে খুঁজল শাহিনুর’কে৷ কিন্তু পেল না। শেষে পাশের শোবার ঘরে উঁকি দিতেই শাহিনুর’কে বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখে চোখমুখ খিঁচে বিরবির করে বলল,
-‘ আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা দেব আমি? ‘
ঘরে ঢুকে প্রথমে ভালোভাবে শাহিনুর’কে নিজের ঘরে যেতে বলল৷ শাহিনুর শুনল না। প্রণয় টের পেল সে কাঁদছে। এর আগে কখনো এভাবে কাঁদেনি। নিজেকে যথেষ্ট শক্ত প্রমাণ করারই চেষ্টা করেছে। নিজের দুর্বলতাগুলো বিন্দুমাত্র প্রকাশ করেনি। তবে আজ কী হলো? মনে প্রশ্ন জাগলেও প্রকাশ্যে আর প্রশ্ন করল না। শাহিনুরের যেমন মনে জোর আছে তারও তেমন শরীরে জোর আছে৷ তাই জোরপূর্বক কোলে তুলে নিজের ঘরে চলে গেল৷ দুচোখের বাঁধভাঙা অশ্রুতে বুক ভিজে ওঠল প্রণয়ের৷ প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় পড়ে শাহিনুর’কে আর বিছানায় শুইয়ে দিল না৷ বরং পাঁজাকোল করেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো একদম বুকের সঙ্গে মিশিয়ে গালের সাথে গাল ছুঁইয়ে বলল,
-‘ এখানে নিয়ে আসা ছাড়া আর কী অভিযোগ আছে নুর? ‘
শাহিনুর ফুঁপিয়ে ওঠল। প্রণয় বলল,
-‘ আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। সোজাসাপটা কথা বলো আমার সঙ্গে। ‘
একটু থেমে আরেকটু গভীর হয়ে প্রশ্ন করল,
-‘ কী অভিযোগ আছে বলো? ‘
এবার ভাঙা কণ্ঠে প্রশ্ন করল শাহিনুর,
-‘ রোমানা আপা’কে কেন ভালোবাসলেন না ডাক্তারসাহেব? ‘
উদ্বিগ্ন প্রণয় সহসা ভীষণ শান্ত এবং গম্ভীর হয়ে গেল৷ গম্ভীরচিত্তেই ভারি নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু পায়ে ঘরে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল শাহিনুর’কে। শাহিনুর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। প্রণয় একটি কথাও বলল না আর। পাশফিরে শুয়ে পড়ল৷ শাহিনুর হাত বাড়িয়ে তার পিঠ স্পর্শ করল। ভাঙা গলায় বলল,
-‘ এই চিঠি’টা আমি সহ্য করতে পারছি না ডাক্তারসাহেব। রোমানা আপার মতো আমিও জানতে চাই কেন ভালোবাসলেন না আপা’কে। ‘
হঠাৎ প্রণয়ের কী হয়ে গেল কিছুই বুঝল না শাহিনুর। চৈত্র মাসের তীব্র উত্তাপ যেমন শরীর জ্বালিয়ে দেয় ঠিক অমনি করে ভালোবেসে শাহিনুরের শরীর জ্বালিয়ে দিল, উত্তপ্ত করে তুলল নিজের ভালোবাসার ছোঁয়ায়। শাহিনুর যখন সম্পূর্ণভাবে প্রণয়েতে মগ্ন হয়ে গেল ঠিক সে মুহূর্তে তার কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে প্রণয় বলল,
-‘ আমার উত্তর তুমি পেয়েছো চন্দ্রকান্তা? ‘
দু’চোখের কার্ণিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নিঃসৃত হলো শাহিনুরের৷ সে অশ্রুজল দেখে নিজের দেহের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিয়ে প্রিয় সহধর্মিণীকে বুকে পিষে বলতে লাগল,
-‘ আর কীভাবে বোঝাবো? একজন পুরুষ দু’জন নারীতে আসক্ত হতে পারে না। ‘
অস্ফুট স্বরে শাহিনুর বলল,
-‘ আমিই কেন? রোমানা আপা কেন নয়। আমার আগে রোমানা আপা আপনার জীবনে এসেছে। আমার চেয়েও আপনাকে অনেক বেশি ভালোবেসেছে রোমানা আপা। ‘
আর কিছু বলতে পারল না শাহিনর ডুকরে কেঁদে ওঠলো। রাতের শুরুতে শাহিনুরের কষ্ট উপলব্ধি না করলেও রাতের শেষটায় ঠিক পারল। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলে ফেলল,
-‘ খুব কষ্ট হচ্ছে নুর? তোমার স্বামী’কে তোমার অধিক কেউ ভালোবাসতো এই সত্যিটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে? ‘
শাহিনুর আর কোন উত্তর দিতে পারল না। কেবল অশ্রুবিসর্জন দিয়ে গেল। প্রণয়ের দৃষ্টিজোড়া চকচক করছে। শাহিনুর হয়তো টের পায়নি প্রণয়ের প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা। কিন্তু প্রণয় খুব টের পেল। মৃদু হাসি ফুটে ওঠল ঠোঁটের কোণে। ভালোবাসার আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে শাহিনুরের ললাটে গভীর এক চুম্বন এঁকে দিল। বলল,
-‘ তুমি ঠিক নারিকেলের মতো শক্ত শাহিনুর। যার বাইরে টা দেখলে বোঝার উপায় নেই ভিতরটা এত স্বচ্ছ, এত নমনীয়! ‘
[৭৩]
নতুন সংসারে দশ, বারো দিন কেটে গেল। ছোট ছোট অভিমানের শেষে সীমাহীন ভালোবাসায় সময়গুলো ভালোই কাটছে শাহিনুরের৷ অতিরিক্ত সুখে ফোড়ন দিতে মাঝেমধ্যে অবশ্য প্রণয়কে প্রশ্ন করে,
-‘ রোমানা আপা কেন নয়? আমিই কেন? ‘
একদিন তো কথার ছলে মুখ ফসকে বলে ফেলল,
-‘ পুরুষ মানুষ কত অদ্ভুত, তাদের সব ভালোবাসা শুধু রূপবতী নারীদের জন্য! ‘
বিনিময়ে প্রণয়ের কঠিন চাহনির কবলে পড়তে হলো। লম্বা একটা সময় দূরে সরেও রইল প্রণয়৷
জোর পূর্বক কয়েকবার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে শাহিনুর৷ কিন্তু লাভ হয়নি। প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলে না প্রণয়। এক হাত দূরত্ব রেখে রাতে ঘুমায়। গভীর রাতে শাহিনুর একটু কাছে ঘেঁষলে, ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে কঠিন স্বরে জবাব দেয়,
-‘ তোমার প্রতি আমি একটুও আগ্রহ বোধ করছি না।’
মন খারাপ করে শাহিনুর ভাবে,
-‘ উচিৎ কথার এত দোষ তা তো বুঝিনি। ‘
এরই মধ্যে শাহিনুরের প্রয়োজনে কাজের মেয়ের খোঁজ করল প্রণয়৷ শাহিনুর প্রণয়কে বলল,
-‘ বাইজি গৃহের রেশমার মেয়ে সখিনার সাথে আমার বেশ সখ্যতা আছে। অন্য কাউকে নয় সখী সখিনাকে নিয়ে আসলেই চলবে। ‘
বিনিময়ে গম্ভীর স্বরে প্রণয় জবাব দিল,
-‘হুম।’
আড়ালে ছোটো করে ভেঙচি দিয়ে মুচকি হাসল শাহিনুর৷ বিরবির করে বলল,
-‘ আর কত মেজাজ যে দেখাবে..’
পরেরদিনই সখিনা’কে নিয়ে এলো প্রণয়। অনেকদিন পর সখী’কে দেখে আবেগে ভেসে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল শাহিনুর৷ এ দৃশ্য দেখে গোপনে ভীষণ ক্ষেপে গেল প্রণয়। কিন্তু প্রকাশ করল না। এদিকে সখিনা’কে পেয়ে আর কোনদিকে নজর দিল না শাহিনুর। তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ একসাথে দুপুরের খাবার সেরে অনেক সময় গল্প করল
খবরাখবর নিল বাইজি গৃহের। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে শাহিনুর খেয়াল করল সখিনার মাঝে বেশ পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সেই পরিবর্তন’টা কী ধরতে পারল না। শুধু বলল,
-‘ তুই আগের চেয়ে অনেক শান্ত হয়ে গেছিস। ‘
সখিনা বলল,
-‘ সে তো তুইও। ‘
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাহিনুর বলল,
-‘ আমার জীবন আর তোর জীবন তো আলাদা সখী।’
বিনিময়ে তাচ্ছিল্য হেসে সখিনা বলল,
-‘ তুই অনেক ভাগ্যবতীরে আমিতো এক হতভাগি। ‘
শাহিনুরের মনে হলো তার মতো করেই অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে সখিনা। তাদের দুজনের মাঝে সেই চাঞ্চল্যকর অনুভূতির কানাকড়িও খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে আশ্চর্যকর বিষয় হলো সখিনা কিছু একটা আড়াল করার চেষ্টা করল। যা টের পেয়েও চেপে গেল শাহিনুর। তাদের মাঝে অনেকটা সময় বেশ দূরত্ব ছিল। কদিন যাক দূরত্ব কাটুক। তারপর না হয় দেখা যাবে।
হাসপাতাল থেকে দু’দিন ছুটি নিল প্রণয়। শাহিনুর অসংখ্যবার প্রশ্ন করলেও ছুটির কারণ বলল না সে।শেষে কিছুটা রাগ নিয়ে অভিমান করেই চুপ হয়ে গেল শাহিনুর৷ রাত তখন দশটা ছুঁই ছুঁই করছে। আলমারি খুলে পছন্দ সই কালো রঙের একটি জরজেট শাড়ি বের করে বিছানায় রাখল প্রণয়। শাহিনুর অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
-‘ নতুন শাড়ি! ‘
-‘ পড়ে এসো। ‘
-‘ কিন্তু কেন কোথায় যাব আমরা? ‘
মৃদু ধমক দিয়ে প্রণয় বলল,
-‘ যা বলছি তাই করো। ‘
চট করে শাড়িটা হাতে নিয়ে শাহিনুর বলল,
-‘ ভালোভাবে বললেই তো হয়। এটুকুর জন্য ধমক দেওয়ার দরকার নেই। ‘
কপট রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল শাহিনুর। পাশের ঘরটা সখিনাকে দিয়েছে সে। তাই সে ঘরে ঢুকে শাড়ি পড়ল। সখিনা চুল আঁচড়ে মাঝখানে সিঁথি কেটে বড়ো একটা খোঁপা করে দিতে দিতে বলল,
-‘ তোর জামাই তোরে অনেক ভালোবাসে নারে? ‘
লাজুক হেসে মাথা নাড়াল শাহিনুর৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সখিনা বলল,
-‘ যা জামাইয়ের কাছে যা আর দেরি করিস না। ‘
শাহিনুর ঘরে আসা মাত্রই প্রণয় তার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে গেল৷ সেই স্থানে, যে স্থানে রোমানার সঙ্গে অসংখ্য সময় ব্যয় করেছে সে। অঙ্গন, রোমানা দু’জনের সঙ্গেই চা,কফির আসর জমিয়েছে। কখনো তার হাত ধরে কখনো বা তার কাঁধে মাথা রেখে পরম শান্তিতে চোখ বুজে দীর্ঘ একটা সময় পার করেছে রোমানা। সেসবের কিছুই জানে না শাহিনুর৷ আজ জানলে হয়তো কষ্ট পাবে। বুকের ভিতর কিঞ্চিৎ পরিমাণ আঘাত লাগবে৷ তবুও শুনতে হবে তাকে। কারণ আজ সে তার মনে চলা সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবে। বেতের চেয়ারে মুখোমুখি হয়ে দু’জন বসল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রণয় বলল,
-‘ আমাদের বিয়ের বয়স বাড়ছে। ‘
প্রণয়ের দৃষ্টির প্রগাঢ়তায় লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠলেও কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। হিসাব করে বের করল তাদের বিয়ের বয়স মাত্র, ছ’মাস। তাই বলল,
-‘ ছ’মাস’কে আপনার কাছে এতবেশি মনে হচ্ছে? বড়ো ভাই’কে দেখে জেবা ভাবির মতো কাউকে প্রয়োজন পড়ল নাকি? ‘
-‘ বাজে কথা বন্ধ করো। ‘
চুপমেরে মাথা নিচু করে বসে রইল শাহিনুর৷ প্রণয় বুক পকেট থেকে একটি জিনিস বের করে তার মাথায় পড়িয়ে দিল। শাহিনুর হাত দিতেই অনুভব করল, খসখসে কিছু। ভ্রু কুঁচকে তাকাল প্রণয়ের দিকে। বিনিময়ে বাঁকা হেসে প্রণয় বলল,
-‘ এ সময় তোমার প্রিয় ফুল পেলাম না৷ তাই পূর্বের সংরক্ষিত গুলো দিয়ে উপহার দিলাম। ‘
ঘ্রাণ পেয়ে শাহিনুর বলল,
-‘ বকুল ফুল? ‘
মাথা নেড়ে সম্মতি দিল প্রণয়। বলল,
-‘ হ্যাঁ তোমার কুড়ানো সেই বকুল ফুল। ‘
পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিল প্রণয়। সেদিন প্রেরণা যখন অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল তাকে। ফুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটিতে পড়েছিল। প্রণয় যখন বাড়িতে আসে তখন সবটা জানতে পারে। যে ফুলে শাহিনুরের স্পর্শ মেখে ছিল সেই ফুলগুলো সযত্নে তুলে নেয় এবং সংরক্ষণ করে রাখে। সবটা শুনে মাথা থেকে বকুলফুলের ছোট্ট মালা খুলে ফেলল। দেখতে পেল ঢেউখেলানো তিনটা চুল দিয়ে মালা গাঁথা হয়েছে। এ পর্যায়ে আরেক ধাপ বিস্ময় নিয়ে তাকাল সে। প্রণয় মুচকি হেসে বলল,
-‘ তোমার চুরির ফুল দিয়ে কী করব বুঝতে পারছিলাম না৷ তাই চুরি করা চুল দিয়ে মালা গেঁথেছি। ‘
-‘ কার চুল চুরি করেছেন আপনি! ‘
-‘ যে আমার মন চুরি করেছে তার। ‘
উত্তেজনায় কাঁপা কণ্ঠে শাহিনুর বলল,
-‘ আমার? ‘
-‘ হ্যাঁ তোমার। ‘
কীভাবে, কবে এসব হয়েছে সবটা শুনতেই ওঠে দাঁড়াল শাহিনুর৷ বারান্দার রেলিং ধরে শহরের রাস্তায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অভিমানী কণ্ঠে বলল,
-‘ এমন পাক্কা চোর জীবনে দেখিনি। ‘
ধীরতার সঙ্গে ওঠে দাঁড়াল প্রণয়। মৃদু পায়ে এগিয়ে শাহিনুরের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। দক্ষিণা হাওয়া ছুঁয়ে দিল ওদের। শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দিল উত্তরপ্রান্তে। ডান হাতে থাকা মরে যাওয়া বকুলফুলের মালা নিজের হাতে তুলে নিল প্রণয়। ধীরে ধীরে পুনরায় শাহিনুরের মাথায় বৃত্তাকারে পরিয়ে দিয়ে খোপার সঙ্গে কৌশল আঁটকে দিল। একহাত শাহিনুরের উন্মুক্ত উদরে রেখে অপরহাতে কাঁধ স্পর্শ করল। আলতোভাবে ঘাড়ে অধর ছুঁয়ে দিতেই কেঁপে ওঠল শাহিনুর৷ সহসা পেছন থেকে বুকে জড়িয়ে নিল প্রণয়। ফিসফিস করে বলল,
-‘ আজ আমি তোমায় আমাকে বলব। আমাকে জানতে পারলেই সব প্রশ্নের উত্তর তুমি পাবে। আমার চন্দ্রকান্তার গল্পও শোনাব। তোমার ডাক্তারসাহেব, আর আমার চন্দ্রকান্তা দু’জনের গল্পের পিছনেই রয়েছে রোমানা’কে ভালো না বাসার কারণ।’