পঁচিশ ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। প্রণয় নুর একে অপরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সবসময় প্রণয় নিজ থেকে শাহিনুরের রাগ, অভিমান ভাঙায়। কিন্তু এবার আর সে নিজে থেকে শাহিনুরের কাছে যায়নি। কাজের মধ্যে ডুবে থেকেই সময় পাড় করছে৷ কষ্ট হলেও মনে মনে উপরওয়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে শাহিনুর। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কঠিন দূরত্ব সৃষ্টি হোক এটাই কাম্য৷ মাঝে একটা দিন চলে গেল৷ পরেরদিন যথাসময়ে হাসপাতালে চলে গেল প্রণয়৷ সারাদিন সখিনার সঙ্গেই কেটে গেল শাহিনুরের। এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিল সে হাসপাতালে যাবে। মুনতাহার সঙ্গে দেখা করে সমস্ত সত্যি উন্মোচন করবে। সবটা জানার পর নিশ্চয়ই পলাশ’কে শাস্তি দেবে মুনতাহা? তার দৃঢ় বিশ্বাস নিজের সন্তানের খু/নিকে কোনভাবেই ক্ষমা করবে না মুনতাহা। সবটা বিশ্বাস করে যদি পলাশকে শাস্তি দিতে চায় তখন সে মান্নাত বুবুর সত্যিটাও প্রকাশ করবে। এতসব পরিকল্পনা একা একাই করল শাহিনুর। সখিনা কয়েকবার জিজ্ঞেস করল,
-‘ সারাদিন এত কী ভাবিস রে তুই? ‘
শাহিনুর মুচকি হেসে বলল,
-‘ তুইও তো সারাদিন কী সব ভেবে ভেবে চোখমুখ দুঃখী করে ফেলিস। কিন্তু কী ভাবিস আমায় বলিস না। তাহলে আমি কেন তোকে বলব? ‘
শাহিনুরের এমন উত্তরে গলা শুঁকিয়ে যায় সখিনার। না সে কিছু বলতে পারে আর না সহ্য করতে পারে। শুধু গোপনে নীরব অশ্রু ঝড়ায়৷ শাহিনুর টের পায় কিন্তু কিছুই বলে না। তবে অনুভব করতে পারে, জীবন একটাই অথচ সে জীবনের জটিলতার অন্ত নেই।
অপরাহ্ণে অবসাদে তিক্ত হয়ে ছাদে গিয়ে মনটা হালকা করার সিদ্ধান্ত নিল শাহিনুর। সখিনা’কে বলতেই সে রাজি হয়ে গেল। বলল,
-‘ তুই যা আমি আসতাছি কয়টা কাপড় শুখাইতে দিছি একবারে নিয়েই নিচে আসমু। ‘
শাহিনুর’কে কথাগুলো বলেই সখিনা রান্নাঘরে গিয়ে থালাতে অল্প ভাত আর তরকারি নিতে নিতে বলল,
-‘ খিদা লাগছে খেয়েই আসতাছি। ‘
একটু অবাক হলো শাহিনুর। ঘনঘন খিদে লাগার পেছনেও কী কোন কারণ আছে? বুঝতে পারে না সে কেন জানি মনে ভীষণ সন্দেহ আসে। পরোক্ষণেই লজ্জিত হয় নিজের চিন্তাভাবনা স্মরণ করে। অন্তত কারো খাওয়া নিয়ে এমন সন্দেহ করা উচিৎ না। হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে পুনরায় ভাবল, অথচ তার খেতে ইচ্ছে করে না। ইদানীং মাছ, মাংস কিছুই সহ্য করতে পারে না৷ এসব রান্না করলেই মনে হয় সবেতে আঁশটে গন্ধ লেগে আছে। এসব বিষয় আহামরি কোন সমস্যা না। হতেই পারে। আর কিছু ভেবে সময় অপচয় করল না শাহিনুর। চুপচাপ ছাদে চলে গেল৷ সখিনা এলো প্রায় দশমিনিট পর৷ দু’জন মিলে ছাদের একপাশে থাকা ফুলগাছগুলো দেখছিল। এমন সময় পশ্চিম পার্শ্বের এক বাসা থেকে প্রচুর চিল্লাচিল্লি শুনতে পেল। সখিনা দৌড়ে পশ্চিম পার্শ্বে গিয়ে ছাদের বর্ডার ধরে উঁকি দিল গলা উঁচিয়ে শাহিনুর’কে ডাকল,
-‘ এই নুর ঝগরা বাজছে দেইখা যা। ‘
মাথায় কাপড় টেনে কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত হয়ে শাহিনুরও গিয়ে সখিনার পাশে দাঁড়াল। টিনসেট বিল্ডিংয়ের বাড়িটা ছয়তালা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। তাই বাড়ির ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সবটাই দেখতে পেল শাহনুর আর সখিনা৷ দু’জন মহিলার কোলেই ছোটো ছোটো বাচ্চা রয়েছে। তারা একে-অপরের সঙ্গে বিশ্রিভাষায় গালাগাল করে ঝগরা করছে। এক পর্যায়ে সেটা হাতাহাতি পর্যন্ত চলে যায়। তারপর কোল থেকে ক্রন্দনরত বাচ্চাদের নামিয়ে একজন ছুটে তার ঘরে চলে গেল, নিমিষেই আবার বেরিয়েও এলো। মুঠো ভর্তি কিছু একটা দ্বিতীয় মহিলার চোখে ছুঁড়ে মারল। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে দ্বিতীয় মহিলার চিৎকার শুনে বুঝতে পারল হাতে শুঁকনো মরিচের গুঁড়ো ছিল৷ যা চোখে ছুঁড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহিলাটি চোখ ধরে মাটিতে বসে পড়ে। আর সেই সুযোগে ইচ্ছে মতো কাঁচা বাঁশের খণ্ড দিয়ে তাকে পেটায় প্রথম মহিলা ৷ এমন ভয়াবহ ঘটনা দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে শাহিনুর৷ সখিনাও হতভম্ব হয়ে শাহিনুর’কে চেপে ধরে। কাঁপা গলায় বলে,
-‘ আল্লাহরে ওরা দুই জা দুই জায়ে এমন ভয়ংকর ঝগরা বাজাইছে!’
মূহুর্তেই আশপাশের মানুষে ভরে গেল বাসাটায়। দ্বিতীয় মহিলা’র স্বামী এসে প্রথম মহিলার চুলে ধরে টেনে হিঁচড়ে বাসা থেকে বের করে দিল। কয়েকজন মহিলা মিলে দ্বিতীয় মহিলার চোখে,মুখে, মাথায় পানি ঢালল। অবস্থা খারাপ হতে দেখে তার স্বামী তাকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। পুরো ঘটনাই সচক্ষে দেখে শাহিনুর কেমন নীরব,নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সখিনা কাপড়চোপড় উঠিয়ে তাকে বলল,
-‘ আয় নিচে জাইগা। ‘
শাহিনুর সেদিক ভ্রুক্ষেপ করল না। অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘ আচ্ছা সখী ঐ মহিলার চোখে মরিচ দিয়ে কেন মারল? এভাবে কেউ চোখে মরিচ দেয়? এখন যদি চোখ নষ্ট হয়ে যায়? ‘
সখিনা বলল,
-‘ তুই বুঝিসবাই বিষয়টা। চোখে মরিচ দিয়া ওরে দুর্বল করে তারপর মারছে৷ নয় কী ঐ মহিলা এইডার সাথে পায়। মরিচ না দিলে কিন্তু এই মহিলার একটা থাবা খাইয়াই চিৎপটাং হয়ে যাইতো। ‘
সহসা শাহিনুরের চোখ দু’টো চকচক করে ওঠল। বলল,
-‘ গা’য়ে এত জোর দিয়ে লাভ কী যদি মাথায় বুদ্ধিই না থাকে? ‘
-‘ প্রথম মহিলাটার অনেক বুদ্ধি এজন্যই মরিচ দিয়ে দুর্বল করছে নয়তো তার সাথে পাইতো না বুঝো নাই সখী? ‘
-‘ খুব বুঝেছি, আসলে গা’য়ের জোরের চেয়েও বুদ্ধির জোর বেশি। ‘
তৎক্ষনাৎ দক্ষিণ আকাশ থেকে উত্তর আকাশে একটি বিমান শব্দ করে চলে গেল। শাহিনুর মাথা তুলে আকাশ পানে তাকিয়ে দেখল সেই দৃশ্য। তারপর শান্ত দৃষ্টিতে সখিনার দিকে তাকাল। মিষ্টি হেসে বলল,
-‘ সত্যি বুদ্ধি থাকলে কত কিছুই করা যায়। গা’য়ের জোর দিয়ে এসব সম্ভব হয় না৷ যেমন এই যে আকাশ পথেও মানুষ চলাচল করতে পারে। কতশত মানুষ নিয়ে বিমান চালক বিমান চালায়। এইটা তো গা’য়ের জোরে না বুদ্ধির জোরেই। কী বুদ্ধি মানুষের! হায় রে দুনিয়া কত রঙ্গই যে দেখলাম! ‘
[৭৯]
প্রণয় ফিরল রাত ন’টায়৷ শাহিনুর তার জন্য খাবার বেড়ে একঘণ্টা সময় অপেক্ষা করল। কিন্তু প্রণয় এলো না৷ শেষে শোবার ঘরে গিয়ে দেখল ঘুমিয়ে পড়েছে প্রণয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরে এসে বারকয়েক ডাকল, সে ডাক শুনে বিরক্তি সুরে প্রণয় বলল,
-‘ ডাকাডাকি বন্ধ করে নিজের মতো খেয়ে শুয়ে পড়ো। আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। ‘
যদিও কথাটা বিশ্বাস করল না শাহিনুর তবুও প্রণয়’কে আর ডাকল না, খাওয়ার জন্যও বলল না। নিজেরও খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু পেটে ব্যথা করছিল বলে অল্প খেয়ে শুয়ে পড়ল। শাহিনুর খাচ্ছে কিনা তা অবশ্য আড়ালে দেখে নিয়ে স্বস্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রণয়৷ আগামীকাল মুনতাহাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে৷ তাই যা করার আজ রাতেই করতে হবে৷ এ কথা মাথায় রেখেই অতি গোপনে মাঝরাতে কোয়ার্টার থেকে হাসপাতালে গেল শাহিনুর৷ সেখানে গিয়ে দেখল মুনতাহা জেগেই আছে। শাহিনুরকে দেখে প্রচণ্ড অবাক হলো মুনতাহা। কিছুটা সন্দেহি দৃষ্টিও নিক্ষেপ করল। সেসবে পাত্তা না দিয়ে শাহিনুর প্রথমে জিজ্ঞেস করল, অরুণা আর শবনমের কথা। মুনতাহা জানাল তারা চলে গেছে। শাহিনুর কিছুটা অবাক হলো, অসুস্থ মেয়েটাকে একা রেখে চলে গেছে বলে।
পলাশ আছে বলেই অরুণা, শবনম নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে গেছে এ সত্যিটা গোপন করল মুনতাহা। এতদিন পর তার স্বামী মুখ ফিরে চেয়েছে তার দিকে। এ খবর বেশি কানে দিতে চায় না, বেশি চোখে পড়ুক এটাও চায় না৷ না জানি কার নজর পড়ে যায় আবার! সন্ধ্যার দিকেই পলাশ ঢাকা থেকে সোজা হাসপাতালে এসেছে। এসেই মুনতাহাকে জড়িয়ে ধরে অনেক সময় কান্নাকাটি করেছে। বুঝিয়েছে সন্তান হারানোর বেদনা। মুনতাহাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, তার পাপের শাস্তিই সে পাচ্ছে। ক্ষমা চেয়েছে মুনতাহার কাছে। কথা দিয়েছে সে সুস্থ হলেই আবারও সন্তান নেবে তারা। এত ভালোবাসা পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে মুনতাহা৷ তার স্বামী কেন তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল, কোথায়ই বা গিয়েছিল সেসব কিছুই জানতো চাইল না। বরং উপরওয়ালার নিকট কৃতজ্ঞতা জানাল মানুষটার পরিবর্তন দেখে। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা অনেকটাই লাঘব হলো স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে।
এসবের কিছুই জানল না শাহিনুর৷ ভাগ্যক্রমে সে যখন এসেছে তার মিনিট পাঁচেক পূর্বে পলাশ কিছু সময়ের জন্য পাঁচফোড়ন গৃহে গেছে৷ মুনতাহাকে কথা দিয়ে গেছে ঘন্টাখানেকের মাঝেই ফিরে আসবে।
প্রণয়ের বলা সমস্ত কথা মুনতাহা’কে খুলে বলল শাহিনুর। বিশ্বাস করানোর জন্য এটাও বলল, সে চাইলে প্রণয়ের থেকে প্রমাণও নিতে পারে৷ সমস্ত কথা শুনে আচম্বিতে শাহিনুরের গালে কষিয়ে এক থাপ্পড় মারল মুনতাহা। মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,
-‘ কালনাগিনী! তোর এতবড়ো সাহস তুই আমার স্বামী’কে আমার সন্তানে খু/নি বলিস। ‘
শাহিনুরের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগল। মুনতাহার দু’পা আঁকড়ে ধরে বলল,
-‘ বিশ্বাস করুন মেজো ভাবি আমি মিথ্যা বলছি না। ‘
মুনতাহা বিশ্বাস করল না। শাহিনুর’কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলল,
-‘ হায় আল্লাহরে… আমার স্বামী খারাপ বলে সেই সুযোগে এই বাইজির বাচ্চা তারে আমার সন্তানের খু/নিও বানাতে চাইছে। যদি আমাকে খু/ন করতো, আমাকে মেরে ফেলতে চাইতো বিশ্বাস করতাম৷ কিন্তু নিজের সন্তান? বিশ্বাস করি না৷ ‘
কিছু সময় পূর্বে যে মানুষটা সন্তানের জন্য আকুতি মিনতি করল। তার কাছে ক্ষমা চাইল সেই মানুষ’টা তার সন্তানের খু/নি হতে পারে কোনভাবেই বিশ্বাস করল না মুনতাহা। উল্টো ভুল বুঝল শাহিনুর’কে। ভাবল পলাশের মাঝে খারাপ বৈশিষ্ট্য আছে বলেই সুযোগ পেয়ে সৎ ব্যবহার করছে শাহিনুর। তাই ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে শাসিয়ে বলল,
-‘ তুই কী ভেবেছিস এসব বলে, আমার স্বামীর বিরুদ্ধে আমাকে নিয়ে তাকে শাস্তি দিবি? কোনোদিন পারবি না, আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না। তোর আসল রূপটা উনাকে যখন বলব তখন দেখবি উনিও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে তোর থেকে। আর স্ত্রী হিসেবে এটাই আমার অনেক বড়ো প্রাপ্তি হবে। ‘
ব্যর্থ হয়ে কোয়ার্টারে ফিরে এলো শাহিনুর। প্রধান দরজা আঁটকে যখন পিছন ঘুরল তৎক্ষনাৎ বসার ঘরে বাতি জ্বলে ওঠল। কিঞ্চিৎ চমকে ওঠল শাহিনুর। কাঠিন্যরূপে সহসা সামনে এসে দাঁড়াল প্রণয়। দু-হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে অগ্নিচক্ষুতে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,
-‘ আমি যদি এখন তোমায় কঠিন শাস্তি দিই ভুল হবে কী? ‘
কেঁপে ওঠল শাহিনুর। শান্ত কণ্ঠে শুধাল,
-‘ শাস্তির কারণ? ‘
শাহিনুরের গালে স্পষ্ট হয়ে ওঠা পাঁচ আঙুলের লাল দাগ দেখে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে প্রণয় বলল,
-‘ আমার স্ত্রী’র গা’য়ে অন্য কেউ কোন সাহসে হাত তুলে? এই সাহসটুকু দেওয়ার কারণটাই কী যথেষ্ট নয়?’
মাথা নুইয়ে ফেলল শাহিনুর। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে কয়েকদফা নিঃশ্বাস ফেলে শাহিনুরের সামনে থেকে চলে গেল প্রণয়। হা করে লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলল শাহিনুর। বুকের ভিতর তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে তার। হাঁসফাঁস লাগছে কেন কেউ বুঝে না, কেন কেউ বুঝতে চায় না? নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না সে৷ মেঝেতে বসে ডুকরে কেঁদে উঠল। তার কান্নার শব্দ শুনল সখিনা, শুনল প্রণয় কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। পাশে দাঁড়িয়ে কেউ স্বান্তনা দিল না। ওরা দু’জনই যেন চাইল, বাস্তবতা মেনে নিতে। ওদের নীরবতা বুঝিয়ে দিল, এই কান্না অনর্থক।
[৮০]
কেটে গেল আরো দু’দিন। এই দু’দিনে দু’টো আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখেছে শাহিনুর। এক, মাঝরাতে অতিরিক্ত পিপাসা লাগায় বসার ঘরে এসেই দেখতে পায় সখিনার ঘরের দরজা খোলা। যেহেতু আগে থেকেই সখিনা’কে সন্দেহ করছিল,সেহেতু মাঝরাতে দরজা খোলা দেখে আবারও সন্দেহ ঢুকে গেল মনে। কোনক্রমেই সখিনার করা কার্যক্রমগুলো স্বাভাবিক নিতে পারে না সে৷ এর পেছনে কী কারণ সেটাও জানে না। যাইহোক সখিনার ঘরে ঢুকে যখন ও’কে পেল না। পুরো বাসায় নজর বোলালো কিন্তু সখিনা নেই। তারপর যখন প্রধান দরজার ছিটকিনি খোলা দেখল, আর বেশি নড়াচড়া করল না। বাতি নিভিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আঁটকে জানালা খোলা রেখে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সখিনা এলো বিশমিনিট পর৷ ওড়না দিয়ে মুখ পেঁচানো ছিল তার। তবুও চিনতে অসুবিধা হয়নি শাহিনুরের। কিন্তু এই ঘটনায় তীব্র সন্দেহ জন্মাল তখন যখন সখিনার হাতে একটি বাঁশি দেখতে পেল সে। নিমিষেই চোখ দুটো বন্ধ করে কল্পনায় রঙ্গনের হাতে থাকা বাঁশির দৃশ্যটি মনে পড়ে গেল। এমন সময় এমন দৃশ্য কেন মনে পড়ল জানে না৷ শুধু জানে এই সখিনার ভিতরে কিছু একটা রহস্য রয়েছে যা তাকে শিঘ্রই বের করতে হবে। দ্বিতীয় দফায় আশ্চর্যজনক ঘটনাটি হলো- সখিনার কাছে একটি ছোট্ট বাটন মোবাইল ফোন রয়েছে। যা অতিগোপনে ব্যবহার করে সে। সব সময় ভয়ে গুটিয়ে থাকার ব্যাপারটা অনেক আগেই ধরেছিল শাহিনুর। কিন্তু গত দুদিনে যা সব দেখেছে এতে সখিনা’কে বেশ নজরে নজরেই রাখছে।
সকালবেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় প্রণয় বলল, আজ রাতে সে ফিরবে না৷ প্রথমে একটু রাগ হলেও পরোক্ষণে রাগটুকু নিঃশেষ করে দেয় শাহিনুর। শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হয়ে প্রণয় তৎক্ষনাৎই বেরিয়ে পড়ে৷ কি জানি সত্যি কাজের জন্য ফিরবে না, নাকি শাহিনুরের প্রতি এক সমুদ্র অভিমান জমেছে বলেই ফিরবেনা। সারাদিন হাঁসফাঁস করেই কাটলো শাহিনুরের। একবার ভাবল, প্রণয়’কে ফোন করে বলবে,
-‘ আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন আপনাকে ছাড়া ফাঁপর লাগে আমার। ‘
পরোক্ষণেই নিজের মন’কে স্বান্তনা দিল,
-‘ যা হচ্ছে তোর ভালোর জন্যই হচ্ছে নুর, মানিয়ে নে। ‘
নিজেকে হাজার আটকাতে চেয়েও পারল না শাহিনুর। প্রণয়’কে ফোন করে বলল,
-‘ আপনার কী সত্যি রাতেও কাজ আছে? ‘
গম্ভীর কণ্ঠে প্রণয় জবাব দিল,
-‘ তোমার কী মনে হয়, আমি মিথ্যা বলেছি? ‘
-‘ আমার খুব ফাঁপর লাগছে। রাতে যদি আরো বেশি লাগে? ‘
টেলিফোনের ওপাশ থেকে দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো। সে শব্দ শুনে নীরব হয়ে গেল শাহিনুর৷ ক্ষণকাল চুপ থেকে প্রণয় বলল,
-‘ দশটার মধ্যে ফেরার চেষ্টা করব দেরি হলে এগারোটা বাজবে তবুও আসব। আশা করি এটুকু সময় কোনভাবে কাটিয়ে দেবে। ‘
মৃদু হাসল শাহিনুর৷ যদিও তেমন কথা হয়না। বিছানায় এক হাত দূরত্ব রেখে ঘুমায় তবুও মানুষ’টাকে ছাড়া এক রাত থাকবে ভাবতেই কেমন ফাঁপর ফাঁপর লাগছিল। সহসা মনে প্রশ্ন জেগে ওঠল, এরপরও কী করে দু’জন আলাদা হবে?
রাত তখন আটটা বাজে। শাহিনুর সখিনা’কে বলেছিল, একাই খেয়ে নিতে। সে প্রণয় এলে খাবে। তবুও সখিনা ডাকল তাকে। ডাকতে ডাকতে ঘরের ভিতর চলে এলো। শাহিনুর বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘ তোকে বললাম তো একাই খেয়ে নিতে। ‘
সখিনা ধীরপায়ে তার কাছে এসে ভয়াতুর কণ্ঠে বলল,
-‘ আমি অন্য কারণে এসেছি নুর। ‘
শাহিনুর ভ্রু কুঁচকে উঠে বসল। মনে মনে ভাবল, নিশ্চয়ই সখিনা কোন বিপদে পড়েছে৷ আর সেই বিপদের কথাটাই এতদিন পর সাহস করে তাকে জানাতে এসেছে। হাজারহোক দু’জনই সেই ছোট্ট বেলাকার সখী বলে কথা। শাহিনুর নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়াল। সখিনার দুকাঁধে ভরসার সহিত হাত রেখে বলল,
-‘ নির্ভয়ে বলে ফেল সখী, তোর জীবনে গুরুতর সমস্যা ঘটেছে বুঝতে পারছি৷ কিন্তু কী সেই সমস্যা ধরতে পারিনি৷ তুই আমাকে সবটা খুলে বল। আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে তোকে সহযোগিতা করব৷ ‘
কথাগুলো বলে শেষ করতেই শাহিনুর খেয়াল করল সখিনা বার বার ঢোক গিলছে। চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে সখিনার একটি হাত ধরে টেনে বসার ঘরে নিয়ে গেল। বলল,
-‘ তুই দাঁড়া আমি তোর জন্য পানি নিয়ে আসছি। ‘
শাহিনুর দ্রুত পায়ে রান্না ঘরে গিয়ে গ্লাসে পানি ভরছিল এমন সময় সখিনা এসে ওর একটা হাত চেপে ধরল৷ বলল,
-‘ আমি পানি খাব না। ‘
শাহিনুর শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘ ভয় পাচ্ছিস কেন বল তো কী হয়েছে? আমার কিন্তু ধৈর্য্য ফুরিয়ে যাচ্ছে। ‘
গ্লাসে পানি ভরে শাহিনুর দাঁড়িয়ে রইল। তার দৃষ্টি সম্মুখে কাঁপতে থাকা সখিনার দিকে স্থির। সখিনা বারকয়েক ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-‘ আমার পেটে বাচ্চা আছে নুর। আমি অন্তঃসত্ত্বা! ‘
বজ্রাহত হয়ে তাকিয়ে রইল শাহিনুর। হাত,পা মৃদু কেঁপে ওঠল তার। ফলসরূপ ভরা গ্লাস থেকে কয়েক ফোঁটা পানি নিচে পড়তে শুরু করল। সখিনার আতংকিত মুখশ্রীতে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে কাঁপা গলায় বলল,
-‘ তোর তো বিয়ে হয়নি! ‘
সখিনা মাথা নাড়িয়ে না করল। শাহিনুর পুনরায় বলল,
-‘ তাহলে তোর পেটে কার বাচ্চা? ‘
সখিনা এবার ঘামতে শুরু করল। শাহিনুর উত্তেজিত হয়ে বলল,
-‘ কার বাচ্চা তোর পেটে? ‘
-‘ আমি তোরে বলতে পারমু না। ‘
ক্রোধী স্বরে শাহিনুর বলল,
-‘ মার খাবি তুই সখী। এই বাচ্চা কার সেটা তুই না বললে আমি কিন্তু খুঁজে বের করব। ‘
সখিনা এবার আশপাশে ভীতু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
-‘ তুই আমারে বিশ্বাস করবি তো? ‘
আশ্চর্য হয়ে শাহিনুর বলল,
-‘ আমি তোকে অবিশ্বাস করতে পারি? ‘
ভরসা দেওয়ার জন্য জোরপূর্বক কথাটি বলল শাহিনুর। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে সখিনা বলে ফেলল,
-‘ ডাক্তারবাবু। ‘
আকস্মাৎ এ ঝরের তাণ্ডব কতটা ভয়াবহ হবে শাহিনুর বা সখিনা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। শাহিনুর নিজেও ভাবতে পারেনি তার ডাক্তারসাহেব’কে নিয়ে এমন কথা শুনে প্রথমবারের মতো অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত হবে সে। সখিনার মুখ থেকে এমন একটি কথা শুনে নিমিষেই অন্য এক শাহিনুরের সৃষ্টি হলো যেন। যে শাহিনুরের আগে পড়ে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস! প্রিয় সখীর মুখ থেকে এমন একটি কথা শুনল যা তাকে মুহূর্তেই সেই শাহিনুরকে তৈরি করে ফেলল, যে শাহিনুর’কে তৈরি করতে চেয়েছিল বাইজি শারমিন শায়লা। সেই শাহিনুর তৈরি হলো – যে শাহিনুরের হাতে সেদিন রাতে প্রাণ হারিয়েছিল সবুর উদ্দিন। হাতে থাকা পানিভর্তি কাঁচের গ্লাসটি দেয়ালে বাড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলল শাহিনুর৷ ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল সখিনা। শাহিনুরের বীভৎস চেহেরা দেখে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল সে৷ কিন্তু দমে রইল না শাহিনুর৷ হিংস্রভাবে গর্জন তুলে সখিনার একহাত টেনে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে হাতের তালুতে ভাঙা কাঁচের গ্লাসটির চৌকা অংশ ঢুকিয়ে দিল। মুহূর্তেই পুরো বিল্ডিং কাঁপিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিল সখিনা। শাহিনুর আরো দ্বিগুণ হিংস্র হয়ে দুপাটির দাঁত জোড়া লাগিয়ে বীভৎস এক শব্দ করল। ভাঙা গ্লাস গেঁথে থাকা হাতটি টেনে রক্তাক্ত হাতের দিকে তাকিয়ে মেঝেতে বসে তড়পাতে শুরু করল সখিনা। তবুও মায়া হলো না শাহিনুরের৷ ওর চুলের মুঠিতে শক্ত করে চেপে ধরে চিৎকার করে বলল,
-‘ এবার বল এই বাচ্চার বাবা কে? ‘
সখিনা তড়পাতে তড়পাতে বলল,
-‘ ডাক্তারবাবু। ‘
অসহনীয় হয়ে পাগলের মতো চারদিকে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো শাহিনুর। রান্নাঘরের এক কোণে বড়োসড়ো একটি বটি দেখতে পেল। আর দেরি না করে সেই বটিতা নিয়েই সখিনার পেটের ওপর পা চেপে ধরে গলায় বটি ধরল। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল সখিনা৷ ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
-‘ তুই আমারে মারিস না, মারিস না। ‘
বাঘের মতো গর্জন দিয়ে ওঠল শাহিনুর,
-‘ তাহলে সত্যি করে বল এই বাচ্চার বাবা কে ? ‘
-‘ আমি যা কইছি সত্যই কইছিরে। ‘
এবার যেন শাহিনুরের ভয়ানক কথাশুনে অন্তরআত্মা কেঁপে ওঠল সখিনার। শাহিনুর সন্তর্পণে বটিটা তার গলার মাঝবরাবর ধরে ক্রোধে জর্জরিত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-‘ আমার সতীন হওয়ার খুব শখ তাইনারে? আমার ডাক্তারসাহেবের বাচ্চার মা হওয়ারও খুব শখ? তোর এই শখ আমি থাকতে কোনদিন পূরণ হবে না। তুই যা বলেছিস তা যদি সত্যি হয় তাহলে তোকে এখনি মরতে হবে। ‘
‘নুর ‘ বলে আর্তচিৎকার করে ওঠল সখিনা৷ শাহিনুর তর্জনী উঁচিয়ে বলল,
-‘ একদম চুপ। আমি বেঁচে থাকতে ডাক্তারসাহেবের সন্তান তোর পেটে আসবে আর তো’কে আমি বাঁচিয়ে রাখব? ‘
সখিনা শরীর ছেড়ে দিল। অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়া বদ্ধ করে, আহত সুরে বলল,
-‘ আমার অসহায়ত্বের সুযোগ তোর স্বামী নিছে বলে তুইও নিবি? মনে রাখিস তোর জামাইও কিন্তু ঐ জমিদার বাড়ির ছেলে!’
লেখকের কথা: বড়ো একটা পর্ব দিয়েছি, বড়ো করে মন্তব্য চাই এবার৷ আর হ্যাঁ কেউ উত্তেজিত হবেন না। সবাই শান্ত থাকুন শেষ অবধি না পড়ে এমন মন্তব্য করবেন না যাতে লেখিকার মন খারাপ হয়ে যায় ওকে?