কোন এক গভীর রজনীতে প্রথম দর্শনেই হৃদয় হরণ হয়েছিল ডক্টর প্রণয় চৌধুরীর। প্রচণ্ড শক্ত মন’টা অতিসন্তর্পণে চুরি করে নিয়েছিল মাত্র পঞ্চাদশী এক কিশোরী। কিশোরীটির পরিচয় পাওয়ার পর ছোট্ট একটি আঘাত লেগেছিল বক্ষগহ্বরে! কারণ সে জমিদার পুত্র। আর কিশোরীটি ঘৃণ্য বাইজি প্রধান শারমিনের কন্যা। এ কী করে সম্ভব! জমিদারের ছেলে হয়ে এক বাইজি কন্যার প্রেমে পড়ল সে! আপনমনে বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠল৷ নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। অন্যকারো বাগদত্তা হয়ে মনের তীব্র অনুভূতি’কে মাটি চাপা দিয়ে দিলো। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। ভাগ্যচক্রে পঞ্চাদশী বাইজি কন্যা হৃদয় ঘরে বধূ রূপ জায়গা করে নিলো। জানতে পারলো, যে কন্যাটি তার ঘরে বধূ রূপে এসেছে তার আসল পরিচয়। দ্বিতীয়বারের মতো আঘাত পেলো আপনজনদের ঘৃণ্য মানসিকতার কথা জানতে পেরে। ভদ্র ঘরের মেয়ে, ভদ্র ঘরের বউ থেকে গর্ভবতী শারমিন’কে বাইজি হতে বাধ্য করেছিল তারই পিতামহী! নিয়তির খেলায় সেই শারমিন বাইজির কন্যাই জমিদার বাড়িতে বউ হয়ে পদার্পণ করল। এক অসহায় নারীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছিল যারা। তাদেরই বংশধরের হাত ধরে শারমিন কন্যা শাহিনুরের আগমন ঘটল জমিদার বাড়িতে, পাঁচফোড়ন গৃহে। অতীত স্মৃতিগুলো কখনোই ভোলা যায় না। তেমনি ভুলেনি প্রণয়, শাহিনুর এবং পাঁচফোড়ন গৃহের প্রতিটি সদস্য। প্রত্যেকেই তাদের পাপের ফল ভোগ করেছে। বহু বছর পূর্বে অলিওরের মা যে অন্যায় করেছিল তার শাস্তি অলিওরের পুরো বংশধর’রা পেয়েছে। অলিওর যে অন্যায় করেছিল তার শাস্তি প্রণয় পেয়েছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। শাহিনুরের বাবার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছে প্রণয়। জন্মদাতার পাপের ফল ভোগ করেছে সে। একসময় সকলে মনে করত শাহিনুরের পাঁচফোড়ন গৃহে বউ হয়ে আসা অভিশাপ ছিল। আজ সকলেই বিশ্বাস করে পাপে পূর্ণ জমিদার বংশ’কে পাপ মুক্ত করার জন্য আশীর্বাদ হয়েই আগমন ঘটেছিল শাহিনুরের। যার ফলে আজ পাঁচফোড়ন গৃহে স্বপ্ন, সুখেরও আগমন ঘটেছে। নির্বংশ হয়ে যাওয়ার তীব্র ভয় দূর হয়েছে জমিদার গিন্নিদের। এবার তারা নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে পারবে।
বাইজি গৃহ একটি অপবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। সেই গৃহে জন্ম হয়েছে শাহিনুরের। বাইজি শারমিন শায়লা আজ থেকে দু’বছর পূর্বে তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটিকে ধরণীর বুকে একা ফেলে পরপারে চলে গেছেন। সেই মূল্যবান সম্পদটি আজ জমিদার বাড়ির সেজো ছেলের বউ। আজ মেয়েটি পরিপূর্ণ। সদ্য আঠারো’তে পা দিয়েছে সে। প্রণয়ের পঞ্চাদশী কিশোরী বধূটি এখন অষ্টাদশী পরিপূর্ণ যুবতি। শুধু তাই নয় সে একজন আদর্শ স্ত্রী, মমতাময়ী মা। শক্তিশালী একজন নারী। যে অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে স্বামী,সন্তান এবং পুরো সংসার সামলাচ্ছে। তার দৃঢ় মানসিকতা, অনন্ত প্রেমের সান্নিধ্য পেয়ে বারংবার মুগ্ধ হচ্ছে প্রণয়।সেই মুগ্ধতা আকাশ ছোঁয়া হলো সেদিন৷ যেদিন শাহিনুর এসে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলো। সে চায় পতিত বাইজি গৃহের পুরোটাতেই হাসপাতাল নির্মাণ করতে। যেখানে রোগাক্রান্ত মানুষ’দের চিকিৎসা দেওয়া হবে। অসহায়, হতদরিদ্র’রা বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবে। আর সেই হাসপাতালের প্রথম এবং প্রধান ডাক্তার হিসেবে নাম থাকবে একজনেরই। তিনি হলেন শাহিনুর শায়লায় প্রাণপ্রিয় স্বামী ডক্টর প্রণয় চৌধুরী। শাহিনুরের পরিকল্পনা শুনে প্রণয় বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে বসে ছিল। এমন সিদ্ধান্তে তার পাশে ছিল ভাইয়ের চেয়েও বেশি অঙ্গন।
স্ত্রী’কে ভালোবেসে প্রণয় যদি নিজের স্বপ্ন’কে ধ্বংস করতে পারে, নিজের পঙ্গুত্বকে হাসি মুখে বরণ করে নিতে পারে৷ স্বামী’কে ভালোবেসে শাহিনুর কেন নতুন করে স্বামীর স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিতে পারবে না?
পল্লব, প্রণয়, অঙ্গন তিন ভাই মিলে বাইজি গৃহকে কয়েকমাসের ভেতরেই একটি হাসপাতালের উপযোগী করে তুলল। অলিওরের বিশাল সাম্রাজ্যের একটি অংশে হাসপাতাল নির্মাণ হচ্ছে। এ খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে জনে জনে দেখতে এলো। শহর জুড়ে হৈহৈ রৈরৈ পড়ে গেল ডক্টর প্রণয় চৌধুরী’কে নিয়ে। মেডিকেল সার্টিফিকেট বাতিল হলেও এখনো তার বেশ সুনাম রয়েছে। জীবনের নানা উত্থানপতনের পর আবারও প্রণয়ের ওঠে দাঁড়ানো, বিশাল একটি হাসপাতাল নির্মাণের মানসিকতা বাহবা পাওয়ারই যোগ্য।
শাহিনুরের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে একটি ব্যক্তিগত বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েই গেল। ঘরের ভিতর স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ, বাইরে ভাইদের সঙ্গে মিলে সুষ্ঠুভাবেই কাজ এগুতে লাগলো। হাসপাতালের জন্য অনুমোদন, লাইসেন্সের জন্য কাগজপত্র এবং মোটা অংকের টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। নামকরণ করা হয়েছে মেয়ে শায়েরা জাহান প্রীতির নামে- “প্রীতি নার্সিং হোম”। নামকরণ উপলক্ষে পাঁচফোড়ন গৃহে বিশাল মিলাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ বাড়িতে আত্মীয় স্বজনে ভরপুর। অঙ্গন’কে পাঠিয়ে টুনটুনি দাদি, আর দাদাকেও নিয়ে আসা হলো। এস.আই সারিম এবং তার বোন সামান্তারও আসার কথা। সেই সামান্তা যে একদিন প্রণয় শাহিনুরের জীবনে শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ধরা দিয়েছিল।
__
টুনটুনি দাদি, দাদা এসেছে সকালে। এসেই প্রণয়ের বিষয়ে সবটা জানতে পেরে দু’জনে মিলে প্রচণ্ড কেঁদেছে। তাদের কান্না দেখে বাড়ির একটি সদস্যরও চোখে অশ্রু ঝড়ায় বাকি নেই। টুনটুনি দাদি প্রণয়ের হাঁটুতে হাত বুলিয়ে অনেকক্ষণ আদর করল৷ মাথা বুলিয়ে স্বান্তনা দিলো৷ প্রণয় মুচকি হেসে বলল,
-‘পঙ্গু নাতি’কে দেখে এত কাঁদছেন। উপরওয়ালা যে বাঁচিয়ে রেখেছেন তার জন্য শুকরিয়া জানাবেন না?’
টুনটুনি দাদি ডুকরে ওঠে বলল,
-‘আ কুদ্দুসের বাপ আমার নাতিডার এই গতি ক্যান হইল।’
দুই বৃদ্ধ, বৃদ্ধার কান্না থামলো সুখ’কে দেখে। শাহিনুর সুখকে টুনটুনি দাদির কোলে দিতেই সে শান্ত হলো। কিছুক্ষণ পর গুটিগুটি পায়ে স্বপ্ন এগিয়ে এলো। দাদা, দাদি দু’জনই দুটো বাচ্চা পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হলো।
বাড়িতে এতবড়ো আয়োজনের জন্য আজ শাহিনুর কাউকেই তেমন সময় দিতে পারছে না। সকাল থেকে পুরো বাড়িতে ছুটোছুটি করছে। প্রণয় হুইলচেয়ারে বসে ওঠানে ঘুরাঘুরি করছে। কখনো দাদা, দাদির সঙ্গে স্বপ্ন, সুখের খেলা দেখছে। কখনো মুগ্ধ চোখে দেখছে খয়েরি রঙের জামদানী শাড়িতে যৌবনশ্রী আবৃত শাহিনুরকে। ডাগর ডাগর আঁখিযুগল ছুঁড়ে ক্ষণে ক্ষণে সেও স্বামী’কে দেখছে। মাঝে মাঝে ইশারায় জিজ্ঞেস করছে,
-‘কফি খাবেন? আনব?’
আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে, চোখে ইশারা দিয়ে প্রণয় বলছে,
-‘কফি লাগবে না৷ তুমি কাজ করো আমি তোমায় দেখি।’
লাজুক মুখে চোখ সরিয়ে পুনরায় কাজে মন দিচ্ছে শাহিনুর৷ চোখের সামনে বউ বড়ো হয়ে গেল। তার সন্তানের মা হলো, তাকে সহ পুরো সংসারের দায়িত্ব নিয়ে নিলো। মেয়েটা কত যত্ন নিয়ে তাকে ভালোবাসে। একটি শব্দ উচ্চারণ করলেও সে শব্দে কত যত্ন, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মিশে থাকে। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলল প্রণয়। চোখের সামনে বউ বড়ো হতে দেখাও বড়ো ভাগ্যের বিষয়। ভাবতেই তীব্র সুখের ঢেউ খেলে গেল বক্ষঃগহ্বরে।
টুনটুনি দাদিরা আজ চলে যেতে চাইলেও জোরপূর্বক রেখে দিলো শাহিনুর। প্রণয়ের সিদ্ধান্ত ছিল তাদের আর ফিরতে দেবে না। যতদিন বেঁচে থাকবে তার কাছে, তার এবং শাহিনুরের সেবা পেয়েই বেঁচে থাকবে। এই মানুষ দু’টোর জন্য যাই করা হোক না কেন কখনো ঋণ শোধ হবে না। তবুও কিছুটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেই শেষ বয়সের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল। রাজি হয়নি বুড়ো,বুড়ি। তারা বিশাল সাম্রাজ্যের বিলাসিতা ভোগের চেয়ে ঐ টোনা,টুনির সংসারেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। দু’টো মিলে ওখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চায়। এটিই দুজনের শেষ ইচ্ছা। তাদের সে ইচ্ছেতে হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার প্রণয় বা শাহিনুরের নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিলো, কিছুদিন তারা এখানে থাকুক তারপর তাদের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হবে৷ মাঝে মাঝে বরং তারাই দেখতে যাবে আত্মিক সম্পর্কের এই মানুষ দু’টোকে।
..
মি.সারিম না এলেও সামান্তা এলো সন্ধ্যার পর। শাহিনুর তখন স্বপ্ন আর সুখ’কে খাওয়াতে ব্যস্ত। সখিনা এসে জানাল,
-‘পুলিশের বোন আইছে।’
শাহিনুর হাত ধুয়ে সুখ আর স্বপ্নকে সখিনার কাছে রেখে বেরিয়ে গেল। সখিনা ছেলে, মেয়ে দু’টোর কাছে এসে ছোট্ট ছোট্ট খেলনা দিয়ে ওদের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেদিন অঙ্গনের দেওয়া শেষ সুযোগটি হাতছাড়া করেনি সখিনা। সত্যি সত্যিই শাহিনুরের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে। বুঝতে পেরেছে, সে কখনোই শাহিনুরের মতো করে জমিদার বাড়িতে, জমিদারের ছেলের মনে জায়গা করে নিতে পারবে না। সবার ভাগ্যেই এক রকম সুখ থাকেনা। শাহিনুর যা পেয়েছে তা আর কেউ একইভাবে পাবে না।যতটুকু পেয়েছে ততটুকু হারানোর ভয়ে নিজের ভুলটুকু বুঝতে পেরেছে সে। এবং অল্পতেই খুশি থাকার চেষ্টা করছে। নিজেকে শুধরে নিয়েছে বলে অঙ্গনও এখন তার সঙ্গে বাজে আচরণ করে না। প্রয়োজনে দু-চারটে কথা ঠিকি বলে। হাজার হোক স্বপ্নের মা সে।এ বাড়িতে তার জায়গা না হয় শুধু স্বপ্নের মা হিসেবেই থাকুক।
সকলের সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে জেবা সামান্তাকে দোতলা প্রণয়ের কক্ষে নিয়ে গেল। প্রণয় তখন বিছানায় বসে কিছু কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছিল৷ হঠাৎ দ্বারের বাইরে শুনতে পেলো,
-‘আসতে পারি?’
কিঞ্চিৎ চমকে তাকাতেই সামান্তাকে দেখতে পেয়ে মৃদু হাসলো। বলল,
-‘সিয়র আসুন। ভালো আছেন?’
কমলা রঙের জর্জেট শাড়িটার লম্বা আঁচলখানা দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীরপায়ে কক্ষে প্রবেশ করল সামান্তা। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে প্রণয়। জেবা চেয়ার টেনে বিছানার সামনে রেখে সামান্তা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘আপনার জন্য নাস্তাপানি পাঠিয়ে দিচ্ছি। গল্প করতে থাকুন।’
মৃদু হাসলো সামান্তা জেবা বিনুনি নাচাতে নাচাতে বেরিয়ে গেল৷ সামান্তা পূর্ণদৃষ্টিতে প্রণয়কে আপাদমস্তক দেখে বলল,
-‘আমি হসপিটালে আপনাকে দেখতে গিয়েছিলাম।’
-‘কেঁদে ছিলেনও।’
-‘আপনি তখন কোমায় ছিলেন।’
-‘আমার মস্তিষ্ক সজাগ ছিল।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সামান্তা। মুচকি হাসলো প্রণয়। বলল,
-‘কেমন আছেন?’
আচমকাই অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল সামান্তা। ক্ষীণ স্বরে বলল,
-‘আপনারা কেমন আছেন সুজন? শায়লা কোথায়?’
-‘আমরা ভালো আছি। ও মেয়েকে খাওয়াচ্ছে।’
চমকে ওঠল সামান্তা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলল,
-‘একদম ভুলে গিয়েছিলাম। অভিনন্দন নতুন বাবা’কে।’
আলতো হেসে প্রণয় বলল,
-‘ধন্যবাদ।’
কথোপকথনের এ সময় শাহিনুর কক্ষে এলো। সামান্তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে বলল,
-‘আপনারা গল্প করুন আমি কফি বানিয়ে আনছি।’
শাহিনুর বেরিয়ে যেতেই প্রণয় বলল,
-‘আপনি কিন্তু এখনো বলেননি সেদিন আমাদের সাহায্য করার কারণ।’
-‘বলতেই হবে?’
সামান্তার দৃষ্টিজোড়ায় এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো প্রণয়। সামান্তা একই ভাবে তাকিয়ে বলল,
-‘পুরুষের ভালোবাসায় আমার কখনোই বিশ্বাস ছিল না৷ কিন্তু আপনার ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধতা দিয়েছে। আর সেই মুগ্ধতাই আমাকে বাধ্য করেছিল সেদিন আইনের বিরোধীতা করতে!’
ফিরে তাকাল প্রণয়। বলল,
-‘বড়ো নিঃসঙ্গ আপনি। বিয়ে করছেন না কেন?’
-‘প্রণয় চৌধুরী পৃথিবীতে একটাই। দু’টো থাকলে দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবা যেতো।’
-‘আপনি… ‘
-‘আমি ডিভোর্সি!’
হতভম্ব হয়ে কয়েক পল তাকিয়ে রইল প্রণয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামান্তা বলল,
-‘মেয়ের নাম কি রেখেছেন?’
-‘ ভালো নাম শায়েরা জাহান প্রীতি। ডাকনাম সুখ।’
-‘মাশাআল্লাহ।’
শাহিনুর কফি নিয়ে এলো। দু’জনকে কফি দিয়ে সামান্তাকে বলল,
-‘আপা আজ কিন্তু থেকে যাবেন। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিন।’
-‘ এ সম্ভব নয় শায়লা আম্মা ভীষণ অসুস্থ। ফিরতে হবে ভাইয়া অপেক্ষা করছে আমার জন্য। একসঙ্গে বাড়ি ফিরব দু’জন।’
..
সকলের থেকে বিদায় নিয়ে পাঁচফোড়ন গৃহের প্রধান ফটক পর্যন্ত যেতেই অঙ্গনের সঙ্গে দেখা হলো সামান্তার। তারই অপেক্ষায় ছিল বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। বলল,
-‘ কার অপেক্ষায় ছিলেন রোমানা নাকি সামান্তা?’
ঈষৎ হেসে অঙ্গন জবাব দিলো,
-‘আমার ভাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষীর।’
-‘ভেরী ইন্টেলিজেন্ট!’
-‘চলুন থানা অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি।’
-‘কী সৌভাগ্য আমার চলুন যাওয়া যাক তবে।’
অঙ্গনের সঙ্গে সামান্তার পরিচয় ঘটে রমেশের মাধ্যমে। ভয়াবহ সেই রাতে মুমূর্ষ অবস্থায় প্রণয়কে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানোর সময় রমেশের সঙ্গে সামান্তাও ছিল। চারদিকে বিপদ যখন থৈথৈ করছিল। বন্ধু হয়ে রমেশের পাশাপাশি প্রণয়ের পাশে সেও দাঁড়িয়েছিল। সারিমের মাধ্যমেই রমেশের সঙ্গে পরিচয় সামান্তার৷ সে পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব হতেই একে অপরকে প্রণয়ের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। সেই রাতে রমেশ প্রিয় বন্ধুকে মাঝরাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পেয়ে সর্বপ্রথম সামান্তাকেই জানিয়েছিল। হসপিটালে ভর্তি থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয়ে সে সহায়তা করেছে। রমেশ,অঙ্গন,সামান্তা ছাড়া প্রণয়ের খোঁজ একটি কাকপক্ষীও জানতো না। এরপরের দিনগুলোতে অল্পস্বল্প কথা হয়েছিল অঙ্গন, সামান্তার। রোমানার সঙ্গে যেই মিলগুলো শাহিনুর প্রণয় পেয়েছিল একই মিল অঙ্গনও পেয়েছে। শুধু বাহ্যিক দিক নয় রোমানার মতো সামান্তার হৃদয়েও প্রণয়ের প্রতি গভীর অনুভূতি টের পেয়েছে। যেদিন টের পেয়েছে তার পরেরদিনই রোমানাকে চিনিয়েছে। শুরু থেকে শেষটা জেনে ব্যথিত হয়েছিল সামান্তা। সে ভীষণ শক্ত মনের অধিকারী। যে ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়ে তার হৃদয়ে ভালোবাসা জন্মেছে। সে ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়েই প্রণয়,শাহিনুর আর ছোট্ট সুখ’কে সুখী দেখতে চায়। মন থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনাও করে।
__
আজ একটু বেশিই খাটুনি হয়েছে। মাথাটাও ধরেছে ভীষণ। সুখ’কে না ঘুম পাড়িয়েই শুয়ে পড়েছে শাহিনুর। প্রণয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঘাটাঘাটি শেষে সুখ’কে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। যত খারাপই লাগুক শাহিনুর এমন নিশ্চুপ থাকে না কখনো। অথচ আজ ভীষণ নিশ্চুপ হয়ে আছে। খটকা লাগাতে দুবার ডাকল। তৃতীয়বার ডাক দিয়ে হাত বাড়িয়ে কাঁধ স্পর্শ করতেই ওঠে বসলো শাহিনুর। ভ্রু কুঁচকালো প্রণয়। রাশভারি কণ্ঠে বলল,
-‘তেল নিয়ে আসো দিয়ে দেই। মাথা ব্যথা কমে যাবে।’
শাহিনুর বলেনি তার মাথা ব্যথা করছে। তবুও মানুষ’টা বুঝে গেছে। মন কিছুটা নরম হলো। নিঃশব্দে ওঠে গিয়ে বাটিতে তেল ঢেলে প্রণয়ের সামনে এসে বসল৷ চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল গুঁজে তেল লাগাতে লাগাতে প্রণয় বলল,
-‘কী হয়েছে?’
চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে শাহিনুর পাল্টা প্রশ্ন করল,
-‘সামান্তা আপা কাঁদছিল কেন? আমাকে দেখে লুকানোর চেষ্টাও করেছিল।’
-‘জানি না!’
-‘মিথ্যা আপনি সব জানেন। বলুন।’
-‘সে আমাদের ঘরের লোক নয়। কাঁদল কি হাসল তাতে আমাদের কী?’
অত্যন্ত কঠিন স্বরে শাহিনুর বলল,
-‘ঐ চোখ দু’টো অন্য রকম কথা বলছিল ডাক্তারসাহেব। যা আমি উনার থেকে আশা করিনি।’
-‘আমাদের আশা অনুযায়ী সব হয় না নুর।’
-‘আমি রোমানা আপাকে মেনে নিয়েছি এরপর আর কাউকে মানতে পারব না।’
-‘মানতে বলিনি।’
-‘আপনি সবটা বুঝেও উনাকে নিষেধ করেননি।’
-‘আরে বাবা কী নিষেধ করব?’
-‘কাঁদতে।’
চুলে বিনুনি গাঁথতে গাঁথতে অধর কামড়ে হেসে ফেলল প্রণয়। শেষ মাথায় ব্যান্ড লাগিয়ে শাহিনুরকে ঘুরিয়ে বসাল। চোখে চোখ রেখে আদুরে স্বরে বলল,
-‘এত অভিমান করলে চলবে? উনি আমাকে কিছু বলেননি। যদি কিছু বোঝাতে চায় তা আমি বোঝার চেষ্টা করিনি। এতেই কি যথেষ্ট নয়? তাছাড়া উনি তোমাকে আমাকে, সুখকে ভীষণ ভালোবাসে।’
-‘আপনাকে কেন?’
-‘নুর, কেউ যদি দূর থেকে কাউকে ভালোবেসে সুখী থাকে থাকুক না। উনি খুব ভালো করেই জানে আমাকে পাওয়ার, কাছে এসে ভালোবাসার কোন অধিকার উনার নেই।’
সহসা প্রণয়ের বুকে মাথা রাখলো শাহিনুর। চোখ বুজে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। বলল,
-‘কাউকে ভালোবাসতে হবে না। আপনার জন্য আমি আছি, সুখ আছে আপনার গোটা পরিবার আছে।’
-‘আচ্ছা বাবা মেনে নিলাম। উনাকে ভালোবাসতে হবে না৷ এটা উনি বুঝেছেন বলেই তো মনের কথা সরাসরি প্রকাশ করেননি।’
-‘করলে খুব খারাপ হয়ে যেতো।’
-‘কী হতো!’
মাথা তুলে তাকাল শাহিনুর৷ তীব্র ক্রোধে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। উপকারীর উপকার তো অস্বীকার করতে পারবে না৷ তাই বলল,
-‘হাতজোড় করে বলতাম আপনাকে যেনো ভালো না বেসে শুধু আপনার ভালো চায়।’
এবার শব্দ করে হেসে ফেলল প্রণয়। দু’হাতে শাহিনুর গাল টিপে দিয়ে বলল,
-‘বাচ্চামি করে ফেললে সুখের আম্মু।’
আহ্লাদে আটখানা হয়ে প্রণয়ের উষ্ণ বুকে মুখ লুকাল শাহিনুর। তৃপ্তিময় হেসে সন্তর্পণে প্রণয়ও তাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।
মধ্যরাত। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। চাঁদের দেখা নেই।নক্ষত্রেরাও বোধহয় অভিমানে লুকিয়ে আছে। চোখে ঘুম নেই শাহিনুরের। প্রচণ্ড হাঁসফাঁস থেকে বিছানা ত্যাগ করল সে। জানালা খুলে মেঘে ঢাকা আকাশপানে তাকিয়ে বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। চোখের কার্ণিশ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। প্রীতি নার্সিং হোমের কাজ চলছে। আজ যদি তার আম্মা বেঁচে থাকত কত খুশি হতো! মেয়েকে নিয়ে নিশ্চয়ই গর্বের শেষ থাকত না। বাইজি গৃহের বিনাশ ঘটিয়ে সেখানে হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে! আদতেও কি কেউ এমন কিছু কল্পনা করেছিল? করেনি নিশ্চয়ই। কল্পনাতীত জিনিসটাই বাস্তবে রূপান্তরিত হচ্ছে। কত হাহাকার, কত আর্তনাদ মিশে ছিল ঐ গৃহে। সবকিছুর বিনাশ ঘটেছে। বুকের ভিতর সুক্ষ্ম এক ব্যথার পাশাপাশি প্রশান্তিও অনুভব হচ্ছে। এরচেয়ে বড়ো প্রতিশোধ আর কী হতে পারে? অসংখ্য মানুষের ভালো করে, প্রিয় অর্ধাঙ্গের স্বপ্ন পূরণের মধ্য দিয়ে বাইজি গৃহের পুরোপুরি ধ্বংস করা কি প্রতিশোধ নয়? যে গৃহে তার আম্মাকে বাইজি হয়ে বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে, যে গৃহ মান্নাত বুবুর অধিকার কেড়ে নিয়ে শুধুমাত্র পলাশ চৌধুরীর ভোগের সামগ্রী করেছে। আজ সেই গৃহ চিরতরে ধ্বংস। বাইজি শারমিন শায়লার কন্যা শাহিনুর শায়লার প্রতিশোধ তো এমনটাই হওয়া উচিৎ।ইতিহাসের পাতায় সারাজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই ঘটনা। হয়তো কোন এক সময় “প্রীতি নার্সিং হোম” সৃষ্টির পেছনের রহস্য লোকের মুখে মুখে থাকবে! সে রহস্যময় গল্পের প্রধান চরিত্র হবে বাইজি শারমিন শায়লা, কন্যা শাহিনুর শায়লা এবং তার শ্রেষ্ঠ স্বামী, মহাপুরুষ প্রণয় চৌধুরী।
শক্তপোক্ত সুঠাম একজোড়া হাত পেছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরতেই চমকে ওঠল শাহিনুর। পেছন ঘুরে হুইলচেয়ারে প্রণয়কে দেখতে পেয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে হেসে ফেলল । প্রণয় তার উন্মুক্ত উদরে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
-‘আকাশের সঙ্গে ঝগরা করছো?’
চমকে ওঠল শাহিনুর। জিজ্ঞেস করল,
-‘কীসের ঝগরা?’
-‘আকাশ আমায় হিংসে করছে বলে। আজ ওর বুকে চাঁদ নেই অথচ আমার বুকে ঠিকি চাঁদ রয়েছে। যে তার আলো দিয়ে আমার জীবনটাকে আলোকিত করে রেখেছে। বেচারার দুঃখ হয় না?’
মুচকি হেসে সন্তর্পণে প্রণয়ের কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরল শাহিনুর। দু’হাতে তাকে আগলে নিলো প্রণয়।
-‘আজ আম্মা আর মান্নাত বুবুকে খুব বেশি মনে পড়ছে ডাক্তারসাহেব।’
-‘দোয়া করো তাদের জন্য। কষ্ট পেওনা। উপরওয়ালা তোমার আম্মার অভাব দূর করতেই সুখ’কে পাঠিয়েছেন। যখনি আম্মাকে মনে পড়বে সুখের মুখ দেখে নিজেকে শান্ত করবে।’
জলপূর্ণ দৃষ্টিতে স্বামীর পানে তাকিয়ে রইল শাহিনুর। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা সুখকেও পূর্ণদৃষ্টিতে দেখল। তার অমন গভীর চাহনি দেখে প্রণয় বলল,
-‘কী দেখছো এভাবে?’
মেয়ের থেকে দৃষ্টি এনে স্বামীর পানে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নিজের কোমল হাত দুটো দিয়ে দাঁড়ি ভর্তি পুরুষালী গাল দু’টো আঁকড়ে ধরল। বলল,
-‘আমার সুখকে, আমার ভালোবাসার ডাক্তারসাহেবকে, আমার প্রিয় সুখের আব্বুকে।’
কপালে কপাল ঠেকিয়ে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রণয়ও। গভীর, মুগ্ধ সেই চোখেতে চোখের মিলন ঘটিয়ে হঠাৎ ফিসফিস কণ্ঠে শাহিনুর বলল,
-‘আপনি কী দেখছেন সুখের আব্বু?’
-‘আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, আঁধার রাতের চন্দ্রকান্তা, প্রিয় সুখের আম্মুকে।’
উপন্যাসটি নিয়ে কিছু কথাঃ এটি সম্পূর্ণ আমার কল্পনা থেকে লেখা৷ প্রতিটি চরিত্রও কাল্পনিক। ইতিহাসে জমিদার এবং বাইজিদের লেখা আছে। আমি সেই জমিদার এবং বাইজিদের নিয়েই আধুনিক সময় উল্লেখ করে কাল্পনিক কাহিনী লিখেছি। যে কাহিনীর প্রায় প্রতিটি চরিত্রই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে মূল চরিত্র বাইজি শারমিন শায়লা, তার কন্যা শাহিনুর শায়লা এবং জমিদার পুত্র প্রণয় চৌধুরী। বাকি সব চরিত্র ছাড়াও উপন্যাসটি লেখা সম্ভব হতো না। গর্ভবতী থাকাকালীন একজন নারী কীভাবে বাইজি হলো? কেন বাইজি হলো? বাইজি গৃহে তার কন্যা সন্তান জন্মের পর তার বেড়ে ওঠা। জমিদার পুত্রদের নজর থেকে আড়ালে রাখতে গিয়ে তাদের সকলের নজরে পড়ে যাওয়া কন্যাকে কীভাবে রক্ষা করবে? শেষ পর্যন্ত বাইজি কন্যার পরিণতি কী হয়? সে কি বাইজি হয় নাকি তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে কেউ আসে? বাইজি কন্যার পরিণতি কি হয়? সবটা জানতে হলে অবশ্যই বাইজি কন্যা উপন্যাসটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে। যে উপন্যাসটি ভালোবাসার এক নিদারুণ ব্যাখ্যা দেবে।
পাঠকদের জন্য কিছু কথা– পৃথিবীতে নিখুঁত জিনিস খুব কম পাওয়া যায়। বাইজি কন্যা উপন্যাসটি নিখুঁত নয়। অনেক ভুলত্রুটি রয়েছে। সেগুলো আপনারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। দীর্ঘ এই উপন্যাসটির শুরু থেকে শেষ অবধি ধৈর্য সহকারে যারা ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার পুরোনো, নতুন সকল পাঠককে কৃতজ্ঞতা জানাই৷ অন্তরের অন্তস্তল থেকে আপনাদের জন্য ভালোবাসা রইল। আপনারাই আমার লেখালেখির শক্তি। আশা করি উপন্যাসটি নিয়ে সকলেই ছোট্ট করে হলেও পেইজে একটি রিভিউ দেবেন। সর্বোপরি সকলকে ভালোবাসা। আমার জন্য দোয়া করবেন সবাই। আসসালামু আলাইকুম।