স্তব্ধ নয়নে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে হুর। চোঁখের পলক টাও যেনো পড়ছে না। জীবন টা যেনো হুট করেই এলোমেলো হয়ে গেলো! এই তো কিছুক্ষন আগেও তার পরিচয় ছিলো সে মিস্টার হাসানের মেয়ে। আর এখন তার নামের সাথে জুড়ে গেছে নতুন একটা নাম।
কিছুক্ষন আগেই হুর আর ফাইয়াজ এর বিয়ে সম্পন্ন হলো। সবকিছু এতোটাই দ্রুত ঘটে গেলো যে হুর সঠিক ডিসিশন নেয়ার সময় টা পর্যন্ত পায় নি। সে জানে না তার সাথে যা হলো তা ঠিক না ভুল। তার মাথায় শুধু একটা জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছে আর তা হলো সে আজকে এই মুহূর্ত থেকে ফাইয়াজ এর স্ত্রী।
এই তো কিছুক্ষন আগের কথা। হুর শাওয়ার নিয়ে রুমে এসেছে মাত্র ঘুমাবে বলে। কিন্তু হুট করে তার রুমে মিসেস হেনা ও মিস্টার হাসান একত্রে প্রবেশ করলেন। দুইজন কে একত্রে এই অসময়ে নিজের রুমে দেখে অবাক হলো হুর। তারপরও নিজের অবাক ভাব কে প্রকাশ না করে মুখে হাসির রেখা টেনে তাদের কাছে গেলো হুর। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-“কি ব্যাপার আম্মু , বাবাই! তোমরা আজ এই অসময়ে আমার রুমে! কোনো বিশেষ কিছু আছে নাকি! কিছু বলবে তোমরা! ”
মিস্টার হাসান ও মিসেস হেনা একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলেন। হয়তো তারা কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু বলতে দ্বিধা বোধ করছে। হুর তাদের ইজি করার জন্য মৃদু হেসে বললো,
-“কি হলো বললে না যে হঠাৎ এই সময়ে আমার রুমে আসার কারণ! দেখো তোমরা এতো uneasy ফীল করছো কেনো! যা বলতে চাচ্ছ বলে ফেলো। ”
হুরের বাবা মা এতে যেনো কিছু টা স্বস্তি পেলো। মিস্টার হাসান মিসেস হেনা কে চোঁখে কিছু একটা ইশারা করে হুরের হাত ধরে তাকে বেডে নিয়ে বসালো। হুরের হাত দুটো কে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
-“দেখো আম্মু ; আমি এখন যা বলবো তা মন দিয়ে শুনবে। আমরা যা করবো তোমার ভালোর জন্যই করবো। আমাদের উপর তোমার ভরসা আছে তো আম্মু! ”
হুরের মনে ভয় কাজ করলেও সে বললো,
-“হ্যা বাবাই আমার তোমাদের উপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে। তোমরা যা করবে আমার ভালোর জন্যই করবে। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি তোমরা সবসময় আমার জন্য যা বেস্ট তাই করেছো। তাহলে আজ কেনো বিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে! ”
হুরের বাবা হাসান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“তোমার ফরিদ আঙ্কেল চাচ্ছেন তোমাকে তার পুত্রবধূ করতে। অর্থাৎ তিনি চান ফাইয়াজ এর সাথে তোমার বিয়ে হোক। আর সেটা আজকেই। ফরিদ চাচ্ছে তোমার আর ফাইয়াজ এর কাবিন টা করিয়ে রাখতে। ”
হুর চোখ বড়ো বড়ো করে ফেললো। সে মোটেও এইসব শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। এর মাঝে মিসেস হেনা হুরের কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“আজকে ফরিদ ভাই এসেছেন ই এই জন্য। উনি নাকি তোকে প্রথম যেদিন দেখেছিলেন সেদিনই ঠিক করেছিলেন তোকে উনার পুত্রবধূ করবেন। আর আজকে প্রস্তাব টা দিয়েই ফেললেন। উনার মনে নাকি ভয় ঢুকেছে আমরা যদি অন্য কারোর সাথে তোর বিয়ে ঠিক করে ফেলি! তাই উনি চাচ্ছেন আজকেই কাবিন টা করিয়ে নিতে। পরবর্তীতে তুই যখন যেতে চাবি তখন বড়ো করে অনুষ্ঠান করে তোকে নিয়ে যাবে। ”
মাথা নিচু করে বসে আছে হুর। হাসান সাহেব হুরের গালে হাত রেখে বললেন,
-“দেখো আম্মু আমরা কিন্তু তোমাকে এতো জলদি বিয়ে দিতে চাই নি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমরাও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম তোমার পড়াশোনা শেষ হলে ফাইয়াজ এর সাথে তোমার বিয়ে দেবো। ফাইয়াজ ছেলে টা খুব ভালো। আমি ওর সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েই বলছি। আমার ওকে তোমার জন্য সম্পূর্ণ যোগ্য মনে হয়। সেই পারবে তোমাকে আগলে রাখতে আমার বিশ্বাস। তাই তো আমি এবং তোমার আম্মু এই বিয়েতে মত দিয়েছি। এখন সব টা তোমার হাতে আম্মু। আমি চাই তুমি আমার এবং তোমার আম্মুর মতামত কে সম্মান করো। আর বিশ্বাস রাখতে পারো তুমি ঠকবে না ; ফাইয়াজ ছেলে টা তোমাকে ভালো রাখবে। বাকি টা তোমার উপর নির্ভর করছে তুমি ভাবো আম্মু কি করবে। ভেবে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাও। আমার বিশ্বাস আছে আমার মেয়ে আমার সিদ্ধান্তে অমত করবে না কারণ সে জানে তার বাবাই তাকে বেস্ট জিনিসটাই দিবে। ”
হাসান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
-“ভেবে সিদ্ধান্ত নিস মা। জীবন টা তোর। তোর মত টাই আসল। তবে আমারও মনে হয় ফাইয়াজ তোর জন্য পারফেক্ট। ”
মিসেস হেনা কথাগুলো বলে রুম থেকে চলে গেলেন। হুর স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সব যেনো তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। এখন সে বুঝতে পারছে কেনো ওই সময় সবাই অদ্ভুত আচরণ করছিলো। হুরের চিন্তার মাঝে কোথা থেকে যেনো লিয়া দৌড়ে এসে হুর কে জড়িয়ে ধরলো। হাপাতে হাঁপাতে বললো,
-“দোস্ত তুই জানিস না আমি কতো টা খুশি হয়েছি তোর আর ফাইয়াজ ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনে। তাই তো আম্মুর কাছে শোনা মাত্র তোদের বাসায় চলে আসলাম। আর হৃদের নাচানাচি তো তুই দেখিস নি। দেখলে বলতি পুরাই পা’গল হয়ে গেছে আনন্দে। ”
লিয়া নিজের কথা শেষ করে হুরের দিকে তাকাতেই তার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। হুরের চোঁখে জল টলমল করছে যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়বে। লিয়া হুরের গালে হাত ছুঁইয়ে বললো,
-“কি হয়েছে হুর! তুই কাঁদছিস কেনো! ওহ, বুঝতে পেরেছি এখনো তোর মনে ফারান রয়ে গেছে তাই না! আমি জানি জীবনের প্রথম ভালোবাসা, প্রথম অনুভূতি ভোলা সম্ভব নয়। সেটা সারাজীবন মনের মাঝে রয়ে যায়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে ফারান হয়তো তোর ভাগ্যে ছিলো না। ফারান তোকে কখনোই ভালোবাসে নি হয়তো। সে হারিয়ে গেছে তোর জীবন থেকে। যাকে আর কখনো তুই ফিরে পাবি না। সে তোকে ভালোবেসে থাকলে এতদিনে তোর কাছে ফিরে আসতো। তাই এক জায়গায় থেমে না থেকে মুভ অন কর হুর। প্রথম অনুভূতিটাকে নাহয় মনের এক কোণে যত্নে রেখে দিস।”
হুর লিয়ার দিকে অশ্রুশিক্ত চোঁখে অসহায় ভাবে তাকাতেই লিয়া আবার বলতে লাগলো,
-“তোর ভালোবাসার মানুষ টাও যদি তোকে ভালোবাসতো তাহলে আমি কখনোই বলতাম না তোকে এই বিয়ে করতে। বরং তখন হয়তো আমি নিজেই এই বিয়ের বিরোধিতা করতাম। কিন্তু তার মনে তোর জন্য কোনো অনুভূতি নেই হুর। তাই আমি তোকে বলবো এই বিয়ে টা তুই কর । একবার বাইরে গিয়ে দেখ তোর পরিবারের সবাই এই সম্পর্কটা তে কতো টা খুশি। নিজের পরিবারের খুশির জন্যই নাহয় রাজী হয়ে যা। আর আমার বিশ্বাস তুই ফাইয়াজ ভাইয়ার কাছে ভালো থাকবি। ভাইয়া মানুষটাই এমন বিশ্বাসযোগ্য। আমার তো এতদিন মনে হতো ভাইয়াকে যেই মেয়ে নিজের লাইফে পাবে সে অনেক লাকি হবে আর আমি প্রচন্ড খুশি হয়েছি কারণ তুই সেই লাকি মেয়ে হতে যাচ্ছিস। ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিস হুর। ”
————
রাত আটটা। কাজী কে ডাকানো হয়েছে। বিয়ে পড়ানো হবে এখন।
কিছুক্ষন আগে হুর নিজে থেকে এসে বলেছে সে এই বিয়েতে রাজী আছে। হুরের পরিবারের সবাই এবং ফরিদ সাহেব খুবই খুশি হয়েছেন হুর বিয়েতে মত দেয়ায়। কিন্তু একজন খুশি হতে পারেনি। সে হলো ফাইয়াজ। ফাইয়াজ ভাবতেও পারেনি হুর বিয়েতে মত দিয়ে দিবে। ফাইয়াজ হুরের দিকে কিছু সময় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এখন তার হাতেও আর কিছু করার নেই। হুর যখন মত দিয়ে দিয়েছে সে এই বিয়ে টা করতে বাধ্য।
হয়ে গেলো বিয়ে। সম্পন্ন হলো কাবিন। আজ থেকে হুর ও ফাইয়াজ একে অপরের জীবন সঙ্গী। নগদ দেনমোহর পরিশোধ করলো ফাইয়াজ। আজ থেকে হুরের উপর তার পূর্ণ অধিকার আছে। কিন্তু হাসির ছিটা ফোটাও নেই দুইজনের মুখে ; না আছে দুজনের মুখে কোনো কথা। ফাইয়াজ মাথা নিচু করে বসে আছে। হয়তো কিছু চিন্তা করছে। আর হুর সে তো নিজের জীবনের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। তার মাথায় ঘুরছে এই বিয়ের পরিণতি টা কেমন হবে! এই সম্পর্ক তার জন্য সুখ বয়ে আনবে নাকি তার জীবনে আসতে চলেছে নতুন কোনো ঝড়!
Leave a comment