সপ্তদশী কিশোরী মেয়ের ভেতরটা দুঃসহ,দুর্নিবার। চোখের কোনা ভরা টলটলে অশ্রু চাঁদের আলোতে জ্ব*লছে। সদ্য বলা কথায় সে নিজেই ভী*ত,শ*ঙ্কিত। চিন্তান্বিত তার দৃষ্টি। ধূসর ভাই কী বলবেন,কী করবেন বিভ্রান্ত মস্তক। ধূসর ভাইয়ের রা*গে আ*গুন হওয়া চেহারা চোখে ভাসে। বেপরোয়া তার ক্রু*দ্ধতা মনে পড়ে। দেহটা ক*ম্পিত হয় আতঙ্কে।
এই যে সে বোম ব্লা*স্ট করল,কী হবে এখন? পিউ যখন গভীর দুঃশ্চি*ন্তায় ডু*বছে, সেই ক্ষনে ধূসরের অনাকাঙ্ক্ষিত নিরুদ্বেগ স্বর ভেসে এলো,
‘ তো?’
পিউ আশ্চর্য বনে তাকাল। ধূসরের উদ্বেগহীন শ্যামলা চেহারায় পূর্ন দৃষ্টি বোলাল। ঘন পল্লব দুবার ঝাপ্টে বলল,
‘ ততো মমানে?’
‘ পুষ্প,ইকবাল দুজন দুজনকে ভালোবাসে, তো?’
পিউ প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে বলল,
‘ আপনি অবাক হননি?’
‘ না।’
‘ কেন?’
ধূসর দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,
‘ আমি জানি এসব।’
পিউয়ের ঠোঁট দুটো নিজ শক্তিতে আলগা হয়ে বসল। সদ্য আকাশ ফেটে মাটিতে পরল যেন। চোখজোড়া কোটর ছাড়িয়ে বলল,
‘ ককী বলছেন?’
ধূসর সরু নেত্রে তাকাল,বলল,
‘ কেন,তোর কী মনে হয়? আমার কাছের মানুষরা আমার নাকের ডগা দিয়ে কিছু করবে,আর টের পাব না? এতটা নির্বোধ আমি ?’
পিউ বিচলিত হয়ে ঢোক গেলে। বারংবার ঠোঁট ভেজায় জ্বিভে। মস্তিষ্ক শূন্য। শিথিল ভাবে দুদিকে মস্তক নেড়ে বোঝাল ‘ না।’
ধূসর ভাই নির্বোধ হতেই পারেনা।
কিন্তু এরকম একটা কথা জেনেও উনি এত নির্লিপ্ত কী করে?
তার অশান্ত, অনিশ্চিত চাউনীতে ধূসরের লোঁচন। কয়েক পল চেয়ে থেকে যেন পড়ে নিল ভেতরের কথা। নিজে থেকেই বলল,
‘ পুষ্প যে ইকবালকে ভালোবাসে,আমি দুই বছর আগে থেকে জানি। ‘
পিউ হোচট খায়। বিস্ময়ে নিস্তব্ধ হয়। চোখের জল, সেই কখন উবে গেছে। শুকনো কোটর দুটো এখন প্রকান্ড রুপে।
‘ ওদের প্রেমের শুরু,কখন কোথায় যাচ্ছে, কবে দেখা করছে, প্রত্যেকটা খবর আমার নখদর্পনে পিউ। ‘
পিউ অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল ‘ কী!’
‘ হু। আমরা পুষ্পর ভার্সিটি গিয়েছিলাম,মনে আছে তোর?’
পিউ ত্রস্ত মাথা দোলাল,মনে আছে বোঝাতে। ধূসর বলল
‘ ইকবাল সেদিন এসেছিল শুধুমাত্র পুষ্পকে সেফ করতে। আমাকে বাচ্চাদের মত একটা কিছু বুঝিয়ে দিয়ে রেখে গিয়েছিল। ভেবেছিল আমি বুঝিনি,কিন্তু ওদের মাথাতেও নেই,আমি সবটা জানি। রেজাল্টের জন্যে নয়,ওর ডিপার্টমেন্ট হেড কেন ডেকেছিলেন সেটাও আমি জানি। ইনফ্যাক্ট,তোর নানাবাড়িতে ইকবালের হঠাৎ আসা আমার জন্যে নয়,পুষ্পর জন্যে, ওটাও আমি জানি। ‘
পিউ হা করে বলল ‘ সব জেনেও আপনি চুপ করে ছিলেন ধূসর ভাই? কেন? ‘
ধূসর প্রথমেই জবাব দিলোনা। বাম দিকে পাতা সেই লোহার চেয়ার টেবিলের দিক এগিয়ে গেল। চেয়ারে বসে,পাশেরটা চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল,
‘ বোস।’
পিউ থম ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। কথাটায় নড়েচড়ে হেঁটে আসে। আলগোছে বসে। একটা মুহুর্তও তার চক্ষুদ্বয় ধূসরের মুখ থেকে সরেনি। তার ব্যাকুল,ব্যগ্র চাউনীতে অনেক প্রশ্ন। পাশাপাশি রাজত্ব করছে ভ*য়। সে যে কৌতুহলে এখন ডানা ঝাপটাবে,ধূসর ভাই কি
উত্তর দেবেন সবটার? অর্ধেক কথা বলে মুখে তালা ঝোলাবেন না তো?
পিউ ঘুরিয়ে পেচিয়ে আগের প্রসঙ্গে ফিরে এলো। কণ্ঠ নরম করে বলল ‘ আপনাকে দেখে কখনও মনে হয়নি আপনি সব জানতেন। ‘
ধূসর বক্র হাসে। যেন কৌতুক শুনল কেবল। হাসিটা পিউকে বিভ্রমে ভোগাতে যথেষ্ট। সে কী হাসার মত কিছু বলেছে? ঠোঁট ফুলিয়ে মিনমিন করে বলল
‘ হাসছেন কেন?’
ধূসর সোজাসাপটা উত্তর দেয়না। উলটে প্রশ্ন করল,
‘ তুই এত বোকা কেন?’
পিউ ভ্রুঁ গোছাল ‘ আমি কী করলাম?’
ধূসরের হাসি মুছে যায়। অদ্ভূত গলায় আওড়ায়,
‘ আমাকে বুঝতে তোর আরো সতের বছর সময় লাগবে পিউ, তখনও পারবি কী না সন্দেহ।’
পিউ চুপ করে গেল। চেয়ে রইল একধ্যানে। মনে মনে বলল,
‘ সতের বছর কেন ধূসর ভাই,প্রসঙ্গ আপনার হলে সতেরশ বছরেও কার্পন্য করব না আমি।’
মুখে বলল ‘ উত্তর টা দিচ্ছেন না।’
‘ কোনটা?’
‘ আপুর ব্যাপারে। কেন চুপ করে ছিলেন! ‘
‘ ইচ্ছে করে। ‘
‘ ইচ্ছে করে? কেন?’
ধূসর একটু চুপ থেকে বলল,
‘ ইকবাল আমার জন্যে প্রথম প্রথম পুষ্পকে প্রত্যাখান করত,অথচ সে নিজেও হাবুডুবু খাচ্ছিল ওর প্রেমে। ভাবত, যদি আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়,যদি আমি ভুল বুঝি!
বলতে বলতে হাসল সে। পিউ গভীর চোখে দ্যাখে সেই অমায়িক হাসি। এই হাসি দেখলে তার বক্ষ আলোড়িত হয়।
ধূসর জানাল, ‘ এসবের জন্যেই ইকবাল আগাতো না আমি জানি। পরবর্তীতে পারেনি। অনুভূতি সামলানো সবার সাধ্যে নেই।
আমি সব জেনেও ভাণ করতাম কিছু জানিনা। ওরা লুকিয়ে রাখতে চাইছিল যখন,আমিও না হয় সাহায্য করলাম তাতে। ‘
পিউ চোখ বড় বড় করে বলল ‘ এর মানে আপনি ওনাদের সম্পর্কটা নিয়ে রাজি? ‘
বলার সময় উজ্জ্বল শোনাল তার কণ্ঠ। যেন ধূসর হ্যাঁ বললেই লাফিয়ে উঠবে।
ধূসরের জবাব,
‘ রাজি না হওয়ার কিছু নেই। ইকবাল কে আমি চিনি। স্বর্নের টুকরো বলা যায়। যদি ভালো না হতো প্রথম দিনই সবার আগে ওদের প্রেমে আমি বাঁধা হতাম। কিন্তু ইকবাল আলাদা, যাকে ভালোবাসবে জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখে তাকে। ওর চোখে আমি পুষ্পর জন্যে ভালোবাসা দেখি,টান দেখি। পুষ্প ভালো থাকবে।’
‘ আমার চোখে কিছু দ্যাখেননা ধূসর ভাই?’
পিউয়ের অন্তঃস্থল জানতে চায়,প্রশ্ন করে। ইকবাল ভাইয়ের চোখে যদি আপুর জন্যে ভালোবাসা দেখতে পান,আমার চোখে আপনার জন্যে কিছু দেখতে পাননি? পাবেন কী করে,তাকিয়েছেন কখনও? দেখেছেন এই নেত্রযূগল? তারা কতটা তৃষ্ণার্ত,বিমূর্ত আপনার প্রেমে! দ্যাখেননি। দেখবেন কেন,এ চোখে তাকানো পাপ। আপনি তো পাপি হতে চাইবেন না ধূসর ভাই, তাইনা?
অভিযোগে পিউয়ের অভ্যন্তর অবসন্ন হয়। হঠাৎ মুখের সামনে ধূসর তুড়ি বাজাতেই ধ্যান কা*টে। চটপট ফেরে সত্ত্বায়। তটস্থ আঁখিতে তাকালে ধূসর বলল,
‘ এই সামান্য একটা কারণে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদার মতো কারণ দেখছিনা।’
পিউ দর্শনেন্দ্রিয় নত করল। ফেলল কোলের ওপর রাখা দুটো হাতের ওপর। নীচু কণ্ঠে বলল,
‘ আপনাকে আমি পুরো কথা এখনও বলিইনি ধূসর ভাই।’
ধূসর ভ্রুঁ বাকায়,কানে আসে তার ভরাট কণ্ঠ ‘ কী কথা?’
পিউ নতজানু মুখটা তুলল না। মনঃস্তাপ নিয়ে জানাল,
‘ সেজো মা চাইছেন আপু সাদিফ ভাইয়ের বউ হোক।’
ধূসর চমকে গেল। ধা*ক্কা খেল। স্পষ্ট প্রকাশ পেল তার প্রশ্নে ‘ কী?’
পিউ মাথা নেড়ে বলল,
‘ হু। চাচ্চুও জানেন। কথা ছিল উনি ফিরলে আব্বুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন। আমি নিজের কানে শুনেছি…..
আস্তে-ধীরে, মৃদু কণ্ঠে সমস্তটা বর্ননা করলো সে। বাদ দিলোনা একটা দাঁড়ি, কমাও। এতক্ষণে নিস্প্রভ থাকা ধূসরের কপালের ভাঁজ তীব্র হয়। বেড়ে আসে নেত্র সংকোচনের মাত্রা। ভাবিত ভঙিতে ওপরের ঠোঁট দিয়ে চেপে রাখে নিচের ঠোঁট। অনুচিন্তন দেখা দেয় রাশভারি মুখমন্ডলে। মহাবিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করল,
‘ এদের কী একটাই কাজ,এর ওর সাথে বিয়ে ঠিক করা? আশ্চর্য! ‘
বর্ননার পিঠে প্রত্যাশিত জবাব পিউ পেলোনা। সে আগ্রহভরে তাকাল। ধূসরের উদ্বীগ্ন চোখমুখ দেখতেই কাঁন্না পেলো আবার। ব্যাপারটা মোটেই সাধারণ নয়। সাধারণ হলে ধূসর ভাই এভাবে চুপ করে থাকতেন না নিশ্চয়ই। ছিঁচকাদুনের মত আপনা আপনি চোখের কোনা ভরে ওঠে তার। আত*ঙ্কিত, ভেজা গলায় বলল,
‘ এখন কী হবে ধূসর ভাই? ‘
ধূসর ভাবনা থেকে প্রস্থান নেয়। পিউয়ের ললিত মুখে দৃষ্টি দেয়। ভ্রু গুছিয়ে বলে ‘ কী হবে?’
পিউ নাক টেনে,বড্ড দুঃ*শ্চিন্তা নিয়ে বলল,
‘ সেজো চাচ্চু একবার বিয়ের কথা খুললে আব্বু ফেরাবেন না। জোর করে হলেও বিয়ে দেবেন।’
পিউয়ের চোখ বেঁয়ে পানি এসছে গাল অবধি। নাকের ডগা স্ফীত। চিন্তায় ফ্যাসফ্যাসে অবস্থা। অথচ হাসি পেলো ধূসরের। ভীষণ ক*ষ্টে মুখটা গম্ভীর রেখে বলল ‘ তোকে বলেছে?’
পিউ মাথা দুলিয়ে বলল ‘ আমি জানি। আব্বুকে চিনব না? আপনি দেখবেন….’
ধূসর সম্পূর্ন করতে দিলোনা। আগেই কোপিত কণ্ঠে হুশিয়ারি দেয়,
‘ এসব বড়দের ব্যাপার নিয়ে তোকে কেউ ভাবতে বলেনি। তোর কাজ হচ্ছে পড়াশুনা করবি,খাবি, ঘুমাবি। ‘
পিউ নিষ্পাপ,উদাস কণ্ঠে বলল ‘ ঘুমতো তিন বছর আগেই হারা*ম করেছি,এখন খাওয়া দাওয়াও হা*রাম হবে।’
ধূসর ব্যর্থ চোখে তাকাল। এই পিচ্চি মেয়েকে বোঝানোর সাধ্য তার আছে?
স্থূল কণ্ঠে বলল ‘ তুই আমার কথা শুনবি, না কি না?’
পিউয়ের কা*ন্না ওমনি শেষ। সে শশব্যস্ত হয়ে বলল,
‘ শুনব।’
‘ চোখ মোছ। এসব ভাবার জন্যে আমি আছি। তোকে যেন মাথা ঘামাতে না দেখি।’
পিউ বাধ্যমেয়ের মত ঘাড় কাত করল। ওড়নার প্রান্ত উঠিয়ে চ্যাটচ্যাটে গাল মুছতে গেলে হাত ধরে ফেলল ধূসর। প্রশ্ন নিয়ে তাকাল সে। ধূসর স্বল্প এগোয়, সাদরে, সযত্নে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নিজেই মুছিয়ে দেয় ডাগর ডাগর চক্ষুদ্বয়। পিউয়ের বিহ্বল,বিমোহিত চাউনীতে দৃষ্টি গাঁথে। সহজ -স্বীকারোক্তি দেয়,
‘ তোকে কাঁদলে খুব বা*জে লাগে পিউ। এতটা বি*শ্রী লাগে যে আমার কিছু একটা করে ফেলতে মন চায়।’
পিউ অবোধ কণ্ঠে শুধাল,
‘ কী মন চায় ধূসর ভাই?’
ধূসর প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। অঞ্জলিপুটে রাখল তার হ্রস্ব আদল। সেখান থেকে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা উঠে গেল তার মসৃন গালে। দু একবার স্লাইড করল জায়গাটায়। স্পর্শে পিউয়ের গাত্র শিরশির করে। মন্থর বেগে বুজে আসে কিশলয়। ধূসর চোখেমুখে দরদ ঢেলে শুধাল,
‘ বেশি ব্য*থা পেয়েছিস? ‘
পিউয়ের শিহরণ মুছে গেল ওমনি। গতকালকের সব কথা পাল্লা দিয়ে মনে পড়ল। চুরি করে ধরা পরার মত করে ফেলল চেহারা। ধূসর ভাই হাতের কাছে পেলে খবর করবেন বলেছিলেন না? আর সে কী না তার সামনেই বসে?
পিউ পরিবেশ সামলাতে, যেঁচে ফটাফট বলে দিল
‘ আর কখনও এরকম করব না ধূসর ভাই।’
ধূসর কিছু বলল না। তার অভিপ্রায় স্বাভাবিক। মেয়েটা ওর ভ*য়ে সকালে খেয়ে যায়নি অথচ একটু আগে ওর বুকে পরেই কাঁদল।
মনে মনে হাসল সে। বাইরেটা শক্ত রাখতে ঠোঁট কাম*ড়ে ধরল।
পিউ ভীত কণ্ঠে বলল ‘ এবারের মত কি ক্ষমা পেয়েছি?’
সে হ্যাঁ -না জানাল না। উলটে প্রশ্ন করল
‘ বললিনাত,অনেক ব্য*থা পেয়েছিস?’
পিউয়ের ঠোঁট উলটে এলো।
‘ ব্য*থা পাওয়ার জন্যেইত মে*রেছেন।’
কথাটায় প্রকাশ পেল তার অভিমান,ছোট্ট মনের বেদ*নাবোধ। অথচ ধূসর স্বভাবসিদ্ধ হাসে। অল্প হলেও, পিউয়ের হৃদয় কাঁ*পানো হাসি। স্বর নামিয়ে বলে,
‘ শরীরের ব্য*থা তো ওষুধ খেলে সেড়ে যায়। দুদিন বাদে ক্ষ*তটাও মিশে যায় ত্বকের নীচে। কিন্তু তুই মর*তে যাচ্ছিলি শোনার পর একজনের বক্ষপিঞ্জরে যে ক্ষ*ত, যে ছিন্ন স্থান,যে য*ন্ত্রনা তৈরী হয়েছিল তা মিশবে কী দিয়ে পিউ?’
প্রগাঢ়, নিবিঢ় গলায় ধূসরের অগভীর অধর নড়তে দেখা যায়। ঠিকড়ে আসে কিছু বাক্যবাণ। দ্বিখণ্ডিত করে পিউয়ের দেহময় ছড়িয়ে থাকা অতি সুক্ষ্ণ নাড়ীটিকেও।
সে আকুল চিত্তে শুধায় ‘ সেই একজন কে ধূসর ভাই?’
তার ভেতরটা দোদুল্যমান। ছট*ফট করছে,কাত*রাচ্ছে। ব্যগ্র হয়ে চাইছে ধূসর ভাই বলুক ‘সেই একজন আমি ‘।
‘ তোর না জানলেও চলবে।’
বরাবরের মত উদ্বেগশূন্য, সংক্ষিপ্ত প্রতিবাক্যে পিউ হতাশ হয়। নেতিয়ে আসে মন। আচমকা ধূসর তার ঘাড়ের কাছটা চে*পে ধরে। রীতিমতো টেনে এগিয়ে নেয় নিজের দিক। পিউয়ের ক্ষুদ্র ঘাড় এঁটে গেল তার পুষ্ট মুঠোয়। মুখটা ঝুঁকে এলো সামনে। মৃদূ ভড়কায় মেয়েটা। ওপাশ থেকে ধূসরের মাথাটাও এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। মুহুর্তে শুরু হলো তার তপ্ত শ্বাস আ*ছড়ে পরার যু*দ্ধ। পিউয়ের বদন উষ্ণীষ হয়ে আসে সেই নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায়। আরেকটু হলে ওষ্ঠযূগল ছুঁইছুই হবে। ধূসরের সরু নাক ছুঁয়ে দেখবে তার মুখমণ্ডল। পিউয়ের শ্বাসরু*দ্ধকর অবস্থা তখন। এত কাছে কখনও আসেনি যে!
ধূসরের এতটা সান্নিধ্য সহ্য হয়না। এই যে পুরো চেহারাটা দেখছে, এতটা নৈকট্য এসব কী আদৌ সত্যি?
ভীষণ ক*ষ্টে,ভয়*ঙ্কর প্রয়াসে সে তাকিয়ে থাকে ধূসরের তামাটে মুখের দিকে। অক্ষিপল্লব কাঁপ*ছে তখন। দ্রিম দ্রিম শব্দে আন্দোলিত হচ্ছে অন্তঃকরণ। ধূসরের অন্তর্ভেদী, মোহময়, নেশার্ত দৃষ্টি পরীক্ষা নেয় তার। মানুষটার কপালে বিন্যস্ত চুল গুলো এত সুন্দর কেন? এত সুন্দর কেন দৃঢ় চিবুকটা? আর ঘন ভ্রুঁ দুটো,যেন সুগভীর খাদ। এর জন্যে যে সে হাজার বার মর*তে পারে।
পিউ ভেতরে ছটফট করে, অনুরোধ জানায়,
‘ এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না ধূসর ভাই। খু*ন হয়ে যাচ্ছি আমি।’
ধূসরের নেত্রদ্বয় তার মুখজুড়ে খেলছে। কপাল,চোখ,নাক, ঠোঁট তীক্ষ্ণ ভাবে মাপছে যেন। পিউয়ের কণ্ঠনালী অবরুদ্ধ এই নিরীক্ষনের তোপে।
পরপর শোনা গেল তার অনমনীয় গলায় একটি মধুর বানী,
‘এই ভূমন্ডলের কোনও একটি মানুষের পৃথিবী তুই। তার আদ্যোপান্ত জুড়ে তুই। তার প্রান সঞ্চালনের পথ্য তুই। তুই তার রো*গ সাড়ানোর জড়িবুটি। একবার ভেবেছিস,তুই না থাকলে তার কী হবে? ‘
পিউ জানে সে উত্তর পাবেনা। ধূসর ভাই অর্ধেক কথা বলে তাকে আন-চান করিয়ে মা*রেন। তবুও মেয়েটা দমবে না। মুখ ফুটে প্রশ্ন করে বসে,
‘ সে কে? ‘
ধূসরের লালচে ঠোঁট দুটো সরে গেল একদিকে। নীরবে হাসল৷ জানাল,
‘ তুই পৃথীবিতে আসার পর যে তোকে সবার আগে ছুঁয়েছে ।’
পিউয়ের ভ্রুঁ গুছিয়ে এলো এক জায়গায়। ধূসর আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। পাল্টাল চেহারার রং। চোখেমুখে স্পষ্ট দ্বিধা। হঠাৎ করেই ঘাড় ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,
‘ ঘরে যা। রাত অনেক হয়েছে। ‘
পিউ ঠোঁট কাম*ড়ে ভাবছিল। কথাটায় ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল, বলল,
‘ আপনি যাবেন না?’
ধূসর কপাল কোঁচকায়। পিউ উঠে মিহি কণ্ঠে বলে,
‘ যাচ্ছি।’
দু কদম হেঁটে থেমে গেল সে। পেছন ফিরতেই ধূসর অন্যদিক তাকাল। পিউ ওড়নার মাথাটা আঙুলে প্যাচাতে প্যাচাতে বলল,
‘ ইয়ে…একা একা সিড়ি দিয়ে নামতে ভ*য় লাগছে!’
ধূসর দৃষ্টি চোখা করে বলে,
‘ এতক্ষণ যে ছাদে দাঁড়িয়েছিলি, ভ*য় লাগেনি?’
পিউ সরল ভাবে দুদিকে মাথা নাড়ল।
আবেদন করল ‘ আপনি সাথে আসুন না একটু। যদি ভূত টুত দেখি, আমি ম*রেই যাব।’
ধূসর শ*ক্ত কণ্ঠে বলল ,
‘ ফের আরেকবার ম*রার কথা উচ্চারণ কর,দ্যাখ কী করি!’
পিউ মুখটা ছোট করে ফেলল। মনে মনে ভেঙচি কাট*ল।
‘ আমি ম*রব বললে দোষ, আর উনি যে দিন রাত নিজের প্রেমের আ*গুনে জ্বালি*য়ে মা*রছেন আমায়, তাতে দোষ নেই। ‘
মুখে বলল,
‘ তাহলে আসুন।’
ধূসর পা বাড়ায়। বলে ‘ হাঁট।’
পিউ এপাশ ফিরে বিজয়ী হাসল। ধূসর তার পেছনে এগোয়। পিউয়ের চোখ সামনে রইলেও মন নিহিত ওই মানুষের প্রতি। যাকে বুকের বা পাশে ,অগ্রমস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে বয়ে চলে সে। সে হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে পেছনে তাকায়। বাল্বের হলুদ আলোতে ধূসরের লম্বা অবয়ব দেয়ালে দৃশ্যমান। সেটা দেখতে দেখতে ধাপে ধাপে কদম বাড়ায়। ধূসরের অন্তকরনে বন্দি কিছু অস্বচ্ছ কথা। যা বাষ্পের ন্যায় ঝাপ্সা। তার পা এগোয় পথে,অথচ দৃষ্টি থাকে সামনের চঞ্চল কিশোরীর দোদুল্য কেশগুচ্ছে।
*****
ঘরের সামনে এসে থমকাল পিউ। অচিরাৎ মাথায় আসে ছাদের কথা। সে কি ধূসর ভাইকে জড়িয়ে ধরেছিল তখন? বেখেয়ালে,না বুঝে জ্ঞান খুইয়ে ঝাঁপিয়ে পরল বুকে? কতক্ষণ ছিল? পিউ চোখ খিঁচে জ্বিভ কা*টল। কুন্ঠায় হাঁস*ফাঁস করল। ইশ! কী লজ্জ্বা! কী লজ্জ্বা!
পিউ আস্তে আস্তে চোরা চোখে একবার পেছনে তাকায়। ধূসরের উপস্থিতি টের না পেয়ে ভেবেছিল চলে গেছে হয়ত। অথচ ঘুরে তাকাতেই চোখাচোখি হলো।সে মানুষ টা বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে। সাথে ভ্রু উঁচায়। পিউ থতমত খেল খানিক। সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল চোখ। হন্তদন্ত ভঙিতে ঢুকতে গেল ভেতরে। চাপানো দরজাটায় নাকটা ঠু*কে গেল ওমনি। ব্যথা*য় ছিটকে পিছিয়ে এলো। নাক ডলতে ডলতে আবার ফিরে তাকাল। ধূসর তখনও দাঁড়িয়ে।
স্পষ্ট বলল ‘ আহাম্মক!’
পিউ লজ্জ্বা পায়। রীতিমতো ঠোঁট উঠে আসে চূড়ায়। আর দাঁড়ায়না, ছুটে ঢুকে যায় কামড়ায়।
ধূসর ফিরে আসে নিজের রুমে। অগোছালো পিউয়ের কথা মনে করে মিটিমিটি হাসে। শীতল চোখ নিবদ্ধ হয় দেয়ালে টাঙানো সেই পেইন্টিং এর ওপর। পরপর প্রশান্ত,মুক্ত শ্বাস নেয়।
এই চোখ, এই নেত্রপল্লব তার জন্যে এক ধরনের উপশম। রুমে এসে একবার দেখলেই যেন উবে যায় সব গ্লানি,সব শ্রান্তি। অথচ চোখের মালিক নিজেও জানেনা এসব। জানলে কী করবে? কবেই বা জানাবে সে? আর কতগুলো দিন পার হলে আসবে সেই মুহুর্ত?
**
পিউয়ের ঘুম আসছে না। নিদ্রা চুরি করেছেন ধূসর ভাই। পিউ কোলবালিশটা অবধি গায়ে জড়াল না আজ। ধূসরের বুকে থাকার ওই দৃশ্য যতবার মনে পড়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। অদ্ভূত শিরশিরে অনুভূতি এসে পা চালায় সাথে। মনে হচ্ছে ধূসরের তীব্র পারফিউমের ঘ্রান আসছে তার জামাকাপড় থেকেও। শরীরে মিশে গিয়েছে ওই কাঙ্ক্ষিত স্পর্শ। এখন কোলবালিশ নিলে মুছে যাবে না?
রাত ফুরালেই ফাগুন শুরু। আসছে বসন্ত। কোকিল ডাকবে,ফুটবে নানান ফুল। রাস্তার পাড়ে লাগানো গাছগুলোয় দেখা দেবে নব নব পল্লব।
শহরজুড়ে হাজার নারী হলদে শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখবে তার প্রিয় মানুষকে। ব্যস্ত পথে নিজেদের মনে লুকিয়ে পা মেলাবে। সময় সময়ে একে অন্যের দিক চেয়ে করবে রঙিন হাসি বিনিময়। ছেলেটা তাকালে মেয়েটি লজ্জায় নামিয়ে নেবে দৃষ্টি। আচ্ছা, তার জীবনে এমন দিন আসবে না? যেদিন সেও একটা লাল -হলুদ মিশেলের শাড়ি পরবে,কানে থাকবে একজোড়া লম্বা ঝুমকো, মাথায় পরবে একটা গোলাপের চাকা,আর থাকবে হাত ভর্তি চুড়ি। আর পাশে পাশে হাঁটবে প্রিয়তম সে। তার ধূসর ভাই। তার পাঁচটে আঙুল জায়গা পাবে ওই শক্ত, খসখসে তালুর মধ্যে। আসবেনা সেইদিন?
পিউ চোখ বুজল। নিঝুম রাতে কক্ষের চারপ্রান্তে তার উতলা নিঃশ্বাসের শব্দ। রাত পোহালেই যে ফাগুন আসছে, যে হাওয়া ধেঁয়ে যাচ্ছে ভোরের দিকে, সেই হাওয়ার একাংশ ছুটে এলো। জানলা গলে প্রবেশ করল কামড়ায়। স্বশব্দে বিছানার দিকে এগিয়ে ছুঁয়ে দিল তাকে।
কানের কাছে ফিসফিস করে জানাল,
‘ তোর বসন্ত আসছে পিউ। খুব শীঘ্রই আসছে।’
***
ইংরেজি প্রথম, দ্বিতীয় পত্র,এই দুই বিষয়ের পরীক্ষা শেষ। আজকে শুক্রবার, পরীক্ষা নেই। আগামীকাল থেকে শুরু সব কঠি*ন ক*ঠিন সাব্জেক্ট। পরশু অবশ্য বাংলা প্রথম পত্র। অথচ পিউয়ের মাথায় ওসব নিয়ে চিন্তা নেই। সে সকাল থেকে মায়ের পেছন পেছন ঘুরছে। ঘ্যান ঘ্যান করছে। অনুনয়- বিনয় করছে।
‘ সে হওয়ার পর তাকে প্রথম ছুঁয়েছিল কে? ‘
এই একটা ব্যাপার সারারাত তাকে ঘুমোতে দেয়নি। হিসেব মত জন্মের পর বাচ্চাদের মায়েরা কোলে নেয়। কিন্তু উনি কাল যেভাবে বলেছিলেন বিষয়টাত ওরকম একদমই মন হয়নি। সঠিক আর সত্যিটা শোনার জন্যেই মেয়েটার এত আকুলি-বিকুলি। পিউ শেষ বার মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মিনা বেগম বলেছেন হাতের কাজ শেষ করে বলবেন,ধীরেসুস্থে। কিন্তু মেয়ে এত অধৈর্য! পেছন পেছন রান্নাঘরেও চলে এসছে।
তিনি গরম পানি চুলোয় বসিয়েছেন মাত্র। পোলাওয়ের মধ্যে দেবেন। পিউ আহ্লাদে ভে*ঙে*চুরে বলল,
‘ ও আম্মু,বলোনা! একটা সামান্য কথা শুনতে চেয়েছি,বলে দিলেইত হয়। ‘
মিনা বেগম বিরক্ত চোখে তাকালেন।
‘ তোর পড়াশুনা নেই? কাল পরীক্ষা মনে আছে?’
‘ আছে। তুমি বলে দাও আমি চলে যাচ্ছি।’
সুমনা বেগম এলেন তখন। বুয়াকে বললেন ‘ একটা পেয়াজ কে*টে দাওত। ডিম ভাজব।’
‘ কে খাবে, রিক্ত?’
‘ হ্যাঁ আপা। ছেলেটা ডিম ভাজি ছাড়া কিচ্ছু খেতেই চায়না। কী যে করি! গায়ে একটা মুরগীর থেকেও কম ওজন। ধরে ছু*ড়ে ফেলা যাবে।’
বুয়া ব্যস্ত হলেন পেয়াজ কা*টায়। সাথে বিজ্ঞের মত হাবভাব করে বললেন,
‘ পোলাপাইন এই বওসে খাইতে চায়না। আমার ডারে পিডা*ইয়া খাওয়ান লাগত। হাত পাখার বারি না খাইলে নলা মুকোত দিতোনা। ‘
বলতে বলতে বটির মাথায় পেয়াজ ধরতেই চোখ জ্ব*লে টলমলে হলো। কাপড়ে মুছতে মুছতে বললেন,
‘ আল্লাহ রে পেইজে কি ত্যাজ!’
সুমনা বললেন,
‘ না পারলে রেখে দাও। আমি কে*টে নিচ্ছি।’
‘ না থাউক,পারমুনে। আফনের করোন লাগতোনা। ‘
পিউ ওসব থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনল চটজলদি।
ফের নাকে বাজিয়ে বলল ‘ আম্মু বলোনা, বলোনা।’
‘ পিউ,রান্নার সময় বিরক্ত করিস না। বলেছিত শেষ হলে বলব। এখন যা পড়তে যা।’
পিউ বিরোধিতা করল ‘ না আমি শুনেই যাব। আমাকে শুনতেই হবে।’
সুমনা বেগম বললেন, ‘ কী কথা? ও কী জানতে চাইছে আপা?’
‘ আরে আর বলিস না। সকাল থেকে কী একটা ঘোড়ার মাথা জিজ্ঞেস করছে। ওর জন্মের পর ওকে কে কোলে নিয়েছে,এটা একটা প্রশ্ন?’
‘ আরে এটাত সহজ একটা কথা পিউ। জন্মের পর কে ছোঁবে, ডাক্তার -নার্স এরাইত ছোঁয়। নার্স রা রক্ত পরিষ্কার করে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে তারপর নিয়ে আসে পরিবারের অন্যদের কাছে। রিক্ত হওয়ার সময় দেখিস নি?’
পিউ হতভম্ব হয়ে বলল ‘ তাহলে কী দাঁড়াল? আমাকে সবার আগে ডাক্তার ছুঁয়েছে?’
‘ হ্যাঁ। শুধু তোকে না সব বাচ্চাকে। পেট থেকে সে বার করবে তো ছোঁবেনা?’
পিউ দুপাশে ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল,
‘ না না ওসব বাদ। আমাদের বাড়ির মধ্যে সবার আগে কে ছুঁয়েছে আমায়? কে কোলে নিয়েছে?’
সুমনা বেগম বললেন,
‘ আমিত তখন এ বাড়িতে ছিলাম না। হয়ত ভাইজান নিয়েছেন। তাইনা আপা?’
মিনা বেগম পোলাওয়ের মধ্যে গরম পানি ঢাললেন। খুন্তি দিয়ে নেড়ে মিশিয়ে দিলেন পুরোটা। উত্তর করলেন,
‘ না। ওকে আমি কাউকে ধরতে দিইনি। এমন কি নিজেও ছুঁইনি।’
পিউ আগ্রহভরে বলল ‘ তাহলে কে?’
সুমনা বেগমের চোখেমুখেও দেখা গেল শুনতে চাওয়ার প্রবণতা। মিনা বেগম কাজে ব্যস্ত থেকেই মৃদূ হাসলেন। জানালেন,
‘ তোকে সবার প্রথম কোলে নিয়েছিল ধূসর। দশ বছরের বাচ্চাটা তোকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে চে*পে ধরেছিল বুকে। আমার এখনও মনে আছে,ধূসর প্রথম বার তোকে কোলে নিয়ে মুখের দিক চেয়েছিল। তখন ও বাচ্চা, কিন্তু ভাবসাব একইরকম মুরুব্বিদের মত। অথচ তোর দিক তাকিয়েই কেমন অবুঝের ন্যায় বলল,
‘ এইরকম সুন্দর বার্বিডলটা তুমি কোত্থেকে আনলে বড় মা?’
সুমনা বেগম হেসে ফেললেন। হাসির শব্দ শোনা গেল বুয়া করিমুন্নেসার ও। পিউয়ের বুকটা ধ্বক করে উঠল। একটা শান্ত পুকুরে ঢিল ছো*ড়ার পর যে উদ্বোলন দেখা যায়,তারই পাশ কা*টাল হৃদয়খানা।
মিনা বেগম কথা শেষ করে তাকালেন,বললেন,
‘ হয়েছে শান্তি?’
পিউ শিথিল বেগে মাথা কাত করে। ছোট-খাটো মুখটা অত্যুজ্জ্বল। নক্ষত্রের মত ঝলক সেখানে। দু-ঠোঁট কানায় কানায় হৃষ্ট হয় কুণ্ঠিত, মুচকি হাসিতে। এর মানে কাল ধূসর ভাই যা বললেন,
❝এই ভূমন্ডলের একজনের পৃথিবী তুই। তার আদ্যোপান্ত তুই। তার প্রান সঞ্চালনের পথ্য তুই। তুই তার রোগ সাড়ানোর জড়িবুটি। ❞
ওসব নিজেকে বোঝাতে বলেছেন?
পিউ বুকের বা-পাশটা ওড়নার ওপর দিয়েই খা*মচে ধরল। এত তীব্র কম্পন তার!
সুমনা বেগমের উৎসাহ এখন তুঙ্গে। পিউয়ের জন্ম সংক্রান্ত সকল কথা শুনে নিচ্ছেন। কৌতুহল সমেত আরো নানান কিছু জানতে চাইলেন। এসব আগে শোনেননি তিনি। পিউ আর দাঁড়াল না। ত্রস্ত বেগে রান্নাঘর থেকে বাইরে এলো। এক্ষুনি ধূসর ভাইয়ের কাছে যাবে সে। গিয়ে বলবে,
‘ আমি সেই মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছি ধূসর ভাই। আজ আমি নিশ্চিত আপনিই সে। ‘
সে ছুট্টে সিড়ির এক ধাপে উঠেও নেমে এলো। ধূসর ভাইত বাড়িতেই নেই। অফিসে গিয়েছেন। ভাবল,
তাতে কী! উনি ফিরলে আর অপেক্ষা নয়। আজই জানিয়ে দেবে তার মনের কথা। বলে দেবে “আমি আপনাকে ভালোবাসি ধূসর ভাই”। অনেক হয়েছে লুকোচুরি! আর সইতে পারছেনা এই টানাপোড়েন। স্নায়ুযু*দ্ধে সে ক্লান্ত। আজত কোনও মনঃদ্বিধা নেই,সে শতভাগ নিশ্চিত ধূসর ভাইও তাকে চায়। মানুষটা হয়ত আর পাঁচজনের মত মনের কথা বলতে পারেনা। সে না পারলেও বা,ও আগাবে। এই ঝুলতে থাকা সম্পর্কের একটা রুপ দেবেই আজ। পিউ পণ করল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এখন শুধু ধূসর ভাইয়ের ফেরার প্রতীক্ষা।
পিউ নিজের কামড়ায় রওনা করতে গিয়ে আবার দাঁড়াল। নজরে পরলেন রুবায়দা বেগম। কাজে মনোনিবেশ তার। শোপিস রাখার শোকেস থেকে একটা একটা জিনিস নামিয়ে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছছেন। এতক্ষণ সব আসবাব মুছেছেন। এই কাজটা তিনি নিজ উদ্যোগে করেন । সিকদার বাড়ির ছেলেমেয়েদের একটা কমন রো*গ আছে। ডাস্ট এলার্জি! সামান্য ধূলোময়লা পেলেই হেঁচে- কেশে একাকার কর সব। অবশ্য এই রো*গ আফতাবেরও রয়েছে। মানুষটা শান্ত,নিরবিলি হলে কী হবে,রো*গ তার চামড়ার ডগায়।
পিউ নিজের ঘরের দিক আর গেল না। রুবায়দা বেগমের কাছে এসে আবদার করল,
‘ আমি করে দেই মেজো মা?’
তিনি হাসি হাসি মুখে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ কেন রে মেয়ে? তুই করবি কেন?’
‘ তোমার ক*ষ্ট হবে না?’
রুবায়দা হেসে ফেললেন। পিউয়ের থুত্নী ধরে বললেন,
‘ ওরে পাকা বুড়ি রে! কত ক*ষ্ট বোঝে আমার!’
পিউ বলল,
‘ আমি না বুঝলে কে বুঝবে? ‘
‘ তাইত। তুইত আমার মেয়ে, তুই না বুঝলে কে বুঝবে?’
পিউ কপাল কোঁচকাল সাথে সাথে। ভাবল,
‘ মেয়ে ডেকোনা মেজো মা। সম্পর্ক বদলে যাবে একটি পলকে……’
মুখে বলল ‘ মেয়ে নই। আমি তোমার মা। ‘
তারপর বিড়বিড় করে বলল ‘ বউমা।’
‘ আচ্ছা বেশ, তাই। এখন সর, ধূলো যাবে গায়ে। নাকেমুখে ঢুকলে হাঁচি দিয়ে কাহিল হবি।’
‘ কিচ্ছু হবেনা। তুমি আমাকে দাও।’
পিউ জোর করে টেনেটুনে কাপড় নিয়ে এলো। রুবায়দা বেগম হার মানলেন। পরা*জিত কণ্ঠে বললেন,
‘ দ্যাখো মেয়ের কান্ড! তুই পারবি না পিউ, আমায় দে।’
‘ পারব আমি। তুমি যাও বিশ্রাম নাও।’
সেই সময় চৌকাঠ থেকে একটি প্রফুল্ল স্বর ভেসে আসে,
‘ আসতে পারি?’
দুজনে একযোগে তাকায়। দুহাতে দুটো ভারি মিষ্টির প্যাকেট সমেত দাঁড়িয়ে মারিয়া। গাল ভরা হাসি। রুবায়দা বললেন,
‘ আরে এসো,এসো। কী খবর তোমার?’
মারিয়া ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
‘ এইত আন্টি আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা কেমন আছেন?’
‘ ভালো। ‘
মারিয়া মিষ্টি বাড়িয়ে দিল ‘ নিন, আপনাদের জন্যে।’
‘ হঠাৎ মিষ্টি কেন?’
‘ একটা সু-সংবাদ আছে।’
‘কী?’
‘ আমার চাকরি হয়েছে?’
‘ ওমা তাই? এত খুব ভালো খবর। ‘
ভালো খবর শুনেও পিউয়ের মন খা*রাপ হলো। মারিয়াপুর চাকরি হয়েছে মানে,সে কী আর পড়াতে আসবেন না? ওর ওইদিনের কথায় দুঃ*খ পেয়েই কী…..
‘ এই পিউ,যা তো মা আপাকে ডেকে নিয়ে আয়।’
সে চোরা চোখে একবার মারিয়ার দিক তাকিয়ে মাকে ডাকতে গেল।
মারিয়া সোফায় বসল। রুবায়দা পাশে। মিনা বেগম বুয়ার হাতে দায়িত্ব ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। মারিয়াকে দেখে খুশি হলেন খুব। সুমনা প্লেটে ভাত তুলে, দুটো কথা বিনিময় করে চলে গেলেন ঘরে। রিক্তকে খাওয়াবেন এখন।
বাকীরা গল্প জুড়লেন। চাকরি পাওয়া কোম্পানির আগামাথা জিজ্ঞেস করলেন। পিউ এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকে। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে টাইলসের মেঝে খোটে। মারিয়ার থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়নি। এখন কথা বলতেও লজ্জ্বা লাগছে তার। নাহলে জ্বিভটা যে মাত্রায় নিশপিশ করছে,এতক্ষণে বকবকের ঝুড়ি খুলে বসত।
তার অস্থিরতা বাড়ল। মারিয়াপু চাকরি নিলে নিশ্চয়ই আর পড়াবেন না। ইশ! কী একটা অবস্থা! আগে চেয়েছিল মেয়েটাকে তাড়াবে আর এখন সে পড়াবেনা জেনে মন খা*রাপ হচ্ছে। তার মুড কথায় কথায় এত সুইং করে কেন?
মিনা বেগম বললেন,
‘ তা ,আমার মেয়েটাকে আর পড়াবেনা বুঝি?’
পিউ চটজলদি সচেতন হয়ে দাঁড়াল। মাকে কোটি কোটি ধন্যবাদ জানাল ওর মনের কথা জিজ্ঞেস করায়।
মারিয়া বলল,
‘ পড়াব আন্টি। চাকরি নিলেও বা,ওর পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি আমি আছি। তবে সন্ধ্যে বেলা আসতে পারবনা। হয় খুব ভোরে বা রাত নটার দিকে পড়াতে হবে, এই আর কী!’
কেউ কিছু বলার আগেই পিউ লাফিয়ে বলল,
‘ নয়টার দিকে পড়ালে ভালো হয়।’
পরপর নিজেই মিইয়ে গেল। ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইল। অথচ মারিয়া ভীষণ সহজ,স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘ ঠিক আছে পিউ,তখনই আসব তাহলে। ‘
কথা শুনে মনে হলো তাদের মধ্যে কিছুই ঘটেনি। যেন সব ঠিকঠাক। পিউ একটু অবাক হয়। লজ্জ্বা,সঙ্কোচ কমার বদলে আরো তরতরিয়ে বৃদ্ধি পায়। মেয়েটা এত ভালো আর সে? ছি! ছি!
জবা বেগম ফিল্টার থেকে জগে পানি ভরেছেন। হৃষ্টপুষ্ট ভারী জগ। খালি থাকলেও বেশ ওজন। হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ শাড়ির কুচিতে পা বাঁধালেন,পরতে গেলেন হুম*ড়ি খেয়ে। বহু ক*ষ্টে নিজেকে সামলালেও পা মুচ*ড়ে গেল। হাত থেকে জগটা ছুটে পরল মেঝেতে। বিকট, জোড়াল শব্দে কেঁ*পে উঠল বসার ঘর। চমকে গেল সকলে। কাচের ছোট ছোট টুকরো এদিক ওদিক ছিটিয়ে গেল। পানিতে তলিয়ে গেল চারপাশ। ব্য*থায় মৃদূ শব্দে আর্ত*নাদ করে উঠলেন জবা।
আওয়াজ পেয়ে ত্রস্ত ছুটল সকলে। মারিয়া সবেগে গিয়েই বসে পরল পাশে।
‘ আন্টি কী হলো,ব্য*থা পেয়েছেন?’
জবা বেগম পায়ের পাতা চে*পে রেখেছেন হাত দিয়ে। চোখ শক্ত করে বোজা।
রুবায়দা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
‘ ও সেজো পরে গেলি কেমন করে? দ্যাখো দেখি… লাগেনিতো?’
‘ আমি ঠিক আছি আপা। ‘
সাদিফের ঘর সিড়ির কোনার দিকে। আওয়াজ পৌঁছে গেল তার কানেও। বাড়িতে সেই এখন একমাত্র পুরুষ। শুক্রবার হলেও আজমল কে সাথে নিয়ে অফিস চক্কর কা*টতে গিয়েছেন সকলে। দলে আনিস ও যোগ হয়েছেন আজ।
সাদিফ দ্রুত পায়ে সিড়ি দিয়ে নামল। গৃহীনিদের ছোটখাটো জটলা বেঁধেছে। সে হন্তদন্ত ভঙিতে আসে। মাকে বসা দেখে ঘাবড়ে, উতলা হয়ে শুধায়,
‘ মা, কী হলো? ব্য*থা পেয়েছো?’
‘ আরে আমি ঠিক আছি।’
মারিয়া কেমন খ্যাক করে বলল,
‘ কী ঠিক আছেন? ব্যথা*য় তাকাতে পারছেন না,আর বলছেন ঠিক আছি? নিন আমার হাতটা ধরুন।’
জবা বেগম গোল গোল চোখে তাকালেন। হতচেতন সাদিফও।
মারিয়া হাত পেতে দেয়। জবা বেগম হাত ধরবেন কী,বিস্ময় তখনও কা*টেনি। এতটুকু মেয়ে তাকে ধমকা*ল?
‘ কী হলো আন্টি,হাতটা ধরুন।’
হুঁশে এলেন তিনি। ‘হু?’ বলে হাত ধরলেন। পিউ বাম হাত আর সে ডান ধরে সুস্থে-ধীরে ওঠাল তাকে। ধরে ধরে নিয়ে বসাল সোফায়।
পেছনে মিনা বেগম বলছিলেন,
‘ আস্তে৷ দেখে দেখে নে।’
জবা বেগম কে বসিয়েই মারিয়া পায়ের কাছে বসল। বলল ‘ একটু গরম সরিষার তেল আর ফাস্টএইড হবে? ‘
সুমনা বেগম ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ বলে ছুটে গেলেন আনতে। রিক্তকে খাওয়ানো ফেলে তিনিও হাজির হয়েছিলেন।
মারিয়া আ*হত পা তুলল হাতে। একটু নাড়াতেই জবা ‘ আল্লাহ” বলে ব্যথায় ক*কিয়ে উঠলেন।
পিউয়ের চোখ ভরে ওঠে। ঠোঁট ভা*ঙল কা*ন্নায়। মিনা বেগম বললেন,
‘ দেখেছিস,ব্য*থা পেলো কে আর কাঁদছে কে?’
জবা বেগমের পাশেই বসে সে। ভদ্রমহিলা ওর কা*ন্না দেখে য*ন্ত্রনা ভুলে গেলেন। হেসে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। রুবায়দা বললেন,
‘ আমাদের পিউত এরকমই।’
সুমনা যেন উড়ে এলেন সব নিয়ে। গর*ম তেলের বাটিটা সাবধানে মেঝেতে রাখলেন। সাদিফের তীক্ষ্ণ চোখ তাকিয়ে মারিয়ার হাতের ওপর। যে হাতদুটো তুলো দিয়ে স্যাভলন ঘষছে মায়ের পায়ে। স্পর্শ পেতেই জবা বেগম নড়ে উঠলেন। বাঁ*ধা দিয়ে বললেন,
‘কী করছো মারিয়া? পায়ে হাত দিচ্ছো কেন?’
মারিয়া শুভ্র হেসে জানাল,
‘ তাতে কী হয়েছে আন্টি? আপনিত আমার মায়ের মত তাইনা? দেখি হাত সরান।’
জবা বেগম মুগ্ধ হলেন। হাত দুটো মারিয়া নিজেই সরিয়ে দিলো । কাচের ঘষা লেগেছে,তবে কা*টেনি।পা মো*চড়ানো তেই যা ব্য*থা পেয়েছেন। তেলের ওপর একটা আঙুল বুলিয়ে সে উষ্ণতা নিরীক্ষন করল। এক হাতে তুলে পুরো পায়ে মালিশ করতে থাকে। যাতে একটু জড়োতা,একটু বিরক্তি,একটু সঙ্কোচ নেই। প্রত্যেকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে হাসে। মেয়েটার এই ব্যবহার বিমোহিত করে তাদের। পিউয়ের ভেতরটাও ছেঁয়ে যায় আদুরে ভালো লাগায়।
সাদিফ বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখতে থাকে। মা-টা যে ওর স্তব্ধতায় ভুলে বসেছে। মারিয়াকে প্রথম থেকে বিদ্বিষ্ট, ঝা*মেলা, আর অসহ্য, মেয়ে মনে হত। যে ঝগড়া ছাড়া কিছুই পারেনা। দেখলে তার ভালো মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে কয়েকবার। অথচ মেয়েটাকে আজ কেমন অচেনা, অন্যরকম লাগছে না? ও কি আসলেই এইরকম? এতটা ভালো?