সকাল দশটা। সবে সবে বাইরে নরম রোদের ছটা নেমেছে। কুমড়ো ফালির মত দৃশ্যায়ন সূর্যটা শান্ত। সোনালী,চকমকে প্রকৃতির এই সময়টায়
সিকদার বাড়ির খাবার টেবিল সম্পূর্ন নিস্তব্ধ,নীরব। এতগুলো মানুষ, অথচ একটুও শব্দ নেই কারো। কয়েক পল মূর্তি বনে রইল একেকজন। দুচোখ ছাপানো রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে দেখে গেল আমজাদের হাস্যজ্জ্বল মুখবিবর।
বিলম্ব হয় তাদের ধাতস্থ হতে। আনিস সবেগে বললেন,
” পিউতো এখনও ছোট ভাইজান। মাত্র ইন্টার দিলো,ভার্সিটিতে ওঠার আগেই বিয়ে দিয়ে দেবে?”
তাল মেলালেন গৃহীনিরা। মিনা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
” আপনি হঠাৎ করে ওর বিয়ে নিয়ে পড়লেন কেন? এই সবে সবে একটা মেয়ের বিয়ে দিলাম,দু তিন বছর যাক তারপর নাহয়….”
রুবায়দা বললেন,
” পিউতো এখনো সংসারের কিছুই বোঝেনা ভাইজান। ওর কি সেই ম্যাচিউরিটি এসেছে বলুন তো!”
আমজাদ কপাল কোঁচকালেন,
” আরেহ,তোমরা এমন ভাবে বলছো যেন আমি এক্ষুণি মেয়েটাকে তুলে দিচ্ছি? ওনারা শুধু দেখতে আসবেন। পছন্দ হলে কথা পাকাপোক্ত হবে। দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায়না! তাছাড়া, বিয়ের পরেও পড়াশুনা করা যায়। রুবা,তুমি বিয়ের পরে পড়োনি? সুমনা পড়েনি? পুষ্প পড়বেনা? তাহলে? পিউও পড়বে।”
আফতাব তীক্ষ্ণ, প্রখর চাউনীতে ধূসরকে দেখছেন। র*ক্তাভ হয়ে উঠছে ওর অক্ষিকোটর। ক্রমে ফুঁসছে চোখা নাক। ঝড়ের পূর্ভাবাস ছেলের চেহারা দেখেই বুঝে নিলেন তিনি।
পিউ মাত্রাতিরিক্ত হো*চট খেয়েছে। যাকে বলে অদৃশ্য ভাবে মুখ থুবড়ে পরেছে ধা*ক্কায়। কাশি সামলে বাবার দিক প্রকট আঁখিতে চাইল সে।
রুদ্ধশ্বাসে বলল,
” আব্বু, আব্বু আমি এখন বিয়ে করব না।”
আমজাদ মোলায়েম কণ্ঠে বললেন,
” কেন করবেনা মা? তুমি মিছিমিছি ভ*য় পাচ্ছো। আজ শুধু দেখে যাবে। কথাবার্তা হবে। বিয়ে হতে বহু দেরী।”
পিউয়ের জ্বিভ ঠেলেঠুলে বের হতে চাইছে,
‘ আমি ধূসর ভাইকে ভালোবাসি’। কিন্তু কী মুসিবত! পারছে না কেন? সব এমন করে কাঁ*পছে কেন ওর? যেন সমস্ত দুনিয়াটা ঘুরছে।
সে আপ্রাণ চেষ্টা চালাল,নিজেকে একটু সাহসী করার। বিন্দুমাত্র পারল না। প্রতিটাবার কেমন অলখ ব্যর্থতা শক্ত হস্তে মুখ,গলবিল শুদ্ধ চেপে রাখল।
বিবেক, লজ্জা,কুণ্ঠা জ্ঞান দিলো চেঁচিয়ে,
‘ এত এত গুরুজনের সামনে কী করে বলবি ওসব? ‘
পিউ আহত মন নিয়ে বসে রয়। আজ যেন কানায় কানায় উপলব্ধি করল সেদিন পুষ্পর পরিস্থিতিটুকু। আবিষ্কার করল,
না,একটা মেয়ের জন্যে এর চাইতে কঠিন,অসহ সময় দুটি হয়না।
তারপর অসহায় চোখে চাইল ধূসরের পানে। কেন চুপ করে আছেন তিনি? কিছুই কি বলবেন না? উত্তর হিসেবে শূন্য,রিক্ত হলো পিউ।
স্টিলের মতন শক্ত হয়ে বসে থাকা ধূসর ভাইকে দেখে ব্যথায় টনটন করে ওঠে বুক। নিহ*ত মনে ভাবে, ওনার হয়ত বলার কিছু নেই।
আনিস শুধালেন, ” ছেলে কী করে ভাইজান?”
” সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকায় দুটো বাড়ি আছে। আমার বন্ধু মুশফিক? ওনার থেকেই খোঁজ পাওয়া। এত চমৎকার ব্যবহার, কথা বললে বুঝবে। আবার ছেলে দেখতেও বেশ ভালো। তাই ভাবলাম এমন দারুণ সমন্ধ হাতছাড়া করে কী লাভ? ”
বলার সময় আমজাদের অভিব্যক্তি ছিল রমরমে। যেন ভীষণ খুশিতে আপ্লুত তিনি।
” তাই বলে এত ছোট মেয়ে ভাইজান!”
তিনি বললেন,
” তোমরা এমন করে কেন ভাবছো সুমনা? আমিতো আজই বিয়ে দিচ্ছি না।”
মিনা মুখ শুকনো করে বললেন,
” তবুও! হঠাৎ করে এভাবে হয় না কি? আর আপনি তো আমাকেও একবার কিছু জানালেন না।”
” তোমাকে পাই কোথায়? সারাক্ষণই তো থাকো রান্নাঘরে। দু দন্ড কথা বলার, আলোচনা করার সময় দাও? আর আমি ভেবেছিলাম, কথাটা সবাইকে একসাথে জানাব। চমকে দেব তোমাদের । তাই সবার সামনে বলেছি। আমার ওনাদের সাথে কথা বলা শেষ, এখন পিউকে পছন্দ করলেই সব এগোবে।”
আফতাব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখানে ওনার বলার কিছু নেই। বাকীরা পরাস্ত নেত্রে একে-অন্যকে দেখলেন। আমজাদ সিকদার কথা দিয়ে এসেছেন যখন, বাকবিতন্ডার কোনও ফাঁকফোকরই রইল না।
আমজাদ পাথর বনে থাকা ধূসরকে বললেন,
” তাহলে বিকেলে চলে এসো ধূসর? তুমি বাড়ির বড় ছেলে, পিউয়ের বড় ভাই, তোমার থাকা জরুরি।”
ভদ্রলোকের খাওয়া শেষ ততক্ষণে। টিস্যুতে মুখ মুছতে মুছতে সিড়ির দিক পা বাড়ালেন। তক্ষুণি শোনা গেল, একটি তেজী, দগদগে স্থূল স্বর। থেমে থেমে বলছে,
” কোনও… পাত্রপক্ষ.. আসবেনা।”
আমজাদ থেমে গেলেন। পিছন ফিরলেন সহসা। নিশ্চিত হতে শুধালেন,
” কী বললে?”
পুষ্প ভীত নজরে ইকবালের দিক তাকায়। তার দৃষ্টিতেও শঙ্কা স্পষ্ট। পুষ্প চাপা কণ্ঠে বলল,
” এবার যে কী হবে!”
সে বিড়বিড় করল, ” কু*রুক্ষেত্র বাধবে।”
ধূসর উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে।
‘ এই বাড়িতে, পিউকে দেখার জন্যে কেউ আসবেনা। যদি আসে, সে চৌকাঠে পা রাখলেও সিকদার ধূসর মাহতাব সেই পা ভে*ঙে ধরিয়ে দেবে হাতে। ”
তার বরফ-ছু*রির মত শীতল চাউনী,পাথরের মত কঠোর চিবুক আর পর্বতের ন্যায় সটান দেহের সঙ্গে ভেসে এল নিখাদ কণ্ঠ। যা একটু হলেও থমকে রাখল সিকদার বাড়ির সকলকে। এক রাশ বেগতিক থমথমে হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল তাদের৷
সাদিফ একবার পিউকে দেখছে,একবার ধূসরকে। আগত পরিস্থিতি অনুমান করে ঘাবড়ে আছে সে।
আমজাদ আশ্চর্য বনে বললেন,
” মানে! কী অভদ্রের মত কথাবার্তা এসব? আমার গেস্ট আসবে,আর তাদের সঙ্গে তুমি এরকম আচরণ করবে? মানে টা কী এসবের?”
ধূসর স্পষ্ট বলল,
” আপনার গেস্ট একজন কেন,একশ জন আসুক,তাতে আমার যায় আসেনা। কিন্তু ওই যে বললাম,পিউ ঘটিত কেউ আসবে না। না মানে, না।”
আমজাদ ফুঁসে উঠলেন ওমনি। উঁচু হলো কণ্ঠ। চুপ করে বসে থাকা আফতাবকে বললেন,
‘ আফতাব! শুনছো তোমার ছেলের কথা? দেখছ ওর বেয়া*দবি? আমার মুখের ওপর কথা বলছে সে।’
আফতাব অথৈ জলে পরে হাঁপিয়ে যাওয়ার ন্যায় তাকালেন। নরম গলায় বোঝাতে গেলেন,
‘ ভাইজান,পিউ ছোট তাই হয়ত ও…. ”
ধূসর মাঝপথে কথা টেনে নিয়ে বলল,
‘ পিউ ছোট হলেও বিয়ে হবেনা। বড় হলেও না। মোট কথা ওর বিয়ে অন্য কোথাও হবেনা। ‘
আমজাদ হতবাক হয়ে বললেন,
‘ কেন হবেনা? কীসের জন্যে? আর হবে না হবে সেই সিদ্ধান্ত তুমি নেবে? আমি ওর বাবা,আমি যা বলব তাই হবে।’ ‘
ধূসর মুখের ওপর বলল,
” হবে না বড় আব্বু। এই একটা ব্যাপারে আপনার কোনও কিছুই শোনা হবেনা। ”
থামল সে। একবার পিউয়ের কাঠ,আত*ঙ্কিত, র*ক্তিম ফর্সা চেহারার দিক চাইল। ফের আমজাদের দিক চেয়ে প্রতাপ সমেত ঘোষণা করল,
” শুধু আপনি না,বাড়ির সবাইকে বলছি,পিউয়ের বিয়ে আমার সাথে হবে। এই পৃথিবীতে ও যদি কারো বউ হয়,সেটা হবে শুধুমাত্র এই সিকদার ধূসর মাহতাবের বউ। ”
সব কিছু স্তব্ধ হয়ে পরল তৎক্ষনাৎ । পিউয়ের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল নিমিষে। চমকে,থমকে যাওয়ার তোপে শিরদাঁড়া বেয়ে তরতর করে বেয়ে চলল হিম হিম প্রবাহ।
হতচকিত হয়ে, খাওয়া রেখে দাঁড়িয়ে পরল সকলে। আফতাব আৎকে ওঠার মতন চাইলেন ছেলের দিক। পরপর ভাইয়ের দিকে।
আমজাদ বাকরহিত,ভাষাহীন,নির্বিকার দাঁড়িয়ে। দুটো বিকট অক্ষিপটও অটল,স্থির।
মিনা, রুবা দৃঢ়ীভূত নজরে একে অপরকে দেখলেন।
শুধুমাত্র ,পুষ্প আর ইকবাল তটস্থ। আগত পরিস্থিতি ভেবেই মস্তিষ্কের দুপাশের শিরা দাপাচ্ছে ওদের।
আমজাদ হতবিহ্বল,
” কী বললে তুমি?”
ধূসরের লহু স্বর,
” যা বলেছি আপনি শুনেছেন। সবাই শুনেছে। ”
পিউয়ের ছোট্ট শরীর গুটিয়ে গিয়েছে। ত্রাসে ধরফর করছে বক্ষপট। ঠকঠক করে কাঁ*পছে হাত- পা। টের পাচ্ছে পিঠ বেয়ে রেখার মত নেমে যাওয়া ঘামের ধারা।
আমজাদ এগিয়ে এলেন। রুষ্ট কণ্ঠে বললেন,
” তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? কী বলছো বুঝতে পারছো নিজে?পিউ তোমার বউ হবে? এমন আজগুবি স্বপ্ন কবে থেকে দেখা শুরু করেছ?”
ধূসর সোজাসুজি বলে দিলো,
” যবে থেকে আপনার মেয়ে আমায় ভালোবাসে।”
আমজাদ হতচেতন হয়ে পিউয়ের দিক ফিরলেন।
ঘটনার আগামাথা না জানা প্রত্যেকেই তাই। এত গুলো শশব্যস্ত, বিদ্যুৎ বেগী চাউনী দেখে পিউয়ের শরীর সম্ভ্রমে অবশ হয়ে গেল।
আমজাদ হা করবেন,এর আগেই ধূসর সদর্পে প্রশ্ন ছুড়ল,
” আমাকে ভালোবাসিস পিউ?”
পিউয়ের বক্ষস্থল ধ্বক করে ওঠে। নীচু হওয়া চক্ষুদ্বয়ে কোটর ভর্তি টলমলে জল নিয়ে মুখ তুলল সে। চোখাচোখি হলো দুজনের।
গভীর,কোমল,ব্যকুল দুটো চোখ, হৃদয় ভে*ঙে আনল সহসা। ভীষণ সাহসে নড়ে উঠল ছোট্ট খাট্টো দেহ। সবার সম্মুখে,
নিম্নাষ্ঠ চে*পে,মাথা নামিয়ে ওপর নীচ ঝাঁকাল পিউ।
হ্যাঁ বাসে। বাসেইতো,নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।
জবাব পেয়ে ধূসর চোখ বুজে নেয়। প্রসস্থ বুক ওঠানামা করে। যেন ধরে রাখা নিঃশ্বাসটুকু এতক্ষণে ছাড়ল ।
মিনা চমকে মুখ চেপে ধরলেন। অবাক লোঁচনে চাইলেন রুবায়দার দিকে। ভদ্রমহিলা ঢোক গি*লছেন। বারবার দেখছেন নিঃসহায়ের মতন বসে থাকা স্বামীকে।
আমজাদ তখনও স্তম্ভিত। হুশ ফিরল ধূসরের কণ্ঠে,
” পেয়েছেন উত্তর? ”
তিনি চোয়াল শক্ত করলেন ওমনি। হনহন করে এগিয়ে এলেন মেয়ের দিক। ছ্যাত করে উঠল পিউয়ের বক্ষস্থল। গতবার বোনের হয়ে কথা বলায় এক প্রকান্ড চড়* খেয়েছিল,এবার তো বাবা মেরেই ফেলবেন ওকে। সে পালানোর জন্যে কোনও রকম দাঁড়াতেও পারল না, আমজাদ শা বেগে এসেই কনুই চে*পে ধরলেন ওর। ধমকে বললেন,
” এই বেয়াদব মেয়ে,কোন্ সাহসে এসব উচ্চারণ করো তুমি? ভদ্রতা- সভ্যতা সব ওর সাথে মিশে খেয়ে ফেলেছো? ভালোবাসার কী বোঝো তুমি? বয়স কত তোমার?”
এমন বজ্রকণ্ঠ,আর বাবার ক্রু*দ্ধ চাউনীতে পিউ ভয়ে ফুঁপিয়ে কেঁ*দে ফেলল। চোখের দিক তাকানোর সাহস কূলালোনা। নাকটা ফুলে উঠল কান্নার দমকে। ভেজা স্বরে আস্তে করে বলল,
” আমি,মিথ্যে বলিনি আব্বু… আমি সত্যিই ওনাকে…”
আমজাদ সিকদার থরথর করলেন উস্মায়। ক্ষিপ্রবেগে হাত ওঠালেন মার*তে। অথচ
এবারেও বাধ সাধল ধূসর। তৎপর পিউকে টেনে আনলো নিজের নিকট। সবার সামনে ওকে বুকের মধ্যে আগলে ধরে চাচার চোখের দিক চাইল। যার প্রতিটি পরতে জেদ, নির্ভয়ের উজ্জ্বল এক ম্রিয়মাণ প্রভা।
বিঘ্ন ঘটায় আমজাদ ক্ষে*পে গেলেন আরও। আফতাবকে বললেন,
” আফতাব,দেখছো তোমার ছেলের স্পর্ধা?”
আফতাব কূল হারা নাবিক। কী করবেন,কী বলবেন, কাকে সামলাবেন নিজেই জানেন না।
তবে পুষ্প মুখ খুলল এবার। বিনয়ী কণ্ঠে বলল,
” আব্বু তুমি এত রে*গে যাচ্ছো কেন? ভাইয়া আর পিউ দুজনকে ভালোবাসলে এতে তো খারাপ কিছু নেই। যখন আমার আর সাদিফ ভাইয়ের বিয়ের কথা উঠেছিল তখনতো তোমরা এক পায়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলে। তাহলে এখন? এখন কী সমস্যা?”
সাদিফ ও মাথা দোলাল। সহমত সে। তবে মুখে টা-টু শব্দ করল না।
আমজাদ র*ক্তিম চোখে চাইলেন,
” সমস্যা আছে। আলবাত আছে। সাদিফ আর ও এক হলো?”
ধূসর চোখ সরু করে বলল, ” বেশ,বলুন তবে। পিউকে আমার হাতে তুলে দিলে কী সমস্যা?”
সব বুঝেও ছেলের নাটকে, আফতাব খেই হারালেন মেজাজের। টেনে টেনে বললেন,
” সমস্যা হলো তুমি তো খুব ভালো ছেলে তাইনা? তোমার মত শান্তশিষ্ট মানুষ কয়জন আছে এই তল্লাটে? ওইজন্যেই তো ভাইজান মেয়ে দিতে এত ভাবছেন! ”
বাবার খোঁচানো কথার জবাব এলো তৎক্ষনাৎ,
” আমি যাই হই,যেমনই হই,পিউ আমাকে এভাবেই চায়। আর আমি এমন থেকেই ওকে ভালো রাখব।”
আমজাদ দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
” তাই? তা কীসের ভিত্তিতে বলছো এই কথা? কোন যুক্তিই বা দিচ্ছো? তোমার আরেকটা পেশা যে রাজনীতি,সেটা ভুলে গিয়েছ? যেখানে মারা*মারি কা*টাকা*টি হয়,জীবনের কোনও ঠিক ঠিকানা থাকেনা, সেখানে কোন আক্কেলে আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেব? ”
” জীবনের ঠিক আমাদের কারোর নেই। কোথাও নেই৷ মরলে অফিসের এসি কেবিনে বসেও মর*তে পারি। এই যুক্তি আপনাকে পুষ্প আর ইকবালের সময় আমি দিয়েছি। তাই নতুন করে কিচ্ছু বলতে চাইনা। আপনি আমার একটা কথা শুনে রাখুন বড় আব্বু…
থামল সে। পিউয়ের দিক তাকাল। ওর কাঁধে রাখা হাতটা আরেকটু সুদৃঢ় করে মিশিয়ে ধরল বক্ষে। প্রচন্ড অধিকারবোধ মিশিয়ে দাপুটে কণ্ঠে বলল,
” পিউ আমার। আমারই থাকবে। আপনার কেন,আল্লাহ না চাইলে কারোর সাধ্য নেই ধূসরের থেকে তার ভালোবাসাকে কে*ড়ে নেওয়ার।”
ইকবাল হাত তালি দিতে গিয়েও থেমে গেল। মাথা নাঁচিয়ে বিড়বিড় করল, ” সাবাশ ব্যাটা!”
পিউ বিমূঢ় নয়নে ধূসরের দিকে চায়। এই প্রথম, এই প্রথম ভালোবাসা শব্দটি ওই মুখে শুনল সে। এক মুহুর্তের জন্য মস্তিষ্ক থমকে দাঁড়াল। প্রখর,প্রখর অনুভূতি কাম*ড়ে ধরল তনুমন। কালো বর্তমান রুদ্ধ করে, স্তব্ধ আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠল এক নির্মল, বিশুদ্ধ দ্যুতি। হৃদয়পটের আনাচে-কানাচে দোল খেল কড়কড়ে, সজীব বসন্তের দোলনাটা। সব ভুলে চোখ জুড়ানো আলো নিয়ে মানুষটার নিরেট চিবুক দেখে গেল সে।
সাদিফ বিস্ময়াভিভূত! পলকও পড়ছেনা। ধূসরের এই আমূল সাহসিকতার ভারে তার মেরুদন্ডহীন স্বত্তাটা কেমন নড়েচড়ে বসল। নত মাথাটা তুলতে চাইল গতিতে । সবটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল,
‘ ভালোবাসলে নিজের মানুষ কে এইভাবে আকড়ে রাখতে হয় সাদিফ। জাহির করে বলার ক্ষমতা থাকতে হয়। তুই তো সেটা পারিসনি । তাহলে কোন আশায়, কীসের আশায় কাউকে ভালোবেসে নিজের করার স্বপ্ন দেখেছিলি? ‘
সাদিফ মেঝের দিক চেয়ে হাসল। ভীষণ, সামান্য সুক্ষ্ম হাসি। দুপাশে মাথা নাড়ল তারপর । না,আজ সে শতভাগ নিশ্চিত,পিউ একদম সঠিক মানুষকে বেছে নিয়েছে ওর জীবনে। ভালোবাসা টিকিয়ে রাখার এতটা আধিপত্য ওর কস্মিনকালেও কী হোতো? তবে আজ সে শিখল, হ্যাঁ ধূসরের থেকে শিখল। ভালোবাসলে বুকে সাহস রাখার নমুনা স্বচক্ষে দেখল। কৃতজ্ঞ রইল সে। খুব কৃতজ্ঞ।
আমজাদ কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে দেখে গেলেন ওদের। আনিস খুশখুশ করছেন। চেয়েও পারছেন না ভাইয়ের মুখের ওপর জবাব দিতে। ধূসর, পিউকে বিয়ে করলে সব দিক থেকেই তো ভালো। তাহলে ভাইজান এমন করছেন কেন? রাজনীতি কি আর কেউ করেনা?
মিনা হাঁস-ফাঁস করছেন। অথচ একটুখানি সুযোগ মিলছেনা কিছু বলার।
স্বামী নামক এই লোকটা কে মাঝেমধ্যেই তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। এই যে,আজকেও পারছেন না।
সেদিন সম্মেলন থেকে বাড়ি ফিরে কত প্রসংশা করলেন রাজনীতির। ধূসরের প্রসংশা তো আড়ালে প্রতি প্রহর করে। তাহলে সেই ছেলের হাতে মেয়েকে দিলে সমস্যাটা কোথায়? ওর মত এতটা আগলে কে রাখবে তার এই বাঁদড় মেয়েকে? দুটোকে পাশাপাশি কী সুন্দর লাগছেনা? মিনার চোখ মুঁদে আসে মুগ্ধতায়। পরপর হতাশ শ্বাস ফেললেন। আমজাদকে কীভাবে বোঝাবেন এখন? বোঝালেও শুনবেন না। ওনার মতে, সে একাই বুদ্ধিমান এই দেশে।
ইকবাল একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। মিনমিন করে বলল,
” ইয়ে আঙ্কেল, বলছিলাম যে,আমি একটা কথা বলব?”
আমজাদ চুপ। না অনুমতি দিলেন,না নিষেধ করলেন। ইকবাল নিজেই বলল,
” পিউকে ধূসরের সাথে বিয়ে দিলে লাভ ছাড়া কিন্তু লস আমি দেখছিনা। না মানে, পুষ্পকে নিয়ে যাওয়ার সময় আপনারা এত কাঁদছিলেন! আন্টি জ্ঞান হারালেন,আপনি ভে*ঙে পরলেন। পিউ-ধূসরের বিয়েতে কিন্তু এরকম কিচ্ছু হওয়ার কোনো চান্স নেই। কারণ পিউ তো এই বাসাতেই থাকবে৷ এমনকি আপনারা নাতি-নাত্নী নিয়ে একসাথে থাকতে পারবেন। বেয়াই বাড়ি মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার ভেজাল নেই,টাকাও বেচে যাবে। বরযাত্রী থাকবেনা৷ গাদা গাদা লোকদের খাওয়াতে হবেনা। এক্সট্রা অতিথির কোনও প্যারাই নেই । সব দিক থেকেই কিন্তু বিষয়টা ভালো হচ্ছে। কী বলো মাই লা… ইয়ে পুষ্প…?”
পুষ্প মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ” হ্যাঁ তাইত।”
রুবায়দা গুটিগুটি পায়ে এসে আফতাবের পাশে দাঁড়ালেন। সবার কান এড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন,
” তুমি চুপ করে আছো কেন? ”
তিনি স্ত্রীর দিক চাইলেন৷ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
” তো কী করতে বলছো?”
” কী করবে মানে? ধূসরের কথা শুনছো না? ও যখন ঠিক করেছে পিউকে বিয়ে করবে,তখন করবেই। তুমি একটু ভাইজানকে বোঝাও না!”
” মাথা গেছে তোমার? আমি পারব না। ”
” তাহলে আমি বলি?”
আফতাব চোখ রাঙালেন ” না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।”
আমজাদ মোটা কণ্ঠে শুধালেন,
” এটাই তোমার শেষ কথা?”
বিলম্বহীন জবাব, ” হ্যাঁ। ”
” যদি আমি না মানি? কী করবে? পালিয়ে বিয়ে করবে? ওউ,পুষ্পর বিয়ের সময় আমাকে হুমকি দিয়েছিলে না? কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার? সেটাই প্রয়োগ করবে এখন, এইত?”
ধূসর একপেশে হাসল। ঠান্ডা গলায় বলল,
“না। সিকদার ধূসর মাহতাব কাপুরষ নয়। বিয়ে করলে লুকিয়ে নয় সবার সামনেই করব। ”
আমজাদ তাজ্জব বনে বললেন,
” তোমাদের সম্পর্ক নিয়ে, আমার অমত আছে জেনেও?”
ধূসর সাফ সাফ জবাব দেয়,
” হ্যাঁ। যদি পিউ আমায় না চাইতো,আমি কোনও দিন টু শব্দও করতাম না। কিন্তু যেখানে ও আমায় চায়, আর আমি ওকে, সেখানে আমিতো নড়বনা বড় আব্বু। আমার সিদ্ধান্তের নড়চড় এমনিতেই হয়না। যেখানে বন্ধু আর বোনের ব্যাপারে আমি এগ্রেসিভ,সেখানে নিজের ভালোবাসা পেতে কতদূর যেতে পারি,আপনার ধারণাও নেই।”
আমজাদ হাসলেন,বিদ্রুপের বক্র হাসি। বললেন,
” পিউয়ের ব্রেইন যে তুমি কতটা সুন্দর ভাবে ওয়াশ করেছ আমি বুঝতে পারছি। বেশ! তুমি যখন,তোমরা যখন এতটা ভেবে ফেলেছো নিজেদের নিয়ে,তাহলে আমিও আমার শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেই?”
সবার হৃদস্পন্দন দুরুদুরু কম্পনে থিতিয়ে এলো। পিউয়ের শীর্ন বুক কাঁ*পছে।
দুশ্চিন্তায় মাথা চুবিয়ে ভাবছে,
” আব্বু আবার ত্যাজ্য করে দেবেন না তো আমাকে?”
আফতাব ভীরু কণ্ঠে শুধালেন, ” কী সিদ্ধান্ত ভাইজান?”
আমজাদ কঠিন কণ্ঠে বললেন,
” যেভাবে এই পরিবার এত বছর ধরে আমি স্বযত্নে জুড়ে রেখেছিলাম, আজ সময় এসেছে সেটা ভা*ঙার।”
সকলের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে এলো। আৎকে উঠল একরকম। ধূসর স্তব্ধ হয়ে বলল,
” আমাদের জন্যে পরিবার কেন ভাঙবে?”
আমজাদ হাত উঁচিয়ে বললেন, ” তোমার সাথে কথা বলছিনা আমি।”
পরপর সোজা আফতাবের দিক চাইলেন তিনি।
বললেন,
” তাহলে কথাটা সবার সামনেই বলছি আফতাব?”
এরপর কণ্ঠ খানিক উঁচু করে বললেন,
” তোমাকে বেয়াই বানাতে আমার কোনও অসুবিধে নেই।”
আফতাব হেসে ফেললেন। বাচ্চাদের মতন ফিকফিকে,ঝরঝরে হাসিটা দাঁতের ফাঁক গলে উঁকি দিলো। তাল মেলালেন আমজাদ। সময়ে সময়ে হুহা করে হাসিতে মেতে উঠলেন দুই ভাই। অথচ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল বাকীরা। ধূসরের কপালে ভাঁজ পড়ল । ঘটনা মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে সবার। একেকজন শুধু বিভ্রান্ত নজরে অপরজনকে দেখছে।
হাসতে হাসতে আমজাদ,আফতাব দুজনের দিক এগিয়ে গেলেন। কোলাকুলিটাও চট করে সেড়ে ফেললেন । আফতাব হৃষ্ট চিত্তে বললেন,
” কী ভাইজান? বলেছিলাম না?”
” বললেই মানব কেন? প্রমাণ নেবনা?”
সকলে তখনও বোকার মত মুখ দেখাদেখি করছে। দুজনের হঠাৎ, বিশেষ করে আমজাদ সিকদারের আকষ্মিক এই আমূল পরিবর্তন সবটা গুলিয়ে দিচ্ছে তাদের।
মিনা বেগম কিচ্ছু বুঝতে না পেরে টুপটাপ পাতা ফেলছেন চোখের। সুমনা জিজ্ঞেস করেই বসলেন,
” ভাইজান! মানে কী এসবের, ইয়ে আমাদের একটু বোঝাবেন?”
শেষ গুটি চেক-মেট দিতেই আমজাদ ‘চ’ সূচক শব্দ করে বললেন,
‘ এই যা! জিতে গেলে? ‘
আফতাব ঠোঁট উলটে বললেন, ‘ আপনি ইচ্ছে করে হেরেছেন ভাইজান। ‘
আমজাদ হেসে উঠলেন। সমাপ্তি খেলার কোর্ট গোছাতে গোছাতে বললেন,
‘ এমন কেন মনে হলো তোমার?’
‘ আমি জানিনা। কিন্তু এই দান আপনার জেতার কথা। ‘
‘ হুম্মম্মম! চিন্তার বিষয়। এই যে আমি হারলাম,আর তুমি জিতলে এর একটা কারণ আছে জানো?’
আফতাবের এত ভণিতা একটুও ভালো লাগছেনা এখন। মাথার মধ্যে চিন্তা,উত্তেজনা দপদপ করলে ভালো লাগে কারো?
সে নরম,তবে অধৈর্য কণ্ঠে বলল,
‘ ভাইজান,ভাইজান আমি একটা জরুরি কথা বলতে এলাম, আর আপনি সেই তখন থেকে….’
আমজাদ এবারেও হাসলেন। মাথা দুলিয়ে বললেন,
‘ জানি তো কী বলবে…’
আফতাব দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। তার ভাইজানের ধারণাও নেই সে কী বলতে চাইছে! থাকলে এমন হাসতে পারত না নিশ্চয়ই! আন্দাজে কী ঢিল মা*রছে,কোথায় মা*রছে কে জানে!
আমজাদ হঠাৎ হাসি থামালেন। গুরুতর মুখভঙ্গি তে চাইলেন ভাইয়ের দিক। তার নিরাশ,মলিন চেহারা দেখে ভ্রু গুটিয়ে শুধালেন,
‘ বেয়াই হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছ,তাইত?’
বৈদ্যুতিক শক লাগলে যেমন ঝটকা খায় মানুষ, ঠিক তেমন ঝাঁকুনি দিয়ে তাকালেন আফতাব। তার গোল গোল চোখ আরো গোলাকার হয়ে আসে। ঠোঁট দুটো ভাগ হয়ে চলে যায়, সমুদ্রের এপাড়-ওপাড়। শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
” আপনি কী করে জানলেন?”
” সেসব পরের কথা, কিন্তু আমি যদি বলি…”
আফতাব পুরোটা শোনার ধৈর্য পেলেন না। ভী*তু বুক আরও শ*ঙ্কিত হলো ভাইয়ের কিন্তু শুনেই। ধরফর করে ওনার হাঁটু আকড়ে বললেন,
” ভাইজান, ভাইজান দোহাই আপনার, অমত করবেন না। আমার ছেলের মেজাজ বেশি, মাথাটাও গরম, কিন্তু ওর মনটা ভালো। যাকে ভালোবাসে ভেতর থেকে বাসে। পিউকে ও খারাপ রাখবেনা। আপনি, আপনি না বললে আমি ম*রে যাব ভাইজান। আমার ছেলের খুশি শেষ হয়ে যাবে….’
আফতাবের চোখ চিকচিক করছে। এক্ষুণি অশ্রু নামল বলে। অথচ আমজাদ বিদ্বিষ্ট হয়ে বললেন,
” আহ! বাচ্চাদের মতো করছো কেন আফতাব? আমি কখন বললাম আমার মত নেই?”
আফতাব আশাহ*ত ভঙিতে মাথা নোয়াতে গিয়েও রকেট বেগে চাইলেন। কণ্ঠে অবিশ্বাস এনে বললেন, ” আপনার মত আছে?”
” আছে। ”
আফতাব কিছুসময় চেয়েই রইলেন ভাইয়ের দিক। এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না।
হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
” আমায় একটা চিমটি কা*টবেন ভাইজান?”
” কেন?”
” স্বপ্ন দেখছি, না সত্যি,নিশ্চিত হতাম।”
আমজাদ হাসলেন। ভাইয়ের মাথায় চাটি বসিয়ে বললেন,
” তুমি আর বড় হলে না!”
আফতাব বুক ভরে শ্বাস ফেললেন। পরপর মুখ কালো করে বললেন,
” আমি আরো কত চিন্তায় ছিলাম এতদিন! ভেবেছি আপনি মানবেন না ওদের সম্পর্ক। খুব ভ*য় লাগছিল আমার। আজ কত দোটানা ঝেড়ে ঝুড়ে সাহস করে এসেছি,আপনি জানেন না।!”
” আসতে তো হোতোই। তুমি ছেলেপক্ষ। প্রস্তাব তো আগে তুমিই দেবে। সত্যি বলতে,আমি আগে হলে দশবার ভাবতাম, কিন্তু ইদানীং এক অন্য রকম পৃথিবী আমার সামনে এসেছে জানো? সেদিন সম্মেলনে গিয়ে বুঝেছি,রাজনীতি দিয়েও মানুষের ভালো করা যায়। উপকার করা যায়। সব কাজেই দরকার নিষ্ঠা,সততা। যা আমাদের ধূসরের আছে আফতাব।”
আফতাব মাথা দোলালেন। তার চঞ্চু ভরা হাসির স্রোত৷ আমজাদ বললেন,
” এত সহজে মেয়ে দিচ্ছি বলে ভেবোনা এমনি এমনি দেব। তোমার ছেলেকে নাকানি-চুাবানী খাওয়ানোর একটা সুযোগ পেয়েছি। আগে খাওয়াব,তারপর। ”
আফতাব সতর্ক চোখে চাইলেন ” কী করবেন ভাইজান?”
আমজাদ রহস্য হাসলেন। হাসিতেই ঝরে পড়ল উত্তর।
সবাই হা করে তাদের দিক তাকিয়ে। ঘটনা শুনে মাথা ঘুরছে ওদের। দুই ভাইয়ের এই আঙুলে তুলে সবাইকে নাঁচানোর দক্ষতায় প্রত্যেকে বিমূর্ত। ধূসর রীতিমতো বিস্ময়ে হাবু*ডুবু খেয়ে বলল,
” এর মানে আপনি জানতেন আমাদের কথা? ”
আমজাদ ফিরলেন ওর দিকে।
” অবশ্যই। আমার নাকের ডগা দিয়ে আমার মেয়েকে বিয়ে করার কথা ভাবছো,আমি জানব না?”
পুষ্প শুধাল, ” তার মানে পাত্রপক্ষ টক্ষ সব বানানো?”
” হ্যাঁ। ”
ধূসরের চোখ তখনও ছোট ছোট হয়ে আছে। আমজাদ এগিয়ে এলেন। পিউ ততক্ষণে সরে দাঁড়িয়েছে ওর থেকে। তিনি কাঁধে হাত রাখলেন ধূসরের। স্মিত হেসে বললেন,
” দেখতে চাইছিলাম,আমার মেয়ের জন্যে কতটা কী লড়তে পারো! আমি সব সময় চেয়েছি,আমার মেয়েদের জীবনে এমন কেউ আসুক,যে পৃথিবীর বিপরীতে গিয়ে হলেও ওর হাত ছাড়বেনা। যার কাছে আমার মেয়ে আমার পর,সব চাইতে নিরাপদ অনুভব করবে। আর খোদার অশেষ রহমতে, আমি তা পেয়েছি। আজ বলতে কোনও দ্বিধা নেই,আমার দুই মেয়েই জহরত বেছে নিয়েছে। হয়ত আমি নিজেও এত নিখাদ হীরে ওদের জন্যে আনতে পারতাম না। ”
ইকবাল চোখ কপালে তুলে ভাবল,
” হিটলার শ্বশুর আমার প্রসংশা করল? মাই গড!”
আমজাদ বললেন,
” তুমি রাজনীতি করো আমি শুরু থেকে চাইনি। বকেছি,মে*রেওছি। চারপাশের অবস্থা দেখেই তোমার ভালোর জন্যে চাইনি সেসব। কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম এখন,সৎ থাকলে যে কোনও পেশা সুন্দর ধূসর। যেটা তুমি আমাকে বুঝিয়েছ। তাই অনুরোধ করব, সারাজীবন এরকম থেকো। কোনও কুৎসিত,নোংরা কাদাপানি ছিটতে দিওনা নিজের শরীরে। ”
মিনা বেগম নাক ফুলিয়ে বললেন,
” আপনি , আপনি তার মানে এতক্ষণ নাটক করছিলেন আমাদের সাথে? মজা দেখছিলেন আমরা কে কী করি সে নিয়ে?”
আমজাদ নির্দ্বিধায় স্বীকারোক্তি দিলেন,
” তোমরা যে এমন করবে আমার জানা ছিল। আমি শুধু দেখতে চাইছিলাম ধূসর কী করে! আফতাব বলছিল,ছেলে মানবেনা,শুনবেনা। আমি তাও একটু যাচাই করলাম আর কী!
তারপর মন খা*রাপ করে বললেন,
” কিন্তু আজও তোমাকে নাকানি-চুাবানী খাওয়ানোর ইচ্ছেটা আমার পূরণ হলো না ধূসর। তা তোমার বাপ যেই ভীতু,তুমি এত সাহস কোথায় পেলে বলো তো!”
আফতাব মুখ গোমড়া করে বললেন ” ভাইজান!”
ধূসর হেসে ফেলল এবার। শুভ্র দাঁত কপাটি মেলে এক স্বচ্ছ, পবিত্র হাসি ঠোঁট গহ্বরের মাঝ থেকে উঠে এলো আজ। প্রবল বেগে আমজাদকে জড়িয়ে ধরল দুহাতে। ভদ্রলোক খানিক চমকালেন। মুচকি হাসলেন পরপর। ধূসরের এতক্ষণের শক্তপোক্ত, ভারী স্বর বিনম্র হলো। বলল,
” আমি আপনার সাথে অনেক বেয়াদবি করেছি বড় আব্বু! তার জন্য ক্ষমা করবেন৷ কিন্তু সেসব…”
আমজাদ পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
” ব্যাস! ব্যাস! বলতে হবেনা। সেসব কারো না কারো ভালোর জন্যে,আমি জানি, বুঝি। ভরসা করি তোমায়।”
পিউ চোখ মুছল ব্যস্ত হাতে। এতক্ষণ এসব মজা ছিল শুনতেই সব চিন্তা শেষ। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মেয়ের এখন কপোল পূর্ন হাসিতে। পুষ্প হেসে, চঞ্চল পায়ে এসে আগলে দাঁড়াল ওকে।
ধূসর সরে এলো। হঠাৎ-ই এক অনুচিন্তন ঝাঁপিয়ে উঠল, শাণিত মস্তকের আশ-পাশে। তক্ষুণি হাসিটা মুছে গেল। আগের মত গুছিয়ে এলো ললাট। পেছনে পুষ্পর হস্তযূগলের মধ্যিখানে দাঁড়ানো, উজ্জ্বল মুখস্রীর পিউকে দেখল একবার। তারপর বাবাকে।
ফের আমজাদের দিক চেয়ে, ঝট করে বলল,
” আমি এক সপ্তাহের মধ্যে পিউকে বিয়ে করতে চাই।”
আরেকবার এক ক্ষুদ্র বাঁজ পরার শব্দ হয়। বসার ঘরে, সদ্য ফোটা আলোর লহরীটুকু কমে যায়। বিস্ময়ের তোপে তাজ্জব বনে তাকাল সবাই। তালিকা থেকে পুষ্প আর ইকবালটাও বাদ পড়েনি।
এমনকি পিউ নিজেই হাসি থামিয়ে স্তম্ভিতের মতন চেয়ে রইল।
আমজাদ বুঝতে না পেরে বললেন,
” এত তাড়াতাড়ি? কেন? আমিতো মেনে নিলাম। তাহলে… ”
ধূসর মুখের ওপর বলল,
” তাহলেও আমি আপনাদের বিশ্বাস করিনা। ”
আমজাদ তব্দা খেলেন। আফতাব বললেন,
” বিশ্বাস করো না মানে?”
ধূসর ছটফটে কণ্ঠে বলল,
” মানে,আপনারা দুই ভাই, আপনাদের ওপর আমার ভরসা নেই। যে কোনও সময় এইভাবে মত পালটে ফেলতে পারেন। দেখা গেল, হঠাৎ বলে বসলেন,পিউকে আমায় দেবেন না। বা কোনও কিছুর জেরে বদলে নিলেন সিদ্ধান্ত,তখন? আমি রিস্ক নেব না। তাই এই সপ্তাহের মধ্যেই পিউকে বিয়ে করতে চাই। ”
আমজাদ, আফতাব মারবেল চোখে একে অন্যকে দেখলেন। তাদের মুখের ওপর বলছে তাদের ভরসা করেনা?
মিনা মোক্ষম সুযোগ লুফে নিলেন। সুর মিলিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। যেভাবে আমাদের সবাইকে এতক্ষণ চিন্তায় মা*রছিল! এই দুই ভাইকে আর এক ফোঁটাও বিশ্বাস করা যায়না।”
আফতাব বললেন, ” ভাবি,আমরা তো মজা করছিলাম।”
” ক্ষমা দাও ভাই। এই মজা আর বেশিক্ষণ চললে কারোর না কারোর হার্ট অ্যা*টাক হোতো। আমার হোতো সবার আগে।”
আমজাদ বললেন,
” তাই বলে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে? এইত সবে পুষ্পর বিয়ে হলো। আর পিউতো ছোট, তোমরাই না বলছিলে এতক্ষণ? ”
” পিউ ছোট -বড় যাই হোক,বউতো আমার হবে। আগে হলে সমস্যা কোথায়?”
লজ্জায় চিবুক গলায় গিয়ে ঠেকেছে পিউয়ের। এই যে বারবার সবার সামনে, জোর গলায় বউ বউ করছে কুণ্ঠায় কান দিয়ে ধোঁয়া ছুটছে তার। অথচ সে মানুষের লজ্জা আছে? কী নির্লজ্জ!
আফতাব বললেন,
” কিন্তু… এত দ্রুত এত আয়োজন কীভাবে সম্ভব! আর তিন দিন আগে একটা বিয়ে শেষ হলো,এখন আবার বিয়ে? লোকে কী বলবে?”
” এখানে লোকের কথা আসছে কেন? আমাদের ব্যাপার, আমরা বুঝে নেব। আর এত আয়োজন করতে কে বলেছে? শুধু কাবিন হলেই তো হচ্ছে।”
জবা বললেন,
” ভাইজান, না মানে বলছিলাম মেয়ে উঠিয়ে দেওয়ার তো কোনও ব্যাপার নেই এখানে। সব যখন ঠিকঠাক, বিষয় টা কিন্তু মন্দ হয়না।”
সুমনা বললেন, ” আমারও তাই মনে হয়।”
আমজাদ অবাক হয়ে বললেন, ” মানে? তোমরা সবাই রাজী?”
ধূসর সোজা পিউয়ের দিক চাইল। এতেই ধড়াস করে উঠল ওর ক্ষুদ্র বুক। এই লোক এমন ভাবে তাকায়! প্রাণ গলার কাছে এসে ঝুলে থাকে।
সে শুধাল,
” তোর কোনও আপত্তি আছে?”
ইকবাল বিড়বিড় করে বলল,
” বিয়ের জন্যে মত নিচ্ছে না ধমকাচ্ছে? গলার স্বর একটু নরম করবে তা না… কিচ্ছু শিখলোনা আমার থেকে।”
পিউ আই-ঢাই করল। জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল অস্বস্তিতে। এত গুরুজনের সামনে সে ছোট মানুষ কী বলবে? হ্যাঁ আমি রাজী, বিয়ে করব? ছি! লজ্জা শরমের একটা বিষয় আছে না, না কী! সে কি ধূসর ভাইয়ের মত অত বেহায়া !
কিন্তু বিয়ের জন্যে যে এখনই মনের ভেতর সাজান সাজান গান বাজছে! গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
” আমি বিয়ে করব। পারলে এক্ষুণি ধূসর ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে পড়িয়ে দাও।”
কিন্তু মন চাইলেই কি সব সম্ভব? পিউ নিরুপায় হয়ে,পায়ের পাতার ওপর চোখ নামিয়ে নিলো।
ইকবাল লাফিয়ে উঠে বলল, ” এইত পিউ হ্যাঁ বলেছে। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ না? পিউপিউ চুপ, মানে ও রাজি।”
আমজাদ এবার সত্যি সত্যি রে*গে গেলেন। লম্বা পায়ে গিয়েই ধপ করে বসে পরলেন সোফায়। গজগজ করে বললেন,
” যা তা একটা সিদ্ধান্ত নেবে,আর সবাই মিলে লাফাবে এর পেছনে। এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হয় কারো?”
পুষ্প বলল, ” এইবার হবে আব্বু। আমার ভাইয়া ইউনিক না? তার বিয়েতে সব ইউনিক হবে। তুমি এত ভেবোনা। শুধু খুব কাছের লোকদের দাওয়াত দিয়ে এসো। বাকি সব আমরা সামলে নেব।”
জবা বললেন ” তুই কী করে সামলাবি? তুই না অসুস্থ?”
” বোনের বিয়ের খুশিতে এখন সুস্থ। আনন্দ ডাবল না?”
জবার তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল ধূসরের সেই কথা। ”ছেলে-মেয়ের বিয়ে, এভ্রিথিং স্যুড বি ডাবল।’
মাথা নেড়ে ভাবলেন,
” এইজনেই ছেলেটা ওসব বলেছিল? ওরে প্যাঁচানো কথা রে বাবা! ক্লু তো ঠিকই দিয়েছিল,আমরাই না বুঝিনি। ”
আফতাব বলার মত কিছু পেলেন না। বিফল ভঙিতে এসে ভাইয়ের পাশে বসে গেলেন তিনিও।
মিনা প্রফুল্ল স্বরে বললেন,
” তাহলে একটা ভালো দিন ঠিক করি এ সপ্তাহে? ও মেজো, তুইত কিছু বললি না,আমার মেয়েকে ছেলের বউ বানাতে আপত্তি -টাপত্তি নেইতো?”
ভদ্রমহিলা বিস্ময়কর চাউনীতে তাকালেন। অভিমানী কণ্ঠে বললেন,
” এ কী কথা আপা? এটা তুমি আমায় জিজ্ঞেস করতে পারলে? এই চিনলে এতদিনে?”
রুবায়দা ঠোঁট উল্টাতেই মিনা এগিয়ে এলেন কাছে। গলা জড়িয়ে বললেন,
” আরে আরে হয়েছে! মজা করলাম একটু। তা কী কী যৌতুক নিবি লিস্ট বানাবি না? ”
আফতাব হা করে বললেন,
” ভাবি,কী সব হাবিজাবি মজা করছেন বলুন তো!”
আনিস আক্ষেপ করে বললেন,
” ইশ,আমার যদি একটা মেয়ে থাকতো,তাহলে আমিও এরকম ভাইজানের ছেলেদের সাথে বিয়ে দিতে পারতাম। ধুর!”
” কেন ভাই? এখনও সময় আছে,একটা মেয়ের বাবা হও,সিরিয়ালে আমার রাদিফ থাকবে তখন। পছন্দ হলে সমন্ধ এগোতে পারবে।”
আনিস হেসে উঠলেন জবার কথায়। সুমনা সতর্ক কণ্ঠে বললেন,
” আপা সামনে তো শুক্রবার। ওই দিনটা ভালো হবেনা?”
ইকবাল ছুটে গিয়ে ধূসরকে জড়িয়ে ধরল। বাহু ঝাঁকিয়ে বলল, ” বন্ধু কংগ্রাচুলেশনস! সমন্ধি থেকে এবার ভায়েরা ভাই হচ্ছি।”
ধূসর হাসল।
রুবায়দা মৃদূ আর্তনাদ করে বললেন,
” এ বাবা! শুক্রবার তো বেশি দেরীও নেই। বিয়ের জন্যে কেনাকাটা করতে হবে।”
” হ্যাঁ হ্যাঁ, রান্না শেষ করে আজই যাই চল।”
আমজাদ, আফতাব দুজন দুজনকে দেখে নীচের দিক চেয়ে মাথা নাড়লেন। এই নারী সমাজে তারা পরাজিত সৈনিক।
সাদিফ চঞ্চল কদমে ঘরের দিক ছুটল। খুশির খবর শুনেই বিশেষ একজনকে মনে পড়ছে তার ।
রাদিফ,রিক্ত বল হাতে নেমে এসেছে ওপর থেকে। বিয়ের কথাবার্তা শুনেই ছেলেটা তীব্র কৌতুহল নিয়ে শুধাল,
” কার বিয়ে হবে?”
জবা উত্তর দিলেন, ” তোর প্রিয় পিউপুর।”
রিক্ত খরগোশের মত লাফিয়ে, হাত তালি দিয়ে বলল,
” কী মজা পিপুর বিয়ে,বিয়ে! ”
পিউয়ের ওষ্ঠযূগলে হাসির বাণ৷ তবে ওই হাসি চাঁদের লুকোনো জ্যোস্নার ন্যায়। সে চোরা,লাজুক নেত্রে একবার ধূসরের দিক তাকাল। অন্তঃপটে বিয়ের ঘন্টা টুং টুং করছে তার। আর হাতে গোনা কদিন,তারপরেই ধূসর ভাই স্বামী হবে ওর। অথচ তাকাতেই কুণ্ঠিত চাউনী পালটে গেল । ধূসর এদিকেই চেয়েছিল। সে চাইতেই, ঠোঁট কা*মড়ে, চোখ রাঙাল। নিরবে বোঝাল,
” খবর আছে তোর!”