ফ্লোরেনসিয়া – ২৮

17 Min Read

–“ফ্লোরেনসিয়া” আমার শহরে তোমাকে স্বাগতম।

থমথমে ভরাট কন্ঠের লোমহর্ষক কথন।সিয়ার স্মৃতিশক্তি ছিলো সর্বদা প্রখর।ওর চিনে নিতে একটুও সময় লাগেনা ওটা এদুয়ার্দোর কন্ঠস্বর।

সিয়া সতর্ক দৃষ্টিতে একবার চারপাশে নজর বুলিয়ে নেয়।একটা সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায়,এক কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে ও।দুর থেকে বহুদুর পর্যন্ত সবকিছু প্রগাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত।হিমশীতল বাতাস বইছে।এইতো কিছুক্ষণ আগে ও’ দাদু ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ির পশ্চাদ্ভাগের উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলো।কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এই সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় কখন আর কিভাবে পৌঁছালো?

দুর্ভাগ্যক্রমে সময় জানা নেই সিয়ার।যদি ঘড়িতে সময় দেখে কামরার বাইরে বেরিয়ে আসতো এবং এই মুহূর্তে সময় দেখতো।তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারতো কতক্ষণ সময় লাগিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় এসে দাড়িয়েছে ও।ইউনিকর্ন’টা অদৃশ হওয়ার পর থেকে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর সময়টুকু মনে নেই সিয়ার।তাই অনায়াসেই এই ঘটনার জন্য এদুয়ার্দোকে দায়ী ভাবলো।ক্রুদ্ধ মেজাজে মনে মনে বললো,,

-সবটাই এই রক্তপিপাসুর ষড়যন্ত্র।ও-ই কিছু একটা করেছে।হয়তো কোনো ইন্দ্রজাল বিছিয়ে ছিলো।

সিয়ার রাগ হয়।ভীষণ রাগ হয়।অকস্মাৎ মশালের আলো নিভে যায়।অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায় দৃষ্টির সম্মুখে থাকা সবকিছু।সজাগ হয়ে উঠে সিয়ার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।চোখের পলকে ওর পেছনে গিয়ে দাড়ায় এদুয়ার্দো।সিয়া উৎকর্ণ কানে তার ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়।

এদুয়ার্দোর শরীর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি মৃদু সুবাস ঘ্রাণেন্দ্রিয় ভেদ করে সিয়ার মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।থমকে যায় হৃৎস্পন্দন।সিয়া বিমোহিত হয়,অবশ হয়ে আসে ওর সর্বাঙ্গ।ধীরে ধীরে দু’চোখের নেত্রপল্লব বুঝে নেয়।

এদুয়ার্দোর চোখজোড়া থেকে সবুজ বর্ণের দুর্লভ দ্যুতি ছড়ায়।জ্বলজ্বলে চোখে সিয়ার পিঠে ছড়িয়ে থাকা ঘন বাদামী মসৃন চুলগুলোর দিকে তাকায়।সামান্য বিস্মিত হয়।আস্তে আস্তে সে নিজেও যেন কোনো অদ্ভুত নেশায় বুদ হয়ে যায়।এ নেশা রক্তের।কি মিষ্টি রক্তের সুবাশ!

এদুয়ার্দোর হিমযুক্ত এক হাত সিয়ার কাঁধ স্পর্শ করে।চার আঙ্গুলে আলগোছে সিয়ার ঘাড়ের কাছের চুল সরিয়ে দেয়।ভয়াবহ মাদক মেশানো মিষ্টি রক্তের সুবাশ।নিমেষেই এদুয়ার্দোর অভ্যন্তরে থাকা হিংস্র পি’শাচ সত্তা জেগে উঠে।লাল টুকটুকে ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে ঝকঝকে সাদা দু’টো তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে।

এমারেল্ড সবুজ মনিগুলোর রঙ বদলে রক্তবর্ণ হয়ে উঠে।জ্বলতে শুরু করে সিয়ার ক্রুশচিহ্ন।ওর কর্ণকুহরে বারি খায় ক্রুদ্ধ গরগরে হিংস্র গর্জনের শব্দ।ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়।সিয়ার ঘাড় স্পর্শ করে একজোড়া ভেঁজা ঠোঁট।দু’টো ধারালো সাদা দাঁত চামড়া ভেদ করে রক্তনালিতে গিয়ে পৌঁছায়।চুকচুক করে রক্ত পান করে।

সিয়া সম্বিত ফিরে পায়।শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগে ডান হাতের কনুই দিয়ে এদুয়ার্দোর বুকে সজোরে আঘাত করে ও।আঘাতের ধাক্কা সামলে নিয়ে এদুয়ার্দো কিছুটা পেছনে সরে যায়।গম্ভীর মুখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে সে।অবাক হয়,সিয়া বশীভূত হয়নি বলে।

সিয়ার মন পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এদুয়ার্দো ইম্যুভিলে এসেছিলো।তাছাড়া কারো কপালে হাত রেখে তার মস্তিষ্কে থাকা সমস্ত স্মৃতি জানতে পারার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এদুয়ার্দোর।যা শুরু থেকেই ছিলো।সে জানতে চেয়েছিলো,সেদিন রাতে এমন কি ঘটেছিলো?ভাম্পায়ারদের মধ্যে কে বা কারা সিয়ার মা,দাদিন আর সাসোলি কুরীকে হ’ত্যা করেছিলো।কিন্তু ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ি পর্যন্ত যেতে হয়নি তাকে।এই সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়াতেই সিয়াকে খুঁজে পেয়েছিলো সে।গভীর রাতে মেয়েটা পাহাড়ের চুড়ায় কি করছে?প্রথমে বিষয়টা ভাবলেও পরে আর এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি এদুয়ার্দো।

হয়তো প্রকৃতি চেয়েছিলো এদুয়ার্দোর শ্বদন্ত সিয়ার রক্তের আস্বাদন গ্রহণ করুক।অলৌকিক কিছু ঘটুক।আলো আঁধারিতে হারিয়ে যাওয়া এদুয়ার্দোর সমস্ত স্মৃতি ফিরে আসুক।আজকের আগেও এরকম হয়েছিলো।প্রথমবার সিয়ার রক্ত পান করার পর প্রায়ই এদুয়ার্দোর চোখের সামনে অস্পষ্ট কিছু ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতি ভেসে উঠত।আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

রক্ত নয়,যেন হৃদপিণ্ড জ্বালিয়ে দেওয়া তীব্র ভয়ংকর বিষ পান করেছে এদুয়ার্দো।তার হৃদপিণ্ড জ্বলতে শুরু করে।চোখের সামনে আবছা কিছু ভিশন দেখতে পায়।অতীতে হারিয়ে যায়।কানে কানে বাজে হৃদয় নিংড়ানো ডাক।কিছু আদুরে শব্দ,,,,

-বাবা এদুয়ার্দো।আমার বড় রাজকুমার।তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত সবুজ নেত্রের সুদর্শন ছেলে আমার।বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের সাথে এভাবে কেনো লড়ছো?

-ও আমাকে বড় ভাই বলে গন্য করে না মা।__এদুয়ার্দোর কন্ঠে রাগের বহিঃপ্রকাশ।

তার কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গর্জে উঠে অন্য একটা ছেলে।অভিযোগ করে বলে,,,,

-মিথ্যা বলছে ও।

এদুয়ার্দোর চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠে।মহিলাটা কে?উনি’তো পিদর্কা স্যাভেরিন নন।তাহলে কেনো তাকে মা বলে ডেকেছিলো এদুয়ার্দো?ছেলেটা নিশ্চয়ই আব্রাহাম ছিলো।ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণের জন্য এদুয়ার্দো অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।

কয়েক পল সময় গড়ায়।সে সম্বিত ফিরে পায় সিয়ার তলোয়ারের খাপ খুলে ফেলার শব্দে।ভয়াল অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করে তার সামনেই দাড়িয়ে আছে সিয়া।সহসা আবারও দপ করে মশাল জ্বলে উঠে।মেয়েটা পুরোপুরি সজ্ঞানে আছে।এর আগে এরকম ঘটনা কোনোদিনও ঘটেনি।আজই প্রথম এদুয়ার্দো কাউকে বশীভূত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

দুর্দম্য আক্রোশ নিমেষেই সিয়াকে কাবু করে ফেলে।ও শক্তহাতে তলোয়ার চেপে ধরে।যেন ওর দু’চোখের দৃষ্টিতে ভয়ংকর দাবানল জ্বলে উঠে।ক্রোধের আতিশয্যে শরীরের সাথে পাল্লা দিয়ে পাতলা কোমল গোলাপি রঙের ঠোঁটজোড়াও নিরন্তর কাঁপতে শুরু করে।

মস্তিষ্কে উদিত হওয়া প্রশ্নগুলো ভুলে এদুয়ার্দো একপা দু’পা করে এগিয়ে যায় সিয়ার দিকে।তার থমথমে পায়ের প্রতিটা পদক্ষেপে প্রগাঢ় দম্ভ প্রকাশ পায়।জলন্ত মশালের আগুনের আলোয় মুখখানা স্পষ্ট দেখা যায়।লাল টুকটুকে ওষ্ঠদ্বয়ে ক্রুর হাসে সে।সিয়ার পিত্তি জ্বলে যায়।রক্তবর্ণ চোখে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে এদুয়ার্দোর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।এদুয়ার্দো বাঁকা হেসে ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

কয়েক পল সময় গড়ায়।নিজেদের মাঝখানে বেশ কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে দু’জন প্রতিপক্ষ।একজনের চোখে দুর্বোধ্য ভয়ংকর ক্রোধ,অন্যজনের ভাবুক দৃষ্টি।

-কিছু তো একটা আছে এই মেয়েটার মাঝে।___এদুয়ার্দো মনে মনে ভাবে।

অকস্মাৎ ভ্রু-কুঞ্চিত করে।কুঁচকে যাওয়া ভ্রু আর সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সিয়াকে অভিনিবেশ সহকারে দেখে।রক্ত হিম করে দেওয়া শীতল কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বলে,,,,,

–তুমি ফ্লোরেনসিয়া।এম আই রাইট?

এদুয়ার্দোর কন্ঠে নিজের নাম শুনে ফুঁসে উঠে সিয়া।ভয়ংকর রোষানলে অন্ধ হয়ে যায়।তলোয়ারের এক কোপে এদুয়ার্দোর শরীর থেকে মাথাটা আলাদা করে মশালের আগুনে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।চোখের সামনে মা-দাদিনের ফ্যাকাশে দু’টো মৃতদেহ ভেসে উঠে।অসামান্য ক্রোধে ওর সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করে।যেন শ’য়তান এদুয়ার্দোকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো না করা পর্যন্ত মনে শান্তি পাবে না ও।

-পাপিষ্ঠ দিয়াবল।আমার হাস্যোজ্জ্বল পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়ে এখন অভিনয় করছিস?___সিয়া ক্রুদ্ধ কন্ঠে মনে মনে বলে।

এদুয়ার্দোর বিস্ময়াভিভূত চাহনি।তার মুখাবয়বে বিরাজিত শক্ত দুরূহ গাম্ভীর্য।সহসা সিয়ার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।ও আক্রোশপ্রসূত কন্ঠে বলে,,,

-হ্যাঁ।আমি ফ্লোরেনসিয়া,তোমার মৃ’ত্যুদূত।

তীব্র বাতাসে সিয়ার গাঢ় বাদামী চুলগুলো উড়তে শুরু করে।এদুয়ার্দোর দু’চোখে সামান্য বিস্ময়।এই মুহূর্তে সিয়াকে বিধ্বংসী মনে হয়।যেন প্রচন্ড আঘাতে জর্জরিত কোনো আহত বাঘিনী দাড়িয়ে আছে।ক্রোধ আর ঘৃণার সংমিশ্রণে যার হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে।

-আমাকে মা’রবে?বোকা মেয়ে।আমি না চাইলে তুমি এখান থেকে জীবিত ফিরে যেতে পারবে না।___এদুয়াদোর বিদ্রুপাত্মক কন্ঠস্বর।ঠোঁটের ভাঁজে লেগে আছে নির্দয় হাসি।অথচ মুখকান্তিতে কত মায়া।তার এমারেল্ড সবুজ চোখজোড়ায় মোহগ্রস্ত চাহনি।সিয়া ওর মনের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ একত্রিত করে প্রাণপণে ধরে রাখে নিজেকে।অসম্ভব,ও এই মায়ায় গলবে না।গলতে পারে না।

-পাপাত্মার পি’শাচ।আমার মা-দাদিনের হ’ত্যাকারী।আমার হাতেই তোমার মৃত্যু লিখেছেন ঈশ্বর।___সিয়ার রাগান্বিত কন্ঠস্বর।

এদুয়ার্দোর ঠোঁটে পৈশাচিক হাসি।হিংস্রাত্মক শান্ত কন্ঠে সে বলে,,,

-আমাকে ভয় পাও।তোমার চোখে ক্রোধ নয়,ভয় দেখতে চাই।

-না আমি অক্ষম,না অসহায়।আর না আমি তোমাকে দেখে ভয় পাই।___সিয়ার কন্ঠে অমিত তেজ।

-এতোটা আত্মবিশ্বাস?__এদুয়ার্দোর কন্ঠে বিস্ময়।

সিয়া ফোঁসফোঁস করে উঠে।এদুয়ার্দো স্থির নেত্র মেলে দেখে।কয়েক পা এগিয়ে সিয়ার সামনে গিয়ে দাড়ায়।সিয়া যেন এতক্ষণ এই মূহুর্ত টার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলো।অবশেষে,অবশেষে মোক্ষম একটা সুযোগ পায় ও।

অকস্মাৎ একটা অভাবনীয় কাজ করে বসে সিয়া।তলোয়ার দিয়ে এদুয়ার্দোর গলা বরাবর আঘাত করে ও।এদুয়ার্দো ত্বরিত সরে দাড়ায়।তলোয়ারের অগ্রভাগের ধারালো অংশের আঘাতে তার গলার চামড়া কেটে যায়।টুপটুপ করে রক্ত ঝড়ে পড়ে।সে বিস্ময়ে অভিভূত।সিয়া পুনরায় তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে তাকে।এবার ওর তলোয়ার’টা বাম হাতে ধরে ফেলে এদুয়ার্দো।

এদুয়ার্দোর হাত থেকেও রক্ত ঝরছে।বেশি না।অল্প অল্প করে।সিয়া কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়,যখন এদুয়ার্দোর গলায় কেটে যাওয়া চামড়ার ক্ষতটুকু আপনা আপনি স্বাভাবিক হয়ে যেতে দেখে।এখন আর রক্ত ঝরছে না ওখান থেকে।

সিয়া ওর বাম হাত দিয়ে এদুয়ার্দোর চিবুকে আঘাত করে।চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে এদুয়ার্দো।মুহূর্তেই ভয়ংকর রাগী চোখে তাকায়।সিয়ার বাম হাতটা নিজের ডানহাতে শক্ত করে ধরে।হিংস্রাত্মক শীতল কন্ঠে বলে,,,

-নির্বোধ,এই সামান্য তলোয়ার দিয়ে রক্তপিপাসুদের মহারাজকে মা’রতে চাইছো?

সিয়ার ভয়াবহ ক্রোধিত দৃষ্টি খানিকটা বিস্ময়ে বদলে যায়।এদুয়ার্দো ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু হাসে।মোহগ্রস্ত শক্তিসম্পন্ন সুমধুর কন্ঠে বলে,,,,

–“ফ্লোরেনসিয়া” তুমি ভীষণ বোকা।

-অসভ্য,জানোয়ার!আমার মায়ের খু’নী।আমি তোমাকে ধ্বংস করবো।আমার হাতেই তোমার মৃ’ত্যু অবধারিত।

ক্রোধিত কন্ঠে কথাগুলো বলে উঠে সিয়া।ওর দু’চোখের দৃষ্টিতে অসামান্য ঘৃনা।এদুয়ার্দোর শান্ত চাহনি।

-নিকৃষ্ট পি’শাচ।তোমার এই অপবিত্র হাতে আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখিয়েছো।আমি এই হাত তোমার শরীর থেকে কেটে আলাদা করে ফেলবো।

এদুয়ার্দোর অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে।বিরক্ত কন্ঠে বলে,,,,

-মার্শাল আর্টে দক্ষ,তোমার মাস্টার বাবা তোমাকে এই প্রশিক্ষণ দিয়েছে?

সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় সিয়ার।এদুয়ার্দোর ধরে থাকা ওর ডান হাতের তলোয়ার ছেড়ে দেয়।এদুয়ার্দো তলোয়ারটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে।সিয়া ওর শরীরের সমস্ত শক্তি ডান হাতের মুঠোয় জমা করে এদুয়ার্দোর বুকে সজোরে ঘুষি মা’রে।কিন্তু ওর হাতটা ধরে ফেলে এদুয়ার্দো।শক্ত গলায় বলে,,,,,

-তোমার প্রশিক্ষণের এই রনকৌশলগুলো আমি জানি।আঘাত কোন দিক থেকে আসবে,কিভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।সব জানা আছে।অযথা লাফালাফি না করে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকো।নাহলে এই পাহাড় থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলবো।লা’শটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।হিংস্র জন্তু জানোয়ারের আহারে পরিনত হবে।

এদুয়ার্দোর কথাগুলো সিয়ার কানে বিষাক্ত হয়ে বাজে।ঘৃনা হয়।ভীষণ ঘৃনা হয়।ওর দু’চোখের মনিগুলো থেকে ক্রোধের ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ে।নিজের দুই পা এদুয়ার্দোর বুকে রেখে উল্টো হয়ে পিছনে ঘুরে দাড়ায়।এদুয়ার্দো ওর হাত ছেড়ে দেয়।তাকে আঘাত করতে পুনরায় দৌড়ে আসে সিয়া।এদুয়ার্দো স্থান পরিবর্তন করে ওর পেছনে গিয়ে দাড়ায়।সিয়া থেমে যায়।চারপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায়।পেছন ঘুরে দেখে।চোখের সামনে বেশ কিছুটা দুরে এদুয়ার্দো দাঁড়িয়ে আছে।আক্রমনাত্মক হয়ে সিয়া পুনরায় দৌড়ে যায় তার দিকে।কিন্তু ঝোঁকের বশে ভয়ংকর একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।

দু’জনেই পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলো।এদুয়ার্দোর দিকে দৌড়াতে গিয়ে সিয়া পাহাড়ের নিচে গড়িয়ে পড়ে।বুকের গভীরে মৃ’ত্যুর হিমেল স্পর্শ অনুভব করে।সিয়ার আফসোস হয়।নিজের ব্যর্থতা মেনে নিতে পারে না ও।নিস্প্রভ কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বলে,,,,

-মা,আমি আপনার অকৃতজ্ঞ মেয়ে।নিজের প্রতিজ্ঞা পূরণ করে আপনার মৃ’ত্যুর প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হওয়া এক অপদার্থ মেয়ে।ঈশ্বর কি আমাকে ক্ষমা করবেন?ক্ষমা করবেন আপনিও?

মা,এই পৃথিবীর কোনো কিছু আমার ভালো লাগে না।আপনাকে ছাড়া সবকিছু বিষাক্ত মনে হয়।আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।আপনি কি জানেন?আমি কত রাত ধরে ঘুমাই না।এই পাহাড় থেকে নিচে পড়লে আমি তৎক্ষনাৎ মা’রা যাবো।মৃ’ত্যুকে ভয় পাইনা আমি।কিন্তু আফসোস,আমি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারি নি।মৃত্যুর পর স্বর্গে আপনার সাথে আমার আবারও কি দেখা হবে?আপনি আমায় বুকে আগলে রেখে ঘুম পাড়াবেন তো ?আমি অনেকগুলো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি।

মা,আমি ব্যর্থ হয়ে আপনার কাছে ফিরে যাচ্ছি।ঈশ্বরের কাছে একটাই শেষ প্রার্থনা।যেন মৃ’ত্যুর পর আবারও আমাদের দেখা হয়।

দু’চোখের নেত্রপল্লব বুজে নেয় সিয়া।ধীরে ধীরে নিচে পড়তে থাকে।ভয় আর যন্ত্রণার সংমিশ্রণে একসময় চেতনা হারায় ও।হঠাৎ ওকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে এদুয়ার্দো।সিয়ার নিষ্পাপ মলিন মুখখানার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,,,,

–“ফ্লোরেনসিয়া” বোকা বাঘিনী।

_____

ইম্যুভিল।

প্রায় শেষ রাত।যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে প্রকৃতি।ঠান্ডায় জমে গেছে সব।হাঁড় কাঁপানো শীতে ঘুমের ঘোরে নাকের উপর কম্বল টেনে নেয় ইনায়া।
কামরার বাইরে বারান্দায় কারো অস্পষ্ট পায়ের আওয়াজ শোনা যায়।খট করে খুলে যায় দরজা।দরজা খোলা ব্যক্তি বেশ অবাক হয়।কারন দরজাটা ছিলো বাইরে থেকে লাগানো।খুব বেশি না ভেবে কামরায় প্রবেশ করে সে।দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে নেয়।যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।নিজের কাছেই নিজেকে চোর বলে মনে হয়।এই প্রথম,এই প্রথম সে বিনা অনুমতিতে কারো কামরায় প্রবেশ করেছে।ভয় পায়।মা’র খাওয়ার ভয়।পরমুহূর্তে নিজেই নিজেকে ঝারি দিয়ে বলে,,,

-কিসের ভয়?তুমি ভাম্পায়ারদের এস্টীম রুলার।

কামরার এক কোণায় একটা ছোট মোমবাতি জ্বলছিলো।যার নিভু নিভু আলোয় আব্রাহাম বিছানার দিকে তাকায়।গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকা দু’জন মেয়েকে দেখতে পায়।অর্ধ মুখ ঢেকে ঘুমে নিমগ্ন থাকা ইনায়াকে দেখে তার হৃৎস্পন্দন থমকে যায়।কতক্ষণ সময় গড়ায় কে জানে!

ধীরে ধীরে তার হৃদস্পন্দের গতি বাড়ে।এতটাই বাড়ে,যেন মনে হয় বক্ষস্থলে অলৌকিক দামামা বাজে।একটা অসম্ভব সুন্দর প্রশান্তি।কি নাম দেওয়া যায় এই অনুভূতির?আব্রাহাম ভাবে।ভাবতে ভাবতেই সামনের দিকে পা বাড়ায়।একপা দু’পা করে হাঁটে।শঙ্কিত হয়।যদি ইনায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়।কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে ও?

ইনায়ার কাছে পৌঁছাতেই রক্তের নেশা জাগে।আব্রাহাম বিছানায় আলগোছে বসে।ঠোঁট ছড়িয়ে দুষ্টু হাসে।ধীর হাতে কম্বল টেনে নেয়।ইনায়া ঘুম জড়ানো মায়াবী কন্ঠে বলে,,,

-আর্নি।কম্বল টেনে নিও না প্লিজ।খুব ঠান্ডা লাগছে।

স্তম্ভিত হয় আব্রাহাম।কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কানে কানে বাজে।দমে যায় সে।কিন্তু পরমুহূর্তেই দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে মনে মনে বলে,,,

-উমহু।আমাকে রক্ত খেতে হবে।

আব্রাহাম পুনরায় ধীরে ধীরে কম্বল টেনে নেয়।সে রক্ত খেতে নয়,ইনায়াকে একনজর দেখতে এসেছে।কিন্তু সেকথা কে বোঝাবে তাকে।ভেতর থেকে তার দুষ্ট আত্মা বলে,,,

-আব্রাহাম তুমি রক্ত খেতে এসেছো,প্রেম করতে নয়।এভাবে লুকোচুরি কেনো খেলছো?ফটাফট রক্ত খাও আর তাড়াতাড়ি বিদায় হও।

আব্রাহাম ধমকে উঠে তার দুষ্ট আত্মাকে।শঙ্কিত গলায় বলে,,,

-এখন তোমার কথা মতো কাজ করে মা’র খাই ওর হাতে।তাইনা?

দুষ্ট আত্মা শব্দ করে হাসে।আব্রাহাম কঠিন গলায় শাসানোর স্বরে বলে,,,

-একদম হাসবে না।

-হাসবো না?তুমি ভীতু।ভাম্পায়ার সাম্রাজ্যের একজন শাসক হয়ে,তুমি কিনা একটা সাধারণ মেয়েকে ভয় পাচ্ছো?

আব্রাহাম কে উস্কে দেয় তার দুষ্ট আত্মা।আব্রাহামের জেদ হয়।সহসা তার মধ্যে পি’শাচ সত্তা জেগে উঠে।দু’ঠোটের ফাঁক দিয়ে দু’টো সাদা ধারালো শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে।ইনায়ার মুখের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে ঘাড়ের কাছে মুখ ডুবিয়ে দেয় সে।এরই মাঝে তার একহাত আঁকড়ে ধরে ইনায়া।মিষ্টি হেঁসে বলে,,,

-আমি তোমাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাবো না।সবসময় তোমার সাথে সাথে থাকবো।ভালবেসে পরম যত্নে বুকের মাঝে আগলে রাখবো।তোমার সব বিপদে-আপদে পাশে থাকবো।

আব্রাহাম থমকে যায়।কথাগুলো যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায় তার।ইনায়ার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসিটা দেখে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায় সে।কিন্তু পরমুহূর্তেই মুখখানা মলিন হয়ে যায় ইনায়ার মুখে “সিয়া” নাম শুনতে পেয়ে।আব্রাহাম বেশ জোরালো গলায় বলে,,,

-ওহ।তারমানে এসব তুমি সিয়া নামের কোনো মেয়েকে বলছিলে?

কামরায় কোনো পুরুষের কন্ঠ শুনতে পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় ইনায়ার।দ্রুত উঠে বসে পড়ে ও।মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় কাউকেই খুঁজে পায়না কামরার মধ্যে।মনের ভুল ভেবে পাশ ফিরে তাকায়।কিন্তু সিয়াকে বিছানায় না দেখে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।দরজাটা হালকা চাপিয়ে রাখা ছিলো।ইনায়া বিছানা থেকে নেমে দাড়ায়।এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে।হয়তো সিয়া এখনো না ঘুমিয়ে বারান্দায় বসে আছে।

_____

কিয়েভ,স্যাভেরিন ক্যাসল।

স্নিগ্ধ ভোরের আলো ফুটে উঠে চারপাশে।একটি বদ্ধ কামরার দরজার সামনে এসে দাড়ান পিদর্কা স্যাভেরিন।দ্বাররক্ষীদের একজন দরজা খুলে দেয়।সগর্বে বুক টানটান রেখে তিনি কামরায় প্রবেশ করেন।চোখে মুখে প্রশান্তিময় হাসি।পেছনে দু’জন দাসী।এই কামরাটা প্রায় সবসময়ই অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে।মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় কাজে কিছুক্ষণের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়।

রাতের অন্ধকারে কামরাটায় আগুনের শিখা জ্বলেনি কখনো।ভয়!এখানে বন্দী থাকা মহিলাকে ভয়ে জর্জরিত করার লক্ষ্যে এরকম শাস্তি দেওয়া হয়।মহিলার গায়ে ময়লাযুক্ত ছেঁড়া পোশাক।ঢিলেঢালা সাদা রঙের লম্বা গাউন পরে কামরার এক কোনায় বসে আছেন তিনি।চুলগুলো উষ্কখুষ্ক।মুখে ধুলোবালি।

কামরার দরজা খোলার শব্দে চমকে তাকান মহিলা।প্রতিবার আশায় বুক বেঁধে আশাহত হওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করেন।কই? তাকে বন্দী দশা থেকে মুক্তি দিতে কেউতো এই কামরায় আসে না।ব্যথা হয়,বুকের মাঝখানে চিনচিনে ব্যথা হয় তার।তিনি ভাবেন,,,

-সত্যিই কি ম’রে গেছে ক্লারেসিয়া?ওকে মে’রে ফেলেছে ওরা?

মহিলা গুনগুনিয়ে কাঁদেন।বিরবিরিয়ে বলেন,,,

-ক্লারেসিয়া কি আসবে না?বি’নাশ হবে না পি’শাচদের?তাহলে কে রক্ষা করবে সাধারণ মানুষগুলোকে?এভাবেই কি শত শত বছর ধরে রক্তপিপাসুদের পাপের রাজত্ব চলতে থাকবে?

ধীরপায়ে মহিলাটার কাছে এগিয়ে যান পিদর্কা স্যাভেরিন।পরনে জমকালো দামী পোশাক।সোনালী রঙের জরি দিয়ে কারুকাজ করা খয়েরী রঙের গাউন।মহিলা ঘৃনাভরা চোখে দেখেন।অতঃপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেন।পিদর্কা স্যাভেরিন হাসেন।হাস্যোজ্জ্বল গলায় প্রশ্ন করেন,,,,

-কেমন আছো তুমি?কামরায় থাকা ইঁদুরগুলো তোমার ঠিকমতো খেয়াল রাখছে তো?

মহিলা প্রত্যুত্তর করেন না।পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকেন।উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করেন পিদর্কা স্যাভেরিন।হঠাৎ হাসি থামিয়ে আফসোস সূচক শব্দ করে বলেন,,,,

-বেচারি।কতটা হতভাগীনি তুমি।আমি ছাড়া তোমাকে খাবার দেওয়ারও কেউ নেই।আমার দয়ায় বেঁচে আছো।নাও খেয়ে নাও।তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।

একজন দাসী শুকনো রুটি আর পানি দেয় মহিলাকে।খান না তিনি।হাত দিয়ে সরিয়ে দেন খাবারের প্লেট।দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,,

-আমার ছেলে কোথায়?

-গুস্তাভ ফ্লভেয়ার?____চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থেকে কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন পিদর্কা স্যাভেরিন।

-সেটা তো তোমার দেওয়া নাম।ওর আসল নাম পাওলো স্যাভেরিন।

-ভুলে যাও।মে’রে ফেলেছি ওকে।____মেকি হেসে উত্তর দেন পিদর্কা স্যাভেরিন।

মূহুর্তেই ভয়াবহ রেগে যান মহিলা।ত্বরিত উঠে দাড়িয়ে পড়েন।ক্রোধের আধিক্যে দু’হাতে পিদর্কা স্যাভেরিনের গলা চেপে ধরেন।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।