ফ্লোরেনসিয়া,কতগুলো নি’পীড়িত মানুষ অসামান্য য’ন্ত্র’ণা নিয়ে অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে আছে।ওরা অপেক্ষায় আছে,কেউ একজন আসবে,র’ক্ত’পি’পা’সুদের নৃ’শং’সতা থেকে তাদের রক্ষা করবে।তুমি যা জানো,তা খুবই সামান্য।এখনো অনেক কিছু জানা বাকি।তোমাকে জানতে হবে শত বছরের পুরনো কাহিনী।
অসংখ্য অগনিত মানুষের প্রতি হওয়া সব নি’র্যা’তন,অ’ত্যা’চার।তাদের দুঃখ,ক’ষ্ট,য’ন্ত্রণার কাছে তোমার এই য’ন্ত্র’ণাগুলো খুবই সামান্য।
ফ্লোরেনসিয়া,একটা কথা সবসময়ই মনে রাখবে।ক্রো’ধ মানুষকে বুদ্ধিহীন করে দেয়।মনের মধ্যে সঞ্চিত সমস্ত আ’ক্রো’শ,ক্রো’ধ,প্র’তি’হিং’সা,জে’দ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।তুমি হবে ধীর,স্থির,শান্ত।অস’হনীয় য’ন্ত্র’ণা কিংবা শত আ’ঘা’তেও মুখ দিয়ে একটা শব্দ করবে না।অব্যর্থ পরিকল্পনা করে এমন এক মোক্ষম আ’ঘা’ত হানবে,যার কবল থেকে শ’ত্রু’রা যেন কেউ বা’চ’তে না পারে।শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যু’দ্ধ করতে হলে তোমাকে শক্তিধর হওয়ার পাশাপাশি বুদ্ধিমতী হতে হবে।বিচক্ষণতার সাথে প্রতিটা পদক্ষেপ নিবে তুমি।খেয়াল রাখবে,ক্রো’ধ তোমার উপর নয় বরং তুমি নিজের ক্রো’ধের উপর আধিপত্য ফলাবে।কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না,তোমার মনের মধ্যে কি চলছে।তোমাকে অনেক বাধা-বিপত্তি আর দুর্জ্ঞেয় রাস্তা পাড়ি দিতে হবে।এতো সহজে তুমি হাল ছেড়ে দিতে পারো না।
ফ্লোরেনসিয়া,তুমি কি আমার কথাগুলো শুনতে পাচ্ছো?
কি অদ্ভুদ সুন্দর ফুলের সুবাশ।যেন স্বর্গের বাগিচায় শুয়ে আছে ও।কর্নকুহরে ভেসে আসে মিষ্টি মধুর এক নারীকন্ঠ।সিয়া উৎকর্ন কানে শোনে।অস্ফুট স্বরে ডাকে,,,,
-মা।
অত্যন্ত দুর্বল দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়।ঘাড়ের পাশে তীব্র ব্যথা অনুভব করে।খোলা আকাশের নিচে উলফুলের উঁচু স্তুপের উপর শুয়ে আছে ও।চারপাশে ছিলো সাদা,বেগুনী,হলুদ রঙের অসংখ্য ক্রোকাস আর উইন্টার জেসমিন ফুলের সমারোহ।
সিয়া উঠে বসার চেষ্টা করে।ঠান্ডায় জমে গেছে হাত পা।আশে পাশে সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুলায় ও।মাথার উপরে সুবিশাল অন্তরীক্ষে শ্বেতশুভ্র মেঘ আর যতদুর চোখ যায়,শুধু সুউচ্চ পাহাড়।তুষারে ঢেকে গেছে সাদা রঙের জেসমিন ফুলগুলো।
সিয়ার দু’চোখে অসামান্য বিস্ময়।এতক্ষণ মিষ্টি মধুর কন্ঠে কথা বলা মানবীকে খুঁজে দেখে ও।কিন্তু কি আশ্চর্য!আশে পাশে কেউ নেই,সম্পূর্ন জায়গাটা জনমানবশূন্য।সিয়া তীব্র যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয়।বুঝতে পারে সুউচ্চ পাহাড় থেকে উলফুলের উঁচু স্তুপের উপর পড়ায় মৃ’ত্যু হয়নি ওর।
কিছুক্ষণ আগে শোনা নারীকণ্ঠের কথাগুলো মস্তিষ্কে গেঁথে যায়।যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে কানে বাজল।বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠে সিয়ার।
-তোমাকে শান্ত থাকতে হবে।______বাতাসে ভেসে আসে ফিসফিসিয়ে বলা কিছু শব্দগুচ্ছ।সিয়া চকিত হয়।কেউ অদৃশ্য থেকে ওর সাথে কথা বলছে।
-কে আপনি?কেনো আমাকে সাহায্য করতে চাইছেন?সামনে আসুন।
-ভয় পেয়ো না।আমি তোমার খুব কাছের একজন।তুমি আমাকে দেখতে পাবে না।____ব্যথাতুর অদৃশ্য কন্ঠ।
-আপনি কি সেই অস্বাভাবিক লম্বা বাদামী চুলের মেয়েটা?___কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে সিয়া।
-না।আমি অন্যকেউ।কন্ঠ শুনেও বুঝতে পারছো না?
-কি করে বুঝবো?দু’জনের কন্ঠস্বর প্রায় একই রকম।
কয়েকপল সময় গড়ায়।কন্ঠস্বরটা আর শোনা যায় না।সিয়ার কথার কোনো প্রত্যুত্তর আসে না।ও উচ্চস্বরে ডাকে,,,
-শুনছেন?আপনি কি এখানেই আছেন?
-হ্যাঁ,বলো।
-অনেক উঁচু পাহাড় থেকে পড়েছি।কিভাবে বেঁচে গেলাম?এখানে এরকম স্তপের মতো উলফুল বিছিয়ে রেখেছে কে?যেন আমাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই কেউ এই নিদারুণ আয়োজন করেছে।
-জানিনা।
সিয়া নিরাশ হয়।জায়গাটা চিনে না ও।ইম্যুভিলে নতুন এসেছে।এখন ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ি কিভাবে ফিরবে?সবাই দুশ্চিন্তা করছে।কে জানে,হয়তো এতক্ষণে খুঁজতে বেরিয়েছে ওকে।সিয়া ভাবে।সহসা ও অদৃশ্য মেয়েটাকে সবিনয়ে বলে,,,
-আমি বাড়িতে ফিরে যেতে চাই।আপনি কি কোনো ভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?
-হ্যাঁ।তোমাকে এখুনি পৌঁছে দিচ্ছি।
যতদুর চোখ যায়,বরফে ঢাকা বিস্তৃত প্রান্তর নজরে পড়ে।হঠাৎ সিয়ার দু’চোখের সামনে দলা দলা কুয়াশার কুন্ডলী উড়ে আসে।ধীরে ধীরে সেগুলো একটা ইউনিকর্নের আকৃতি ধারণ করে।যেন তীব্র সাদা আলো বিচ্ছুরিত হয় ইউনিকর্নের সম্পূর্ণ শরীর থেকে।সিয়া ভয়াবহ চমকায়।এই ইউনিকর্ন’টাই গতকাল রাতে দেখেছিলো ও।অকস্মাৎ সন্দেহ হয়।মনে মনে ভাবে,,,,
-এসব ঐ জা’নো’য়া’র’টার ষড়যন্ত্র নয়তো?
-এই ইউনিকর্নটা আমার ছিলো।ওর নাম থ্যাসো।ও তোমাকে আলোর বেগে ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে পৌঁছে দিবে।তুমি কারো নজরে পড়বে না।ওর পিঠে চড়ে বসো।
সিয়ার সন্দেহ গাঢ় হয়।ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে যেতে হবে সেকথা একবারও বলেনি ও।তাহলে এই এই অদৃশ্য মেয়েটা তা কিভাবে জানলো?
-আমাকে বিশ্বাস করো।
এই মূহূর্তে মেয়েটাকে বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই সিয়ার।জীবনের এক ভ’য়ংক’র যুদ্ধে নেমেছে ও।অতিক্রম করতে হবে সব ভয়াবহ দুর্গম পথ।প্রতি পদে পদে ঘনিয়ে আসবে বিপদ।মৃ’ত্যু ভয় হবে যে পথের একমাত্র সঙ্গী।ঝুঁকি তো নিতেই হবে।সিয়া ভাবে।অতঃপর আলগোছে নেমে দাড়ায়।ধীরপায়ে হেঁটে যায় ইউনিকর্নের দিকে।সাদা রঙের লম্বা পেঁচানো শিং টার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।
ইউনিকর্ন একটি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন স্বর্গীয় প্রাণী।সাধারণ সময়ে এরা শান্ত ও পবিত্র হলেও প্রয়োজনে হয়ে উঠে প্রচন্ড বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী।এরা দেখতে ঘোড়ার মতো অথচ এদের গতি আলোর গতির সমতুল্য।পৌরানিক রুপকথায় সিয়া পড়েছিলো ইউনিকর্ন সম্পর্কে।কিন্তু আজ স্বচক্ষে দেখছে।এই স্বর্গীয় প্রানীটার সাথে অশুভ শক্তির কোনো সংযোগ থাকতে পারে না।তাই সিয়া বিশ্বাস করে অদৃশ্য মেয়েটা’কে।
সিয়া কাছে গিয়ে দাড়াতেই ইউনিকর্ন’টা সামনের দু’হাটু ভাজ করে বসে।সিয়া আলতো হাতে স্পর্শ করে দেখে।গতকাল রাতে এটাকে স্পর্শ করতেই উধাও হয়ে গিয়েছিলো।আজ কত শান্ত হয়ে বসে আছে সিয়ার সামনে।সিয়া অস্ফুট স্বরে ডাকে,,,
-থ্যাসো।
ইউনিকর্ন’টা উঠে দাড়ায়।ওর সাদা শিং থেকে সোনালী রঙের অদ্ভুত আলো ছড়ায়।সিয়া বিস্মিত চোখে দেখে।অকপটে জানতে চায়,,,,
-ওর শিং থেকে ছড়ানো এই আলো?
অদৃশ্য মেয়েটা দৃঢ় কন্ঠে বলে,,,,
-আজ ও নিজের প্রকৃত মালিক খুঁজে পেলো।ও তোমার বাহন।থ্যাসো।যখনই ওর নাম ধরে ডাকবে,ও তোমার সামনে উপস্থিত হবে।
-কিন্তু কেনো?
-সময় হলে তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।
-আপনি কে?আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?
সিয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর আসে না।ক্ষণকাল সময় গড়ায়।সিয়া পুনরায় ডাকে,,,
-শুনছেন?আমি জানতে চাই,আপনি কে?
নেই।কোনো সাড়াশব্দ নেই।হয়তো চলে গেছে।সিয়া থ্যাসোর পিঠে চড়ে বসে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,,,,
-চলো।
থ্যাসো মেঘের উপর দিয়ে সিয়াকে নিয়ে আলোর গতিতে ছুটে যায়।শ্বেতশুভ্র মেঘ গুলো যেন হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে।অসম্ভব সুন্দর কিছুটা সময়।স্বর্গীয় ঘোড়ায় চেপে সিয়া বাড়ি ফিরে আসে।সবটাই কেমন স্বপ্নের মতো লাগে।যেন কোনো রুপকথার গল্প।যে গল্পের প্রিন্সেস সিয়া।ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ির কাছে পৌঁছে থ্যাসো মাটিতে নেমে দাড়ায়।সিয়া সম্বিত ফিরে পায়।কিছুক্ষণের জন্য নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছিলো।ভুলে গিয়েছিলো সব দুঃখ।মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলছিলো।বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছিলো থ্যাসো।
সিয়ার বুক চিরে অসহনীয় য’ন্ত্রণার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।সবটাই বাস্তব।কোনো কিছু কাল্পনিক নয়।নয় কোনো রুপকথার গল্প।র’ক্তচোষা পি’শাচ,ঐ অস্বাভাবিক লম্বা বাদামী চুলের মেয়ে,ইউনিকর্ন।সবকিছুই ছিলো পৃথিবীতে,এখনো আছে।রুপকথার গল্পে পড়া প্রাণীগুলো সিয়া স্বচক্ষে দেখে নিলো এক এক করে।কে জানে,ওর জীবনে আরও কতকিছু দেখা বাকি আছে এখনো।এরপর যা দেখবে,তার কোনো কিছুই অস্বাভাবিক বা অকল্পনীয় মনে হয় না ওর কাছে।
-কিন্তু অদৃশ্য মেয়েটা কে?কেনো আমাকে সাহায্য করলো?
সিয়ার হৃদয় কোণে একাধিক প্রশ্ন জেগে উঠে।কিন্তু কবে আর কে উত্তর দিবে এগুলোর?সিয়া ভাবে।ভাবতে ভাবতে ধীরপায়ে হাঁটতে থাকে ও।জলাশয় পেরিয়ে পেছন ফিরে দেখে।থ্যাসো নেই।ওকে নিয়ে ভাবে না সিয়া।দ্রুতপায়ে হেঁটে পশ্চাদ্ভাগের উঠোনে পৌঁছাতেই বিধ্বস্ত মুখের ইনায়াকে দেখতে পায়।
সিয়াকে দেখে ইনায়ার দেহে প্রাণ ফিরে আসে।ব্যতিব্যস্ত পায়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে যায় সিয়ার কাছে।জড়িয়ে ধরে ওকে।উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চায়,,,,
-কোথায় গিয়েছিলে?সেই ভোরবেলা থেকে তোমাকে খুঁজে যাচ্ছি।যখন আবছা আলো,আবছা অন্ধকার ছিলো।তুমি জানো?আমার কতটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো।
ইনায়ার গলা শুকিয়ে আসে।সিয়াকে ছেড়ে দিয়ে চোখের কোণের অশ্রু মুছে নেয় ও।সিয়ার দু’গালে হাত রেখে বলে,,,,
-আমি তোমাকে আশে পাশের সব জায়গায়গুলোতে খুঁজেছি।তুমি কোথাও ছিলে না।আমার ভীষণ ভয় করছিলো।
-দুরের একটা পাহাড়ে গিয়েছিলাম।
-একা একা কেনো গিয়েছিলে?অন্তত আমাকে সাথে নিয়ে যেতে।
-শান্ত হও ইনায়া।আমি একদম সুস্থ আছি।বাকিরা কি করছে?তারা কি আমার বাড়িতে না থাকার খবর জেনে গেছে?
-হ্যাঁ।দাদু,ক্রিস্তিয়ান,কুরী আংকেল সবাই তোমাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন।
-বাবা আর আর্নি?
-বাবা একটা জরুরী কাজে শহরে গেছেন।ফিরে আসতে দেরি হবে বলেছেন।তিনি কিছুই জানেন না।আর্নি কামরায় বসে কাঁদছে।ও ভেবেছে তোমাকে ওরা অপহরন করে নিয়ে গেছে।
-বাবাকে কেনো যেতে দিলে?____শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে সিয়া।
-জানিনা,বাবা কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন।আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে তোমাকে খুঁজে না পেয়ে তার কামরায় ছুটে গিয়েছিলাম।তখন বাবার বালিশের উপর এই চিরকুট’টা পেয়েছি।
ইনায়া একটা ছোট কাগজের টুকরো এগিয়ে দেয় সিয়ার দিকে।সিয়া ত্বরিত সেটা খুলে পড়তে শুরু করে,,,
“আমি একটা জরুরী কাজে শহরে যাচ্ছি।ফিরে আসতে দেরি হবে।দুশ্চিন্তা করো না।ক্রিস্তিয়ানের সাথে ঠিক সময়ে একাডেমিতে চলে যেও।আজ তোমাদের প্রথম ক্লাস।কোনো ভুল করো না যেন”
-এখন কয়টা বাজে?___চিরকুট টা ভাঁজ করে ইনায়ার হাতে দিয়ে জানতে চায় সিয়া।
-প্রায় নয়টা বেজে গেছে।___মলিন কন্ঠে উত্তর দেয় ইনায়া।
-প্রথম দিনই একাডেমির ক্লাস মিস হলো।
ইনায়া পরপর দু’বার চোখের পলক নাড়ায়।সিয়ার আচরণ আগের দিনগুলোর তুলনায় আজ একটু ভিন্ন রকম মনে হয়।
-চলো কামরায় যাওয়া যাক।আশা করি বাবা খুব শীগ্রই ফিরে আসবেন।
সিয়া দ্রুতপায়ে বারান্দা হয়ে কামরায় প্রবেশ করে।ইনায়া বিস্মিত চোখে দেখে।কিছুতো একটা পরিবর্তন এসেছে সিয়ার মধ্যে।
_____
খারকিভ,ওয়াভেল কোট।
উর্ধ্বগগনে মেঘের সমাবেশ।দুর্গের একটি টাওয়ারের রুফটবে বসে উদ বাজায় ইজাবেল।ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে আছে মিষ্টি হাসির রেশ।ছাদের রেলিঙের কাছে দাড়িয়ে ছিলো আব্রাহাম।তার হালকা নীলাভ আঁখিযুগল ছিলো দুর আকাশের দিকে স্থির।পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অ্যাভোগ্রেডো।মনোযোগ দিয়ে নিজের ইজাবেলকে দেখছিলো।সহসা তাকে ডেকে উঠে আব্রাহাম,,,,
-অ্যাভোগ্রেডো!
-জ্বি,এস্টীম রুলার।
-প্রেমে পড়েছিলে কখনো?
অ্যাভোগ্রেডো থতমত খায়।অজানা আশংকায় ভয়াবহ ভীত হয়।ইজাবেলের দিকে তাকিয়েছিলো,সেটা রুলার দেখে ফেলেননি তো?নতুবা আচমকা এমন প্রশ্ম কেনো করবেন?অ্যাভোগ্রেডো ভাবে।ভেবে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।আব্রাহাম পেছন ঘুরে দাড়ায়।এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,,,
-কি হলো?
-হ্যাঁ,,,।
আব্রাহাম আগ্রহ নিয়ে তাকায়।অ্যাভোগ্রেডো ভড়কে যায়।হুশ ফিরে পায় নিজের।কথা ঘুরিয়ে বলে,,,
-জ্বি না।
-আচ্ছা।
-জ্বি।
-তারপর?তোমাদের ওভারলর্ড কি করছেন?
-কামরায় আছেন।
হাতের উদ যন্ত্রটা চেয়ারের উপর রেখে ইজাবেল উঠে দাড়ায়।মন খারাপ করে এগিয়ে যায় আব্রাহামের দিকে।অভিযোগের সুর তুলে বলে,,,
-আমি উদ বাজিয়ে শোনাচ্ছি।তা না শুনে আপনারা দু’জন গল্প করছেন?
-শুনেছি তো।____আব্রাহাম সহাস্যে বলে।
-ঠিক আছে।আমি কামরায় ফিরে যাচ্ছি।
ইজাবেল পেছন দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করে।আব্রাহাম ওকে থামায়।অকপটে জিজ্ঞেস করে,,,,
-তুমি কি ওভারলর্ডকে রাজি করাতে পারবে?
-কোন বিষয়ে?___চাঞ্চল্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ইজাবেল।
-একাডেমির স্টুডেন্টদের মার্শাল আর্টের রণকৌশল শেখানোর বিষয়ে।
-অসম্ভব ভাই।ওভারলর্ড প্রিন্সিপালের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছেন।আমার পক্ষে সম্ভব নয় তাকে রাজি করানো।
-ভেবে দেখো।একমাত্র তুমি’ই পারবে তাকে রাজি করাতে।
ইজাবেল ভাবে।গতকাল একাডেমিতে বলা প্রিন্সিপালের কথাগুলো মনে করে ও।এদুয়ার্দোকে উদ্দেশ্য করে প্রিন্সিপাল বলেছিলেন,,,,
-মিঃ ক্লিভল্যান্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন।আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে,ইউক্রেনের একজন বেস্ট ফাইটার হিসাবে আপনি মাশার্ল আর্টের শিরোপা জিতেছিলেন।সুতরাং আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ ছিলো।এই একাডেমির স্টুডেন্টদের যদি মার্শাল আর্টের কিছু রণকৌশল শেখাতেন,তাহলে খুব ভালো হতো।বাচ্চারা আপনার থেকে অনেক ভালো কিছু শিখতে পারতো।অনুপ্রাণিত হতো।আপনি কি কাইন্ডলি আমার প্রস্তাব’টা একটু ভেবে দেখবেন?
-দুঃখিত।আমার কাছে পর্যাপ্ত সময় নেই।___এদুয়ার্দোর গম্ভীর কন্ঠস্বর।
তার গম্ভীর কন্ঠে প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ঘটনা মনে পড়তেই ইজাবেল শুকনো একটা ঢোক গিলে নেয়।আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত গলায় বলে,,,
-প্রয়োজন নেই।কোনো প্রয়োজন নেই।আমি রাজি করাতে পারবো না তাকে।আপনি ভাবলেন কি করে,আমার কথায় রাজি হবেন তিনি?তাছাড়া রাজি হলেই বা কি লাভ?
আব্রাহামের লাল টুকটুকে দু’ঠোটের ফাঁকে দুষ্টু হাসির ঝলকানি খেলে যায়।এদুয়ার্দোকে জব্দ করাই তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য মনে হয়।একাডেমিতে স্টুডেন্টদের রণকৌশল শেখাতে রাজি করাতে পারলে,মেয়েদের দ্বারা বেশ নাস্তানাবুদ হবে এদুয়ার্দো।এখানেই তার আনন্দ।ভাবতেই আব্রাহামের চোখগুলো খুশিতে চকচক করে উঠে।সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় ইজাবেলের দিকে।বামপাশে দাঁড়িয়ে ইজাবেলের ডান কাঁধে হাত রেখে বলে,,,
-শোনো।আমাকে তো জানো?শাসক হওয়ার পাশাপাশি আমি একজন সুপুরুষ।আমার জন্য পছন্দের মেয়ের অভাব হবে না।আমি চাইলেই যখন খুশি একজন ভাম্পায়ার কন্যাকে বিয়ে করে নিতে পারি।কারন মেয়েদের প্রতি অনুভূতি আছে আমার।কিন্তু তুমি একটা বিষয় চিন্তা করো,আমাদের ওভারলর্ডের কোনো মেয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।এভাবে চলতে থাকলে,তাকে চিরকাল নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে।তুমি কি তাই চাও?
বেশ চিন্তায় পড়ে যায় ইজাবেল।বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায় ও।ছোট বোনকে উল্টা পাল্টা বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করতে পেরে আব্রাহাম ঠোঁট চেপে হাসে।মুখখানা করুন করে বলে,,,,,
-শোনো।যা করার তোমাকেই করতে হবে।ওভারলর্ডকে রাজি করাবে।আমার দৃঢ় বিশ্বাস,একাডেমির সব সুন্দরী মেয়েদের কাছাকাছি থাকলে,মেয়েদের প্রতি তার একটু হলেও আগ্রহ জন্মাবে।তখন মহারাজকে আর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে না।শুধুমাত্র একবার মেয়েদের প্রতি অনুভূতি জন্মাক।দেখে নিও,তিনিও একজন ভাম্পায়ার কন্যাকে জীবন সঙ্গী হিসাবে গ্রহন করবেন।
-আপনি সত্যি বলছেন?___অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ইজাবেল।
-অবশ্যই।____আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে উত্তর দেয় আব্রাহাম।
-কিন্তু কিভাবে সম্ভব?তিনি ভাম্পায়ার সাম্রাজ্যের ওভারর্লড।তার কি এই সব ছোটখাটো বিষয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় আছে?
-আমি মানলাম তিনি খুব ব্যস্ত থাকেন।তাই বলে তোমার জন্য প্রতিদিন অল্প একটু সময় দিতে পারবেন না?একাডেমিতে তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রশিক্ষণ দিতে কে বলেছে?যাবেন,একটু হাত-পা নাড়িয়ে দেখাবেন।তারপর চলে আসবেন।
আব্রাহাম কথাগুলো জোরে জোরেই বলছিলো।একটু দুরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো অ্যাভোগ্রেডো।সে বেশ বুঝতে পারে আব্রাহামের মনে কি চলছে।এদুয়ার্দোকে ফাঁসাতেই তার এই পরিকল্পনা।সহজ-সরল ইজাবেল বুঝতে পারে না।আব্রাহামের কথা বিশ্বাস করে নেয়।উচ্ছ্বসিত চোখে মিষ্টি হেঁসে বলে,,,,
-আমি চেষ্টা করবো।
দু’জনের কথার মাঝখানেই থমথমে পা ফেলে টাওয়ারের ছাদে এসে উপস্থিত হয় এদুয়ার্দো।চোখে মুখে সেই চিরচেনা গাম্ভীর্য।ইজাবেল মিটিমিটি হাসে।আব্রাহাম আর অ্যাভোগ্রেডো বুকের কাছে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়ায়।নত মস্তকে সম্মান জানায় তাকে।এদুয়ার্দো রাশভারি কন্ঠে ডাকে,,,,
-ইজাবেল।
-জ্বি।অনারেবল ওভারলর্ড।
-নিজের কামরায় ফিরে যাও।
আদেশ পেয়ে দ্রুত প্রস্থান করে ইজাবেল।এদুয়ার্দো আব্রাহামকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,,
-এখানে তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠিয়েছিলাম।কাজটা কতদুর হয়েছে?
-আশা করি,আজই হয়ে যাবে।
-যাও কাজটা শেষ করে এসো।
আব্রাহাম ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে দুর্গের সীমানা ছেড়ে যায়।শুধুমাত্র অ্যাভোগ্রেডো দাড়িয়ে থাকে।এদুয়ার্দোকে উদ্দেশ্য করে সবিনয়ে বলে,,,,
-অনারেবল ওভারলর্ড।আমার জন্য কোনো আদেশ?
-ইম্যুভিলে কিছু অতি বিশ্বস্ত সেনা পাঠাও।ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে থাকা উইজার্ড এবং কুরী পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করো।প্রত্যেকটা সদস্যকে নজরে নজরে রাখবে।যারা কাস্ত্রোরুজে ওদের উপর আক্রমণ করেছিলো।তারা আবারও ওদের উপর আক্রমণ করবে।আশা করি,বাকিটা তুমি বুঝতে পেরেছো।
-জ্বি।___অ্যাভোগ্রেডোর দৃঢ় কন্ঠ।
অ্যাভোগ্রেডো চলে যেতেই এদুয়ার্দো ছাদের কিনারায় গিয়ে দাড়ায়।তার মাথায় একাধিক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো।গতকাল রাতে সিয়ার মস্তিষ্ক পড়েছিলো সে।যেখানে ভীষণ পরিচিত দশজন র’ক্তপিপা’সুর নাম খুঁজে পেয়েছিলো।শুধুমাত্র এইটুকুই।এর বেশি কিছু জানতে পারেনি এদুয়ার্দো।মেয়েটা বেশ রহস্যময়ী।কিছু তো আছে ওর মধ্যে।নতুবা ওর মস্তিষ্কে সঞ্চিত সমস্ত স্মৃতি কেনো পড়তে পারেনি সে?এর থেকেও বড় প্রশ্ন,,,,এই দশজন রক্তপিপাসুর নাম ও কি করে জানলো?কেনোই বা এই নামগুলো মস্তিষ্কে গেঁথে রেখেছে?যদি ডিয়েটসের প্রশ্ন আসে,তাহলে তাকে অপহরন করেছিলো শুধুমাত্র এদুয়ার্দো।যেহেতু ক্রিসক্রিংগলের সামনে এদুয়ার্দো নিজের মায়ের নাম বলেছিলো।সেই হিসাব অনুয়ায়ী সিয়ার দুইজন ভাম্পায়ারের নাম জানার কথা ছিলো।তাহলে বাকি আটজনের নাম কিভাবে জানলো?
________
প্রাসকোভিয়া।
অতিপ্রাকৃত রহস্যে ঘেরা গহীন জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ক্রিসক্রিংগল।মার্টিন লরেন্স’কে খুঁজে পেতেই তার এই দুর্গম পথযাত্রা।ডান হাতে একটা তলোয়ার আর গলায় ক্রুশ লকেট।এই ছিলো তার নিজেকে রক্ষা করার হাতিয়ার।প্রাসকোভিয়ায় কখনো সূর্যের আলো প্রবেশ করেনি।দিনের বেলাতেও এই জঙ্গল ভয়াবহ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে।হিংস্র জানোয়ারের কবল থেকে বাঁচতে বাম হাতে একটা আগুনের মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে হাঁটছিলেন তিনি।চারদিকে কেমন গাঁ ছমছমে ভাব।অজানা আতংকে শিঁউরে উঠে হৃদপিণ্ড।মৃ’ত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দৃঢ় সংকল্প বন্ধ মনে এগিয়ে যাচ্ছেন সাবধানী পায়ে।এই জঙ্গলের প্রতিটা পদে পদে বিপদ।ভয়াবহ সব ফাঁদ পাতা থাকে।জঙ্গলের গাছপালাগুলোতে আলো পড়লেও ভয়ংকর লাগে দেখতে।রাতে বা দিনে এই জঙ্গলের গহীনে প্রবেশ করার নিষিদ্ধতা জারি করা হয়েছিলো।লোক মুখে শোনা যায়,প্রাসকোভিয়ার গহীনে প্রবেশ করলে কেউ জীবিত ফিরে যায় না।হাঁটতে হাঁটতে একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখে থমকে দাড়ান ক্রিসক্রিংগল।জঙ্গলের মাটিতে কতগুলো মাথার খুলি আর কঙ্কাল পড়ে আছে।হঠাৎই তার মনে বলে উঠে,,,
-জীবন মূল্যবান।তোমার দু’টো মেয়ে আছে।যাদের তুমি ছাড়া কেউ নেই।ফিরে যাও।ফিরে যাও নিজের মেয়েদের কাছে।
দমে যান ক্রিসক্রিংগল।কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে হয়,মার্টিন লরেন্সকে খুঁজে বের করতে হবে।ডিয়েটসের কাছে এতোদিন ধরে গচ্ছিত থাকা গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো মার্টিনকে ফিরিয়ে দিতে হবে।এর সাথে সিয়ার জীবন জড়িয়ে আছে।শেষ একটা চেষ্টা করে দেখতে হবে তাকে।
ক্রিসক্রিংগল পুনরায় হাঁটতে শুরু করেন।জঙ্গলের আরও গভীরে চলে যান।যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিলো মৃ’ত্যু ফাঁদ।হাঁটতে হাঁটতে আচমকা কোনো কিছুর সাথে পা বেঁধে পড়ে যান তিনি।বিকট আওয়াজ করে উপর থেকে কিছু একটা নিচে পড়ার আভাস পান।ত্বরিত লাফ দিয়ে সরে যান।সাথে সাথে মাথার উপর থেকে শব্দ করে পড়ে যায় একটা বৃহৎ আকৃতির গাছের গুঁড়ি।যা দু’পাশে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিলো।এটা ফাঁদ।গাছের গুঁড়িটা গায়ের উপরে পড়লে নির্ঘাত মৃ’ত্যু হতো।অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে যান ক্রিসক্রিংগল।ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বসা থেকে উঠে দাড়ান।মাটি থেকে তলোয়ার আর মশাল তুলে নেন।ইতোমধ্যে মশালের আগুন নিভে গেছে।আবারও আগুন জ্বালাতে হবে তাতে।ভাবতে ভাবতে দু’পা এগোতেই চমকে দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি।চোখের সামনে রাস্তার মাঝখানে পথ আগলে দাড়িয়ে আছে পাঁচজন কালো পোশাক ধারী লোক।যাদের মুখগুলো কালো মাস্ক দিয়ে ঢাকা ছিলো।কয়েক পা পিছিয়ে যান ক্রিসক্রিংগল।শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,,,
-তোমরা কারা?